
ফিতনা (Fitna): ক্ষমতার দাবানল, সভ্যতার পরীক্ষা এবং খাঁটি সোনার সন্ধান
Table of Contents
- 1 ভূমিকা: সভ্যতার ফাটল ও মানুষের আদিমতম সংকট
- 2 ফিতনা: শব্দতত্ত্বের প্রত্নতত্ত্ব ও আগুনের রূপক
- 2.1 আভিধানিক শেকড় ও ধাতুশিল্পীর অগ্নিকুণ্ড
- 2.2 জাহেলিয়ার কবিতা: প্রেম ও জ্ঞানীয় বিপর্যয়
- 2.3 কুরআনিক রূপান্তর: বিশ্বাস ও দমনের দ্বান্দ্বিকতা
- 2.4 ঐশ্বরিক পরীক্ষা ও মন্দের যৌক্তিকতা
- 2.5 রাজনৈতিক পরিভাষা নির্মাণ: যুদ্ধ বনাম ফিতনা
- 2.6 সামাজিক অরাজকতা ও মনস্তাত্ত্বিক সংকট
- 2.7 সভ্যতার দহনকাল ও দীর্ঘস্থায়ী বিভাজন
- 3 প্রথম ফিতনা (৬৫৬–৬৬১ খ্রিস্টাব্দ): ঐক্যের কফিনে প্রথম পেরেক
- 4 দ্বিতীয় ফিতনা (৬৮০–৬৯২ খ্রিস্টাব্দ): কারবালার ট্র্যাজেডি ও মক্কার অবরোধ
- 5 তৃতীয় ফিতনা (৭৪৪–৭৫০ খ্রিস্টাব্দ): উমাইয়াদের পতন ও আব্বাসীয় উত্থান
- 6 চতুর্থ ফিতনা (৮০৯–৮২৭ খ্রিস্টাব্দ): ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ ও বাগদাদের ধ্বংস
- 7 পঞ্চম ফিতনা (নবম–দশম শতাব্দী): সামারার অরাজকতা ও খলিফার ক্ষমতাহীনতা
- 8 জাঞ্জ ও কারমাতিয়ান বিদ্রোহ: নিচুতলার মানুষের ফিতনা (The Zanj and Qarmatian Revolts)
- 9 বাইরের শক্তির খেলা: বাইজান্টাইন ও পারসিক প্রভাব (Geopolitical Opportunism)
- 10 ফিতনার সমাজতত্ত্ব: কেন মানুষ বিশৃঙ্খলা বেছে নেয়?
- 11 আধুনিক যুগে ফিতনা: ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ও ডিজিটাল দহন
- 12 ফিতনার তাত্ত্বিক ব্যবচ্ছেদ: ধ্রুপদী মুসলিম দর্শন থেকে আধুনিক সমাজবিজ্ঞান
- 13 উপসংহার: ছাইয়ের নিচে আগুনের খোঁজ
- 14 তথ্যসূত্র
ভূমিকা: সভ্যতার ফাটল ও মানুষের আদিমতম সংকট
মানবসভ্যতার দীর্ঘ ও সর্পিল ইতিহাসকে যদি আমরা খুব দূর থেকে, অনেকটা মহাকাশচারীর দৃষ্টিতে দেখি, তবে মনে হবে এটি একটি নিরবচ্ছিন্ন অগ্রগতির গল্প। গুহার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে মানুষ অট্টালিকা বানিয়েছে, চাকা আবিষ্কার করে দূরত্ব ঘুচিয়েছে, আর এখন মঙ্গলে বসতি গড়ার স্বপ্ন দেখছে। এই গল্পটা আমাদের মুগ্ধ করে, অহংকারী করে। কিন্তু আমরা যদি এই ইতিহাসের লেন্সটাকে একটু জুম-ইন করি, মানুষের সম্পর্কের রসায়নটাকে মাইক্রোস্কোপের নিচে ফেলি, তবে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন, বিষাদগ্রস্ত চিত্র ভেসে ওঠে। সেখানে দেখা যায়, নির্মাণের চেয়ে ধ্বংসের গল্পই বেশি। মানুষ খুব যত্ন করে, তিল তিল করে একটি সমাজ বা রাষ্ট্র গড়ে তোলে, বিশ্বাসের সুতো দিয়ে সম্পর্কের চাদর বোনে। তারপর হঠাৎ একদিন, কোনো এক অজানা জাদুকরের ইশারায় সেই সাজানো বাগান তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে।
কেন এমন হয়? কেন শান্তির ললিতবাণী শোনানো, কবিতাপ্রেমি মানুষগুলোই হঠাৎ করে দানবে পরিণত হয়? কেন ভাই তার ভাইয়ের বুকে ছুরি বসাতে দ্বিধা করে না? কেন গতকালের প্রতিবেশী আজকের ঘাতক হয়ে ওঠে?
এই প্রশ্নগুলো চিরন্তন। সমাজবিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন ‘সিভিল ওয়ার’ (Civil War) বা গৃহযুদ্ধ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেন ‘অ্যানার্কি’ (Anarchy) বা অরাজকতা। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস, বিশেষ করে সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীর আরব ও পারস্য সমাজের প্রেক্ষাপটে এই অবস্থার একটি বিশেষ, গাঢ় নাম আছে – ‘ফিতনা‘। শব্দটি ছোট, মাত্র তিনটি আরবি অক্ষরের সমষ্টি – ‘ফা’, ‘তা’, ‘নুন’। কিন্তু এর ভার বা গ্রাভিটি (Gravity) এতই তীব্র যে, এটি গত চৌদ্দশ বছর ধরে মুসলিম মানস, রাষ্ট্রদর্শন এবং সমাজচিন্তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এই একটি শব্দকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার ভলিউম ইতিহাস লেখা হয়েছে, বিশাল সাম্রাজ্যের মানচিত্র বারবার বদলে গেছে, এবং ধর্মতত্ত্বের (Theology) জটিল সব সমীকরণের জন্ম হয়েছে।
আমরা যখন ‘ফিতনা’ শব্দটি উচ্চারণ করি, তখন সাধারণত আমাদের মনে ধর্মীয় কোনো অনুষঙ্গ ভেসে ওঠে। মনে হয়, এটি হয়তো শুধুই পাপ বা পুণ্যের হিসাব। কিন্তু আমরা যদি ধর্মতাত্ত্বিক চশমাটা কিছুক্ষণের জন্য টেবিলে নামিয়ে রেখে, নিরেট সমাজতাত্ত্বিক (Sociological) এবং ঐতিহাসিক (Historical) দৃষ্টিতে দেখি, তবে দেখব ফিতনা আসলে মানব মনস্তত্ত্বের এক চরম সংকটকাল। এটি এমন এক সময় যখন সমাজের ‘মোরাল কম্পাস’ (Moral Compass) বা নৈতিক দিকনির্দেশনা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। চুম্বক যেমন দিক হারায়, মানুষও তেমনি সত্য-মিথ্যা গুলিয়ে ফেলে। কে ঠিক আর কে ভুল, কে সত্যের পক্ষে আর কে মিথ্যার পক্ষে – এই সীমানাটা তখন আর স্পষ্ট থাকে না। চারদিকে তৈরি হয় এক ধোঁয়াশা বা ‘ফগ অফ ওয়ার’ (Fog of War)। আর সেই ধোঁয়াশায় মানুষ একে অপরের টুঁটি চেপে ধরে, নিজের অজান্তেই।
ভাবুন তো, একটি সমাজ যেখানে সবাই সবাইকে চেনে, একে অপরের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হঠাৎ একটি গুজব, কিংবা ক্ষমতার একটি দ্বন্দ্ব – আর তাতেই গতকালের বন্ধুটি আজকের শত্রু হয়ে গেল। এই যে রূপান্তর, এই যে সাইকোলজিক্যাল শিফট (Psychological Shift) – এটা কীভাবে ঘটে? ফিতনা কি শুধুই বিশৃঙ্খলা? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে কোনো গভীর অর্থ? এটি কি শুধুই রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াই, নাকি এর শেকড় আরও গভীরে, মানুষের অবচেতন মনের অন্ধকার অলিন্দে?
আরব ঐতিহাসিকরা যখন তাদের সময়কার গৃহযুদ্ধগুলোর বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তারা এই শব্দটি খুব সচেতনভাবে ব্যবহার করেছেন। তারা একে নিছক ‘যুদ্ধ’ (Harb) বলেননি। কারণ যুদ্ধে শত্রু চেনা যায়। শত্রুর পোশাক আলাদা থাকে, ভাষা আলাদা হতে পারে, তাদের অবস্থান সীমান্তের ওপারে থাকে। কিন্তু ফিতনায় শত্রু থাকে নিজের ঘরেই। নিজেরই স্বজন, নিজেরই গোত্রের মানুষ। তাই এর বেদনা অনেক গভীর, এর ক্ষত সহজে শুকায় না। বাইরের শত্রু আপনাকে হত্যা করলে আপনি শহীদ বা বীর হবেন, কিন্তু ফিতনায় আপনি হত্যা করলে বা নিহত হলে – উভয় ক্ষেত্রেই এক গভীর শূন্যতা আর প্রশ্নবোধক চিহ্ন ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।
আমরা আজ ইতিহাসের সেই ধুলোমাখা, রক্তে ভেজা পথ ধরে হাঁটব। দেখব, সপ্তম শতাব্দী থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত পাঁচটি বড় ফিতনা বা মহাদুর্যোগ কীভাবে একটি উদীয়মান সভ্যতাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। আমরা দেখব মদিনা থেকে বাগদাদ, কারবালা থেকে সামাররা – কীভাবে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে রক্তগঙ্গা বয়ে গেছে। আবেগ বা বিশ্বাস দিয়ে নয়, আমরা ঘটনাগুলোকে দেখব যুক্তির লেন্স দিয়ে। বোঝার চেষ্টা করব, আগুনের ভেতর দিয়ে গিয়ে মানুষ কি আসলেই খাঁটি সোনা হয়, নাকি পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
ফিতনা: শব্দতত্ত্বের প্রত্নতত্ত্ব ও আগুনের রূপক
আভিধানিক শেকড় ও ধাতুশিল্পীর অগ্নিকুণ্ড
যেকোনো জটিল, বহুমাত্রিক ধারণাকে বুঝতে হলে সবার আগে তার শেকড় বা রুট (Root) খুঁজতে হয়। মানুষের যেমন বংশপরিচয় থাকে, শব্দেরও তেমনি একটা জীবন থাকে, ইতিহাস থাকে, বিবর্তন থাকে। একটি শব্দ কেবল কয়েকটি অক্ষরের সমষ্টি নয়, বরং এটি একটি নির্দিষ্ট সময়ের সমাজমানস, সংস্কৃতি এবং মনস্তত্ত্বের ধারক। ‘ফিতনা’ (Fitna) শব্দটি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই শব্দটির জন্ম কোথায়? এর আভিধানিক বা লেক্সিক্যাল (Lexical) অর্থ কী? সপ্তম শতাব্দীর আরবের রুক্ষ মরুভূমিতে জন্ম নেওয়া এই শব্দটি কীভাবে হাজার বছরের পথ পাড়ি দিয়ে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এক অপরিহার্য পরিভাষায় পরিণত হলো? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের ডুব দিতে হবে ধ্রুপদী আরবি অভিধানগুলোতে, যেমন ইবনে মানজুরের কালজয়ী গ্রন্থ লিসান আল-আরব-এর পাতায়, যেখানে শব্দটির দার্শনিক গভীরতা এবং রূপক ব্যবহারের এক বিস্ময়কর জগত উন্মোচিত হয়। এই প্রত্নতাত্ত্বিক খনন আমাদের দেখায় যে, ভাষা কীভাবে একটি সভ্যতার বিবর্তনের সাক্ষী হতে পারে।
শব্দটির মূল ধাতু বা রুট হলো ‘ফ-ত-ন’ (F-T-N)। প্রাচীন আরবের সমাজব্যবস্থা ও জীবনযাত্রার সাথে এই ধাতুটি গভীরভাবে জড়িয়ে ছিল। সেই সময়ে যখন স্বর্ণকার বা ধাতুশিল্পীরা (Metallurgists) কাজ করতেন, তখন তারা এক বিশেষ এবং অত্যন্ত সতর্ক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতেন। খনি থেকে যখন সোনা বা রুপা আহরণ করা হয়, তখন তা কখনোই বিশুদ্ধ অবস্থায় থাকে না; তার সাথে মিশে থাকে মাটি, পাথর এবং অন্যান্য খাদ বা ভেজাল। এই অপরিচ্ছন্ন, কাঁচা ধাতুকে তখন প্রচণ্ড উত্তপ্ত আগুনে, বা বলা ভালো, অগ্নিচুল্লিতে (Crucible) ফেলে দেওয়া হতো। আগুনের লেলিহান শিখায় ধাতুর গায়ে লেগে থাকা খাদগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যেত, আর নিচ থেকে বেরিয়ে আসত চকচকে, খাঁটি, তরল সোনা। এই যে সোনাকে আগুনে পুড়িয়ে খাঁটি ও মেকি আলাদা করার প্রক্রিয়া – প্রাচীন আরবরা একেই বলত ফিতনা। (Lane, 1863)। অর্থাৎ, শব্দটির জন্মের সাথে জড়িয়ে আছে আগুন, দহন এবং শুদ্ধিকরণের এক তীব্র চিত্রকল্প। এটি কেবল পোড়ানো নয়, এটি হলো সত্যকে মিথ্যার আবর্জনা থেকে আলাদা করার এক নির্মম কিন্তু প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া। ভাষাতাত্ত্বিকরা এই প্রক্রিয়াকে বলেন মেটাফোরিক্যাল ট্রান্সফার (Metaphorical Transfer), যেখানে একটি ভৌত বা ফিজিক্যাল কাজ ধীরে ধীরে একটি তাত্ত্বিক ধারণায় পরিণত হয়।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, শব্দটির আদি অর্থ হলো – পরীক্ষা (Test) বা বিচার (Trial)। কিন্তু এটা যেমন তেমন পরীক্ষা নয়। এ এক দহনকাল। আগুনের ভেতর দিয়ে গিয়ে নিজের সত্তার প্রমাণ দেওয়া। এই রূপকটি যখন মানুষের জীবনে প্রয়োগ করা হয়, তখন এর অর্থ দাঁড়ায় – মানুষের নৈতিক চরিত্র ও ঈমানের দৃঢ়তা যাচাই করা। সমাজেও যখন ফিতনা আসে, তখন আসলে সমাজের মানুষের চরিত্র পরীক্ষা করা হয়। কে লোভী, কে ত্যাগী, কে সুবিধাবাদী আর কে নীতিবান – স্বাভাবিক সময়ে তা বোঝা যায় না। সুসময়ে তো সবাই বন্ধু, সবাই সাধু। কিন্তু দুঃসময়ের আগুনে কে টিকে থাকে, কে তার নীতিতে অটল থাকে, সেটাই ফিতনা ঠিক করে দেয়। ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে একে বলা হয় সিমান্টিক এক্সটেনশন (Semantic Extension) বা অর্থের সম্প্রসারণ, যেখানে একটি ভৌত প্রক্রিয়া (সোনা গলানো) কালক্রমে একটি বিমূর্ত বা অ্যাবস্ট্রাক্ট ধারণায় (নৈতিক পরীক্ষা) রূপান্তরিত হয়। এই রূপান্তরটি আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে, কেন আরবরা গৃহযুদ্ধকে ফিতনা বলত – কারণ তারা মনে করত, এই যুদ্ধগুলোই মুমিনদের ঈমানের আসল পরীক্ষাগার।
জাহেলিয়ার কবিতা: প্রেম ও জ্ঞানীয় বিপর্যয়
ইসলামের আগমনের আগে, অর্থাৎ আইয়ামে জাহেলিয়া (Jahiliyya) বা অজ্ঞতার যুগেও এই শব্দের ব্যবহার ছিল, তবে তা ছিল ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। তৎকালীন আরবি কবিতায় ফিতনা শব্দটি প্রায়শই প্রেম, সৌন্দর্য এবং আসক্তির সাথে যুক্ত ছিল। কোনো নারীর অসামান্য সৌন্দর্য যদি কোনো পুরুষের বিবেক-বুদ্ধি গুলিয়ে দিত, তাকে পাগলপারা করে তুলত, তবে সেই অবস্থাকে ফিতনা বলা হতো। এখানে ফিতনা মানে হলো এমন এক জাদুকরী বা সম্মোহনী শক্তি, যা মানুষের যৌক্তিক চিন্তক্ষমতা বা র্যাশনালিটি (Rationality) কেড়ে নেয়। একজন প্রেমিক যখন তার প্রেমিকার জন্য নিজের গোত্র, পরিবার বা সামাজিক মর্যাদা ভুলে যায়, তখন সে ফিতনায় পতিত হয়। এই অর্থে, ফিতনা ছিল এক ধরণের জ্ঞানীয় বিপর্যয় (Cognitive Disruption), যেখানে আবেগ যুক্তির ওপর জয়লাভ করে।
প্রাক-ইসলামী যুগের এই ব্যবহারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি ফিতনার একটি মৌলিক মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে – বিশৃঙ্খলা বা কনফিউশন। প্রেমে পড়লে মানুষের মনের ভেতরে যে উথাল-পাথাল তৈরি হয়, সমাজেও ফিতনা তৈরি হলে ঠিক তেমনি এক বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়। প্রেমিকের মতো ফিতনাগ্রস্ত সমাজের মানুষও হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তারা আবেগের বশবর্তী হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, যুক্তির দ্বারা নয়। এই সময় শব্দটির সাথে ‘জুনুন’ বা পাগলামির একটি সম্পর্ক ছিল। অর্থাৎ, ফিতনা এমন একটি অবস্থা যা মানুষকে স্বাভাবিক আচরণের বাইরে নিয়ে যায়। এই রোমান্টিক বা ব্যক্তিগত ফিতনার ধারণাটি পরবর্তীতে রাজনৈতিক ফিতনার ধারণাকে বুঝতে সাহায্য করে, কারণ উভয় ক্ষেত্রেই মানুষ তার স্বকীয়তা হারিয়ে স্রোতের বা আবেগের অনুকূলে ভেসে যায়।
কুরআনিক রূপান্তর: বিশ্বাস ও দমনের দ্বান্দ্বিকতা
কুরআনের অবতরণের সাথে সাথে ফিতনা শব্দটি এক বিশাল ধর্মতাত্ত্বিক রূপান্তর (Theological Transformation) লাভ করে। কুরআনে শব্দটির ব্যবহারিক বৈচিত্র্য বা সিমান্টিক ডাইভারসিটি (Semantic Diversity) লক্ষ্য করার মতো। প্রসঙ্গভেদে এর অর্থ আমূল বদলে গেছে, যা শব্দটির গভীরতাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রথমত, মক্কী জীবনের প্রেক্ষাপটে ফিতনা শব্দটিকে ব্যবহার করা হয়েছে নিপীড়ন (Persecution) অর্থে। যখন মক্কার নতুন বিশ্বাসীদের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হচ্ছিল, তাদের ধর্মত্যাগে বাধ্য করার জন্য অমানুষিক চাপ দেওয়া হচ্ছিল, তখন সেই অবস্থাকে ফিতনা বলা হয়েছে। কুরআনের একটি বিখ্যাত আয়াতে বলা হয়েছে, “ফিতনা হত্যার চেয়েও গুরুতর” (Fitna is worse than killing)।
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও মানবাধিকার দর্শনে (Philosophy of Human Rights) এই বাক্যটির তাৎপর্য অপরিসীম। সাধারণ দৃষ্টিতে মনে হতে পারে হত্যাই সর্বোচ্চ অপরাধ। কিন্তু কুরআনিক দর্শনে, হত্যার মাধ্যমে মানুষের জৈবিক অস্তিত্ব শেষ হয়, কিন্তু ফিতনার মাধ্যমে (এখানে নির্যাতন বা জোরপূর্বক ধর্মত্যাগ অর্থে) মানুষের আত্মা, তার বিশ্বাস এবং তার মানবিক মর্যাদাকে ধ্বংস করা হয়। একজন মানুষকে তার মত প্রকাশের জন্য বা বিবেকের স্বাধীনতার জন্য নির্যাতন করাটা হত্যার চেয়েও বড় অপরাধ – এই ধারণাটি এখান থেকেই উৎসারিত। এটি মানুষের ফ্রিডম অফ কনশায়েন্স (Freedom of Conscience) বা বিবেকের স্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। মুহাম্মাদ আসাদ তার তাফসিরে উল্লেখ করেছেন যে, মানুষকে তার বিশ্বাস থেকে জোরপূর্বক বিচ্যুত করা তার আত্মিক মৃত্যুর সামিল, যা শারীরিক মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ। (Asad, 1980)।
ঐশ্বরিক পরীক্ষা ও মন্দের যৌক্তিকতা
দ্বিতীয়ত, ফিতনাকে দেখা হয়েছে একটি ঐশ্বরিক পরীক্ষা বা ডিভাইন ট্রায়াল (Divine Trial) হিসেবে। কুরআনে বলা হয়েছে, মানুষের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি হলো ফিতনা। এখানে ফিতনা নেতিবাচক নয়, বরং এটি একটি নিউট্রাল বা নিরপেক্ষ পরীক্ষার ক্ষেত্র। অতিরিক্ত সম্পদ মানুষকে অন্ধ করে দিতে পারে, ক্ষমতা মানুষকে স্বৈরাচারী (Tyrant) করতে পারে, আবার সন্তানের প্রতি অন্ধ ভালোবাসা মানুষকে অন্যায়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে। আল্লাহ মানুষকে এই উপাদানগুলো দিয়ে পরীক্ষা করেন যে, সে কি এগুলোর মোহে পড়ে নিজের নৈতিকতা বিসর্জন দেবে, নাকি এগুলোকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে ‘খাঁটি সোনা’ হিসেবে উত্তীর্ণ হবে।
এই দর্শনের মূলে রয়েছে থিওডিসি (Theodicy) বা মন্দের অস্তিত্বের যৌক্তিকতা – কেন পৃথিবীতে দুঃখ-কষ্ট বা প্রলোভন আছে? ফিতনার ধারণা উত্তর দেয়: এগুলো হলো আত্মশুদ্ধির মাধ্যম। পৃথিবীর জীবনকে যদি একটি পরীক্ষাগার হিসেবে কল্পনা করা হয়, তবে ফিতনা হলো সেই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। সম্পদ বা ক্ষমতা পাওয়া মানেই আল্লাহর ভালোবাসা নয়, বরং এটি একটি কঠিন ফিতনা বা পরীক্ষার শুরু। মানুষ এই ফিতনার মধ্য দিয়ে গিয়েই তার আধ্যাত্মিক পূর্ণতা অর্জন করে। (Badawi & Haleem, 2008)। এই অর্থে ফিতনা মানুষের অস্তিত্বের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা তাকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ করে এবং তার নৈতিক মেরুদণ্ডকে শক্তিশালী করার সুযোগ দেয়।
রাজনৈতিক পরিভাষা নির্মাণ: যুদ্ধ বনাম ফিতনা
তৃতীয়ত এবং ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থটি হলো – সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভেদ (Dissension) বা গৃহযুদ্ধ। যখন মদিনার রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রসারিত হলো এবং বিভিন্ন স্বার্থের সংঘাত শুরু হলো, তখন ফিতনা শব্দটি তার ধর্মতাত্ত্বিক খোলস ছেড়ে রাজনৈতিক ময়দানে প্রবেশ করল। এই রূপান্তরটি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ঐতিহাসিক এবং সমাজবিজ্ঞানীরা একে বলেন রাজনৈতিক পরিভাষা (Political Terminology) তৈরির প্রক্রিয়া। যখন খলিফা উসমানের হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী গৃহযুদ্ধগুলো শুরু হলো, তখন মুসলিম স্কলার এবং ঐতিহাসিকরা এই সংঘাতগুলোকে নিছক ‘যুদ্ধ’ বা ‘হারব’ (Harb) বলতে চাইলেন না।
