হিন্দুদের পুরাণসমূহ কেবল পৌরাণিক ঘটনায় পরিপূর্ণ নয়, এসব জাতপাতেও যথেষ্ট পরিপূর্ণ। বৃহদ্ধর্ম পুরাণ হল হিন্দুদের একটি পুরাণ। এর নানা স্থানে জাতিভেদ সম্বন্ধে অনেক কথা বলা আছে।
বর্ণ
অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে ব্রহ্মার শরীরের নানান অংশ থেকে নানান বর্ণের উৎপত্তির কথা বলে হলেও বৃহদ্ধর্ম পুরাণে বিষ্ণুর শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে বিভিন্ন বর্ণের উৎপত্তি দেখানো হয়েছে। বিভিন্ন বর্ণের উৎপত্তি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
“ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর মূল প্রকৃতি সম্ভূত, এরমধ্যে সত্ত্বদেহ সনাতন বিষ্ণু মধ্যম। তার মুখ হতে সর্ববেদের আশ্রয় বিপ্রগণ, প্রজাপালনের জন্য বাহু হতে ক্ষত্রিয়গণ,ধনরক্ষার জন্য উরু হতে বৈশ্যগণ ও পূর্বোক্ত বর্ণত্রয়ের সেবার জন্য দুই পা হতে শূদ্রগণ উৎপন্ন হয়েছে। ভগবান বিষ্ণু এভাবে চারটি বর্ণ সৃজন করে তাদের ধর্মের উৎপাদন করেন।“ বৃহদ্ধর্মপুরাণ /উত্তরখন্ড/প্রথম অধ্যায়
বিভিন্ন বর্ণকে সৃষ্টি করার সময় যে তাদের কর্ম নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়, তা উপরেই বর্ণিত হয়েছে। সেই বর্ণনির্দিষ্ট কর্ম যেন কেউ পরিত্যাগ না করে সেজন্য বলা হয়েছে-
“তত্ত্বপ্রার্থী ব্যক্তির বৈধকর্ম ত্যাগ করা কোনক্রমেই উচিত নয়।…ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চারবর্ণই স্বধর্ম নিরত হলে বিপ্রত্ব প্রাপ্তি হয়ে থাকে। ব্রাহ্মণ হয়ে যদি যথাচিত ব্রাহ্মণের ধর্ম প্রতিপালন করে , তা হতেই তত্ত্বজ্ঞান লাভে সক্ষম হয়। শূদ্র যথাবিধি শূদ্রধর্ম পালন করলে বৈশ্যত্ব, বৈশ্য বৈধ বৈশ্য ধর্ম পালনে ক্ষত্রিয়ত্ব ও ক্ষত্রিয় শাস্ত্রোক্ত ক্ষত্রিয় ধর্ম পালনে বিপ্রত্ব এবং বিপ্র সদাচার সম্পন্ন হলে মুক্তি লাভ করে থাকে ।“ বৃহদ্ধর্মপুরাণ /উত্তরখন্ড/প্রথম অধ্যায়
এই যে স্বধর্ম অর্থাৎ জন্মসূত্রে বর্ণ নির্ধারিত কর্ম, যা পালন করলে ক্ষত্রিয় বিপ্রত্ব অর্থাৎ ব্রাহ্মণত্ব প্রাপ্ত হয়, বৈশ্য ক্ষত্রিয়ত্ব প্রাপ্ত হয় এবং শূদ্র বৈশ্যত্ব প্রাপ্ত হয়; এই প্রাপ্তি নিশ্চয় এক জন্মে ঘটে না, কেননা এরপরেই বলা হয়েছে-
“সমুদয় বর্ণই স্বধর্ম পরিহার পূর্বক উচ্চবর্ণের ধর্ম পালন করলে ঘোর নরকে পতিত হয়ে থাকে, এজন্য নিজ নিজ ধর্মের অনুষ্ঠানই সকলের কর্তব্য ।“ বৃহদ্ধর্মপুরাণ /উত্তরখন্ড/প্রথম অধ্যায়
বর্ণবৈষম্য
