ভূমিকা
পৃথিবীর বহু দেশের শিক্ষাবঞ্চিত এবং সভ্যতার আলো বঞ্চিত কোটি কোটি মুসলমানের মধ্যে যেই মিথ্যাচার প্রচার করা হয়, তাদের সাথে যেই জালিয়াতি করা হয়, তাদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে তাদের সাথে যেই প্রতারণা করা হয়, তার বিরুদ্ধে আমরা অবস্থান নিই যুক্তির সাহায্যে, শিক্ষা, বিজ্ঞান এবং মানবতার স্বার্থে। এই আর্টিকেলে মুসলিমদের মধ্যে বহুল প্রচলিত একটি দাবি বিশ্লেষণ এবং ভুল প্রমাণ করা হয়েছে, দাবিটি হচ্ছে, “নবীর চন্দ্র বা চাঁদ দ্বিখণ্ডন করার স্বপক্ষে ফটোগ্রাফিক প্রমান আছে।” কারণ মাঝে মাঝেই এরকম কিছু ভুয়া সংবাদ বাঙলাদেশের পত্রপত্রিকা এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখতে পাওয়া যায়। এমনকি, কয়েকটি টিভি চ্যানেল এবং সরকারী প্রচার মাধ্যমেও এই ভুয়া খবরটি অনেকবার প্রচারিত হয়েছে। মনে রাখতে হবে, সাধারণ মুসলমান বা ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে যুক্তি এবং জ্ঞানের চর্চা ঘটানোই আমাদের মূল উদ্দেশ্য।
মুমিনদের মুমিনীয় দাবি
মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে খুব জোরেসোরেই প্রচার করা হয় যে, মার্কিন নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং নাকি চাঁদে গিয়ে আজান শুনে এবং চাঁদ দুইভাগে বিভক্ত দেখে মুসলিম হয়ে গিয়েছিলেন। আসুন মিজানুর রহমান আজহারীর একটি ওয়াজ শুনি, নিল আর্মস্ট্রং কি আসলেই ইসলাম গ্রহণ করেছিল?
ভিডিও: https://www.nastikya.com/videos/azhari/nil_armstrong_azhari.webm
মুসলিমগণের বিশ্বাস, যখন তাদের নবী মক্কায় ছিলেন, তখন তার বিশেষ অনুরোধে আল্লাহ্ মোজেজা হিসেবে মক্কাবাসীদের সামনে চন্দ্র বা চাঁদ দ্বিখণ্ডিত করেছিলেন। কোরআন এবং হাদিসগ্রন্থসমূহে এবিষয়ে পরিষ্কার বর্ণনা রয়েছে। খুব পরিষ্কারভাবে এ-ও বলা আছে যে, চাঁদ দুইভাগে ভাগ হয়ে পাহাড়ের দুইপাশে খণ্ড হিসেবে পতিত হয়েছিলো।
কেয়ামত আসন্ন, চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে।
কুরআন ৫৪ঃ১
সহীহ মুসলিম (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৫৩/ কিয়ামত, জান্নাত ও জাহান্নামের বিবরণ
পরিচ্ছদঃ ৯. চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার বিবরণ
৬৮১৯। মুহাম্মদ ইবনু মুসান্না ও ইবনু বাশশার (রহঃ) … আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হল। তবে আবূ দাঊদ (রহঃ) এর হাদীসে রয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সময় (চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়েছে)।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
সহীহ মুসলিম (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৫৩/ কিয়ামত, জান্নাত ও জাহান্নামের বিবরণ
পরিচ্ছদঃ ৯. চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার বিবরণ
৬৮১৮। যুহায়র ইবনু হারব ও আবদ ইবনু হুমায়দ (রহঃ) … আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মক্কাবাসী লোকেরা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট তাদের একটি নিদর্শন (মু’জিযা) দেখানোর দাবী করল। তিনি তাদের (দু’বার) চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হওয়ার নিদর্শন দেখালেন।
মুহাম্মাদ ইবনু রাফি (রহঃ) … আনাস (রাঃ) থেকে শায়বানের অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
সহীহ মুসলিম (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৫৩/ কিয়ামত, জান্নাত ও জাহান্নামের বিবরণ
পরিচ্ছদঃ ৯. চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার বিবরণ
৬৮১৫। আবূ বকর ইবনু আবূ শায়বা, আবূ কুরায়ব ইসহাক ইবনু ইবরাহীম, উমার ইবনু হাফস ইবনু গিয়াস, ও মিনজাব ইবনু হারিছ তামিমী (রহঃ) … আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মিনায় আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে ছিলাম। এমতাবস্থায় (হঠাৎ করে) চন্দ্র বিদীর্ন হয়ে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। এক খন্ড পাহাড়ের এ পাশে পড়ল এবং অপর খন্ড পড়ল পাহাড়ের ওপাশে। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমরা সাক্ষী থাক।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
সহীহ বুখারী (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৫০/ আম্বিয়া কিরাম (আঃ)
পরিচ্ছদঃ ২০৭৭. মুশরিকরা মুজিযা দেখানোর জন্য নবী করীম (সাঃ) এর নিকট আহবান জানালে তিনি চাঁদ দু’টুকরা করে দেখালেন
৩৩৭৭। খালাফ ইবনু খালিদ আল-কুরায়শী (রহঃ) … ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যামানায় চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
সরাসরি বই থেকে বিষয়গুলো দেখি, সহীহ আত তিরমিযী, আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানীর তাহকীককৃত, হুসাইন আল মাদানী প্রকাশনী, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০২ সহিহ মুসলিম, ইসলামিক সেন্টার, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৬০


বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম দাবী করেন যে, তাদের কাছে চন্দ্র দ্বিখণ্ডনের হওয়ার ফটোগ্রাফিক প্রমাণ আছে। তারা নিজেদের দাবীর স্বপক্ষে চাঁদের কাছ থেকে তোলা দৃশ্যের এই ছবিসমূহ ব্যবহার করে থাকেন,


দাবীর উৎস
২০০৭ সালে, মিশরীয় ভূতাত্ত্বিক ড. জগলুল আল নাজ্জার উক্ত ছবিসমূহ ব্যবহার করে দাবি করেছিলেন যে, নাসা চাঁদের দ্বিখণ্ডিত হওয়ার প্রমাণ খুঁজে পেয়েছে। Dr. Zaghloul El-Naggar, “The Moon Cleft Asunder“, Elnaggarzr.com, Archive.org capture dated October 26, 2007 অদ্ভুত দাবিটি তারপর ছড়িয়ে পড়েছিলো জাফারিয়া নিউজের মত কিছু সংবাদ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। Mohamed Ali, “Crack on moon confirms Prophet Muhammad (S) had split it“, Jafariya News, March 22, 2008 খুব অদ্ভুতভাবেই, লক্ষ লক্ষ আধুনিক শিক্ষাবঞ্চিত মুসলমান সেসকল নিউজ বিশ্বাস করেছিলো, এবং ভক্তি সহকারে প্রচার করেছিল।
বিশ্লেষণ
লুনার রিল
রিল মানে পৃষ্ঠতলের উপর যেকোনো ধরনের উপত্যকা বা পরিখা আর লুনার রিল মানে চাঁদের পৃষ্ঠতলের উপর যেকোনো ধরনের উপত্যকা বা পরিখা।
চাঁদের ওপর আমরা যে দাগ দেখতে পাই, সে দাগ আসলে লোনার রিল ছাড়া কিছু না। রিল খুব দীর্ঘ হতে পারে এবং তার মধ্যে গভীর গিরিসংকট অনুরুপ খাদ থাকতে পারে। একটি রিল কয়েক কিলোমিটার প্রশস্ত এবং দৈর্ঘ্যে শত শত কিলোমিটার হতে পারে। কেবল চাঁদেই নয়, সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহতে, বিশেষ করে মঙ্গল, শুক্র এবং বেশ কয়েকটি উপগ্রহেও একইরকম গঠনের রিল পাওয়া যায়।
আবিষ্কৃত রিলসমূহ কিভাবে গঠিত হয়েছে, তা প্রতিটি ক্ষেত্রে এখনো নিশ্চিতভাবে জানা সম্ভব হয়নি। বিজ্ঞানীগণ প্রাপ্ত তথ্য প্রমাণ যাচাই করে দেখছেন। তবে তারা এখনো অতীতে চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার বিন্দুমাত্র কোনো সম্ভবনা পাননি।
রিলের প্রকারভেদ
চন্দ্র পৃষ্ঠে তিন ধরনের রিল রয়েছে :
১। সর্পিলাকার রিল, যেসব রিল নদীর মত বাঁকানো এবং সাধারণত ভাঙা লাভা টিউব বা বিলুপ্ত লাভা প্রবাহের অবশিষ্টাংশ বলে মনে করা হয়। এসকল রিল সাধারণত একটি বিলুপ্ত আগ্নেয়গিরি হতে শুরু হয়, তারপর একেবেঁকে চলে কখনও কখনও বিভক্ত হয়ে পৃষ্ঠতলের উপর প্রভাবিত হয়ে যায়।
২। ধনুকাকৃতির রিল, মসৃণ বক্রাকার এবং লাভাপ্রবাহ সৃষ্ট সমতল রিল যা চন্দ্রের অন্ধকার অঞ্চলের কাছাকাছি পাওয়া যায়। ধারনা করা হয় যে এসকল রিল তৈরি হয়েছিল লাভা প্রবাহের শীতল, সংকুচিত অববাহিকা হতে।
৩। সরলাকৃতি দীর্ঘ রিল, রৈখিক পথ অনুসরণ করে এবং সমতল খাদের মত মনে করা হয়। অর্থাৎ, দুটি সমান্তরাল ফাটলের মধ্যকার নিমজ্জিত ভূত্বক। এসব সহজেই পাওয়া যায় আগ্নেয়গিরির মুখ হতে বা সরলরেখায় অবস্থিত পাহাড় বেষ্টিত স্থানে।
চন্দ্রপৃষ্ঠের প্রায় সকল স্থানেই লুনার রিলের অস্তিত্ব রয়েছে। লুনার রিল যদি কেবল চাঁদের দ্বিখণ্ডিত হওয়ার মাধ্যমেই সৃষ্টি হতো তাহলে চন্দ্রপৃষ্ঠের সকল স্থানেই লুনার রিলের অস্তিত্ব থাকতো না। অতএব, পরিষ্কারভাবেই লুনার রিল চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার প্রমাণ বহন করেনা। “চাঁদ পুরোপুরি দুইভাগে বিভক্ত হয়েছে” এমন রূপকথার প্রমাণ হয়তো রূপকথার জগতেই রয়েছে।
রিলসমূহের ছবি
এই রিলসমূহ চাঁদের পৃষ্ঠকে কিভাবে দাগিয়েছে সেটি বুঝার জন্য, আমাদের আরও উপর থেকে তোলা চাঁদের ছবিসমূহের দিকে নজর দিতে হবে। চাঁদের ওপর থাকা এসকল খাদ দেখে কি মনে হয় যে, তারা চাঁদকে দুইভাগে বিভক্ত করে রেখেছে?