আরবি ভাষায় ‘হারব’ শব্দটি সাধারণত ব্যবহৃত হয় দুই ভিন্ন জাতি বা ধর্মের মানুষের মধ্যকার যুদ্ধের ক্ষেত্রে, যেখানে শত্রু-মিত্র পরিষ্কার। কিন্তু যখন নিজের ভাইয়ের সাথে যুদ্ধ, যখন এক সাহাবীর তলোয়ার আরেক সাহাবীর দিকে তাক করা, তখন তাকে কী নাম দেওয়া যায়? এই বিব্রতকর এবং বেদনাদায়ক অবস্থাকে ব্যাখ্যা করার জন্য তারা বেছে নিলেন ‘ফিতনা’ শব্দটি। এর মাধ্যমে তারা বোঝাতে চাইলেন যে, এই যুদ্ধগুলো সাধারণ ক্ষমতার লড়াই নয়, বরং এটি উম্মাহর জন্য একটি কঠিন পরীক্ষা। এটি এমন এক অবস্থা যখন সত্য এবং মিথ্যা মিশে একাকার হয়ে যায়, যখন যুদ্ধের ধোঁয়াশা (Fog of War) মানুষের দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে ফেলে। (Lewis, 1988)। এই শব্দের ব্যবহার প্রমাণ করে যে, তারা এই সংঘাতগুলোকে কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং নৈতিক সংকট হিসেবে দেখেছিলেন।
সামাজিক অরাজকতা ও মনস্তাত্ত্বিক সংকট
এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ফিতনা মানে হলো এমন এক সামাজিক অরাজকতা (Social Anarchy), যা প্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলা বা অর্ডার (Order) কে ভেঙে ফেলে। এটি এমন এক পরিস্থিতি যেখানে সমাজের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ নষ্ট হয়ে যায়, এবং বিভিন্ন উপদল বা ফ্যাকশন (Factions) নিজেদের স্বার্থে সংঘাতে লিপ্ত হয়। এই অবস্থায় সাধারণ মানুষ এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক সংকটে পড়ে, যাকে সমাজবিজ্ঞানে অ্যানোমি (Anomie) বা আদর্শহীনতা বলা যেতে পারে। তারা বুঝতে পারে না কার আনুগত্য করবে, বা কোন পক্ষটি সঠিক। এই অনিশ্চয়তাই ফিতনার সবচেয়ে ভয়ানক দিক। ফিতনা কেবল শরীরের রক্ত ঝরায় না, এটি সমাজের আত্মবিশ্বাস এবং পারস্পরিক আস্থাকে খুন করে।
ঐতিহাসিক তাবারির বর্ণনায় আমরা দেখি, ফিতনার সময়গুলোতে গুজব বা প্রোপাগান্ডা (Propaganda) কীভাবে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ত এবং মানুষের বিচারবুদ্ধি লোপ পেত। এই সময়গুলোতে মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রিত হতো মব সাইকোলজি (Mob Psychology) বা গণমনস্তত্ত্ব দ্বারা, যেখানে যুক্তির চেয়ে আবেগই মুখ্য হয়ে উঠত। মানুষ তখন স্বতন্ত্র সত্তা হারিয়ে ভিড়ের অংশ হয়ে যেত এবং এমন সব নৃশংস কাজ করত যা স্বাভাবিক সময়ে কল্পনাও করা যায় না। ফিতনা তাই কেবল একটি রাজনৈতিক ঘটনা নয়, এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক মহামারী যা সমাজের সামষ্টিক বিবেককে অকেজো করে দেয়।
সভ্যতার দহনকাল ও দীর্ঘস্থায়ী বিভাজন
পরবর্তীতে রাজনৈতিক পরিভাষায় ফিতনা বলতে স্থায়ীভাবে এমন গৃহযুদ্ধ বা সিভিল স্ট্রাইফ (Civil Strife)-কে বোঝানো হতে থাকে, যা মুসলিম উম্মাহর ঐক্য বা কমিউনাল সলিডারিটি (Communal Solidarity) বিনষ্ট করে এবং দীর্ঘমেয়াদি বিভাজন সৃষ্টি করে। এটি কেবল সাময়িক দাঙ্গা নয়, বরং এটি ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেওয়া ঘটনা। ঐতিহাসিকরা প্রধানত চারটি, এবং অনেক ক্ষেত্রে পাঁচটি বড় ফিতনার কথা উল্লেখ করেন। প্রতিটি ফিতনা ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে, জন্ম দিয়েছে নতুন নতুন ধর্মতাত্ত্বিক দল (Theological Sects) এবং রাজনৈতিক মতবাদের। যেমন, প্রথম ফিতনা থেকে শিয়া ও খারিজি মতবাদের জন্ম, দ্বিতীয় ফিতনা থেকে কারবালার বিয়োগান্তক আখ্যান এবং রাজতন্ত্রের সুদৃঢ়করণ, তৃতীয় ফিতনা থেকে উমাইয়াদের পতন ও আব্বাসীয়দের উত্থান, এবং চতুর্থ ফিতনা থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই বা মিহনা (Mihna)-এর সূচনা।
এই প্রতিটি ঘটনাই ছিল মুসলিম সভ্যতার একেকটি দহনকাল। আগুনের সেই আদিম রূপকটি এখানে এসে পূর্ণতা পায় – এই গৃহযুদ্ধগুলোর আগুনে পুড়ে কেউ ছাই হয়েছে, আবার কোনো কোনো মতবাদ বা গোষ্ঠী নতুন শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। সুতরাং, ফিতনা শব্দটির প্রত্নতাত্ত্বিক খনন করলে আমরা দেখি, এটি সোনা গলানোর আগুন থেকে শুরু করে মানুষের হৃদয়ের পরীক্ষা, এবং শেষ পর্যন্ত সভ্যতার ভাঙা-গড়ার এক বিশাল আখ্যানে পরিণত হয়েছে। শব্দটির এই বিবর্তন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ভাষা কেবল ভাব প্রকাশের মাধ্যম নয়, এটি ইতিহাসেরও সাক্ষী। ফিতনার ইতিহাস পাঠ করা মানে আসলে মানুষের ক্ষমতা, লোভ, ত্যাগ এবং সত্যের সন্ধানের চিরন্তন দ্বান্দ্বিকতাকে পাঠ করা।
প্রথম ফিতনা (৬৫৬–৬৬১ খ্রিস্টাব্দ): ঐক্যের কফিনে প্রথম পেরেক
প্রথম ফিতনা বা দ্য ফার্স্ট ফিতনা (The First Fitna) ছিল মুসলিম ইতিহাসের সেই অভাবনীয় ও ট্র্যাজিক মুহূর্ত যখন তাত্ত্বিক আদর্শের সুউচ্চ মিনার বাস্তব রাজনীতির বা রিয়েলপলিটিক (Realpolitik)-এর রুক্ষ জমিতে আছড়ে পড়েছিল। মদিনার শান্ত সমাজ, যা এতদিন ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ ছিল, তা হঠাৎ করেই স্বার্থ ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এই মহাবিপর্যয়ের সূচনা হয় তৃতীয় খলিফা উসমান ইবনে আফফানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে, যখন মিশরের বিদ্রোহীরা মদিনায় খলিফার বাসভবন ঘেরাও করে এবং দীর্ঘ একচল্লিশ দিনের অবরোধের পর তাকে হত্যা করে, তখন কেবল একজন শাসকের মৃত্যু হয়নি; বরং মদিনার পবিত্রতা, খলিফার পদের অলঙ্ঘনীয়তা এবং উম্মাহর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা – সবই একসাথে ভেঙে পড়েছিল। এই ঘটনাটি ছিল মুসলিম মানসে এক বিশাল আঘাত, কারণ এতদিন পর্যন্ত তলোয়ার কেবল বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে উত্তোলিত হতো, কিন্তু এই প্রথম তা নিজ নেতার রক্তে রঞ্জিত হলো। উসমানের রক্তমাখা জামা এবং তার স্ত্রী নিলার কর্তিত আঙুল দামেস্কে মুয়াবিয়ার কাছে পাঠানো হলে তা এক ভয়াবহ আবেগের বিস্ফোরণ ঘটায়, যা যুক্তি ও ন্যায়বিচারের স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ করে দেয়।
উসমানের মৃত্যুর পর আলী ইবনে আবি তালিব চতুর্থ খলিফা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি ক্ষমতা নিলেন এমন এক সময়ে যখন পুরো রাষ্ট্র টালমাটাল, চারদিকে অরাজকতা এবং অবিশ্বাস। তার সামনে তখন পাহাড়সম চ্যালেঞ্জ। একদিকে রাষ্ট্রজুড়ে অরাজকতা, অন্যদিকে উসমানের আত্মীয় এবং সিরিয়ার শক্তিশালী গভর্নর মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান কঠোর দাবি তুললেন – সবার আগে উসমানের হত্যাকারীদের বিচার হতে হবে। এটি ছিল প্রাচীন আরবীয় কিসাস (Qisas) বা রক্তের বদলা বা রেট্রিবিউটিভ জাস্টিস (Retributive Justice) নেওয়ার দাবি। মুয়াবিয়ার যুক্তি ছিল, খলিফার হত্যাকারীদের শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত নতুন খলিফার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, আলীর অবস্থান ছিল অত্যন্ত প্রাগম্যাটিক (Pragmatic) বা বাস্তববাদী। তিনি জানতেন, হত্যাকারীরা তখন মদিনার অলিতে-গলিতে মিশে আছে, তাদের হাতে অস্ত্র এবং তাদের পেছনে শক্তিশালী জনসমর্থনও আছে। মিসর ও কুফা থেকে আসা এই বিদ্রোহীরা তখন মদিনার কার্যত নিয়ন্ত্রক। এই মুহূর্তে তাদের বিচার করতে গেলে মদিনায় তাৎক্ষণিক গৃহযুদ্ধ শুরু হবে এবং রাষ্ট্র পুরোপুরি ভেঙে পড়বে। আলী চাইলেন আগে নিজের শাসন সুসংহত করতে, রাষ্ট্রযন্ত্রকে সচল করতে এবং প্রদেশগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে, যাতে পরে তিনি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারেন।
এই মৌলিক মতপার্থক্য বা ডিসএগ্রিমেন্ট (Disagreement) থেকেই জন্ম নিল মহাবিপর্যয়। মুসলিম বিশ্ব দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একদল আলীর পক্ষে, যারা রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা বা অর্ডার (Order) এবং কেন্দ্রীয় শাসনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছিল। তারা মনে করত, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব টিকে থাকাই প্রধান কথা। আরেকদল উসমানের রক্তের বদলা চাওয়ার পক্ষে, যারা বিচার বা জাস্টিস (Justice) কে অগ্রাধিকার দিচ্ছিল এবং মনে করত, ন্যায়বিচারহীন শাসন অবৈধ। এই দ্বন্দ্ব কেবল রাজনৈতিক ছিল না, এটি ছিল আবেগ, নীতি এবং গোত্রীয় আভিজাত্যের এক জটিল সংমিশ্রণ। আরবের পুরনো গোত্রপ্রীতি বা আসাবিয়্যাহ (Asabiyyah), যা ইসলামের শুরুতে কিছুটা স্তিমিত হয়েছিল, তা এই সংকটের সুযোগে আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কুরাইশদের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং মদিনা বনাম দামেস্কের ভূ-রাজনৈতিক লড়াই এই ফিতনাকে আরও উস্কে দেয়।
জামল যুদ্ধ: উটের পিঠে গৃহবিবাদ
এই সংঘাতের প্রথম বড় বিস্ফোরণ ঘটে যখন আলীর প্রবীণ দুই সাহাবী তালহা এবং জুবায়ের, এবং নবী মুহাম্মদের স্ত্রী আয়েশা আলীর নীতির বিরোধিতা করেন। তাদের দাবি ছিল উসমানের হত্যার বিচার নিশ্চিত করা এবং তারা মনে করতেন আলীর প্রশাসন হত্যাকারীদের দ্বারা প্রভাবিত। তারা মদিনা ছেড়ে মক্কায় এবং পরে বসরায় চলে যান জনসমর্থন আদায়ের জন্য। ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে বসরার উপকণ্ঠে ইতিহাসের এক মর্মান্তিক অধ্যায় রচিত হয়, যা ‘উটের যুদ্ধ’ বা ব্যাটল অফ ক্যামেল (Battle of the Camel) নামে পরিচিত। আয়েশা একটি উটের ওপর হাওদায় বসে যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত ছিলেন বলে যুদ্ধের এই নামকরণ। এটি ছিল ইসলামের ইতিহাসে প্রথমবার যখন মুসলিমরা একে অপরের বিরুদ্ধে তলোয়ার ধরেছিল। ভাই তার ভাইয়ের দিকে তীর ছুড়েছিল, সাহাবী তার সহযোদ্ধার বিরুদ্ধে লড়েছিলেন।
যুদ্ধটি ছিল সংক্ষিপ্ত কিন্তু অত্যন্ত রক্তক্ষয়ী। আলী যুদ্ধ এড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন, দূত পাঠিয়েছিলেন সন্ধির জন্য। কিন্তু তৃতীয় পক্ষের উসকানিতে বা যুদ্ধের ময়দানের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির চাপে বা ফগ অফ ওয়ার (Fog of War)-এর কারণে রাতের অন্ধকারে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আলী এবং তার প্রতিপক্ষ – উভয় পক্ষই বিশ্বাস করত তারা সত্যের পথে আছে, যা এই ট্র্যাজেডিকে আরও গভীর করে তোলে। যুদ্ধে আলী বিজয়ী হন। তালহা ও জুবায়ের নিহত হন, যা আলীর জন্য ছিল ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত কষ্টের। আয়েশাকে আলী অত্যন্ত সম্মানের সাথে, প্রহরা দিয়ে মদিনায় ফেরত পাঠান। কিন্তু হাজার হাজার প্রাণ ঝরে যায়, এবং মুসলিম ঐক্যের দেহে যে ক্ষত তৈরি হয়, তা আর কখনোই পুরোপুরি শুকায়নি। এই যুদ্ধ প্রমাণ করে যে, ফিতনা একবার শুরু হলে তা থামানো নেতাদেরও সাধ্যের বাইরে চলে যায় এবং পবিত্রতম সম্পর্কগুলোও রাজনীতির যুপকাষ্ঠে বলি হতে পারে। (Madelung, 1997)।
সিফফিনের প্রান্তর ও কুরআনের পাতা
উটের যুদ্ধের রেশ কাটতে না কাটতেই শুরু হয় ফিতনার দ্বিতীয় পর্ব, যা ছিল আরও দীর্ঘস্থায়ী এবং ধ্বংসাত্মক। এবার আলীর প্রতিপক্ষ মুয়াবিয়া, যিনি সিরিয়ার গভর্নর হিসেবে একটি সুশৃঙ্খল এবং শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। ৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে ইউফ্রেটিস নদীর তীরে সিফফিন নামক প্রান্তরে দুই বাহিনী মুখোমুখি হয়। এই যুদ্ধ ছিল দুই ভিন্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতির লড়াই – আলীর ধর্মতাত্ত্বিক ও আদর্শবাদী নেতৃত্ব বনাম মুয়াবিয়ার দক্ষ ও কূটকৌশলী রাজনীতি। মাসের পর মাস ধরে ছোটখাটো খণ্ডযুদ্ধ চলতে থাকে, কারণ কেউই চূড়ান্ত আক্রমণ করতে চাইছিল না। অবশেষে যখন পুরোদমে যুদ্ধ শুরু হলো এবং কয়েক দিনের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর আলীর সেনাপতি মালিক আল-আশতারের নেতৃত্বে আলীর বাহিনী বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাল, ঠিক তখনই যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল।
মুয়াবিয়া ছিলেন অত্যন্ত চতুর রাজনীতিবিদ বা শ্রুড পলিটিশিয়ান (Shrewd Politician)। পরাজয় নিশ্চিত জেনে তিনি তার প্রধান উপদেষ্টা আমর ইবনুল আসের পরামর্শে এক ঐতিহাসিক ও ধূর্ত চাল চাললেন। তার সৈন্যরা বর্শার আগায় কুরআনের পাতা (সে সময়ের পান্ডুলিপি) ঝুলিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হলো এবং চিৎকার করে বলতে লাগল, “এসো, আমরা আল্লাহর কিতাব দিয়ে ফয়সালা করি।” এটি ছিল একটি মাস্টারস্ট্রোক অব সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার (Psychological Warfare) বা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। আলীর বাহিনীর অনেকেই ছিল সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ এবং কারি (কুরআন পাঠক)। তারা তাদেরই ধর্মগ্রন্থের বিরুদ্ধে অস্ত্র চালাতে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। আলী তার সৈন্যদের বোঝাতে চাইলেন যে, এটি একটি সামরিক কৌশল বা মিলিটারি ডিসেপশন (Military Deception), মুয়াবিয়া আসলে কুরআন মানছেন না, বরং পরাজয় এড়াতে চাইছেন। কিন্তু তার নিজের সৈন্যদের মধ্যে বিদ্রোহ দেখা দিল; তারা যুদ্ধ করতে অস্বীকার করল এবং আলীকে বাধ্য করল যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে। শেষ পর্যন্ত আলী ‘তাহকিম’ বা সালিশি (Arbitration) মেনে নিতে বাধ্য হলেন। এই সালিশি প্রক্রিয়া কোনো চূড়ান্ত সমাধান আনতে পারেনি, বরং আলীর দলের মধ্যে এক ভয়াবহ ভাঙন ধরিয়ে দেয়, যা ফিতনাকে নতুন মাত্রা দান করে।
খারিজিদের উত্থান: উগ্রবাদের আদি রূপ
সিফফিনের যুদ্ধের এই সালিশি মেনে নেওয়া থেকেই জন্ম নিল ইতিহাসের অন্যতম উগ্র এবং জটিল একটি গোষ্ঠী – ‘খারিজি’ বা দ্য খারিজিটস (The Kharijites)। ‘খারিজি’ শব্দের অর্থ হলো ‘যারা বেরিয়ে গেছে’। আলীর বাহিনীর একটি উগ্র অংশ, যারা শুরুতে আলীকে সালিশি মানার জন্য চাপ দিয়েছিল, তারাই পরে মত পাল্টে বলল, “আপনি কেন মানুষের সালিশ মেনে নিলেন? বিচার করার মালিক একমাত্র আল্লাহ।” তাদের ঐতিহাসিক স্লোগান ছিল – “লা হুকমা ইল্লা লিল্লাহ” (No judgment but God’s)। তাদের যুক্তি ছিল, কুরআনে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে, তাই সালিশ মানা মানে কুরআনের হুকুম অমান্য করা। আর কুরআনের হুকুম অমান্য করা মানেই কুফরি।
এই যুক্তিতে তারা আলী এবং মুয়াবিয়া উভয়কেই ধর্মত্যাগী বা কাফের ঘোষণা করল। তাদের এই দর্শনটি তাকফির (Takfir) বা অন্য মুসলিমকে কাফের ফতোয়া দেওয়ার সংস্কৃতির জন্ম দেয়। তাদের যুক্তি ছিল সরল কিন্তু ভয়াবহ – যারা আমাদের মতো ভাববে না, তারা সবাই কাফের এবং তাদের হত্যা করা বৈধ। এই খারিজিরাই হলো ইতিহাসের প্রথম রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উগ্রবাদী দল। তারা ছিল চরমপন্থী পিউরিটান (Puritan)। তারা মনে করত, বিশ্বাস কেবল অন্তরের বিষয় নয়, কাজের মাধ্যমে তা প্রমাণ করতে হবে। সামান্যতম পাপ করলেও মানুষ কাফের হয়ে যায় এবং তার রক্ত হালাল হয়ে যায়। তাদের এই দর্শন পরবর্তীকালে মুসলিম বিশ্বে ফিতনাকে আরও দীর্ঘস্থায়ী করেছে। তারা বিশ্বাস করত, নেতা বা শাসক হতে হবে নিখুঁত। যদি শাসক ভুল করে, তবে তাকে হত্যা করা বৈধ। এই নৈরাজ্যবাদী চিন্তা (Anarchist Thought) রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করে তোলে। ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে এই খারিজিদেরই এক আততায়ী, আবদুর রহমান ইবনে মুলজাম, ফজরের নামাজের সময় আলীকে বিষাক্ত তরবারি দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে। আলীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রথম ফিতনার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে এবং মুয়াবিয়া একক ক্ষমতার অধিকারী হন। শুরু হয় উমাইয়া রাজবংশ। (Kennedy, 2004)।
শিয়াদের উত্থান: আনুগত্য ও আদর্শের সংগ্রাম
সিফফিনের সালিশি প্রক্রিয়া যখন আলীর শিবিরকে দ্বিধাবিভক্ত করে এবং খারিজিদের মতো উগ্র গোষ্ঠীর জন্ম দেয়, তখন একই সাথে আলীর প্রতি অনুগত ও আদর্শনিষ্ঠ একটি গোষ্ঠীর পরিচিতি আরও সুস্পষ্ট এবং দৃঢ় হয়। এই গোষ্ঠীই ইতিহাসে শিয়া (Shia) নামে পরিচিতি লাভ করে, যার মূল উৎস আরবি শব্দ ‘শিয়াত আলী’ (Shi’at Ali) বা ‘আলীর দল’। প্রথম ফিতনার আগে ‘শিয়া’ কোনো সুসংগঠিত ধর্মীয় সম্প্রদায় ছিল না, বরং এটি ছিল একটি রাজনৈতিক অবস্থান বা পলিটিক্যাল পজিশন (Political Position) যা বিশ্বাস করত যে নবী মুহাম্মদের পর মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব বা ইমামত (Imamate)-এর ন্যায্য হকদার ছিলেন আলী ইবনে আবি তালিব। তারা তাদের এই দাবির পেছনে নবীর সাথে আলীর রক্তের সম্পর্ক, তার জ্ঞান এবং বিভিন্ন সময়ে নবীর দেওয়া ইঙ্গিতের (যেমন গাদীর খুমের ঘটনা) ওপর জোর দিত। কিন্তু প্রথম ফিতনার রক্তাক্ত অধ্যায় এই রাজনৈতিক অবস্থানকে একটি গভীর ধর্মতাত্ত্বিক ও আবেগপূর্ণ আদর্শে রূপান্তরিত করে। আলীর সমর্থকরা বিশ্বাস করত, তিনি কেবল চতুর্থ খলিফাই নন, বরং তিনি ছিলেন উম্মাহর বৈধ এবং একমাত্র ঐশ্বরিকভাবে মনোনীত নেতা বা ইমাম। সুতরাং, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ছিল কেবল রাজনৈতিক বিদ্রোহ নয়, বরং ধর্মের বিরুদ্ধে এক মহাপাপ।
প্রথম ফিতনার প্রতিটি ঘটনাই শিয়া পরিচিতি নির্মাণে ইন্ধন জুগিয়েছে। উসমানের হত্যাকাণ্ডের পর যখন আলী খলিফা হন, তখন তার সমর্থকরা ভেবেছিল যে অবশেষে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উটের যুদ্ধ এবং সিফফিনের যুদ্ধে যারা আলীর পক্ষে তলোয়ার ধরেছিলেন এবং প্রাণ দিয়েছিলেন – যেমন আম্মার ইবনে ইয়াসির – তারা শিয়া আখ্যানে শাহাদাতের মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠেন। সিফফিনের প্রান্তরে যখন সালিশির প্রস্তাব আসে, তখন আলীর শিবিরের একটি বড় অংশ বিভ্রান্ত হলেও, তার সবচেয়ে একনিষ্ঠ অনুসারীরা তার সিদ্ধান্তকেই চূড়ান্ত বলে মেনে নেয়। তারা খারিজিদের মতো আলীকে ত্যাগ করেনি, বরং এই কঠিন পরীক্ষাকেও ইমামের প্রতি আনুগত্যের অংশ হিসেবে দেখেছিল। এই আনুগত্যই ছিল শিয়া মতবাদের মূল ভিত্তি। তাদের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ইরাকের কুফা নগরী, যা ছিল আলীর রাজধানী এবং তার সবচেয়ে শক্তিশালী সমর্থক ঘাঁটি। প্রথম ফিতনা শিয়াদের জন্য ছিল এক অগ্নিপরীক্ষা, যেখানে তারা কেবল তাদের নেতার প্রতিই নয়, বরং আহল আল-বাইত (Ahl al-Bayt) বা নবীর পরিবারের প্রতি ভালোবাসার আদর্শের জন্য লড়াই করেছিল। ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে যখন আলীকে হত্যা করা হয়, তখন এই শাহাদাত শিয়াদের রাজনৈতিক দর্শনকে এক স্থায়ী রূপ দেয়। আলী তাদের কাছে কেবল একজন নিহত খলিফা ছিলেন না, তিনি হয়ে ওঠেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আত্মদানকারী প্রথম ইমাম এবং এক চিরন্তন অনুপ্রেরণার উৎস। এই ট্র্যাজেডিই শিয়াদের মধ্যে এক স্বতন্ত্র পরিচয়বোধ এবং ঐতিহাসিক শোকের সংস্কৃতি তৈরি করে, যা পরবর্তীকালে কারবালার ঘটনার মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে। (Madelung, 1997)।