বর্ণপ্রথাকে একটা পিরামিডের সাথে তুলনা করা যায়। পিরামিডের উপরের দিকে অবস্থান করে ব্রাহ্মণ, এর নিচে ক্ষত্রিয়, এর নিচে বৈশ্য এবং এর নিচে শূদ্রেরা। যারা সবচাইতে উপরে অবস্থান করে তারা সুযোগ সুবিধাও অধিক ভোগ করে থাকে। বর্ণপ্রথায় কে কার সেবা করবে সেই প্রসঙ্গে বৃহদ্ধর্ম পুরণ বলছে-
“ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণের , বৈশ্য ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের এবং শূদ্র ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের সেবা করবে এবং ব্রাহ্মণ প্রভৃতি বর্ণত্রয়ের শূদ্রকে তরণ করা কর্তব্য ।“ বৃহদ্ধর্মপুরাণ /উত্তরখন্ড/প্রথম অধ্যায়
উপরের উক্তি থেকে বোঝা যায় বর্ণব্যবস্থায় ব্রাহ্মণের সুবিধাই সবচাইতে বেশি ছিল এবং ব্রাহ্মণ হতে নিচের দিকে সুবিধা ক্রমশ কমতে থাকে।
মনুসংহিতার মতো বৃহদ্ধর্ম পুরাণও বিভিন্ন বর্ণের মানুষদের নামের শেষে বিভিন্ন ধরণের উপাধী যুক্ত করতে বলছে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যের উপাধি ঠিকঠাক থাকলেও শূদ্রকে ‘দাস’ উপাধী যুক্ত করতে বলা হয়েছে । আর ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় নারীর নামের ক্ষেত্রে দেবী যুক্ত করতে বলা হলেও বৈশ্য ও শূদ্র নারীর নামের শেষে ‘দাসী’ যুক্ত করতে বলা হয়েছে। বৃহদ্ধর্ম পুরাণের ভাষায়-
“ব্রাহ্মণের নামের আগে দেব ও শর্মা ,ক্ষত্রিয়ের রায় ও বর্মা , বৈশ্যের ধন ও শূদ্রের দাস শব্দ ব্যবহার হবে।… ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় স্ত্রীর নামের শেষে দেবী, বৈশ্য ও শূদ্র স্ত্রীর দাসী পদ ব্যবহার করা কর্তব্য ।“বৃহদ্ধর্মপুরাণ /উত্তরখন্ড/প্রথম অধ্যায়
একই অপরাধের শাস্তির ক্ষেত্রেও বর্ণভেদে বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। ব্রাহ্মণ কুকর্ম করলেও তাকে কোনো কঠিন শাস্তি দেওয়া হত না। অপরদিকে অন্য বর্ণের মানুষদের একই অপরাধে কঠিন দণ্ডে দণ্ডিত করা হত। ব্রাহ্মণের শাস্তি প্রসঙ্গে বৃহৎদ্ধর্ম পুরাণ বলছেঃ
- …শিষ্য গুরুকে, পুত্র পিতাকে, রমণী স্বামীকে অবজ্ঞা করলে , রাজা দণ্ডপ্রদান করবেন কিন্তু কোন ব্রাহ্মণকে কুকর্মান্বিত জেনে দৈহিক দন্ড দেবেন না কারণ, ব্রাহ্মণ, স্ত্রী, বৃদ্ধ ও বালক এরা বধ্য নয়।“ বৃহদ্ধর্মপুরাণ /উত্তরখন্ড/৩য় অধ্যায়
- ব্রাহ্মণ বধের যোগ্য হলে, তার মস্তক মুন্ডন করে তার সার শরীরে গোবর মাখিয়ে গাধার পিঠে চড়িয়ে তাকে সম্পূর্ণ নগর পরিভ্রমণ করাবে , এটাই ব্রাহ্মণের দণ্ড। ব্রহ্মনির্দিষ্ট এমন দন্ডের প্রায়শ্চিত্ত নেই। বৃহদ্ধর্মপুরাণ /উত্তরখন্ড/৩য় অধ্যায়
