গত ২৪ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় একটি সংবাদমাধ্যম ‘সময় টিভি’ তাদের নিউজ পোর্টাল থেকে “মহানবীর (সা.) ১৪০০ বছর আগের যে বাণী সত্য প্রমাণ পেল বিজ্ঞান” শিরোনামে একটি নিউজ আর্টিকেল প্রকাশ করে। মহানবীর (সা.) ১৪০০ বছর আগের যে বাণী সত্য প্রমাণ পেল বিজ্ঞান – সময় আসুন নিউজ আর্টিকেলটি পড়ে দেখি এবং জানি তারা কি বলছে:

সময় টিভি তাদের ইউটিউব চ্যানেল থেকেও এনিয়ে একটি ভিডিও প্রকাশ করে। যা এখন পর্যন্ত দেড় মিলিয়ন বার দেখা হয়েছে, লাইক এসেছে ২ লাখ ৫৬ হাজার!
আসুন দেখি যে হাদিসকে কেন্দ্র করে আলোচনা সেই হাদিসটি আসলে কি বলছে:
গ্রন্থঃ সহীহ মুসলিম (হাঃ একাডেমী)
অধ্যায়ঃ ১। ঈমান (বিশ্বাস) (كتاب الإيمان)
হাদিস নম্বরঃ ৩৬৮
৮৪. নিম্ন জান্নাতী, তথায় তার মর্যাদা।
(…) নিশ্চয় জান্নাতের দু’ চৌকাঠের মধ্যকার দূরত্ব মক্কা ও হাজরের (বাহরাইনের একটি জনপদের) দূরত্বের মতো। অথবা বর্ণনাকারী বলেন, মক্কা ও বাসরার দূরত্বেরে ন্যায়। (ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩৭৬, ইসলামিক সেন্টারঃ ৩৮৭)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
পরের হাদিসেও এবিষয়ে কথা বলা হয়েছে:
গ্রন্থঃ সহীহ মুসলিম (হাঃ একাডেমী)
অধ্যায়ঃ ১। ঈমান (বিশ্বাস) (كتاب الإيمان)
হাদিস নম্বরঃ ৩৬৯
৮৪. নিম্ন জান্নাতী, তথায় তার মর্যাদা।
(…) জান্নাতের দরজাসমূহের দু’ চৌকাঠের মাঝখানের দূরত্ব মক্কা ও হাজার অথবা হাজার ও মক্কার মাঝখানের দূরত্বের সমান। বর্ণনাকারী বলেন, আমার জানা নেই, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনটি আগে বলেছিলেন। (ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩৭৭, ইসলামিক সেন্টারঃ ৩৮৮)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
প্রথম হাদিসটি থেকে এটা বোঝা যায় না যে, নবী বলেছেন জান্নাতের দুই দরজার মধ্যবর্তী জায়গার দূরত্ব মক্কা থেকে হাজার অথবা মক্কা থেকে বুশরার দূরত্বের সমান। বরং, এটাই বোঝা যায় যে, হাদিস বর্ণনাকারী নিশ্চিত ছিলেন না নবী মক্কা থেকে হাজারের দূরত্বের কথা বলেছেন নাকি মক্কা থেকে বুশরার দূরত্বের কথা বলেছেন। বর্ণনাকারীর মতে, নবী হয় মক্কা থেকে হাজারের দূরত্বের কথা বলেছেন নাহয় মক্কা থেকে বুশরার দূরত্বের কথা বলেছেন।
আবার দ্বিতীয় হাদিসে দেখা যায়, নবী বলেছেন, জান্নাতের দুই দরজার মধ্যবর্তী জায়গার দূরত্ব মক্কা থেকে হাজার অথবা হাজার থেকে মক্কার দূরত্বের সমান। বর্ণনাকারী জানেন না, নবী কোনটা আগে বলেছেন। এখানে তো মক্কা থেকে বুশরার দূরত্বের কথাই আসেনি।
অর্থ্যাৎ, নবীজি কখনোই এমনটি বলেননি যে, জান্নাতের দুই দরজার মধ্যবর্তী জায়গার দূরত্ব মক্কা থেকে হাজার অথবা মক্কা থেকে বুশরার দূরত্বের সমান। ‘ইসলাম প্রাকটিস’ নামের ফেসবুক পেইজটি হাদিসের অপব্যাখ্যা দিয়েছে, আর সময় টিভি সেই অপব্যাখ্যা প্রচার করেছে।