মুরজিয়া মতবাদ: বিচার স্থগিত রাখার রাজনীতি ও সামাজিক প্রতিষেধক
খারিজিদের এই উগ্রবাদ এবং তাকফিরি চিন্তাধারার বিপরীতে, এবং ফিতনার ভয়াবহ রক্তপাত থেকে সমাজকে রক্ষা করার তাগিদে, উমাইয়া শাসনামলের শুরুর দিকে এক নতুন ধর্মতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক দর্শনের উদ্ভব ঘটে, যার নাম ‘মুরজিয়া’ বা দ্য মুরজিয়া (The Murji’ah)। এই শব্দটি এসেছে আরবি ‘ইরজা’ থেকে, যার অর্থ হলো ‘পিছিয়ে দেওয়া’ বা ‘স্থগিত রাখা’ বা পোস্টপোনমেন্ট (Postponement)। মুরজিয়াদের মূল দর্শন ছিল খারিজিদের ঠিক বিপরীত। খারিজিরা যেখানে পাপী বা ভিন্নমতাবলম্বী মুসলিমদের কাফের ঘোষণা করছিল এবং হত্যা করছিল, সেখানে মুরজিয়ারা বলল – “আমরা কোনো মুসলিমকে, সে যত বড় পাপীই হোক না কেন, কাফের বলব না। তাদের অন্তরে ঈমান আছে কি নেই, তা বিচার করার আমরা কেউ নই। এই বিচার আমরা কিয়ামতের দিন আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিলাম।”
মুরজিয়া মতবাদ ছিল মূলত ফিতনার একটি বুদ্ধিবৃত্তিক অ্যান্টিডোট (Antidote) বা প্রতিষেধক। সমাজে যখন গৃহযুদ্ধ চলছিল, তখন সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল যে আলী সঠিক নাকি উসমান, নাকি মুয়াবিয়া? মুরজিয়ারা এই বিতর্কে না গিয়ে বলল, “উভয় পক্ষই মুসলিম ছিল, তাদের বিচার আল্লাহ করবেন। আমাদের কাজ হলো বর্তমানে শান্তি বজায় রাখা।” এই দর্শনটি উমাইয়া শাসকদের জন্য সুবিধাজনক ছিল, কারণ এর মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ধর্মীয় যৌক্তিকতা কমে যায়। মুরজিয়ারা বিশ্বাস করত, শাসক যদি পাপীও হয়, তবুও তার আনুগত্য করতে হবে যতক্ষণ না সে নামাজ ত্যাগ করে, যাতে ফিতনা বা গৃহযুদ্ধ এড়ানো যায়। তারা ঈমানকে কেবল বিশ্বাসের বিষয় হিসেবে সংজ্ঞায়িত করল, কাজের সাথে একে সরাসরি যুক্ত করল না। অর্থাৎ, কেউ পাপ কাজ করলেও সে মুমিন থাকতে পারে।
এই মতবাদটি তৎকালীন সমাজকে পুরোপুরি ভেঙে পড়া থেকে রক্ষা করেছিল। এটি একটি পলিটিক্যাল কুইয়েটিজম (Political Quietism) বা রাজনৈতিক নীরবতা পালনের সংস্কৃতি তৈরি করে। এর ফলে উমাইয়া শাসনামলে ভিন্ন ভিন্ন মতের মানুষ – শিয়া, সুন্নি, এবং অন্যান্যরা – একই সমাজে বসবাস করতে পেরেছিল। মুরজিয়াদের এই ‘বিচার স্থগিত রাখা’র নীতি পরবর্তীতে সুন্নি রাজনৈতিক ও ধর্মতাত্ত্বিক দর্শনের বা সুন্নি অর্থোডক্সি (Sunni Orthodoxy)-এর ভিত্তি তৈরিতে বিশাল ভূমিকা রাখে। সুন্নিরা পরবর্তীতে মেনে নেয় যে, সাহাবীদের মধ্যকার বিবাদ নিয়ে চুপ থাকা এবং তাদের সম্মানে আঘাত না করা উচিত। মুরজিয়া মতবাদ শিখিয়েছিল যে, নিখুঁত সমাজ বা নিখুঁত শাসক পাওয়া অসম্ভব, তাই মন্দের ভালো হিসেবে স্থিতিশীলতাকে বেছে নেওয়াই শ্রেয়। এটি ছিল ফিতনার আগুন নেভানোর জন্য এক শীতল জলের প্রবাহ, যা উগ্রবাদের মুখে সহনশীলতার বার্তা দিয়েছিল। (Watt, 1973)।
দ্বিতীয় ফিতনা (৬৮০–৬৯২ খ্রিস্টাব্দ): কারবালার ট্র্যাজেডি ও মক্কার অবরোধ
প্রথম ফিতনার দগদগে ক্ষত শুকানোর আগেই মুসলিম উম্মাহর বুকে নেমে আসে দ্বিতীয় ফিতনা বা দ্য সেকেন্ড ফিতনা (The Second Fitna)-এর কালো ছায়া। এই সংঘাতের প্রকৃতি ছিল প্রথম ফিতনার চেয়েও জটিল এবং এর ফলাফল ছিল আরও সুদূরপ্রসারী। প্রথম ফিতনা যদি হয় আদর্শ ও বাস্তবতার সংঘাত, তবে দ্বিতীয় ফিতনা ছিল স্পষ্টতই রাজতন্ত্র বনাম খিলাফতের লড়াই। এর মূল কারণ নিহিত ছিল মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ানের একটি ঐতিহাসিক ও বিতর্কিত সিদ্ধান্তে – তিনি তার জীবদ্দশায় নিজের পুত্র ইয়াজিদকে উত্তরাধিকারী বা সাকসেসর (Successor) হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। এই সিদ্ধান্তটি ছিল প্রাচীন আরব গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য এবং ইসলামি খিলাফতের মূল চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। আরবরা কখনোই বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রে বা ডাইনাস্টিক মোনার্কি (Dynastic Monarchy)-তে অভ্যস্ত ছিল না; তাদের নেতা নির্বাচনের পদ্ধতি ছিল গোত্রপ্রধানদের পরামর্শ বা শুরা (Shura)-ভিত্তিক। খুলাফায়ে রাশেদীনের নির্বাচন পদ্ধতিও ছিল এই নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। মুয়াবিয়ার এই পদক্ষেপের মাধ্যমে ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা কার্যত একটি সাম্রাজ্যবাদী রাজতন্ত্রে বা মুলক (Mulk)-এ রূপান্তরিত হয়, যা মদিনার ধর্মপ্রাণ সাহাবী এবং সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর যখন ইয়াজিদ ক্ষমতায় বসেন, তখন সেই চাপা ক্ষোভ আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়ে এবং শুরু হয় এক দীর্ঘস্থায়ী রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম।
ইয়াজিদের শাসনভার গ্রহণ করার সাথে সাথেই মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। মদিনার অভিজাত সাহাবীরা, বিশেষ করে যারা নবী মুহাম্মদের প্রত্যক্ষ সাহচর্য পেয়েছিলেন, তারা ইয়াজিদের আনুগত্য করতে অস্বীকার করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন হুসাইন ইবনে আলী, আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের এবং আব্দুল্লাহ ইবনে উমর। তারা মনে করতেন, ইয়াজিদ ব্যক্তিগত চরিত্রে কলুষিত এবং শাসনে অযোগ্য; তার হাতে উম্মাহর নেতৃত্ব নিরাপদ নয়। এই রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নেতৃত্বের বৈধতা বা লেজিটিমেসি (Legitimacy) নিয়ে প্রশ্ন থেকেই দ্বিতীয় ফিতনার সূত্রপাত। এই ফিতনা প্রমাণ করে যে, ক্ষমতা যখন কেন্দ্রীভূত হতে থাকে এবং জনগণের মতামতের তোয়াক্কা করা হয় না, তখন সমাজ কতটা ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। এই সময়কালে মুসলিম বিশ্ব কেবল রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত হয়নি, বরং ধর্মীয় ও সামাজিকভাবেও এমন এক ফাটল তৈরি হয়, যা আজও বিদ্যমান।
কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনা: রক্তে লেখা প্রতিবাদ
দ্বিতীয় ফিতনার সবচেয়ে হৃদয়বিদারক এবং প্রভাবশালী ঘটনাটি ঘটে ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে, যা কারবালার ট্র্যাজেডি নামে পরিচিত। আলীর পুত্র এবং নবী মুহাম্মদের দৌহিত্র হুসাইন ইবনে আলী ইয়াজিদের আনুগত্য বা বায়আত (Bay’ah) মেনে নিতে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, অন্যায় এবং স্বৈরাচারী শাসনের কাছে মাথা নত করা মানে সত্যের অপমৃত্যু। কুফার জনগণ, যারা উমাইয়া শাসনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ছিল, তারা হুসাইনকে চিঠি পাঠিয়ে আমন্ত্রণ জানায় এবং প্রতিশ্রুতি দেয় যে তারা তাকে সমর্থন দেবে। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে হুসাইন তার পরিবার-পরিজন ও ঘনিষ্ঠ অনুসারীদের একটি ছোট দল নিয়ে মক্কা থেকে ইরাকের কুফার পথে রওনা হন। কিন্তু রাজনীতির খেলা বড় নির্মম ও পরিবর্তনশীল। কুফার গভর্নর উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ কঠোর হস্তে কুফার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন এবং হুসাইনের সমর্থকদের ভীতি প্রদর্শন ও হত্যা করে ছত্রভঙ্গ করে দেন। ফলে হুসাইন যখন ইরাকের কারবালা প্রান্তরে পৌঁছান, তখন তিনি দেখেন যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হাজার হাজার মানুষ নেই, বরং ইয়াজিদের বিশাল বাহিনী তাকে ঘিরে রেখেছে।
৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর (১০ মহরম) কারবালার রুক্ষ প্রান্তরে এক অসম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। একদিকে হুসাইনের মাত্র ৭২ জন সঙ্গী, অন্যদিকে ইয়াজিদের হাজার হাজার সুসজ্জিত সৈন্য। হুসাইনকে প্রস্তাব দেওয়া হয় – হয় ইয়াজিদের আনুগত্য করো, নতুবা মৃত্যু বরণ করো। হুসাইন জিল্লাতের জীবনের চেয়ে সম্মানজনক মৃত্যুকে বেছে নিলেন। ইয়াজিদের বাহিনী নির্মমভাবে হুসাইন এবং তার পরিবারের প্রায় সকল পুরুষ সদস্যকে হত্যা করে। এমনকি হুসাইনের ছয় মাসের শিশু আলী আসগরও রেহাই পায়নি। তাঁবুর নারীদের বন্দী করে দামেস্কে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ঘটনাটি মুসলিম মানসে, বিশেষ করে শিয়া মতাদর্শে বা শিইজম (Shi’ism)-এ এক স্থায়ী ও গভীর প্রভাব ফেলে। কারবালা কেবল একটি যুদ্ধ ছিল না; এটি ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের অনন্ত সংগ্রামের প্রতীক বা প্যারাডাইম অফ মার্টারডম (Paradigm of Martyrdom)। হুসাইনের শাহাদাত রাজনৈতিক বিরোধকে ধর্মীয় আবেগের তুঙ্গে নিয়ে যায়। এর ফলে শিয়া ও সুন্নি বিভাজন পাকাপোক্ত হয় এবং শিয়াদের মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহা ও শোকের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, যা পরবর্তীকালে উমাইয়াদের পতনে বড় ভূমিকা রাখে। (Hawting, 2000)।
ফিতনায় নারীর ভূমিকা: জয়নাব ও বিবি সাকিনা
দ্বিতীয় ফিতনার ইতিহাসে সাধারণত পুরুষদের যুদ্ধ ও রাজনীতির কথাই বেশি শোনা যায়, কিন্তু এই ফিতনায় নারীদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সক্রিয় এবং কৌশলগত। কারবালার যুদ্ধের পর যখন হুসাইন নিহত হলেন, তখন তার বোন জয়নাব বিনতে আলী এবং কন্যা সাকিনা (বা রুকাইয়া) উমাইয়া স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মশাল হয়ে উঠলেন। কারবালার প্রান্তর থেকে কুফা এবং কুফা থেকে দামেস্ক পর্যন্ত বন্দীদশায় জয়নাব এক অসাধারণ সাহস ও বাগ্মিতার পরিচয় দেন। কুফার গভর্নর উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ এবং দামেস্কে ইয়াজিদের দরবারে দাঁড়িয়ে তিনি যে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছিলেন, তা ছিল উমাইয়া প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে এক বিশাল আঘাত। জয়নাব তার ভাষণে কারবালার সত্য ঘটনা তুলে ধরেন এবং ইয়াজিদের কর্মকাণ্ডকে অনৈসলামিক ও অমানবিক হিসেবে চিত্রিত করেন। তার এই ভূমিকা ছিল কাউন্টার-নারেটিভ (Counter-Narrative) তৈরির এক অনন্য উদাহরণ।
জয়নাবের এই সাহসী ভূমিকা কেবল শোক প্রকাশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; তিনি জনমত গঠনেও বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। মদিনায় ফিরে এসে তিনি কারবালার ঘটনা মানুষের কাছে বর্ণনা করতে থাকেন, যা উমাইয়াদের বিরুদ্ধে জনরোষ তৈরি করে। তার নেতৃত্বে নারীরা ফিতনার সময় কেবল ভুক্তভোগী ছিলেন না, বরং তারা ছিলেন রাজনৈতিক সক্রিয়বাদী বা পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্ট (Political Activist)। একইভাবে, বিবি সাকিনা পরবর্তীকালে তার বুদ্ধিমত্তা, সাহিত্যজ্ঞান এবং সামাজিক প্রভাবের মাধ্যমে মদিনার সমাজে এক বিশেষ স্থান দখল করেন। নারীদের এই ভূমিকা প্রমাণ করে যে, ফিতনার সময় যুদ্ধের ময়দানের বাইরেও এক সমান্তরাল লড়াই চলছিল, যেখানে শব্দ ও সত্য ছিল প্রধান অস্ত্র। এই নারীরাই ছিলেন কারবালার বার্তা বাহক, যারা নিশ্চিত করেছিলেন যে হুসাইনের আত্মত্যাগ যেন ইতিহাসের অতলে হারিয়ে না যায়।
আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের বিদ্রোহ ও মক্কার অবরোধ
কারবালার নৃশংস ঘটনার পর উমাইয়া শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভের আগুন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মক্কার প্রভাবশালী নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের নিজেকে খলিফা ঘোষণা করেন। তিনি ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ এবং রক্ষণশীল নেতা, যিনি উমাইয়াদের শাসনকে অনৈসলামিক মনে করতেন। হেজাজ (মক্কা ও মদিনা), ইরাক, এবং মিশরের বিশাল অংশ তার নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। কার্যত, এই সময়ে মুসলিম বিশ্বে দুইজন খলিফা ছিলেন – সিরিয়ায় উমাইয়ারা এবং মক্কায় ইবনে জুবায়ের। ইবনে জুবায়েরের বিদ্রোহ ছিল উমাইয়াদের জন্য অস্তিত্বের সংকট। ৬৮৩ খ্রিস্টাব্দে ইয়াজিদ মদিনার বিদ্রোহ দমন করার জন্য এক বিশাল বাহিনী পাঠান। হাররার যুদ্ধ বা ব্যাটল অফ আল-হাররা (Battle of al-Harra) নামে পরিচিত এই যুদ্ধে মদিনার আনসার ও মুহাজিরদের সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এবং মদিনা শহর তিন দিনের জন্য লুটপাটের অনুমতি দেওয়া হয়। এটি ছিল মদিনার পবিত্রতার ওপর এক বিশাল আঘাত।
মদিনা দখলের পর উমাইয়া বাহিনী মক্কার দিকে অগ্রসর হয় এবং ইবনে জুবায়েরকে অবরুদ্ধ করে। এই অবরোধের সময় উমাইয়া সেনাপতিরা মক্কার কাবা ঘর লক্ষ্য করে মিনজানিক বা ক্যাটাপাল্ট (Catapult) ব্যবহার করে পাথর ও আগুনের গোলা ছুড়তে থাকে। এর ফলে কাবার গিলাফ পুড়ে যায় এবং কাবার দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি ছিল মুসলিম বিবেকের জন্য এক বিশাল ধাক্কা – ক্ষমতার দ্বন্দ্বে খোদ আল্লাহর ঘরও নিরাপদ ছিল না। অবরোধ চলাকালীন ইয়াজিদের মৃত্যুর খবর আসে, ফলে উমাইয়া বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং ইবনে জুবায়েরের ক্ষমতা সাময়িকভাবে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই শান্তি ছিল ক্ষণস্থায়ী। উমাইয়াদের নতুন খলিফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রকে পুনর্গঠন করেন এবং তার নির্দয় সেনাপতি হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে মক্কায় পাঠান।
৬৯২ খ্রিস্টাব্দে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ পুনরায় মক্কা অবরোধ করেন। দীর্ঘ ছয় মাসের অবরোধের পর মক্কার প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। হাজ্জাজের বাহিনী আবারও কাবা ঘরে পাথর নিক্ষেপ করে। শেষ পর্যন্ত আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের বীরত্বের সাথে লড়াই করে কাবা চত্বরেই নিহত হন। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় ফিতনার সমাপ্তি ঘটে। উমাইয়া শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং মারওয়ানীয় শাখা ক্ষমতা সুসংহত করে। কিন্তু এই বিজয়ের মূল্য ছিল অনেক চওড়া। দ্বিতীয় ফিতনা প্রমাণ করে যে, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য শাসকরা ধর্মের পবিত্রতম স্থানকেও ধ্বংস করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। এই ফিতনা মুসলিম উম্মাহকে এমনভাবে বিভক্ত করে দেয় যে, মক্কা ও মদিনার রাজনৈতিক গুরুত্ব কমে যায় এবং ক্ষমতার কেন্দ্র চিরতরে দামেস্ক ও পরবর্তীতে বাগদাদে সরে যায়। (Hawting, 2000)।
তৃতীয় ফিতনা (৭৪৪–৭৫০ খ্রিস্টাব্দ): উমাইয়াদের পতন ও আব্বাসীয় উত্থান
তৃতীয় ফিতনা বা দ্য থার্ড ফিতনা (The Third Fitna) ছিল মুসলিম ইতিহাসের অন্যতম নাটকীয় ও রূপান্তরমূলক অধ্যায়, যা উমাইয়া রাজবংশের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছিল এবং এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল। প্রথম দুটি ফিতনার মতো এটি কোনো একক যুদ্ধ বা ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং এটি ছিল ধারাবাহিক গৃহযুদ্ধ, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র এবং গণবিদ্রোহের এক জটিল সমষ্টি, যা ৭৪৪ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এই ফিতনার পটভূমি তৈরি হয়েছিল উমাইয়া খিলাফতের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এবং দীর্ঘদিনের জমে থাকা সামাজিক ক্ষোভ থেকে। ৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে শক্তিশালী খলিফা হিশাম ইবনে আব্দুল মালিকের মৃত্যুর পর উমাইয়া পরিবার এক ভয়াবহ নেতৃত্ব সংকটে পড়ে। তার উত্তরসূরি, খলিফা দ্বিতীয় ওয়ালিদ ছিলেন একজন বিলাসপরায়ণ, খামখেয়ালি এবং অধার্মিক শাসক হিসেবে পরিচিত। তার অসংযত জীবনযাপন এবং ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি অবজ্ঞা উমাইয়াদের নৈতিক ভিত্তি বা মোরাল অথরিটি (Moral Authority)-কে দুর্বল করে দেয়। খলিফার বিরুদ্ধে পরিবারের ভেতর থেকেই বিদ্রোহ শুরু হয় এবং ৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে তাকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ড ছিল উমাইয়াদের ঐক্যের শেষ সুতোটি ছিঁড়ে ফেলার মতো। এরপর একের পর এক খলিফা পরিবর্তন হতে থাকে – তৃতীয় ইয়াজিদ, ইব্রাহিম এবং অবশেষে দ্বিতীয় মারওয়ান – কিন্তু কেউই কেন্দ্রীয় শাসনকে সুসংহত করতে পারেননি। এই রাজনৈতিক অস্থিরতা বা পলিটিক্যাল ইনস্ট্যাবিলিটি (Political Instability) রাষ্ট্রকে ভেতর থেকে অসার করে দেয়।
মাওয়ালি সংকট: দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকদের ক্ষোভ ও অর্থনৈতিক বৈষম্য