- “রাজাদের আদি ভগবান মনু ব্রাহ্মণ, সতী ও গরুর রক্ষার জন্য নিয়ম সংস্থাপন করে গিয়েছেন যে, ব্রাহ্মণ, সতী ও গরুদের ফুল দিয়েও আঘাত করবে না এবং কেশমুণ্ডন, সর্বস্বগ্রহণ ও দেশান্তর নির্বাসন ছাড়া কুকর্ম সমন্বিত ব্রাহ্মণের অন্য দৈহিক দন্ড নেই ।“ বৃহদ্ধর্মপুরাণ /উত্তরখন্ড/২য় অধ্যায়
ব্রাহ্মণকে বৃহদ্ধর্ম পুরাণ অপরাধের শাস্তির ক্ষেত্রে যে ছাড় দিয়েছে তা আমরা আগেই দেখেছি কিন্তু ব্রাহ্মণদের আরও অনেক সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। রাজাকেও ব্রাহ্মণদের পূজা করার কথা বৃহদ্ধর্ম পুরাণ বলছে। বৃহদ্ধর্ম পুরাণে আছে, “রাজারা সর্বদা স্বস্তয়ন ও বিপ্রপূজাপরায়ণ হবে।“ বৃহদ্ধর্মপুরাণ /উত্তরখন্ড/৩য় অধ্যায়
অন্যদিকে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করেছে বৃহদ্ধর্ম পুরাণ।
অপরাধ করলে ক্ষত্রিয় কেমন শাস্তি পাবে সে বিষয়ে বৃহদ্ধর্ম পুরাণ বলছে-
“ক্ষত্রিয় যদি পরদ্রব্যহরণ বা পরস্ত্রীগমণ করে , তাহলে তার হাত,পা , নাক, কান ,কেটে সর্বস্ব গ্রহণ করে অপর রাজ্যে তাকে নির্বাসিত করবে। কোন রাজা বা রানী রাজ্যের বিপ্লবকারী হলে , ভূপতি তাকে শরজালে বিদ্ধ এবং শক্তি চক্র ও গদা প্রভৃতি দ্বারা তাড়িত করবে। দুষ্ট ক্ষত্রিয়ের এমন দন্ড বিহিত আছে…” বৃহদ্ধর্মপুরাণ /উত্তরখন্ড/৩য় অধ্যায়
অপরাধ করলে বৈশ্য কেমন শাস্তি পাবে সে বিষয়ে বৃহদ্ধর্ম পুরাণ বলছে-
” যে বৈশ্য পরস্ত্রী ও পরদ্রব্যহরণ ইত্যাদি ঘোরতর পাপকার্যে আসক্ত হয়, শূল দ্বারা তার শরীর বিভিন্ন, কিংবা তাকে বৃক্ষ শাখায় লম্বিত করে তাকে বধ করবে, এটাই বৈশ্যের দণ্ড।“ বৃহদ্ধর্মপুরাণ /উত্তরখন্ড/৩য় অধ্যায়
আমরা দেখেছি শাস্তির ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণকে মোটামুটি ছাড় দেওয়া হয়েছে। তার শাস্তির পরিমাণ নগন্য। কিন্তু ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যকে কঠোর দণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। কিন্তু শূদ্রকে সবচাইতে কঠিন শাস্তি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। শূদ্রের শাস্তি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
“শূদ্রকূলে কেউ পাপাচারী হইলে তাকে হাতির পায়ের তলায় দলিত কিংবা লোহার কড়াই প্রভৃতিতে ভেজে করে হত্যা করাই শাস্ত্রসম্মত। কারণ এক ব্যক্তির জন্য সমুদয় কুল কিংবা গ্রাম নষ্ট করা বৈধ নয়।“ বৃহদ্ধর্মপুরাণ /উত্তরখন্ড/৩য় অধ্যায়