রিমা আরিয়াডিয়াস
মুসলিমগণ যেসকল ছবিকে চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হওয়ার প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করে সেসকল ছবি আসলে অ্যাপোলো মিশন থেকে প্রাপ্ত রিমা আরিয়াডিয়াস নামে একটি রিলের ফটোগ্রাফ। রিলটি চাঁদের উপর ৬.৪° উত্তর ১৪.০° পূর্বে (ভৌগোলিক অবস্থান) পাওয়া গেছে। আরিয়াডিয়াস গর্তের নামে রিলটির নামকরন করা হয়েছে, যা চাঁদের পূর্ব দিকের শেষসীমা চিহ্নিত করে। এটি ৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি রৈখিক রিল মাত্র, যা চাঁদের পরিধির মাত্র শতকরা ৩ ভাগ জুড়ে অবস্থিত।
বিজ্ঞানীরা মুখ খুলেছেন
নাসার বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে, চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার দাবির স্বপক্ষে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ২০১০ সালে, নাসা বিজ্ঞানী ব্র্যাড বেইলি মন্তব্য করেন, “আমার অনুরোধ, আপনি ইন্টারনেটে যা পড়ছেন তাই বিশ্বাস করবেন না। কেবল পিয়ার-রিভিউড পেপারস’ই বৈজ্ঞানিকভাবে গ্রহণযোগ্য উৎস। বর্তমানে এমন কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই যা বলে, অতীতে চাঁদ দুই (বা আরো) অংশে বিভক্ত হয়ে পরে পুনরায় কোনো একসময়ে একত্রিত হয়েছে।” Brad Bailey, “Evidence of the moon having been split in two“, NASA Lunar Science Institute, June 21, 2010
প্রথম দিকে, নাসার বিজ্ঞানীদের যখন বিষয়টি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়, তারা প্রশ্নটি বুঝতেই পারেন নি। Was the Moon Split In Two?

পরবর্তীতে যখন আরও ভালভাবে তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয়, বিষয়টি তারা ইন্টারনেটের গুজব বলে পুরোপুরিই উড়িয়ে দেন। Brad Bailey, “Evidence of the moon having been split in two“, NASA Lunar Science Institute, June 21, 2010

(লেখাটি উইকিইসলামের একটি লেখার ভাবানুবাদ)
ভাবানুবাদ করেছেন – মাহমুদুল হাসান
সংযুক্তিঃ সংশয় সম্পাদক
আরও পড়ুন
মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত কিছু মিথ এবং মিথ্যাচার
সুনিতা উইলিয়ামসকে নিয়ে মুসলিমদের জালিয়াতি