তৃতীয় ফিতনার মূল চালিকাশক্তি ছিল কেবল রাজবংশীয় কোন্দল নয়, বরং এর পেছনে ছিল গভীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণ। উমাইয়া শাসনব্যবস্থা ছিল মূলত আরবকেন্দ্রিক বা আরব সেন্ট্রিক (Arab-centric)। তারা বিশ্বাস করত, ইসলাম ও শাসনক্ষমতা মূলত আরবদের জন্যই। কিন্তু সাম্রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথে বিপুল সংখ্যক অনারব মানুষ – পারসিক, কিবতি, বার্বার এবং মধ্য এশীয়রা – ইসলাম গ্রহণ করে। এই অনারব মুসলিমদের বলা হতো মাওয়ালি (Mawali)। ইসলামের সাম্য বা ইগালিটারিয়ানিজম (Egalitarianism)-এর নীতি অনুযায়ী তাদের আরবদের সমান অধিকার পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে উমাইয়া শাসকরা তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে দেখত। মাওয়ালিদের সেনাবাহিনীতে উচ্চপদ দেওয়া হতো না, এমনকি মুসলিম হওয়ার পরেও তাদের ওপর অমুসলিমদের জন্য প্রযোজ্য কর বা জিজিয়া (Jizya) চাপিয়ে দেওয়া হতো। এই প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য বা ইনস্টিটিউশনাল ডিসক্রিমিনেশন (Institutional Discrimination) মাওয়ালিদের মধ্যে এক বিশাল ক্ষোভের জন্ম দেয়। তারা অনুভব করতে থাকে যে, উমাইয়া শাসন আসলে ইসলামের নামে আরব আভিজাত্য বা আরব সুপ্রিমেসি (Arab Supremacy)-এর শাসন। এই ক্ষুব্ধ মাওয়ালিরাই ছিল ফিতনার জ্বালানি। তারা এমন একটি পরিবর্তনের অপেক্ষায় ছিল যা তাদের সামাজিক মর্যাদা ও অর্থনৈতিক মুক্তি দেবে। আব্বাসীয় বিপ্লব বা আব্বাসিদ রেভোলিউশন (Abbasid Revolution) সফল হওয়ার পেছনে এই মাওয়ালিদের সমর্থন ছিল নির্ণায়ক। এটি ফিতনার একটি গুরুত্বপূর্ণ ইকোনমিক অ্যাঙ্গেল (Economic Angle), যা দেখায় যে ধর্মতাত্ত্বিক বা রাজনৈতিক স্লোগানের আড়ালে আসলে অর্থনৈতিক বঞ্চনার ইতিহাস লুকিয়ে ছিল।
গোত্রীয় সংঘাত ও আব্বাসীয় বিপ্লব: খোরাসানের ঝড়
উমাইয়াদের পতনের আরেকটি বড় কারণ ছিল সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ বিভাজন। উমাইয়া সেনাবাহিনী ঐতিহাসিকভাবে দুটি প্রধান আরব গোত্রীয় জোট – কায়স বা মুদার (উত্তর আরবীয়) এবং ইয়ামান বা কালব (দক্ষিণ আরবীয়) – এর দ্বন্দ্বে বিভক্ত ছিল। এই দ্বন্দ্বকে বলা হয় কায়স বনাম ইয়ামান (Qays vs. Yaman) সংঘাত। রাষ্ট্র যখন দুর্বল, তখন এই দুই পক্ষের রেষারেষি চরমে পৌঁছায় এবং সেনাবাহিনী তার কার্যকারিতা হারায়। খলিফা দ্বিতীয় মারওয়ান কায়স গোত্রের ওপর বেশি নির্ভরশীল ছিলেন, যা ইয়ামান গোত্রকে ক্ষুব্ধ করে এবং তাদের বিদ্রোহীদের দিকে ঠেলে দেয়। ঠিক এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগে পূর্বাঞ্চলের খোরাসান প্রদেশ থেকে এক নতুন ও বিধ্বংসী শক্তির আবির্ভাব ঘটে। তারা হলো আব্বাসীয় বা দ্য আব্বাসিদস (The Abbasids)। আব্বাসীয়রা ছিল নবী মুহাম্মদের চাচা আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের বংশধর। তারা খুব চতুরতার সাথে একটি শক্তিশালী প্রোপাগান্ডা ক্যাম্পেইন বা দাওয়া (Da’wa) শুরু করে। তাদের স্লোগান ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয় – “আল-রিদা মিন আল-মুহাম্মদ” বা “মুহাম্মদের পরিবারের পছন্দসই ব্যক্তির শাসন”। তারা সরাসরি নিজেদের নাম না বলে অস্পষ্টভাবে ‘আহল আল-বাইত’ বা নবীর পরিবারের অধিকারের কথা বলত, যা শিয়া এবং সুন্নি উভয় পক্ষের অসন্তুষ্ট মানুষদের আকৃষ্ট করেছিল। তারা প্রচার করতে থাকে যে, উমাইয়ারা অধার্মিক, তারা কারবালায় নবীর বংশধরদের হত্যা করেছে এবং তারা ইসলামের মূল নীতি থেকে বিচ্যুত হয়েছে।
আব্বাসীয় আন্দোলনের মূল পরিকল্পনাকারী এবং মাঠপর্যায়ের নেতা ছিলেন এক রহস্যময় ও প্রতিভাবান জেনারেল, যার নাম আবু মুসলিম খোরাসানি। তার আসল পরিচয় নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে, তবে তিনি ছিলেন খোরাসানের মাওয়ালিদের অবিসংবাদিত নেতা। তার দক্ষ প্রোপাগান্ডা এবং সামরিক কৌশলে খোরাসানের গ্রাম ও শহরগুলো উমাইয়াদের বিরুদ্ধে জেগে ওঠে। তিনি কালো পতাকা বা ব্ল্যাক ব্যানার (Black Banner) উড়িয়ে বিদ্রোহের সূচনা করেন, যা ছিল আব্বাসীয় বিপ্লবের প্রতীক। তার নেতৃত্বে মাওয়ালি এবং ক্ষুব্ধ আরবদের এক সম্মিলিত বাহিনী উমাইয়া গভর্নরদের একের পর এক পরাজিত করতে থাকে। ৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহীরা কুফা দখল করে এবং আবুল আব্বাস আস-সাফফাহকে প্রথম আব্বাসীয় খলিফা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে জাব নদীর তীরে বা ব্যাটল অফ জাব (Battle of the Zab)-এ উমাইয়া ও আব্বাসীয় বাহিনীর মধ্যে চূড়ান্ত যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় মারওয়ানের বিশাল বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। মারওয়ান পালিয়ে মিশরে যান, কিন্তু সেখানে তাকে ধরা হয় এবং হত্যা করা হয়।
তৃতীয় ফিতনার ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী এবং বৈপ্লবিক। এর মাধ্যমে প্রায় ৯০ বছরের আরবকেন্দ্রিক উমাইয়া শাসনের অবসান ঘটে এবং পারস্য-প্রভাবিত, কসমোপলিটান বা বিশ্বজনীন (Cosmopolitan) আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজধানী দামেস্কের মরুভূমি থেকে সরে আসে বাগদাদের উর্বর ভূমিতে। এটি ছিল ইসলামের ইতিহাসে এক বিশাল প্যারাডাইম শিফট (Paradigm Shift)। ক্ষমতার কেন্দ্র পরিবর্তনের সাথে সাথে সংস্কৃতিরও পরিবর্তন ঘটে; আরব আভিজাত্যের বদলে পারস্য আমলাতন্ত্র এবং ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক নতুন যুগের সূচনা হয়। মাওয়ালিরা তাদের কাঙ্ক্ষিত অধিকার লাভ করে এবং ইসলামি সভ্যতা সত্যিকারের একটি বৈশ্বিক সভ্যতায় রূপ নেয়। (Donner, 2010)।
চতুর্থ ফিতনা (৮০৯–৮২৭ খ্রিস্টাব্দ): ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ ও বাগদাদের ধ্বংস
চতুর্থ ফিতনা (The Fourth Fitna) আব্বাসীয় খিলাফতের ইতিহাসে এক গভীরতম ক্ষত এবং মুসলিম সভ্যতার এক ট্র্যাজিক মোড় হিসেবে চিহ্নিত। ৮০৯ থেকে ৮২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী এই সংঘাতটি কেবল দুজন রাজপুত্রের – আমিন এবং মামুনের – ক্ষমতার লড়াই ছিল না; বরং এটি ছিল এক বিশাল সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক দর্শন, সাংস্কৃতিক আভিজাত্য এবং ধর্মতাত্ত্বিক কর্তৃত্বের সংঘাত। খলিফা হারুন আল-রশিদের স্বর্ণযুগ বা গোল্ডেন এজ (Golden Age)-এর ঠিক পরেই এই অন্ধকার অধ্যায়টি নেমে আসে, যা আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। ঐতিহাসিকরা একে‘দ্য গ্রেট আব্বাসিদ সিভিল ওয়ার’ বা মহান আব্বাসীয় গৃহযুদ্ধ (The Great Abbasid Civil War) নামে অভিহিত করেন, কারণ এই যুদ্ধের ব্যাপ্তি এবং ধ্বংসযজ্ঞ ছিল আগের তিনটি ফিতনার চেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির। এখানে প্রথমবারের মতো বাগদাদ – যাকে বলা হতো ‘মদিনাত আস-সালাম’ বা শান্তির নগরী – তা নিজেই রণক্ষেত্রে পরিণত হয় এবং তার জৌলুস ধুলোয় মিশে যায়। হারুন আল-রশিদ তার জীবদ্দশায় সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য ৮০২ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় পবিত্র কাবা ঘরের দেয়ালে ‘মক্কা প্রটোকল’ ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন, যেখানে তিনি তার দুই পুত্র – মুহাম্মদ আল-আমিন এবং আব্দুল্লাহ আল-মামুন – এর মধ্যে ক্ষমতা ও অঞ্চল ভাগ করে দেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি যে, এই ভাগাভাগিই ভবিষ্যতে সাম্রাজ্যকে দ্বিখণ্ডিত করার ব্লু-প্রিন্ট হয়ে দাঁড়াবে। আমিন পেয়েছিলেন বাগদাদ এবং আরব-প্রধান পশ্চিমাঞ্চল, আর মামুন পেয়েছিলেন মারভ এবং পারসিক-প্রভাবিত পূর্বাঞ্চল বা খোরাসান। এই বিভাজনটি ছিল মূলত আরব অভিজাততন্ত্র (Arab Aristocracy) এবং উদীয়মান পারসিক আমলাতন্ত্র (Persian Bureaucracy)-এর মধ্যকার এক অবশ্যম্ভাবী সংঘাতের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ।
ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও বাগদাদের অবরোধ: ভাই যখন ভাইয়ের ঘাতক
৮০৯ খ্রিস্টাব্দে হারুন আল-রশিদের মৃত্যুর পর বাগদাদে আমিন খলিফা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আমিনের মা ছিলেন হাশেমী আরব বংশোদ্ভূত জুবাইদা, যা তাকে বাগদাদের অভিজাত আরব শ্রেণি বা আবনা আল-দাওলা (Abna al-Dawla)-এর কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় করে তুলেছিল। অন্যদিকে, মামুনের মা ছিলেন একজন পারসিক দাসী, যার ফলে খোরাসানের পারসিক জনগণ এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণি তাকে নিজেদের প্রতিনিধি মনে করত। আমিনের প্রধান উজির ফজল ইবনে আল-রাবি তাকে প্ররোচিত করেন যে, মামুনের স্বায়ত্তশাসিত ক্ষমতা বাগদাদের কেন্দ্রীয় শাসনের জন্য হুমকি। এই রাজনৈতিক প্ররোচনা বা পলিটিক্যাল ইন্সটিগেশন (Political Instigation)-এর ফলে আমিন তার ভাই মামুনের উত্তরাধিকার বাতিল করে নিজের শিশুপুত্র মুসাকে উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেন। এটি ছিল মক্কার পবিত্র চুক্তির সরাসরি লঙ্ঘন। প্রত্যুত্তরে মামুন তার উজির ফজল ইবনে সাহল এবং সেনাপতি তাহির ইবনে হুসাইনের পরামর্শে বাগদাদের সাথে সব ধরণের সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং খোরাসানকে একটি স্বাধীন দুর্গ হিসেবে গড়ে তোলেন। ৮১১ খ্রিস্টাব্দে আমিন তার বিখ্যাত সেনাপতি আলী ইবনে ইসার নেতৃত্বে বিশাল এক আরব বাহিনী খোরাসান আক্রমণের জন্য পাঠান। রায় শহরের কাছে সংঘটিত এই যুদ্ধে মামুনের ক্ষুদ্র কিন্তু অত্যন্ত সুশৃঙ্খল বাহিনী অভাবনীয় বিজয় অর্জন করে। আলী ইবনে ইসা নিহত হন এবং এই পরাজয় বাগদাদের মনোবল চূর্ণ করে দেয়। যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায় এবং মামুনের বাহিনী বাগদাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
৮১২ খ্রিস্টাব্দে শুরু হওয়া বাগদাদ অবরোধ ছিল মধ্যযুগের যুদ্ধের ইতিহাসে এক ভয়াবহ অধ্যায়। মামুনের দুই সেনাপতি তাহির ইবনে হুসাইন এবং হারসামা ইবনে আয়ান দুই দিক থেকে বাগদাদকে অবরুদ্ধ করেন। এই অবরোধ প্রায় এক বছর বা চৌদ্দ মাস স্থায়ী হয়েছিল। বাগদাদ তখন কেবল একটি শহর ছিল না, এটি ছিল বিশ্বের সমৃদ্ধতম মেট্রোপলিস। অবরোধের ফলে শহরে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, এবং সামাজিক কাঠামো পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। এই সময়ে বাগদাদের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নিম্নবর্গের যুবক, চোর এবং ভবঘুরেরা এক অদ্ভুত মিলিশিয়া বাহিনী গড়ে তোলে, যাদের বলা হতো আইয়ারুন (Ayyarun)। ঐতিহাসিক তাবারির মতে, এই আইয়ারুনরা ছিল কার্যত নগ্ন বা অর্ধনগ্ন, তাদের গায়ে কোনো বর্ম ছিল না, হাতে ছিল কেবল পাথর, লাঠি বা খেজুর পাতার মাদুর। তারা ধনী ও অভিজাতদের প্রাসাদ লুট করত এবং একই সাথে আক্রমণকারী খোরাসানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে অসীম সাহসের সাথে লড়াই করত। এই আইয়ারুনদের উত্থান প্রমাণ করে যে, ফিতনা কেবল রাজপ্রাসাদের বিষয় ছিল না, এটি একটি শ্রেণিসংগ্রাম (Class Struggle) বা সামাজিক বিপ্লবের রূপ নিয়েছিল, যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্র অকেজো হয়ে পড়লে সমাজের তলা থেকে নৈরাজ্যবাদী শক্তি উঠে আসে। (Tabari, 1990)। তাহিরের বাহিনী বাগদাদের বিখ্যাত গোলাকার শহর বা রাউন্ড সিটি এবং এর ভেতরের প্রাসাদগুলোতে মানজানিক (Catapults) বা পাথর নিক্ষেপকারী যন্ত্র দিয়ে অবিরাম আক্রমণ চালায়। বাগদাদের সুরম্য অট্টালিকা, বাগান এবং লাইব্রেরিগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। দজলা বা টাইগ্রিস নদীর জল মানুষের রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল বলে কথিত আছে। ৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে আমিন পালানোর চেষ্টা করেন কিন্তু ধরা পড়েন। তাহিরের নির্দেশে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এবং তার মস্তক ছেদন করে খোরাসানে মামুনের কাছে পাঠানো হয়। ভাইয়ের হাতে ভাইয়ের এই হত্যাকাণ্ড আব্বাসীয়দের পবিত্রতা বা স্যাক্রালিটি (Sacrality) নষ্ট করে দেয় এবং খলিফার পদের প্রতি মানুষের সম্ভ্রম কমিয়ে দেয়।
বুদ্ধিবৃত্তিক ফিতনা: মুতাজিলা দর্শন ও মিহনা
আমিনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে গৃহযুদ্ধ বা সামরিক ফিতনার সমাপ্তি ঘটলেও, মামুনের শাসনামলে এক নতুন ও অভিনব ফিতনার জন্ম হয়, যাকে ঐতিহাসিকরা বলেন বুদ্ধিবৃত্তিক ফিতনা (Intellectual Fitna) বা মতাদর্শিক সংকট। মামুন ছিলেন একজন উচ্চশিক্ষিত এবং দর্শনের প্রতি অনুরাগী শাসক। তিনি গ্রিক দর্শন, যুক্তিবিদ্যা এবং বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তার শাসনামলেই বাগদাদে ‘বাইতুল হিকমাহ’ বা ‘হাউজ অফ উইজডম’ পূর্ণতা পায়। কিন্তু তার এই জ্ঞানতৃষ্ণা রাজনীতির সাথে মিশে এক ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। মামুন বিশ্বাস করতেন যে, রাষ্ট্রের দায়িত্ব কেবল আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা নয়, বরং প্রজাদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে সঠিক পথে পরিচালনা করাও খলিফার দায়িত্ব। তিনি মুতাজিলা (Mu’tazila) বা যুক্তিবাদী ধর্মতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। মুতাজিলারা বিশ্বাস করত যে, মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা বা ফ্রি উইল (Free Will) আছে এবং কুরআন আল্লাহর বাণী হলেও তা ‘সৃষ্ট’ বা ক্রিয়েটেড (Created), অর্থাৎ কুরআন আল্লাহর মতো অনাদি বা অনন্ত নয়। এই মতবাদটি তৎকালীন রক্ষণশীল সুন্নি মানস বা অর্থোডক্স থিওলজি (Orthodox Theology)-এর সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল, যারা বিশ্বাস করত কুরআন আল্লাহর কালাম এবং তা অনাদি বা আনক্রিয়েটেড (Uncreated)।
৮২৭ খ্রিস্টাব্দে মামুন এই ধর্মতাত্ত্বিক বিতর্ককে রাষ্ট্রীয় আইনে পরিণত করেন এবং ৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে কুখ্যাত মিহনা (Mihna) বা ইনকুইজিশন চালু করেন। ইসলামের ইতিহাসে এটিই প্রথম ঘটনা যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস যাচাই করা হতো এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের শাস্তি দেওয়া হতো। বিচারকরা সরকারি কর্মকর্তাদের এবং ধর্মীয় পণ্ডিতদের ডেকে প্রশ্ন করতেন: “তুমি কি বিশ্বাস করো কুরআন সৃষ্ট?” যারা ‘না’ বলত বা চুপ থাকত, তাদের বরখাস্ত করা হতো, কারাগারে পাঠানো হতো, এমনকি নির্যাতন করা হতো। এই নির্যাতনের সবচেয়ে বড় শিকার ছিলেন বিখ্যাত হাদিস বিশারদ ও ফকিহ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল। তাকে দিনের পর দিন বেত্রাঘাত করা হয় এবং দীর্ঘ সময় কারাগারে রাখা হয়। কিন্তু তিনি তার অবস্থানে অটল ছিলেন। ইমাম আহমদের এই প্রতিরোধ তাকে সাধারণ মানুষের কাছে এক জীবন্ত কিংবদন্তিতে পরিণত করে। মামুনের এই নীতি ছিল মূলত ধর্মীয় কর্তৃত্ব (Religious Authority) বা ওলামাদের ক্ষমতা খর্ব করে খলিফার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা বা অ্যাবসোলিউট অথরিটি (Absolute Authority) প্রতিষ্ঠার একটি রাজনৈতিক কৌশল। তিনি চেয়েছিলেন খলিফা হবেন ধর্মের চূড়ান্ত ব্যাখ্যাকার। কিন্তু বাস্তবে এটি হিতে বিপরীত হয়। মিহনা রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে এক বিশাল ফাটল তৈরি করে এবং সাধারণ মানুষ মুতাজিলা দর্শনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। মামুনের মৃত্যুর পরেও তার পরবর্তী দুই খলিফা – মুতাসিম এবং ওয়াসিক – এই নীতি চালিয়ে যান। অবশেষে খলিফা মুতাওয়াক্কিল এই নীতি বাতিল করেন এবং মিহনার সমাপ্তি ঘটে। এই বুদ্ধিবৃত্তিক ফিতনা প্রমাণ করে যে, তলোয়ার দিয়ে মানুষের শরীর দখল করা গেলেও, বিশ্বাস বা আত্মা দখল করা যায় না। (Cooperson, 2005)।
আব্বাসীয় রাজনৈতিক কাঠামোর রূপান্তর ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব
চতুর্থ ফিতনার ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী এবং কাঠামোগত। এই যুদ্ধের মাধ্যমে আব্বাসীয় খিলাফতের ক্ষমতার ভরকেন্দ্র স্থায়ীভাবে আরবদের হাত থেকে সরে যায়। আমিনের পরাজয় ছিল মূলত বাগদাদ-ভিত্তিক আরব অভিজাত শ্রেণির পরাজয়। মামুন ক্ষমতায় আসার পর পারসিকরা প্রশাসন এবং সংস্কৃতির প্রতিটি স্তরে প্রাধান্য বিস্তার করে। তবে মামুনের ভাই মুতাসিম যখন ক্ষমতায় আসেন, তিনি আরব বা পারসিক কাউকেই পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। ফিতনার অভিজ্ঞতায় তিনি দেখেছিলেন যে, এই দুই জাতিই রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সচেতন এবং উচ্চাভিলাষী। ফলে তিনি এক নতুন সামরিক বাহিনী গঠনের দিকে ঝুঁকে পড়েন – যা ছিল মধ্য এশিয়া থেকে আনা তুর্কি ক্রীতদাস সৈন্য বা মামলুক (Mamluk) বা গিলমান (Ghilman)। এই তুর্কিরা ছিল দুর্দান্ত যোদ্ধা এবং তাদের কোনো স্থানীয় সামাজিক শেকড় ছিল না, তাই মনে করা হতো তারা খলিফার প্রতি অন্ধভাবে অনুগত থাকবে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তই পরবর্তীতে আব্বাসীয়দের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যা পঞ্চম ফিতনার পটভূমি তৈরি করে।