পূর্বে সম্ভবত কোনো শূদ্রের অপরাধে সম্পূর্ণ গ্রামের শূদ্রদের মেরে ফেলার বিধান ছিল। তাই হয়তো বৃহদ্ধর্ম পুরাণের রচয়িতা বলছেন বলেন, ‘এক ব্যক্তির জন্য সমুদয় কুল কিংবা গ্রাম নষ্ট করা বৈধ নহে।‘
ব্রাহ্মণের মহিমা
আমরা আগেই দেখেছি বৃহদ্ধর্ম পুরাণে ব্রাহ্মণকে কঠিন শাস্তি থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এটাই ব্রাহ্মণের একমাত্র privilege ছিল না। বৃহদ্ধর্ম পুরাণের উত্তরখণ্ডের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ব্রাহ্মণের সীমাহীন প্রশস্তি কীর্তিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছেঃ
- ব্রাহ্মণেরাই পৃথিবীর দেবতা
- ব্রাহ্মণেরাই নিজের সমস্ত বস্তু ভোজনও অন্যকে দান করে থাকেন।
- তাদেরই অনুগ্রহে ক্ষত্রিয় প্রভৃতি ভোজন করতে পারে।
- কারণ সমগ্র বসুন্ধরা, নিখিল ধর্মই ব্রাহ্মণের।
- ক্ষত্রিয় প্রভৃতি সকলেই ব্রাহ্মণের শেষ গ্রহণ করে থাকে।
- ব্রাহ্মণেরা সকলের পিতা এবং ব্রাহ্মণীরা সকলের মাতাস্বরূপ।
- নিখিল তীর্থই ব্রাহ্মণের চরণ সম্ভূত।
- যতদিন পর্যন্ত গো ও ব্রাহ্মণ অবস্থিত আছে, ততদিন পর্যন্তই বসুমতি স্থিরমত অবস্থিতি করতে পারবেন।
- তাই পৃথিবী রক্ষার জন্য দ্বিজ,গো ও সতী স্ত্রীকে পূজা করা কর্তব্য ।
- সতী স্ত্রী, গো ,ব্রাহ্মণ এই তিনই জগতের মঙ্গল স্বরূপ ।
- যে ব্যক্তি এদের দ্বেষ করবে সে মঙ্গল হতে বিচ্যুত হবে।
- বিপ্রদের দুই চরণ , গরুদের পিঠ ,নারীদের সমস্ত অঙ্গকে জ্ঞানীরা তীর্থ বলে জানবেন।
- যে ব্যক্তি ইত্যাদি অঙ্গ মর্যাদা অতিক্রম করে সে ঘোর নরকগামী হয়ে থাকে এবং তাকে জীবনমৃত বলা যায় ।
- ব্রাহ্মণ প্রাণায়মবলে প্রভূত পাপরাশি দগ্ধ করে থাকে।
এছাড়া বৃহদ্ধর্ম পুরাণের উত্তরখণ্ডের প্রথম অধ্যায়ে বলা হয়েছে, “ক্ষত্রিয় প্রভৃতি বর্ণত্রয় ব্রাহ্মণকে আগমন করতে দেখলে প্রণাম করবে, যদি তা না করা হয় তবে তারা ব্রহ্মহত্যা পাপে লিপ্ত হয়”
সুতরাং দেখতেই পাচ্ছেন, আজকের দিনে আইনের চোখে, মানবতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে সকলেই সমান হলেও প্রাচীন যুগে তা ছিল না।কিন্তু সেই প্রাচীন যুগকেই অনেকে স্বর্ণযুগ বলে প্রলাপ বকছেন বর্তমানে। তারা হয় প্রাচীন যুগ সম্বন্ধে অজ্ঞ, নয়তো তারা আপাদমস্তক ধূর্ত।
সহায়ক গ্রন্থ
বৃহদ্ধর্ম পুরাণ; শ্রী পঞ্চানন তর্করত্ন কর্তৃক সম্পাদিত; শ্রী কেবলরাম চট্টোপাধ্যায় দ্বারা মুদ্রিত ও প্রকাশিত