সময় টিভি দাবি করেছে, সম্প্রতি স্যাটেলাইট প্রযুক্তিতে পাওয়া ছবিতে দেখা গেছে মক্কা থেকে বাহরাইনের হাজারের দূরত্ব এবং মক্কা থেকে সিরিয়ার বুশরার দূরত্ব একই, মক্কা থেকে হাজার এবং বুশরা উভয়ের দূরত্বই ১২০০ কিলোমিটার।
সময় টিভি তাদের এমন দাবির সমর্থনে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র উল্লেখ করেনি। সূত্র হিসেবে তারা ‘ইসলাম প্রাকটিস’ নামক ফেসবুক পেইজের পোস্টটির একটি স্ক্রিনশট ব্যবহার করেছে, যেখানে কোনো তথ্যসূত্র ছাড়াই এটি দাবি করা হয় যে, মক্কা থেকে হাজার এবং বুশরার দূরত্ব একই, ১২০০ কিলোমিটার। তারা নিজেরাও কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র উল্লেখ করলো না, যে ফেসবুক পোস্টের কথা উল্লেখ করলো সেই ফেসবুক পোস্টেও কোনো তথ্যসূত্র উল্লেখ করা হয়নি। বিষয়টা কতোটা হাস্যকর, একটা ইসলামিক পেইজ ইসলামকে সত্য প্রমাণের চেষ্টায় কোনো সূত্র ছাড়াই কিছু পোস্ট করলো আর তারাও সেই পোস্টের ভিত্তিতে খবর ছাপিয়ে ফেললো। অথচ তারা দেশের জনপ্রিয় একটি সংবাদমাধ্যম, লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের পাঠক, শ্রোতা, দর্শক।
মক্কা থেকে বাহরাইনের হাজার এবং সিরিয়ার বুশরার দূরত্ব মোটেও এক নয়। ডিস্টেন্স ক্যালকুলেটর DISTANCE.TO এর সাহায্যে আমরা জানতে পারি, মক্কা থেকে বাহরাইনের হাজারের দূরত্ব ১২১৭.৭৪ কিলোমিটার (৭৫৬.৬৭ মাইল) এবং মক্কা থেকে সিরিয়ার বুশরার দূরত্ব ১২৭৭.৩৬ কিলোমিটার (৭৯৩.৭১ মাইল)। অর্থ্যাৎ, মক্কা থেকে বাহরাইনের হাজার এবং সিরিয়ার বুশরার দূরত্বে ৫৯.৬২ কিলোমিটারের (৩৭.০৪ মাইল) পার্থক্য বিদ্যমান। এই ৫৯.৬২ কিলোমিটার (৩৭.০৪ মাইল) কোনোভাবেই নগন্য দূরত্ব নয়। সুতরাং, মক্কা থেকে হাজার এবং বুশরার দূরত্ব সমান দাবি করার কোনো অর্থ নেই।


তাছাড়াও, সপ্তম শতাব্দীর মক্কায় জন্ম নেওয়া, ছোট থেকে বড় হওয়া একজন মানুষের মক্কা থেকে দুটি স্থানের দূরত্ব যে প্রায় সমান বা কাছাকাছি সেটা জানাটা খুবই স্বাভাবিক, এতে অলৌকিকতার কিছু নেই, এজন্য তার নবী হওয়ার প্রয়োজন নেই। সেসময় মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজনে উটের পিঠে চড়ে দূর-দূরান্তে যাতায়াত করতো। একস্থান থেকে অন্যস্থানে পৌঁছাতে কেমন সময় লাগে তার ভিত্তিতে একস্থান থেকে অন্যস্থানের দূরত্ব আন্দাজ করতে পারতো।
পরিষ্কারভাবেই, সময় টিভি ‘ইসলাম প্রাকটিস’ নামের ফেসবুক পেইজের পোস্টটি বিচার বিশ্লেষণ করে দেখেনি এবং একটি ভিত্তিহীন ফেসবুক পোস্টের ভিত্তিতে একটি ভিত্তিহীন খবর প্রচার করে হলুদ সাংবাদিকতার একটি চমৎকার উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। হয়তো তারা ইচ্ছে করেই ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আবেগ এবং অন্ধত্বকে কাজে লাগিয়ে লাভবান হওয়ার অসৎ উদ্দেশ্য থেকেই এমন হীন কাজটি করেছে।
সংবাদমাধ্যমের কাজ নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সবার উদ্দেশ্যে সত্য সংবাদ প্রচার করা। কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম কিংবা রাজনৈতিক দলের পক্ষে প্রচার-প্রচারণা চালানো সংবাদমাধ্যমের কাজ নয়।