চতুর্থ ফিতনা মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের ধারণায় এক স্থায়ী পরিবর্তন আনে। এই সময় থেকেই শিয়া মতবাদ রাজনৈতিকভাবে আরও সুসংগঠিত হতে থাকে। মামুন রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে অষ্টম শিয়া ইমাম আলী আর-রিদাকে তার উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেছিলেন, যা আব্বাসীয় পরিবারের ভেতরেই তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল। যদিও ইমাম রিদা মামুনের আগেই মারা যান, কিন্তু এই ঘটনা শিয়াদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে নতুন মাত্রা দেয়। বাগদাদের ধ্বংসযজ্ঞ এবং পরবর্তী মিহনার ফলে খলিফার পবিত্র ভাবমূর্তি বা ক্যারিশম্যাটিক লিডারশিপ (Charismatic Leadership) নষ্ট হয়ে যায়। জনগণ বুঝতে পারে খলিফাও ভুল করতে পারেন এবং তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সম্ভব। অর্থনৈতিকভাবেও এই ফিতনা ছিল বিপর্যয়কারী। বাগদাদ পুনর্গঠনে বিশাল অর্থ ব্যয় হয় এবং দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধের ফলে কৃষি ও বাণিজ্যের যে ক্ষতি হয়, তা পূরণ করতে আব্বাসীয়দের কয়েক দশক লেগে যায়। তবে সবচেয়ে বড় ক্ষতি ছিল মনস্তাত্ত্বিক। বাগদাদের রাস্তায় যখন আইয়ারুনরা নগ্ন হয়ে যুদ্ধ করছিল, তখন তা সভ্যতার ভঙ্গুরতা বা ফ্রাজিলিটি অফ সিভিলাইজেশন (Fragility of Civilization)-কে উন্মোচিত করে দিয়েছিল। মানুষ দেখেছিল যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেও মানুষ আদিম হিংস্রতায় ফিরে যেতে পারে। চতুর্থ ফিতনা তাই কেবল একটি ক্ষমতার লড়াই ছিল না, এটি ছিল একটি উদীয়মান সভ্যতার আত্মপরিচয়ের সংকট এবং তার ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণকারী এক অগ্নিপরীক্ষা। (El-Hibri, 1999)।
পঞ্চম ফিতনা (নবম–দশম শতাব্দী): সামারার অরাজকতা ও খলিফার ক্ষমতাহীনতা
পঞ্চম ফিতনা বা পঞ্চম ফিতনা (The Fifth Fitna) আব্বাসীয় ইতিহাসের পূর্ববর্তী সংঘাতগুলোর মতো কোনো একক যুদ্ধক্ষেত্র বা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নাটকীয় ঘটনা ছিল না; বরং এটি ছিল এক দীর্ঘস্থায়ী প্রতিষ্ঠানিক অবক্ষয়, সামরিক বা মিলিটারি ক্যু (Military Coup) এবং কেন্দ্রীয় শাসনের ধীরলয়ের মৃত্যু। ঐতিহাসিকরা এই সময়কালকে ‘অ্যানার্কি অ্যাট স্যামাররা’ বা সামারার নৈরাজ্য (The Anarchy at Samarra) হিসেবে চিহ্নিত করেন, যা ৮৬১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৮৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল, তবে এর প্রভাব এবং রেশ দশম শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। প্রথম চারটি ফিতনা ছিল মূলত আদর্শিক বা বংশানুক্রমিক নেতৃত্বের লড়াই, কিন্তু পঞ্চম ফিতনা ছিল রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তনের এক ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। এই সংকটের মূলে ছিল খলিফাদের নিজস্ব নিরাপত্তা এবং ক্ষমতার জন্য বিদেশি ক্রীতদাস সৈন্যদের ওপর অতিনির্ভরশীলতা। খলিফা মুতাসিম বিল্লাহ (৮৩৩–৮৪২ খ্রি.) যখন তার ভাই মামুনের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন, তখন তিনি আব্বাসীয় সেনাবাহিনীর চিরাচরিত কাঠামোর ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন। খোরাসানি সৈন্য এবং আরব গোত্রগুলোর রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ তাকে বিরক্ত করে তুলেছিল। তিনি এমন এক বাহিনী চেয়েছিলেন যারা রাজনীতির মারপ্যাঁচ বুঝবে না, যাদের কোনো স্থানীয় আত্মীয়তার বন্ধন বা কিনশিপ টাইজ (Kinship Ties) থাকবে না এবং যারা হবে খলিফার প্রতি অন্ধভাবে অনুগত। এই লক্ষ্যেই তিনি মধ্য এশিয়ার স্টেপ অঞ্চল থেকে হাজার হাজার তুর্কি যুবককে ক্রীতদাস হিসেবে কিনে আনেন এবং তাদের কঠোর সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে এক এলিট বাহিনী গড়ে তোলেন। এদের বলা হতো গিলমান (Ghilman) বা মামলুক (Mamluks)। এই নতুন সামরিক ব্যবস্থা বা মিলিটারি স্লেভারি (Military Slavery) ছিল ইসলামের ইতিহাসে এক বৈপ্লবিক কিন্তু বিপজ্জনক সংযোজন।
সামারা: বিচ্ছিন্নতার রাজধানী ও প্রিটোরিয়ানবাদের উত্থান
তুর্কি সৈন্যদের বাগদাদে অবস্থান সাধারণ জনগণের সাথে তীব্র সংঘাত তৈরি করে। তুর্কিরা ছিল রুক্ষ এবং তাদের সংস্কৃতি বাগদাদের কসমোপলিটান বা বিশ্বজনীন পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। তারা প্রায়ই বাগদাদের রাস্তায় ঘোড়া নিয়ে দাপিয়ে বেড়াত, যা স্থানীয়দের ক্ষুব্ধ করত। এই উত্তেজনা প্রশমন এবং তুর্কি সৈন্যদের সাধারণ মানুষের প্রভাব থেকে আলাদা রাখার জন্য খলিফা মুতাসিম ৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী বাগদাদ থেকে ১০০ কিলোমিটার উত্তরে দজলা নদীর তীরে এক নতুন শহর প্রতিষ্ঠা করেন। এর নাম দেওয়া হয় ‘সুররা মান রা’আ’ (যে দেখে সেই আনন্দিত হয়), যা লোকমুখে ‘সামারা’ নামে পরিচিতি পায়। সামারা ছিল এক বিশাল সামরিক গ্যারিসন নগরী, যেখানে খলিফা এবং তার সৈন্যরা বসবাস করতেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছিল খলিফা তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন, কিন্তু বাস্তবে তিনি নিজেকে তার মূল জনসমর্থন বা পপোলার বেস (Popular Base) থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। সামারার প্রাসাদে খলিফা কার্যত তার নিজস্ব প্রহরীদের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে পড়েন। রোমান ইতিহাসের প্রিটোরিয়ান গার্ড (Praetorian Guard)-এর মতো এই তুর্কি সৈন্যরা ধীরে ধীরে বুঝতে পারে যে, খলিফার টিকে থাকা বা না থাকা তাদের তলোয়ারের ওপর নির্ভর করছে। খলিফা মুতাওয়াক্কিল (৮৪৭–৮৬১ খ্রি.) যখন তুর্কি সেনাপতিদের ক্রমবর্ধমান ঔদ্ধত্য নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন এবং তাদের ক্ষমতা খর্ব করার উদ্যোগ নেন, তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তুর্কি সেনাপতিরা, বিশেষ করে ওয়াসিফ এবং বুগা, খলিফার নিজস্ব পুত্র আল-মুনতাসিরের সাথে ষড়যন্ত্র করে ৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে এক গভীর রাতে মুতাওয়াক্কিলকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ড ছিল আব্বাসীয় খিলাফতের ইতিহাসে এক চূড়ান্ত টার্নিং পয়েন্ট। এর আগে খলিফাকে হত্যা করার কথা কল্পনাও করা যেত না, খলিফার রক্ত ছিল পবিত্র বা স্যাক্রোস্যাঙ্কট (Sacrosanct)। কিন্তু এই ঘটনার মধ্য দিয়ে সেই পবিত্রতার দেওয়াল ভেঙে পড়ে এবং খলিফা কেবল একজন নশ্বর শাসকে পরিণত হন, যাকে চাইলেই সরিয়ে দেওয়া যায়। (Gordon, 2001)।
অরাজকতার দশক (৮৬১–৮৭০): পুতুল খলিফাদের ট্র্যাজেডি
মুতাওয়াক্কিলের হত্যাকাণ্ডের পর সামারায় যে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়, তা ইতিহাসের পাতায় সামারার নৈরাজ্য (The Anarchy at Samarra) নামে পরিচিত। ৮৬১ থেকে ৮৭০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মাত্র নয় বছরে চারজন খলিফা –আল-মুনতাসির, আল-মুসতাইন, আল-মু’তাজ এবং আল-মুহতাদি – সিংহাসনে বসেন এবং তাদের প্রত্যেককেই তুর্কি সেনাপতিদের ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয়। আল-মুনতাসির তার বাবার হত্যাকারীদের সহায়তায় ক্ষমতায় বসলেও মাত্র ছয় মাস রাজত্ব করার পর রহস্যজনকভাবে মারা যান (ধারণা করা হয় তাকে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল)। এরপর তুর্কিরা আল-মুসতাইনকে খলিফা হিসেবে নির্বাচন করে। কিন্তু ক্ষমতার দ্বন্দ্বে তিনি বাগদাদে পালিয়ে যান এবং সেখানে নিজেকে সুরক্ষিত করার চেষ্টা করেন। সামারার তুর্কি বাহিনী বাগদাদ অবরোধ করে এবং দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের পর মুসতাইন আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন; পরবর্তীতে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর ক্ষমতায় আসেন তরুণ আল-মু’তাজ। তার শাসনামল ছিল আরও করুণ। রাজকোষ তখন শূন্য, সৈন্যদের বেতন দেওয়ার মতো অর্থ খলিফার ছিল না। বেতন না পেয়ে ক্ষুব্ধ তুর্কি সৈন্যরা খলিফাকে প্রাসাদের বাইরে প্রচণ্ড রোদে দাঁড় করিয়ে রাখে এবং নির্যাতন করে। শেষ পর্যন্ত তিনি পদত্যাগ করেন এবং কারাগারে অনাহারে বা তৃষ্ণায় মৃত্যুবরণ করেন। এরপর আসেন আল-মুহতাদি, যিনি একজন ধার্মিক এবং ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে নিজেকে দ্বিতীয় উমর ইবনে আব্দুল আজিজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি তুর্কিদের দুর্নীতি দমন করার চেষ্টা করেন, কিন্তু ফলাফল সেই একই – তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই সময়কালে খলিফার পদটি কার্যত একটি প্রহসনে পরিণত হয়। তুর্কি সেনাপতিরা তাদের ইচ্ছেমতো খলিফা নিয়োগ করত এবং বরখাস্ত করত। এই দশককে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেন প্রিটোরিয়ানিজম (Praetorianism) বা সামরিক বাহিনীর দ্বারা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের যুগ। এই অরাজকতার ফলে আব্বাসীয়দের কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা বা সেন্ট্রাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (Central Administration) পুরোপুরি ভেঙে পড়ে এবং প্রদেশের ওপর থেকে বাগদাদের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে যায়।
ইকতা প্রথা ও সামন্তবাদের সূচনা: অর্থনৈতিক ধস
পঞ্চম ফিতনার অন্যতম প্রধান অনুঘটক ছিল আব্বাসীয় অর্থনীতির কাঠামোর আমূল পরিবর্তন। তুর্কি সৈন্যদের বিশাল বেতন এবং বিলাসবহুল জীবনযাত্রার খরচ মেটাতে গিয়ে রাজকোষ বা বাইতুল মাল (Bayt al-Mal) দ্রুত শূন্য হয়ে যায়। নগদ অর্থের অভাবে সরকার সৈন্যদের বেতন বা ‘আতা’ (Ata) দেওয়ার পরিবর্তে জমির খাজনা আদায়ের অধিকার প্রদান করতে শুরু করে। এই ব্যবস্থাকে বলা হয় ইকতা (Iqta)। ইকতা প্রথার মাধ্যমে সেনাপতিদের নির্দিষ্ট অঞ্চলের জমি প্রদান করা হতো এবং তারা সেই অঞ্চল থেকে সরাসরি কর আদায় করে নিজেদের ও তাদের সৈন্যদের খরচ মেটাতেন। এর ফলে সেনাপতিরা কেবল সামরিক নেতাই থাকলেন না, তারা কার্যত সেই অঞ্চলের সামন্ত প্রভু বা ফিউডাল লর্ড (Feudal Lord)-এ পরিণত হলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রাজস্ব আসা কমে গেল এবং খলিফার অর্থনৈতিক ক্ষমতা সংকুচিত হয়ে এল। এটি ছিল আব্বাসীয় আমলাতন্ত্রের বা ব্যুরোক্রেসি (Bureaucracy) কফিনে শেষ পেরেক। আগে যেখানে বেসামরিক আমলারা বা কাতিব (Katib) রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন, এখন সেখানে সামরিক অফিসাররা সর্বেসর্বা হয়ে উঠলেন। এই সামরিকীকরণ বা মিলিটারাইজেশন (Militarization) সমাজকে এমন এক স্তরে নিয়ে গেল যেখানে সাধারণ কৃষকরা শোষণের শিকার হলো এবং কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাহত হলো। সেচ ব্যবস্থা বা ইরিগেশন সিস্টেম (Irrigation System) রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভেঙে পড়ল, বিশেষ করে দক্ষিণ ইরাকের ‘সাওয়াদ’ অঞ্চলে, যা ছিল সাম্রাজ্যের শস্যভাণ্ডার। এই অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে আরও উস্কে দেয় এবং সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বিদ্রোহের জন্ম দেয়। (Kennedy, 2004)।
সাম্রাজ্যের খণ্ডবিখণ্ডীকরণ: কেন্দ্রবিমুখী শক্তির উত্থান
সামারার অরাজকতার প্রত্যক্ষ ফলস্বরূপ আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের পেরিফেরি বা প্রান্তীয় অঞ্চলগুলো কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। যখন কেন্দ্রের শক্তি দুর্বল হয়, তখন কেন্দ্রবিমুখী শক্তি (Centrifugal Forces) মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মিশরে আহমদ ইবনে তুলুন নামে এক তুর্কি গভর্নর নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করেন। ৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত তুলুনিদ রাজবংশ (Tulunid Dynasty) ছিল আব্বাসীয় যুগে মিশরের প্রথম স্বাধীন মুসলিম রাজবংশ। ইবনে তুলুন বাগদাদে কর পাঠানো বন্ধ করে দেন এবং সেই অর্থ দিয়ে মিশরের উন্নয়ন ও নিজস্ব সেনাবাহিনী গঠনে ব্যয় করেন। তিনি সিরিয়াও দখল করে নেন, যা ছিল আব্বাসীয় খলিফার জন্য এক বিশাল অপমান। পূর্বে, অর্থাৎ ইরান ও খোরাসানে, উত্থান ঘটে সাফ্ফারিদ ও সামানীয় রাজবংশের। ৮৬১ খ্রিস্টাব্দে সিস্তানে ইয়াকুব ইবনে আল-লাইস আল-সাফ্ফার নামে এক তামা শিল্পী বা ‘সাফ্ফার’ বিদ্রোহ করেন এবং সাফ্ফারিদ রাজবংশ (Saffarid Dynasty) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন একজন উগ্র আরব-বিরোধী এবং পারসিক জাতীয়তাবাদী চেতনার ধারক। তার আন্দোলন ছিল অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে এক ধরণের পপুলিস্ট বা জনতুষ্টিবাদী (Populist) বিদ্রোহ। ৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাগদাদ দখলের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হন, যদিও তিনি পরাজিত হন, কিন্তু তার এই দুঃসাহস প্রমাণ করে যে খলিফার ক্ষমতা কতটা ভঙ্গুর ছিল। অন্যদিকে, ট্রান্সঅক্সিয়ানাতে সামানীয় রাজবংশ (Samanid Dynasty) এক সুশৃঙ্খল এবং সংস্কৃতিমনা সুন্নি পারসিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে, যারা খলিফার নামমাত্র আনুগত্য স্বীকার করলেও কার্যত স্বাধীন ছিল। এই রাজবংশগুলোর উত্থান প্রমাণ করে যে, ‘দার আল-ইসলাম’ বা ইসলামি বিশ্ব রাজনৈতিকভাবে আর এক ছিল না; এটি বহু কেন্দ্রে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল।
আমির আল-উমারা ও বুইয়িদ দখল: খিলাফতের প্রতীকী রূপান্তর
দশম শতাব্দীর শুরুতে খলিফা আল-মুকতাদির এবং তার পরবর্তী খলিফাদের সময় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। সামরিক সেনাপতিদের ক্ষমতা এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা সামাল দেওয়ার জন্য খলিফারা ৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে এক নতুন পদ সৃষ্টি করেন – আমির আল-উমারা (Amir al-Umara) বা ‘আমিরদের আমির’। এই পদে আসীন ব্যক্তি কার্যত খলিফার সমস্ত রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতেন, আর খলিফার কাজ ছিল কেবল নামাজ পড়ানো এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পৌরহিত্য করা। এটি ছিল খলিফার রাজনৈতিক মৃত্যুর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। এই পরিস্থিতির চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে ৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে, যখন কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী পার্বত্য অঞ্চল ‘দ্যাইলাম’ থেকে আগত শিয়া বুইয়িদ বা বুইয়িদ রাজবংশ (Buyid Dynasty) বাগদাদ দখল করে নেয়। বুইয়িদ নেতা মুইজ আল-দৌলা বাগদাদে প্রবেশ করেন এবং খলিফা আল-মুসতাকফিকে অন্ধ করে ক্ষমতাচ্যুত করেন। বুইয়িদরা ছিল দ্বাদশ ইমামি শিয়া বা টোয়েলভার শিয়া (Twelver Shia)। তারা চাইলেই আব্বাসীয় খিলাফত বিলুপ্ত করতে পারত, কিন্তু তারা এক চতুর রাজনৈতিক কৌশল বা পলিটিক্যাল প্রাগমাটিজম (Political Pragmatism) অবলম্বন করে। তারা জানত যে, সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ সাম্রাজ্যে শিয়া শাসন টিকিয়ে রাখতে হলে আব্বাসীয় খলিফাকে পুতুল হিসেবে গদিতে রাখা প্রয়োজন। তাই তারা খলিফাকে কেবল একটি প্রতীকী বা সিম্বলিক (Symbolic) পদে পর্যবসিত করে। খলিফা কেবল বুইয়িদ আমিরদের ক্ষমতার বৈধতা বা লেজিটিমেসি (Legitimacy) দেওয়ার যন্ত্রে পরিণত হন। এই সময় থেকে ইসলামি রাজনৈতিক তত্ত্বে এক নতুন দ্বৈত ব্যবস্থার উদ্ভব হয় – একদিকে খলিফা যার হাতে ধর্মীয় মর্যাদা, অন্যদিকে সুলতান বা আমির যার হাতে থাকে ‘শাওকা’ বা সামরিক শক্তি। পঞ্চম ফিতনার এই পরিসমাপ্তি ধ্রুপদী ইসলামি খিলাফতের রাজনৈতিক অধ্যায়ের ইতি টানে এবং এক দীর্ঘস্থায়ী সামরিক সামন্ততন্ত্রের যুগের সূচনা করে, যেখানে ‘খলিফা’ ছিলেন কেবল একটি নাম, আর ‘ক্ষমতা’ ছিল তলোয়ারের ডগায়। (Kraemer, 1992)।
পঞ্চম ফিতনা ও সামারার নৈরাজ্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে যান এখানে – পঞ্চম ফিতনা এবং সামারার নৈরাজ্য (Anarchy at Samarra): ইতিহাসের ধুলো, ক্ষমতার নগ্ন খেলা আর এক মৃত্যু উপত্যকা
জাঞ্জ ও কারমাতিয়ান বিদ্রোহ: নিচুতলার মানুষের ফিতনা (The Zanj and Qarmatian Revolts)
ইসলামের ইতিহাসের প্রথম চারটি ফিতনা ছিল মূলত ক্ষমতার শীর্ষবিন্দুতে থাকা অভিজাতদের লড়াই – হাশেমী বনাম উমাইয়া, শিয়া বনাম সুন্নি, কিংবা আরব বনাম পারসিক। এই যুদ্ধগুলো ছিল রাজপ্রাসাদ, সেনাবাহিনী এবং ধর্মতাত্ত্বিক বিতর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ, যাকে সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন আনুভূমিক সংঘাত (Horizontal Conflict)। কিন্তু নবম শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে দশম শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত আব্বাসীয় খিলাফত এমন এক অভিনব ও ভয়াবহ ফিতনার মুখোমুখি হয়, যা পূর্বের সকল সংঘাতের চরিত্র বদলে দেয়। এটি ছিল সমাজের একেবারে নিচুতলার মানুষ – শৃঙ্খলিত ক্রীতদাস, ভূমিহীন কৃষক এবং মরুভূমির প্রান্তিক বেদুঈনদের সশস্ত্র অভ্যুত্থান। ঐতিহাসিক এবং সমাজবিজ্ঞানীরা এই বিদ্রোহগুলোকে বলেন সামাজিক ফিতনা (Social Fitna) বা উল্লম্ব সংঘাত (Vertical Conflict)। এই ফিতনা কোনো খলিফা বদলানোর জন্য ছিল না, বরং এটি ছিল প্রচলিত সমাজকাঠামো, অর্থনৈতিক শোষণ এবং ধর্মীয় অনুশাসনের মূলে কুঠারাঘাত করার এক বিপ্লবী প্রচেষ্টা। বিশেষ করে দক্ষিণ ইরাকের জলাভূমিতে আফ্রিকান ক্রীতদাসদের জাঞ্জ বিদ্রোহ (Zanj Rebellion) এবং আরব উপদ্বীপে উগ্র শিয়া মতাদর্শী কারমাতিয়ান আন্দোলন (Qarmatian Movement) প্রমাণ করে যে, ফিতনা কেবল রাজনৈতিক নয়, এটি তীব্রভাবে অর্থনৈতিক এবং শ্রেণিগত হতে পারে। মার্কসীয় ইতিহাসবিদরা এই ঘটনাগুলোকে মধ্যযুগের ইসলামি ইতিহাসে শ্রেণিসংগ্রাম (Class Struggle)-এর সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করেন। এই বিদ্রোহগুলো আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছিল এবং প্রমাণ করেছিল যে, ‘দার আল-ইসলাম’-এর শান্তি কেবল ওপরতলার জাঁকজমক দিয়ে বিচার করা যায় না; এর ভিত্তিমূলে জমে ছিল বঞ্চনার এক বিশাল বারুদ।
জাঞ্জ বিদ্রোহ: নোনাজলে লেখা ক্রীতদাসদের রক্তগাথা (৮৬৯–৮৮৩ খ্রি.)
আব্বাসীয় খিলাফতের স্বর্ণযুগে বাগদাদ যখন ঐশ্বর্যের নগরী, তখন দক্ষিণ ইরাকের বসরা সংলগ্ন বিশাল জলাভূমি বা মার্শল্যান্ডস (Marshlands)-এ চলছিল এক অমানবিক দাসপ্রথা। দজলা ও ফোরাত নদীর মোহনায় জমে থাকা লবণাক্ত স্তর অপসারণ করে সেই জমিকে চাষযোগ্য করার জন্য পূর্ব আফ্রিকা (জাঞ্জিবার, সুদান, ইথিওপিয়া) থেকে হাজার হাজার কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস ধরে আনা হয়েছিল। আরবিতে এদের বলা হতো জাঞ্জ (Zanj)। এই জাঞ্জদের জীবন ছিল দুর্বিষহ; তাদের কাজ ছিল দিনের পর দিন বিষাক্ত নোনা কাদা ও নাইট্রাস মাটি বা সল্টপিটার (Saltpeter) পরিষ্কার করা। তাদের না ছিল পর্যাপ্ত খাবার, না ছিল বসবাসের ন্যূনতম ব্যবস্থা। ম্যালেরিয়া এবং অপুষ্টিতে হাজার হাজার ক্রীতদাস মারা যেত, কিন্তু মালিকদের তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। এই অমানবিক পরিস্থিতিই ছিল ফিতনার উর্বর ক্ষেত্র। ৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে এই বারুদের স্তূপে যিনি আগুন দিলেন, তিনি নিজে কোনো ক্রীতদাস ছিলেন না; তিনি ছিলেন আলী ইবনে মুহাম্মদ নামের এক রহস্যময় এবং কারিশম্যাটিক পারসিক বংশোদ্ভূত আরব নেতা। তিনি নিজেকে আলীর বংশধর দাবি করতেন এবং জাঞ্জদের মুক্তির স্বপ্ন দেখাতেন। তিনি ক্রীতদাসদের প্রতিশ্রুতি দিলেন – সম্পদ, মুক্তি এবং সামাজিক মর্যাদা। তার স্লোগান ছিল কুরআনের আয়াত: “আল্লাহ মুমিনদের জান ও মাল কিনে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে।” আলী ইবনে মুহাম্মদপ্রচলিত শিয়া মতবাদের সাথে উগ্র খারিজি সমতাবাদ (Kharijite Egalitarianism)-এর মিশ্রণ ঘটান। তিনি প্রচার করেন যে, খলিফা হওয়ার অধিকার কেবল কুরাইশদের নয়, বরং যেকোনো যোগ্য ও ধর্মপ্রাণ মুসলিমের – সে যদি ইথিওপিয়ান ক্রীতদাসও হয়। এই মতাদর্শ নিচুতলার মানুষের মনে এক অভাবনীয় উদ্দীপনা সৃষ্টি করে।
জাঞ্জ বিদ্রোহ কোনো সাধারণ দাঙ্গা ছিল না; এটি ছিল এক সুসংগঠিত গরিলা যুদ্ধ (Guerrilla Warfare)। আলী ইবনে মুহাম্মদের নেতৃত্বে জাঞ্জরা তাদের হাতের কোদাল ও বেলচা ফেলে অস্ত্র তুলে নেয়। তারা জলাভূমির ভৌগোলিক সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে আব্বাসীয় বাহিনীকে একের পর এক পর্যুদস্ত করতে থাকে। তারা খালের মধ্যে বাঁধ দিয়ে সরকারি জাহাজের গতিপথ আটকে দিত এবং চোরাগোপ্তা হামলা চালাত। বিদ্রোহীরা এতটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে, তারা ‘আল-মুখতারা’ (নির্বাচিত নগরী) নামে নিজস্ব রাজধানী স্থাপন করে, যেখানে নিজস্ব মুদ্রা চালু করা হয় এবং জুমার খুতবা পাঠ করা হয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই বিদ্রোহে কেবল আফ্রিকান ক্রীতদাসরাই নয়, বরং স্থানীয় শোষিত আরব কৃষক এবং বেদুঈনরাও যোগ দিয়েছিল। বিদ্রোহীরা বসরা শহর দখল করে এবং নির্মম গণহত্যা চালায়। ঐতিহাসিক তাবারির মতে, এই বিদ্রোহে লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। এটি আব্বাসীয় অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড বা কৃষি ও বাণিজ্যে ধস নামায়। বাগদাদ থেকে খলিফার ভাই এবং সেনাপতি আল-মুওয়াফফাক দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে এই বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হন। আলী ইবনে মুহাম্মদের মস্তক ছেদন করে বাগদাদে প্রদর্শিত হয়। কিন্তু এই যুদ্ধের ফলে দক্ষিণ ইরাকের কৃষিব্যবস্থা চিরতরে ধ্বংস হয়ে যায় এবং আব্বাসীয়দের সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি নিঃশেষ হয়ে পড়ে, যা পঞ্চম ফিতনার পথ প্রশস্ত করে। (Popovic, 1999)।
জাঞ্জ বিদ্রোহ নিয়ে বিস্তারিত জানতে যান এখানে – জাঞ্জ বিদ্রোহ (Zanj Rebellion) (৮৬৯-৮৮৩ খ্রি.): লোনাজলে রক্তে লেখা এক বিস্মৃত ইতিহাসের আখ্যান
কারমাতিয়ান আন্দোলন: মরুঝড় ও সাম্যবাদী ফিতনা
জাঞ্জ বিদ্রোহ যখন আব্বাসীয়দের ভিত্তি নড়িয়ে দিচ্ছিল, ঠিক তখনই আরব উপদ্বীপের পূর্ব প্রান্তে বাহরাইন (বর্তমান আল-আহসা অঞ্চল) থেকে উত্থান ঘটে এক নতুন ও অধিকতর বিপজ্জনক শক্তির – কারমাতিয়ান (Qarmatians) বা আল-কারামিতা। এরা ছিল ইসমাইলি শিয়া মতবাদের এক উগ্র শাখা, যারা বিশ্বাস করত যে ইসলামের বাহ্যিক বিধান বা শরিয়াহ (Shari’ah)-র যুগ শেষ হয়ে গেছে এবং ইমাম মাহদির আগমনের মাধ্যমে এক নতুন আধ্যাত্মিক যুগ শুরু হয়েছে। তাদের এই দর্শন ছিল বাতিনিয়া (Esotericism) বা গূঢ়বাদের চরম রূপ। কারমাতিয়ানরা কেবল একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী ছিল না, তারা ছিল রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে এক বৈপ্লবিক শক্তি। নবম শতাব্দীর শেষদিকে হামদান কারমাত এবং পরবর্তীতে আবু সাঈদ আল-জান্নাবির নেতৃত্বে তারা বাহরাইনে এক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এই রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আধুনিক ঐতিহাসিকরা অনেকে প্রোটো-সোশ্যালিজম (Proto-Socialism) বা আদি-সমাজতন্ত্রের সাথে তুলনা করেন। তাদের সমাজে কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না, সকল সম্পদ ছিল রাষ্ট্রের বা সম্প্রদায়ের। তারা কৃষকদের কর মওকুফ করে দিয়েছিল এবং রাষ্ট্র থেকে জনগণকে বিনামূল্যে শস্য ও ঋণ প্রদান করা হতো। সমাজে নারী ও পুরুষের মেলামেশা ছিল তুলনামূলকভাবে অবাধ। কিন্তু তাদের এই ‘ইউটোপিয়া’ বা কল্পরাজ্য বাইরের জগতের জন্য ছিল এক মূর্তিমান আতঙ্ক বা রিন অফ টেরর (Reign of Terror)। তারা মনে করত, মূলধারার সুন্নি ও শিয়া মুসলিমরা সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে, তাই তাদের হত্যা করা এবং তাদের সম্পদ লুট করা বৈধ।
কারমাতিয়ানরা তাদের মতবাদ প্রচারের চেয়ে তলোয়ারের জোরে ভীতি প্রদর্শনে বেশি বিশ্বাসী ছিল। তারা হাজীদের কাফেলায় নিয়মিত হামলা চালাত, হত্যা করত এবং সম্পদ লুট করত। তাদের কাছে হজ্জ্ব ছিল মূর্তিপূজার নামান্তর। তাদের যুক্তি ছিল, আল্লাহ কোনো নির্দিষ্ট স্থানে বা ঘরে আবদ্ধ নন। দশম শতাব্দীর শুরুর দিকে তারা ইরাক ও সিরিয়ার সীমান্তে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। আব্বাসীয় খলিফারা তখন সামারার নৈরাজ্যে এতটাই দুর্বল ছিলেন যে, তারা কারমাতিয়ানদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছিলেন না। কারমাতিয়ানরা আব্বাসীয়দের দুর্বলতাকে পুঁজি করে তাদের ঔদ্ধত্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। তাদের নেতা আবু তাহির আল-জান্নাবি ঘোষণা করেন যে, প্রচলিত ধর্মগুলোর দিন শেষ এবং তিনি তার অনুসারীদের নিয়ে এক নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলবেন। তাদের এই সহস্রাব্দবাদ (Millenarianism) বা মাহদীবাদী বিশ্বাস তাদের যেকোনো নৃশংস কাজ করার নৈতিক বৈধতা দিত। তারা বিশ্বাস করত, পুরনো জগতকে ধ্বংস করলেই কেবল নতুন সত্যের জগত প্রতিষ্ঠিত হবে।
মক্কার লুণ্ঠন ও হাজরে আসওয়াদ চুরি: মুসলিম বিবেকের ওপর চূড়ান্ত আঘাত
কারমাতিয়ানদের নৃশংসতার চূড়ান্ত এবং ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়টি রচিত হয় ৯৩০ খ্রিস্টাব্দে। হজ্জ্বের মৌসুমে আবু তাহির আল-জান্নাবির নেতৃত্বে কারমাতিয়ান বাহিনী অতর্কিতভাবে মক্কা আক্রমণ করে। মক্কার পবিত্র হারাম শরীফের ভেতরে তারা যে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, তা ছিল কল্পনাতীত। হাজীরা যখন কাবার চারপাশে তাওয়াফ করছিলেন, তখন কারমাতিয়ানরা তাদের ওপর তরবারি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হারাম শরীফের চত্বর হাজীদের লাশের স্তূপে ভরে যায়। ঐতিহাসিক ইবনে আল-আসিরের বর্ণনায়, কারমাতিয়ানরা পবিত্র জমজম কূপে নিহতদের লাশ ফেলে কূপটি ভরাট করে দেয়। আবু তাহির কাবার দরজায় দাঁড়িয়ে আস্ফালন করে বলেছিলেন, “আমিই আল্লাহ, আমিই সৃষ্টি করি এবং আমিই ধ্বংস করি।” তিনি ব্যঙ্গ করে বলছিলেন, “কোথায় তোমাদের আবাবিল পাখি? তারা কেন পাথর ছুড়ে আমাকে ধ্বংস করছে না?” এই ঘটনা মুসলিম বিশ্বের ধর্মতাত্ত্বিক বিশ্বাসে এক প্রচণ্ড ধাক্কা বা থিওলজিক্যাল শক (Theological Shock) দেয়। সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করতে থাকে, আল্লাহ কেন তার ঘর রক্ষা করলেন না?
কারমাতিয়ানরা কেবল হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি; তারা মক্কা ত্যাগের সময় পবিত্র হাজরে আসওয়াদ (Black Stone) বা কালো পাথরটি কাবার দেয়াল থেকে উপড়ে নিয়ে যায়। তারা পাথরটি বাহরাইনে তাদের রাজধানী আল-আহসায় নিয়ে যায় এবং সেখানে তাদের নিজস্ব উপাসনালয়ে স্থাপন করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল হজ্জ্বের কেন্দ্র মক্কা থেকে বাহরাইনে সরিয়ে আনা। দীর্ঘ ২২ বছর পর্যন্ত হাজরে আসওয়াদ কারমাতিয়ানদের দখলে ছিল। এই সময়কালে মুসলিমরা ভাঙা হৃদয়ে পাথরবিহীন কাবার দিকে ফিরেই নামাজ পড়ত এবং হজ্জ্ব করত। ৯৫২ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয় খলিফা এক বিশাল অংকের মুক্তিপণের বিনিময়ে হাজরে আসওয়াদ উদ্ধার করেন। বলা হয়, পাথরটি যখন ফেরত দেওয়া হয়, তখন তা খণ্ডবিখণ্ড অবস্থায় ছিল। কারমাতিয়ানদের এই কাজ ছিল ফিতনার এক নতুন সংজ্ঞা – যেখানে বিদ্রোহীরা কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতা চায়নি, বরং তারা উম্মাহর আধ্যাত্মিক কেন্দ্রকেই ধ্বংস করতে চেয়েছিল। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, সমাজে যখন চরম বৈষম্য এবং ধর্মীয় অরাজকতা দেখা দেয়, তখন মানুষ কতটা বিধ্বংসী হতে পারে। (Daftary, 2007)।
সামাজিক ফিতনার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ: কেন ঘটেছিল এই বিস্ফোরণ?
জাঞ্জ ও কারমাতিয়ান বিদ্রোহকে কেবল ধর্মীয় উন্মাদনা বা দস্যুবৃত্তি হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এর পেছনে ছিল গভীর আর্থ-সামাজিক কারণ। আব্বাসীয় খিলাফতের সেই সময়ে সম্পদের সুষম বণ্টন ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল। বাগদাদ ও সামারার অভিজাতরা যখন বিলাসিতায় মত্ত, তখন কৃষকরা অতিরিক্ত করের চাপে পিষ্ট হচ্ছিল। এই বিদ্রোহগুলো ছিল মূলত সামাজিক দস্যুতা (Social Banditry)-এর এক চরম রূপ, যা ঐতিহাসিক এরিক হবসবাম (Eric Hobsbawm)-এর তত্ত্বের সাথে মিলে যায়। হবসবামের মতে, প্রাক-আধুনিক সমাজে যখন রাষ্ট্র সাধারণ মানুষকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয় এবং শোষণ চরমে পৌঁছায়, তখন প্রান্তিক মানুষ ধর্মীয় বা মসিহবাদী (Messianic) নেতার অধীনে সংগঠিত হয়। আলী ইবনে মুহাম্মদ বা আবু তাহির আল-জান্নাবি ছিলেন সেই সব নেতা, যারা শোষিত মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে ধর্মীয় মতাদর্শের মোড়কে ব্যবহার করেছিলেন।
জাঞ্জ বিদ্রোহ ছিল মূলত উৎপাদন সম্পর্কের সংঘাত (Conflict of Production Relations)। ক্রীতদাসরা ছিল উৎপাদনের হাতিয়ার, আর মালিকরা ছিল ভোগকারী। আলী ইবনে মুহাম্মদ এই সম্পর্ককে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। অন্যদিকে, কারমাতিয়ানরা ছিল এক ধরণের র্যাডিক্যাল ইউটোপিয়ান (Radical Utopian) গোষ্ঠী। তারা মনে করত আব্বাসীয় শাসন বাসুন্নি অর্থোডক্সি আসলে দুর্নীতির আঁতুড়ঘর। তাদের বিদ্রোহ ছিল প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের (Establishment) বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক যুদ্ধ। যদিও তাদের পদ্ধতি ছিল সন্ত্রাসবাদী, কিন্তু তাদের উত্থান আমাদের দেখিয়ে দেয় যে, সমাজের একটি বড় অংশ আব্বাসীয় শাসনব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। এই সামাজিক ফিতনাগুলো আব্বাসীয় খিলাফতকে এতটাই দুর্বল করে দিয়েছিল যে, পরবর্তীতে বুইয়িদ বা সেলজুকদের মতো বিদেশি শক্তিগুলোর পক্ষে বাগদাদ দখল করা সহজ হয়ে যায়। এগুলো ছিল সেই উইপোকা, যা মহীরুহসম আব্বাসীয় সাম্রাজ্যকে ভেতর থেকে ফোঁকরা করে দিয়েছিল।
বাইরের শক্তির খেলা: বাইজান্টাইন ও পারসিক প্রভাব (Geopolitical Opportunism)
ইসলামের ইতিহাসের প্রাথমিক যুগে যখন মদিনা, দামেস্ক বা বাগদাদের রাজপথে মুসলিমরা একে অপরের রক্ত ঝরাচ্ছিল, তখন সীমান্তের ওপারে ওৎ পেতে থাকা দুই প্রাচীন মহাশক্তি – বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য (পূর্ব রোমান) এবং পারসিক সংস্কৃতি (সাসানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর যার রাজনৈতিক পুনরুত্থান ঘটছিল) – বসে বসে কেবল তামাশা দেখছিল না। তারা এই ফিতনাগুলোকে নিজেদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার এবং ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের সুবর্ণ সুযোগ বা জিওপলিটিক্যাল অপরচুনিজম (Geopolitical Opportunism) হিসেবে দেখেছিল। সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামের ঝোড়ো গতির বিজয়ে বাইজান্টাইনরা তাদের সবচেয়ে সমৃদ্ধ প্রদেশগুলো – সিরিয়া, মিশর এবং প্যালেস্টাইন – হারিয়েছিল। তারা কোণঠাসা হয়ে আনাতোলিয়ার (বর্তমান তুরস্ক) পার্বত্য এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু যখনই মুসলিম উম্মাহর মধ্যে গৃহযুদ্ধ বা ফিতনা শুরু হতো, কনস্টান্টিনোপলের সম্রাটরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেন। তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, মুসলিমদের এই অভ্যন্তরীণ কোন্দলই তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র চাবিকাঠি। ফিতনার সময় মুসলিম সেনাবাহিনী যখন সীমান্তের পাহারা কমিয়ে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত হতো, তখন বাইজান্টাইনরা আক্রমণাত্মক পররাষ্ট্রনীতি বা অফেন্সিভ ফরেন পলিসি (Offensive Foreign Policy) গ্রহণ করত। তারা কখনো মুসলিম বিদ্রোহীদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করত, আবার কখনো দুর্বল খলিফাকে জিম্মি করে অপমানজনক সন্ধিচুক্তি চাপিয়ে দিত। এই অধ্যায়ে আমরা দেখব কীভাবে ফিতনা কেবল একটি অভ্যন্তরীণ সংকট ছিল না, বরং এটি ছিল আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক জটিল দাবাখেলা, যেখানে মুসলিম শাসকরা নিজেদের গদি বাঁচাতে কাফের বা বিজাতীয় শক্তির সাথে হাত মেলাতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। এটি ছিল বাস্তববাদী রাজনীতি (Realpolitik)-এর এক নির্মম প্রদর্শনী, যেখানে ধর্মীয় আদর্শের চেয়ে রাষ্ট্রের টিকে থাকা বা রিজন ডি’স্টেট (Raison d’état) অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
প্রথম ফিতনা ও মুয়াবিয়ার কূটনৈতিক চাল: শত্রুর সাথে সন্ধি
প্রথম ফিতনার সময় (৬৫৬–৬৬১ খ্রি.) যখন আলী এবং মুয়াবিয়ার মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চরমে, তখন বাইজান্টাইন সম্রাট দ্বিতীয় কনস্ট্যান্স (Constans II) পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সিরিয়ার গভর্নর হিসেবে মুয়াবিয়া ছিলেন বাইজান্টাইন সীমান্তের পাহারাদার। কিন্তু আলীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তাকে তার মূল সেনাবাহিনী ইরাকের দিকে নিয়ে যেতে হচ্ছিল। এই অবস্থায় মুয়াবিয়া বুঝতে পারলেন, যদি তিনি বাইজান্টাইনদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যান এবং একই সাথে আলীর মোকাবেলা করেন, তবে তার পরাজয় নিশ্চিত। রোমানরা যেকোনো মুহূর্তে সিরিয়া আক্রমণ করে দামেস্ক দখল করে নিতে পারে। এই অস্তিত্বের সংকট বা এক্সিসটেন্সিয়াল ক্রাইসিস (Existential Crisis) থেকে বাঁচার জন্য মুয়াবিয়া এক নজিরবিহীন ও বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিলেন। ৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাইজান্টাইন সম্রাটের সাথে এক অপমানজনক যুদ্ধবিরতি চুক্তি বা ট্রুস (Truce) স্বাক্ষর করলেন। এই চুক্তি অনুযায়ী, মুয়াবিয়া সম্রাটকে দৈনিক ১০০০ স্বর্ণমুদ্রা, একটি ঘোড়া এবং একজন ক্রীতদাস কর বা ট্রিবিউট হিসেবে দিতে রাজি হলেন। (Theophanes, 1883)।
ইসলামের ইতিহাসে এটি ছিল এক অভাবনীয় ঘটনা। যে মুসলিমরা কয়েক বছর আগেও রোমানদের পরাজিত করে জিজিয়া কর আদায় করছিল, আজ গৃহযুদ্ধের কারণে তাদেরই নেতা রোমান সম্রাটকে কর দিচ্ছেন। মুয়াবিয়ার এই পদক্ষেপ ছিল বিশুদ্ধ স্ট্র্যাটেজিক প্রাগমাটিজম (Strategic Pragmatism)। তিনি জানতেন, বাইরের শত্রুকে টাকা দিয়ে শান্ত রেখে আগে ঘরের শত্রুকে (আলীকে) পরাজিত করা জরুরি। বাইজান্টাইন সম্রাটও এই সুযোগে সিরিয়া পুনরুদ্ধারের চেষ্টা না করে অর্থ নেওয়াকেই লাভজনক মনে করলেন, কারণ তাদের নিজেদেরও তখন বলকান অঞ্চলে স্লাভদের সাথে যুদ্ধ চলছিল। মুয়াবিয়ার এই কূটনীতি তাকে আলীর বিরুদ্ধে পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করার সুযোগ দেয় এবং শেষ পর্যন্ত উমাইয়া খিলাফত প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। কিন্তু এর বিনিময়ে মুসলিম উম্মাহর সম্মান বা প্রেস্টিজ এবং বাইজান্টাইনদের বিরুদ্ধে জিহাদের ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ণ হয়। ফিতনা বাইজান্টাইনদের ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়ে দেয় এবং তাদের পুনর্গঠনের সময় করে দেয়।
দ্বিতীয় ফিতনা ও প্রক্সি যুদ্ধ: জারাজিমা ও মারদাইত আতঙ্ক
দ্বিতীয় ফিতনার সময় (৬৮০–৬৯২ খ্রি.) উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান যখন মক্কায় আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের এবং ইরাকে শিয়া ও খারিজি বিদ্রোহ সামলাতে ব্যস্ত, তখন বাইজান্টাইন সম্রাট চতুর্থ কনস্টাইনটাইন এবং পরবর্তীতে দ্বিতীয় জাস্টিনিয়ান এক নতুন ও চতুর কৌশল অবলম্বন করেন। তারা সরাসরি বড় কোনো সেনাবাহিনী না পাঠিয়ে মুসলিম সাম্রাজ্যের ভেতরে অস্থিতিশীলতা তৈরির জন্য প্রক্সি যুদ্ধ (Proxy Warfare) শুরু করেন। বাইজান্টাইনরা লেবানন ও সিরিয়ার সীমান্তবর্তী আমানুস পর্বতমালার খ্রিস্টান বিদ্রোহী গোষ্ঠী, যারা ‘জারাজিমা‘ বা ‘মারদাইত’ (Mardaites) নামে পরিচিত ছিল, তাদের উস্কে দেয়। এই মারদাইতরা ছিল দুর্দান্ত গরিলা যোদ্ধা। বাইজান্টাইনদের অর্থ ও আশ্রয়ে তারা উমাইয়া সাম্রাজ্যের গভীরে – সিরিয়া, প্যালেস্টাইন এবং জর্ডান পর্যন্ত – লুটপাট চালাতে থাকে। তারা গ্রাম জ্বালিয়ে দিত, মুসলিমদের হত্যা করত এবং উমাইয়াদের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিত। খলিফা আব্দুল মালিকের জন্য এটি ছিল ‘ঘরের ভেতর সাপ’ পোষার মতো অবস্থা।
আব্দুল মালিক জানতেন, ইবনে জুবায়েরকে পরাজিত না করা পর্যন্ত তিনি মারদাইতদের মোকাবেলা করতে পারবেন না। তাই ৬৮৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাইজান্টাইন সম্রাটের সাথে এক অত্যন্ত অপমানজনক চুক্তি করতে বাধ্য হন। ঐতিহাসিক তথ্যানুযায়ী, খলিফা সম্রাটকে প্রতিদিন ১০০০ স্বর্ণমুদ্রা, একটি ঘোড়া এবং একটি ক্রীতদাস দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এছাড়াও সাইপ্রাস, আর্মেনিয়া এবং আইবেরিয়া (জর্জিয়া) থেকে আদায়কৃত রাজস্ব রোমান ও মুসলিমদের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করার শর্ত মেনে নেন। একে বলা হয় কন্ডোমিনিয়াম (Condominium) বা যৌথ শাসন। আব্দুল মালিকের এই নমনীয়তা বাইজান্টাইনদের অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করে তোলে, কিন্তু খলিফা এর মাধ্যমে তার ‘রেয়ার’ বা পেছনের দিক সুরক্ষিত করেন। এই সময়কালের ইতিহাস প্রমাণ করে যে, ফিতনার সময় মুসলিম শাসকরা সার্বভৌমত্বের বা সভরেইনটি (Sovereignty) সাথে আপস করতেও প্রস্তুত ছিলেন। মারদাইতদের এই সমস্যা এতটাই প্রকট ছিল যে, শেষ পর্যন্ত আব্দুল মালিক তাদের অনেককে অর্থের বিনিময়ে উমাইয়া সেনাবাহিনীতে ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে নিয়োগ দিয়ে শান্ত করেন। (Kaegi, 1992)।
আব্বাসীয় ফিতনা ও বাইজান্টাইন পুনরুত্থান: শিকার যখন শিকারী
চতুর্থ ফিতনা (আমিন ও মামুনের যুদ্ধ) এবং পরবর্তী পঞ্চম ফিতনার সময় (সামারার অরাজকতা) বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য তাদের ইতিহাসে অন্যতম শক্তিশালী রাজবংশ – ম্যাসেডোনিয়ান রাজবংশের বা ম্যাসেডোনিয়ান ডাইনাস্টি (Macedonian Dynasty) শাসনাধীনে ছিল। আব্বাসীয়রা যখন বাগদাদ ধ্বংস করছে এবং তুর্কিরা যখন খলিফাদের হত্যা করছে, তখন বাইজান্টাইনরা তাদের দীর্ঘদিনের রক্ষণাত্মক খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে এবং পুরোদমে আক্রমণ বা রিকনকোয়েস্ট (Reconquest) শুরু করে। নবম ও দশম শতাব্দীতে বাইজান্টাইন সম্রাটরা, বিশেষ করে নাইসিফরাস ফোকাস এবং জন জিমিস্কেস, আব্বাসীয়দের দুর্বলতার পূর্ণ সুযোগ নেন। তারা আনাতোলিয়ার সীমানা পেরিয়ে মুসলিম ভূখণ্ডের গভীরে প্রবেশ করেন। ৯৬২ খ্রিস্টাব্দে নাইসিফরাস ফোকাস আলেপ্পো দখল করেন এবং হামদানিদ আমির সাইফ আল-দৌলার প্রাসাদে লুটপাট চালান। সাইফ আল-দৌলা ছিলেন ফিতনার যুগে বাইজান্টাইনদের বিরুদ্ধে একমাত্র প্রতিরোধকারী শক্তি, কিন্তু বাগদাদের খলিফা বা অন্য মুসলিম শাসকদের কাছ থেকে তিনি কোনো সাহায্য পাননি।
৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে বাইজান্টাইনরা ক্রিট দ্বীপ পুনরুদ্ধার করে এবং ৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে তারা অ্যান্টিওক (Antioch) শহরটি দখল করে নেয়, যা তিন শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে মুসলিমদের শাসনাধীনে ছিল। অ্যান্টিওক দখল ছিল মুসলিম বিশ্বের জন্য এক বিশাল মনস্তাত্ত্বিক আঘাত। বাইজান্টাইন বাহিনী প্যালেস্টাইনের দিকে অগ্রসর হয় এবং জেরুজালেমের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। বাগদাদে তখন শিয়া বুইয়িদরা সুন্নি খলিফাকে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং কারমাতিয়ানরা হাজীদের হত্যা করছে – বাইজান্টাইনদের ঠেকানোর মতো কেউ ছিল না। এই সময়টাকে ঐতিহাসিকরা বলেন বাইজান্টাইন রেনেসাঁ (Byzantine Renaissance) এবং মুসলিমদের জন্য রাজনৈতিক পক্ষাঘাতের যুগ। ফিতনা বাইজান্টাইনদের এতটাই সাহসী করে তুলেছিল যে, তারা মুসলিম খলিফাদের ‘বারবারিয়ান’ বা অসভ্য বলে উপহাস করত এবং মনে করত শীঘ্রই তারা পুরো মধ্যপ্রাচ্য আবার খ্রিস্টান শাসনে ফিরিয়ে আনতে পারবে। মুসলিমদের এই দুর্বলতা এবং বিভাজনই পরবর্তীতে একাদশ শতাব্দীতে ক্রুসেডারদের বা ক্রুসেডার (Crusaders)-দের আক্রমণের পথ প্রশস্ত করে দেয়। (Whittow, 1996)।
পারসিক প্রভাবের খেলা: সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ ও শুউবিয়া আন্দোলন
ফিতনার ভূ-রাজনীতিতে পারসিক প্রভাব বাইজান্টাইনদের মতো সরাসরি সামরিক আগ্রাসন ছিল না, বরং এটি ছিল এক ধরণের সাংস্কৃতিক অন্তর্ঘাত (Cultural Subversion) এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক মেরুকরণ। আব্বাসীয় বিপ্লবের পর থেকেই পারসিকরা রাষ্ট্রযন্ত্রে শক্তিশালী অবস্থান করে নেয়। কিন্তু চতুর্থ ফিতনার (আমিন বনাম মামুন) সময় এই প্রভাব এক জাতীয়তাবাদী রূপ নেয়। মামুনের বিজয়ের পেছনে ছিল খোরাসানি এবং পারসিক অভিজাতদের সমর্থন, যারা আরব আধিপত্য মেনে নিতে চাইছিল না। এই সময়কালে শুউবিয়া আন্দোলন (Shu’ubiyya Movement) প্রবল আকার ধারণ করে। শুউবিয়ারা দাবি করত যে, সাহিত্য, বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতিতে পারসিকরা আরবদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। ফিতনার সময় এই বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন রাজনৈতিক বিভাজনকে আরও গভীর করে তোলে।
পঞ্চম ফিতনার সময় যখন কেন্দ্রীয় শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন পারস্যের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় রাজবংশগুলো (যেমন সাফ্ফারিদ, সামানীয়, এবং বুইয়িদ) স্বাধীনতা ঘোষণা করে। বিশেষ করে বুইয়িদরা, যারা ছিল শিয়া মতাবলম্বী পারসিক, তারা বাগদাদ দখল করে আরব খলিফাকে তাদের হাতের পুতুলে পরিণত করে। তারা প্রাচীন পারসিক বা সাসানীয় রাজাদের উপাধি ‘শাহানশাহ’ (রাজাদের রাজা) ব্যবহার করতে শুরু করে, যা ছিল আরব ইসলামি ঐতিহ্যের প্রতি এক স্পষ্ট চ্যালেঞ্জ। ঐতিহাসিকরা একে বলেন ইরানি ইন্টারমেজো (Iranian Intermezzo) বা ইরানি মধ্যযুগ। যদিও তারা ইসলাম ত্যাগ করেনি, কিন্তু তারা খিলাফতের আরব চরিত্রকে ধ্বংস করে পারসিক রাজতান্ত্রিক মডেল চাপিয়ে দিয়েছিল। এটি ছিল এক ধরণের ‘সফট পাওয়ার’ বা মৃদু শক্তি (Soft Power)-এর খেলা, যেখানে বাইরে থেকে কোনো আক্রমণ ছাড়াই ফিতনার সুযোগে পারসিকরা সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এই ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে বাগদাদ তার কেন্দ্রীয় গুরুত্ব হারায় এবং ক্ষমতার ভরকেন্দ্র পূর্ব দিকে সরে যায়। এই বিভাজিত মুসলিম বিশ্ব পরবর্তীতে মোঙ্গলদের আক্রমণের সময় কোনো সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়।
উপসংহার: ফিতনার বৈশ্বিক সমীকরণ
বাইজান্টাইন এবং পারসিক প্রভাবের এই ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ফিতনা কখনোই ভ্যাকুয়াম বা শূন্যস্থানে ঘটে না। একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা সবসময়ই প্রতিবেশী শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর জন্য নিমন্ত্রণলিপি হয়ে আসে। মুয়াবিয়ার বাইজান্টাইনদের কর দেওয়া বা মামুনের পারসিকদের ওপর নির্ভরতা – সবই ছিল তাৎক্ষণিক ক্ষমতা রক্ষার কৌশল। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এর মূল্য দিতে হয়েছে পুরো সভ্যতাকে। বাইজান্টাইনরা ফিতনার সুযোগে তাদের আয়ু আরও ৫০০ বছর বাড়িয়ে নিয়েছিল, আর পারসিকরা আরব খিলাফতকে ভেতর থেকে বদলে দিয়েছিল। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে যাকে ব্যালেন্স অফ পাওয়ার (Balance of Power) বা শক্তির ভারসাম্য বলা হয়, ফিতনার যুগে তা পুরোপুরি মুসলিমদের বিপক্ষে চলে গিয়েছিল। মুসলিমরা যখন নিজেদের ভাইয়ের বুকে তলোয়ার চালাচ্ছিল, তখন তাদের শত্রুরা মানচিত্রের সীমানা নতুন করে আঁকছিল। এটি ইতিহাসের সেই নির্মম শিক্ষা – “যে জাতি নিজেদের মধ্যে বিবাদ করে, তাদের ভাগ্য বাইরের শক্তি দ্বারা নির্ধারিত হয়।”
ফিতনার সমাজতত্ত্ব: কেন মানুষ বিশৃঙ্খলা বেছে নেয়?
সপ্তম থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বকে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া পাঁচটি ফিতনার ইতিহাস কেবল রাজাদের ক্ষমতার পালাবদল বা যুদ্ধের পরিসংখ্যান নয়; বরং এটি মানব আচরণের এক গভীর সমাজতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক দলিল। কেন একটি স্থিতিশীল সমাজের সাধারণ মানুষ – কৃষক, কামার, কুমার বা ধর্মপ্রাণ মুসল্লি – হঠাৎ করে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, নৈতিকতা এবং প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক বিসর্জন দিয়ে ধ্বংসাত্মক গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে? সমাজবিজ্ঞান এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ফিতনা কোনো আকস্মিক দুর্ঘটনা বা দৈবদুর্বিপাক (Divine Intervention) নয়, বরং এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার চরম বিস্ফোরণ। মানুষ যখন সামষ্টিক বিশৃঙ্খলা বা কালেক্টিভ ক্যাওস (Collective Chaos) বেছে নেয়, তখন তার পেছনে কাজ করে সুনির্দিষ্ট কিছু কার্যকারণ সম্পর্ক বা কজালিটি (Causality)। এই কারণগুলো রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যর্থতা থেকে শুরু করে মানুষের অবচেতন মনের আদিম প্রবৃত্তি পর্যন্ত বিস্তৃত। ইতিহাসের এই ফিতনাগুলোকে ব্যবচ্ছেদ করলে আমরা প্রধানত তিনটি মৌলিক চালিকাশক্তি বা ড্রাইভার দেখতে পাই: রাজনৈতিক বৈধতার সংকট, অর্থনৈতিক বঞ্চনা এবং গণমনস্তত্ত্বের অন্ধকার দিক। এই উপাদানগুলো যখন একত্রে মেশে, তখন সমাজ তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং মানুষ তার যুক্তিবোধ বিসর্জন দিয়ে এক আদিম হিংস্রতায় লিপ্ত হয়। ফিতনার এই সমাজতত্ত্ব আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে, কেন সভ্যতার পলিস্তরা এত পাতলা এবং কেন শান্তির সময়ও যুদ্ধের বীজ সুপ্ত থাকে।
বৈধতার সংকট: যখন শাসকের আসনে ফাটল ধরে
যেকোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতার মূল ভিত্তি হলো বৈধতা (Legitimacy)। বিখ্যাত জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber) তার তত্ত্বে দেখিয়েছেন যে, মানুষ কেবল গায়ের জোরে বা ভয়ে শাসকের আনুগত্য করে না, বরং তারা আনুগত্য করে কারণ তারা বিশ্বাস করে যে শাসকের শাসন করার নৈতিক ও আইনগত অধিকার রয়েছে। ফিতনার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রতিটি বড় সংঘাতের সূত্রপাত হয়েছে এই বৈধতার সংকটের বা ক্রাইসিস অফ লেজিটিমেসি (Crisis of Legitimacy)-এর মাধ্যমে। প্রথম ফিতনার কথাই ধরা যাক। তৃতীয় খলিফা উসমান ইবনে আফফানের শাসনামলের প্রথমার্ধে কোনো সমস্যা ছিল না, কারণ জনগণ তাকে নবী মুহম্মদের সাহাবী এবং বৈধ খলিফা হিসেবে মানত। কিন্তু যখনই তার বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি বা নেপোটিজম (Nepotism) এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ অপব্যবহারের অভিযোগ উঠল, তখনই তার শাসনের নৈতিক ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে গেল। বিদ্রোহীরা মনে করল, তিনি আর ‘খলিফাতুর রাসুল’ পদের যোগ্য নন, বরং তিনি গোত্রীয় স্বার্থে কাজ করছেন। এই ‘বিশ্বাসভঙ্গ’ বা ব্রিচ অফ ট্রাস্ট (Breach of Trust)-ই ছিল বিদ্রোহের মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি। জনগণ যখন মনে করে শাসক আর তাদের প্রতিনিধিত্ব করছে না, বা শাসক নিজেই ‘সামাজিক চুক্তি’ বাসোশ্যাল কন্ট্রাক্ট (Social Contract) লঙ্ঘন করেছেন, তখন তারা আনুগত্য প্রত্যাহার করে নেয় এবং বিকল্পের সন্ধান করে।
একইভাবে দ্বিতীয় ফিতনার মূলে ছিল মুয়াবিয়ার দ্বারা তার পুত্র ইয়াজিদকে উত্তরাধিকারী মনোনয়ন। এটি ছিল আরবের চিরাচরিত পরামর্শভিত্তিক বা শুরা (Shura) পদ্ধতির সরাসরি লঙ্ঘন এবং রাজতান্ত্রিক বংশানুক্রমিক প্রথা বা ডাইনাস্টিক সাকসেশন (Dynastic Succession) চাপিয়ে দেওয়া। মদিনার ধর্মপ্রাণ মুসলিম এবং কুফার শিয়ারা ইয়াজিদকে বৈধ শাসক হিসেবে মেনে নিতে পারেনি, কারণ তাদের দৃষ্টিতে ইসলামি নেতৃত্বের শর্ত হলো ‘তাকওয়া’ (খোদাভীতি) ও যোগ্যতা, কেবল বংশপরিচয় নয়। এই বৈধতার সংকটই কারবালার ট্র্যাজেডি এবং আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের বিদ্রোহের জন্ম দেয়। চতুর্থ ফিতনাতেও আমরা দেখি, হারুন আল-রশিদের করা পবিত্র চুক্তি বা কোভেন্যান্ট (Covenant) যখন খলিফা আমিন লঙ্ঘন করলেন, তখন তার ভাই মামুনের বিদ্রোহ করার নৈতিক বৈধতা তৈরি হলো। অর্থাৎ, ফিতনা তখনই ঘটে যখন শাসক তার ক্ষমতাকে ন্যায়বিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখতে ব্যর্থ হন। শাসকের আদেশের প্রতি জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত শ্রদ্ধা বা ভলান্টারি কমপ্লায়েন্স (Voluntary Compliance) যখন উঠে যায়, তখন রাষ্ট্র কেবল বলপ্রয়োগের মাধ্যমে টিকে থাকতে পারে না, এবং তখনই অরাজকতার দ্বার উন্মুক্ত হয়। (Weber, 1978)।
অর্থনৈতিক বঞ্চনা ও আপেক্ষিক বঞ্চনার তত্ত্ব
ফিতনার দ্বিতীয় এবং সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী অনুঘটক হলো অর্থনৈতিক বৈষম্য। সমাজবিজ্ঞানী টেড রবার্ট গার (Ted Robert Gurr) তার বিখ্যাত বই হোয়াই মেন রেবেল (Why Men Rebel)-এ আপেক্ষিক বঞ্চনা তত্ত্ব (Relative Deprivation Theory) উপস্থাপন করেছেন। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, মানুষ কেবল দরিদ্র হলেই বিদ্রোহ করে না; তারা বিদ্রোহ করে যখন তারা দেখে যে তাদের প্রাপ্য অধিকার বা সম্পদ অন্যরা ভোগ করছে এবং তাদের অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে। ইসলামি ইতিহাসের ফিতনাগুলোতে এই তত্ত্বের নিখুঁত প্রতিফলন দেখা যায়। উমাইয়া শাসনামলে রাষ্ট্রের আয়তন ও সম্পদ বহুগুণ বেড়েছিল, কিন্তু সেই সম্পদের সুষম বণ্টন হয়নি। গনিমতের মাল এবং রাজস্বের সিংহভাগ কুক্ষিগত ছিল আরব অভিজাত শ্রেণির হাতে। অথচ রাষ্ট্রের জন্য যারা যুদ্ধ করছিল, সেই নবদীক্ষিত অনারব মুসলিম বা ‘মাওয়ালি’রা ছিল অবহেলিত। তাদের ওপর অন্যায়ভাবে জিজিয়া কর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং তাদের সামাজিক মর্যাদা দেওয়া হতো না। এই বৈষম্য মাওয়ালিদের মনে এক গভীর ক্ষোভের জন্ম দেয়, যা তৃতীয় ফিতনায় আব্বাসীয় বিপ্লবের জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছিল। তারা মনে করেছিল, ইসলামি সাম্য বা ইসলামিক ইগালিটারিয়ানিজম (Islamic Egalitarianism)-এর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা হয়েছে।
জাঞ্জ বিদ্রোহ এবং কারমাতিয়ান আন্দোলনের মতো ‘সামাজিক ফিতনা’গুলো ছিল এর আরও উগ্র রূপ। দক্ষিণ ইরাকের জলাভূমিতে আফ্রিকান ক্রীতদাসরা (জাঞ্জ) যখন বিদ্রোহ করেছিল, তখন তাদের সামনে কোনো ধর্মীয় সূক্ষ্ম তত্ত্ব ছিল না; তাদের সামনে ছিল কেবল বেঁচে থাকার সংগ্রাম এবং অমানবিক শ্রম থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। আব্বাসীয় অভিজাতদের বিলাসিতা এবং তাদের চরম দারিদ্র্যের এই ব্যবধানই তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিতে বাধ্য করেছিল। কারমাতিয়ানরা যে সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমবন্টন ব্যবস্থার ডাক দিয়েছিল, তা ছিল তৎকালীন সামন্ততান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ। সুতরাং, ফিতনার সমাজতত্ত্বে অর্থনীতি একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। মানুষ যখন দেখে যে বিদ্যমান ব্যবস্থায় তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই, তখন তারা সেই ব্যবস্থা বা সিস্টেমকে ধ্বংস করার জন্য বিশৃঙ্খলা বা অরাজকতাকে বেছে নেয়। তাদের কাছে তখন ফিতনা মনে হয় মুক্তির একমাত্র পথ, যদিও শেষ পর্যন্ত তা হয়তো আরও বড় ধ্বংস ডেকে আনে।
গণমনস্তত্ত্ব ও দানবীয়করণ: আমরা বনাম ওরা
ফিতনার সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো, এটি মানুষের যুক্তিবোধ হরণ করে এবং তাকে এক অন্ধ আবেগের স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী গুস্তাভ লে বন (Gustave Le Bon) তার দ্য ক্রাউড: আ স্টাডি অফ দ্য পপুলার মাইন্ড (The Crowd: A Study of the Popular Mind) বইতে দেখিয়েছেন যে, মানুষ যখন ভিড় বা দলের অংশ হয়ে যায়, তখন তার ব্যক্তিগত বিবেকবুদ্ধি লোপ পায় এবং সে এক ধরণের সমষ্টিগত মন (Collective Mind) দ্বারা চালিত হয়। ফিতনার সময় এই মব সাইকোলজি (Mob Psychology) বা গণমনস্তত্ত্ব অত্যন্ত সক্রিয় থাকে। এই সময়ে গুজব বা রিউমার (Rumor) আগুনের মতো কাজ করে। প্রথম ফিতনার সময় উসমানের রক্তমাখা জামা এবং তার স্ত্রী নিলার কর্তিত আঙুল দামেস্কের মসজিদে প্রদর্শন করা ছিল এক শক্তিশালী ভিজ্যুয়াল প্রোপাগান্ডা (Visual Propaganda)। এটি দেখার পর সাধারণ মানুষের মস্তিষ্কের যৌক্তিক অংশ বা প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (Prefrontal Cortex) কাজ করা বন্ধ করে দেয় এবং আবেগের কেন্দ্র বা অ্যামিগডালা (Amygdala) নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। তারা তখন আর বিচার করতে চায় না কে দোষী বা কে নির্দোষ; তারা কেবল প্রতিশোধ চায়। সিফফিনের যুদ্ধে বর্শার আগায় কুরআনের পাতা ঝোলানোর ঘটনাটিও ছিল এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের বা সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার (Psychological Warfare)-এর এক মাস্টারস্ট্রোক, যা আলীর সৈন্যদের ধর্মীয় আবেগকে বিভ্রান্ত করে তাদের যুদ্ধ থামাতে বাধ্য করেছিল।
ফিতনার আরেকটি মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া হলো প্রতিপক্ষকে ‘অমানুষ’ বা ডিহিউম্যানাইজেশন (Dehumanization) করা। সমাজতাত্ত্বিক হেনরি তাজফেল (Henri Tajfel)-এর সামাজিক পরিচয় তত্ত্ব (Social Identity Theory) অনুযায়ী, মানুষ সংকটের সময় নিজেদের ‘ইন-গ্রুপ’ (In-group) বা আপন দল এবং ‘আউট-গ্রুপ’ (Out-group) বা শত্রু দলে ভাগ করে ফেলে। তখন তৈরি হয় এক তীব্র ‘আমরা বনাম ওরা’ (Us vs. Them) মানসিকতা। শিয়াদের দৃষ্টিতে সুন্নিরা হয়ে ওঠে ‘নাসিবি’ বা আহলে বাইতের শত্রু, আর সুন্নি বা খারিজিদের দৃষ্টিতে অন্যরা হয়ে ওঠে ‘কাফের’ বা মুরতাদ। যখনই প্রতিপক্ষকে ধর্মীয়ভাবে ‘কাফের’ বা সামাজিকভাবে ‘শত্রু’ হিসেবে ট্যাগ দেওয়া হয়, তখন তাকে হত্যা করা মানসিকভাবে সহজ হয়ে যায়। তখন প্রতিবেশী তার প্রতিবেশীকে হত্যা করতে দ্বিধা করে না, কারণ সে তার মধ্যে আর মানুষকে দেখে না, দেখে কেবল একটি ঘৃণ্য মতবাদকে। ফিতনার সময় এই মনস্তাত্ত্বিক বিভাজন এতটাই গভীর হয় যে, তা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলতে থাকে, যেমনটি আমরা কারবালার ঘটনার পর শিয়া-সুন্নি বিভাজনে দেখেছি। আবেগ, ভীতি এবং ঘৃণার এই বিষাক্ত মিশ্রণ মানুষকে ফিতনার হাতিয়ারে পরিণত করে।
ফিতনার ভীতি ও রাজনৈতিক দর্শনের রূপান্তর: স্বৈরাচারই কি শ্রেয়?
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলা এই ফিতনা, রক্তপাত এবং অরাজকতা মুসলিম মানস এবং রাজনৈতিক চিন্তাধারায় এক স্থায়ী ট্রমা বা কালেক্টিভ ট্রমা (Collective Trauma) তৈরি করেছিল। ধ্রুপদী মুসলিম পণ্ডিতরা দেখেছিলেন যে, ফিতনার নামে যে আদর্শিক লড়াই শুরু হয়, তার শেষ ফল হয় রাষ্ট্র ভেঙে পড়া, জান-মালের নিরাপত্তা নষ্ট হওয়া এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণের পথ সুগম হওয়া। এই বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে মধ্যযুগের মুসলিম রাজনৈতিক দর্শনে এক বিশাল পরিবর্তন বা প্যারাডাইম শিফট (Paradigm Shift) ঘটে। প্রাথমিক যুগের ‘আদর্শ খিলাফত’-এর স্বপ্ন ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসে এবং তার জায়গা নেয় কঠোর বাস্তবতা বা পলিটিক্যাল রিয়ালিজম (Political Realism)। একাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত তাত্ত্বিক আল-মাওয়ার্দি (Al-Mawardi) তার আল-আহকাম আস-সুলতানিয়া (Al-Ahkam al-Sultaniyya) গ্রন্থে এবং পরবর্তীতে ইমাম আল-গাজালি (Al-Ghazali) তাদের লেখনীতে এই নতুন দর্শনের ভিত্তি স্থাপন করেন। তাদের মূল কথা ছিল – “ফিতনার চেয়ে স্বৈরাচার ভালো” (Tyranny is better than Anarchy)।
আল-গাজালি তার বিখ্যাত গ্রন্থ আল-ইকতিসাদ ফিল ইতিকাদ (Al-Iqtisad fi al-I’tiqad)-এ যুক্তি দেন যে, রাষ্ট্রের প্রধান উদ্দেশ্য হলো ধর্ম রক্ষা করা এবং দুনিয়ার শৃঙ্খলা বজায় রাখা। যদি কোনো শাসক জালিমও হন, কিন্তু তিনি যদি ফিতনা দমন করে শান্তি বজায় রাখতে পারেন এবং মুসলিমদের নামাজ পড়ার সুযোগ দেন, তবে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে না। কারণ, বিদ্রোহ করলেই ফিতনা শুরু হবে, আর ফিতনা মানেই হত্যা, লুণ্ঠন এবং ধর্মের বিনাশ। গাজালির মতে, “এক রাতের অরাজকতার চেয়ে ষাট বছরের স্বৈরাচারী শাসন উত্তম।” এটি ছিল ডকট্রিন অফ নেসেসিটি (Doctrine of Necessity) বা অনিবার্যতার নীতি। পণ্ডিতরা এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, নিখুঁত ন্যায়বিচার বা জাস্টিস প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যদি পুরো সমাজ ধ্বংস হয়ে যায়, তবে সেই প্রচেষ্টার কোনো মূল্য নেই। তাই তারা ‘মন্দের ভালো’ বা লেসার অফ টু ইভিলস (Lesser of Two Evils) হিসেবে স্থিতিশীলতাকে বেছে নিয়েছিলেন। এই দর্শন পরবর্তীকালে মুসলিম বিশ্বে রাজনৈতিক নীরবতা বা পলিটিক্যাল কুইয়েটিজম (Political Quietism)-এর সংস্কৃতি গড়ে তোলে। জনগণ মনে করতে শুরু করে যে, শাসকের রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামানো তাদের কাজ নয়, তাদের কাজ কেবল ইবাদত করা এবং ব্যক্তিগত জীবনে ধর্ম পালন করা। এই মানসিকতা মুসলিম সমাজকে দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ থেকে হয়তো কিছুটা রক্ষা করেছিল, কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এর ফলে মুসলিম বিশ্বে জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা বা গণতন্ত্রের ধারণা বিকশিত হতে বাধাগ্রস্ত হয় এবং স্বৈরাচারী শাসকরা ধর্মের দোহাই দিয়ে তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার লাইসেন্স পেয়ে যায়। (Lambton, 1981)। ফিতনার এই ভয় বা ফিয়ার অফ ফিতনা (Fear of Fitna) আজও মুসলিম রাজনৈতিক অবচেতনে গভীরভাবে প্রোথিত।
উপসংহার: ছাইয়ের নিচে আগুনের খোঁজ
ইতিহাসের এই দীর্ঘ যাত্রাপথ এবং সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ আমাদের সামনে একটি আয়না ধরে দেয়। সেই আয়নায় আমরা দেখি, সভ্যতা আসলে খুব ভঙ্গুর। হাজার বছরের গড়ে তোলা বিশ্বাস ও সম্পর্ক মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে ক্ষমতার লোভ আর অসহিষ্ণুতার আঘাতে। ফিতনা কেবল অতীতের কোনো ঘটনা নয়; এটি মানব সমাজের এক চিরন্তন দুর্বলতা। যখনই সমাজে ন্যায়বিচার থাকে না, যখনই সম্পদ গুটিকতক মানুষের হাতে জমা হয়, এবং যখনই আবেগকে পুঁজি করে ঘৃণা ছড়ানো হয় – তখনই ফিতনার আগুন জ্বলে ওঠে। মদিনার শান্ত সমাজ থেকে বাগদাদের রাজপথ, কারবালার প্রান্তর থেকে সামারার প্রাসাদ – সর্বত্রই আমরা দেখেছি মানুষের হাহাকার। ফিতনা শব্দটির ধাতুগত অর্থ ছিল সোনাকে আগুনে পুড়িয়ে খাঁটি করা। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী দেয়, ফিতনার আগুনে সমাজ পুড়লে সবসময় খাঁটি সোনা বের হয় না। অনেক সময় শুধুই ছাই আর ধ্বংসস্তূপ অবশিষ্ট থাকে। প্রথম ফিতনা মুসলিম ঐক্য ভেঙেছে, দ্বিতীয় ফিতনা পবিত্র স্থানগুলোকে রক্তাক্ত করেছে, তৃতীয় ও চতুর্থ ফিতনা শহর ও সভ্যতা ধ্বংস করেছে, আর পঞ্চম ফিতনা রাষ্ট্রযন্ত্রকেই অকার্যকর করে দিয়েছে। বাগদাদ পুড়েছে, দামেস্ক পুড়েছে, আলেপ্পো পুড়েছে।
তবে অন্ধকারের মধ্যেও আলো থাকে। ফিতনার এই ইতিহাস এবং তার সমাজতাত্ত্বিক ব্যবচ্ছেদ আমাদের শেখায় সহনশীলতা ও প্রতিষ্ঠানের বা ইনস্টিটিউশন (Institution)-এর গুরুত্ব। এটি আমাদের সতর্ক করে দেয় যে, আবেগের চেয়ে যুক্তি, এবং সংঘাতের চেয়ে সমঝোতা বা কম্প্রোমাইজ (Compromise) অনেক বেশি জরুরি। ফিতনা আমাদের চরিত্র উন্মোচন করে দেয়। এটি আমাদের প্রশ্ন করে – সংকটের সময় আমরা কোন দিকে থাকব? আমরা কি আগুনের ইন্ধন জোগাব, নাকি পানি ঢালব? মানুষ হিসেবে আমাদের ট্র্যাজেডি হলো, আমরা ইতিহাস পড়ি কিন্তু ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিই না। আমরা বারবার একই গর্তে পা দিই। পৃথিবীটা ভাঙা-গড়ার এক অনন্ত খেলা। ফিতনা আসে, ঝড় আসে, আবার শান্ত হয়। ধ্বংসস্তূপের ওপর নতুন ঘাস গজায়, ফুল ফোটে। কিন্তু সেই ঝড়ে যারা হারিয়ে যায়, তাদের আর ফিরে পাওয়া যায় না। আগুনের কাজ পোড়ানো, কিন্তু সেই আগুনে পুড়ে আমরা ছাই হবো নাকি সোনা হবো – সেটা ঠিক করার ক্ষমতা ইতিহাস বা ভাগ্য নয়, বরং আমাদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ফিতনার এই অনন্ত চক্র ভাঙার চাবিকাঠি আমাদের সংযম, ন্যায়বিচার এবং বিবেকের কাছেই গচ্ছিত।
আধুনিক যুগে ফিতনা: ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ও ডিজিটাল দহন
একবিংশ শতাব্দীর চকমকে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ এবং বিশ্বায়নের যুগে দাঁড়িয়ে আমরা যদি মনে করি যে মধ্যযুগীয় ফিতনা বা গৃহবিবাদের সেই অন্ধকার অধ্যায়গুলো আমরা পেছনে ফেলে এসেছি, তবে তা হবে এক মারাত্মক ভ্রান্তি। ইতিহাসের মঞ্চ বদলায়, কুশীলব বদলায়, অস্ত্রের ধরন বদলায়, কিন্তু মানুষের আদিম প্রবৃত্তি এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বের মূল চিত্রনাট্যটি অপরিবর্তিতই থেকে যায়। ধ্রুপদী ইসলামের ইতিহাসে যে ফিতনাগুলোকে আমরা উটের পিঠে বা তলোয়ারের ঝনঝনানির মধ্যে দেখেছি, আধুনিক যুগে তা নতুন পরিভাষা এবং নতুন বিধ্বংসী রূপ নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভাষায় যাকে আমরা ব্যর্থ রাষ্ট্র (Failed State), গৃহযুদ্ধ (Civil War) কিংবা প্রক্সি যুদ্ধ (Proxy War) বলি, তা মূলত সেই চিরায়ত ফিতনারই আধুনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্করণ। ফিতনার মূল সংজ্ঞা – সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়া, ভাইয়ের হাতে ভাইয়ের রক্তপাত এবং সত্য-মিথ্যার বিভাজন রেখা মুছে যাওয়া – আজকের সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া কিংবা ইরাকের পরিস্থিতির সাথে হুবহু মিলে যায়। তফাৎ শুধু এই যে, সপ্তম শতাব্দীর ফিতনায় যা ছিল মরুভূমির বালুকাময় প্রান্তর, আজকের ফিতনায় তা কংক্রিটের ধ্বংসস্তূপ এবং ডিজিটাল স্ক্রিনের নীল আলো। আধুনিক যুগে ফিতনা কেবল ভৌগোলিক সীমানায় আবদ্ধ নেই; এটি ইন্টারনেটের অপটিক্যাল ফাইবার বেয়ে মানুষের ড্রইংরুম থেকে শুরু করে অবচেতন মন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা আজ এমন এক সময়ে বাস করছি, যাকে বলা যেতে পারে ভগ্ন সত্যের যুগ (Age of Broken Truth), যেখানে ফিতনা কোনো নির্দিষ্ট যুদ্ধের নাম নয়, বরং এটি একটি স্থায়ী সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা বা পারমানেন্ট স্টেট অফ ক্রাইসিস (Permanent State of Crisis)।
ব্যর্থ রাষ্ট্র ও ভূ-রাজনীতির দাবাখেলা: ধ্রুপদী ফিতনার আধুনিক মানচিত্র
মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বের সাম্প্রতিক ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা ইতিহাসের এক নির্মম পুনরাবৃত্তি বা হিস্টোরিক্যাল রিকারেন্স (Historical Recurrence) দেখতে পাই। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া এবং ইয়েমেন – এই রাষ্ট্রগুলো আজ আধুনিক ফিতনার এক একটি জীবন্ত পরীক্ষাগারে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় যখন একটি রাষ্ট্র তার সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, নাগরিকদের মৌলিক নিরাপত্তা দিতে পারে না এবং দেশের অভ্যন্তরে একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠী ক্ষমতার জন্য লড়াই করে, তখন তাকে ব্যর্থ রাষ্ট্র (Failed State) বলা হয়। এই ব্যর্থ রাষ্ট্রের ধারণাটি ধ্রুপদী আরবি পরিভাষা ‘ফিতনা’-এর সমার্থক। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের কথা বিবেচনা করা যাক। ২০১১ সালে যা শুরু হয়েছিল একটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের দাবি হিসেবে, তা দ্রুতই রূপান্তরিত হয় এক ভয়াবহ ফিতনায়। এখানে সমাজের প্রতিটি স্তর বিভক্ত হয়ে পড়ে – শিয়া বনাম সুন্নি, কুর্দি বনাম আরব, সেক্যুলার বনাম ইসলামিস্ট। উমাইয়া বা আব্বাসীয় যুগের ফিতনায় যেমন বাইজান্টাইন বা পারসিকরা কলকাঠি নাড়ত, ঠিক তেমনি আধুনিক সিরিয়া বা ইয়েমেনে আমরা দেখি প্রক্সি যুদ্ধ (Proxy War)-এর ভয়াবহ খেলা। একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে যখন বাইরের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো (যেমন আমেরিকা, রাশিয়া, ইরান, সৌদি আরব বা তুরস্ক) নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য বিভিন্ন গোষ্ঠীকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে, তখন তাকে প্রক্সি যুদ্ধ বলে। ইয়েমেনের সানা কিংবা সিরিয়ার আলেপ্পো শহরের ধ্বংসস্তূপের দিকে তাকালে মনে হয় যেন সেই ‘সামারার নৈরাজ্য‘ বা ‘কারবালার বিয়োগান্তক’ দৃশ্যগুলোই ফিরে এসেছে, তবে অনেক বেশি বিধ্বংসী মারণাস্ত্র নিয়ে।
এই আধুনিক ফিতনায় সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ এবং তাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য। ধ্রুপদী ফিতনায় যেমন বাগদাদ বা মদিনা আক্রান্ত হয়েছিল, আধুনিক ফিতনায় আমরা দেখেছি প্রাচীন পালমিরা, মসুলের গ্র্যান্ড মসজিদ বা আলেপ্পোর সুক (বাজার) ধ্বংস হতে। একে বলা হয় সাংস্কৃতিক নির্মূলীকরণ (Cultural Cleansing)। ফিতনার আগুন কেবল বর্তমানকে পুড়িয়ে ছাই করে না, এটি একটি জাতির অতীত এবং ইতিহাসকেও মুছে ফেলতে চায়। রাষ্ট্র যখন ভেঙে পড়ে, তখন মানুষ তার নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্রের ওপর আর ভরসা করতে পারে না; ফলে তারা ফিরে যায় তাদের আদিম পরিচয়ের কাছে – তা হতে পারে গোত্র, মাযহাব বা এথনিসিটি। ইরাক বা লিবিয়ায় আমরা দেখেছি কীভাবে কেন্দ্রীয় শাসন বা সেন্ট্রাল অথরিটি (Central Authority) ভেঙে পড়ার পর মানুষ ছোট ছোট মিলিশিয়া বাহিনী বা সশস্ত্র গোষ্ঠীর অধীনে আশ্রয় নিয়েছে। এটি সেই নবম শতাব্দীর ‘ইকতা’ প্রথা বা সামরিক সামন্তবাদেরই আধুনিক রূপ, যেখানে রাষ্ট্রপতির চেয়ে স্থানীয় ওয়ারলর্ড বা যুদ্ধবাজ নেতা (Warlord)-এর ক্ষমতা বেশি। এই পরিস্থিতি তৈরি করে এক দীর্ঘস্থায়ী অরাজকতা বা ক্রনিক অ্যানার্কি (Chronic Anarchy), যেখানে শান্তি প্রক্রিয়া বা যুদ্ধবিরতি কেবল কাগজের টুকরো ছাড়া আর কিছুই নয়। আধুনিক ফিতনার এই ভূ-রাজনৈতিক দিকটি প্রমাণ করে যে, সভ্যতা বা রাষ্ট্রব্যবস্থা অত্যন্ত ভঙ্গুর একটি বিষয়; ক্ষমতার লোভ এবং বাইরের হস্তক্ষেপের সামান্য আঘাতেই তা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে পারে। (Rotberg, 2004)।
ডিজিটাল ফিতনা: অ্যালগরিদমের অদৃশ্য যুদ্ধক্ষেত্র
একবিংশ শতাব্দীর ফিতনার সবচেয়ে ভয়ানক এবং অভিনব দিকটি হলো এর ডিজিটাল রূপান্তর। তলোয়ার বা মিসাইল দিয়ে মানুষের শরীর হত্যা করা যায়, কিন্তু ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়া দিয়ে মানুষের মন, বিবেক এবং সমাজের ঐক্য হত্যা করা সম্ভব। আধুনিক যুগে ফিতনা তৈরি করতে এখন আর ঘোড়সওয়ার বাহিনীর দরকার হয় না; একটি স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট সংযোগই যথেষ্ট। একে সমাজতাত্ত্বিকরা বলছেন ডিজিটাল ফিতনা (Digital Fitna) বা সাইবার-বিশৃঙ্খলা (Cyber-Chaos)। সপ্তম শতাব্দীতে উসমানের রক্তমাখা জামা বা বর্শার আগায় কুরআনের পাতা ছিল প্রোপাগান্ডার হাতিয়ার; আর আজ সেই স্থান দখল করেছে ফেক নিউজ (Fake News), ডিপ ফেক (Deep Fake) ভিডিও এবং ফটোশপ করা ছবি। সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগরিদমগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যে, তা মানুষের নেতিবাচক আবেগ – ভয়, ঘৃণা এবং ক্রোধ – কে উস্কে দেয়। ফেসবুকে বা টুইটারে একটি মিথ্যা গুজব মুহূর্তের মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে যায়, যা থামানোর কোনো উপায় থাকে না। এই ঘটনাকে তথ্যের অস্ত্রায়ন বা উইপোনাইজেশন অফ ইনফরমেশন (Weaponization of Information) বলা হয়।
আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির তাত্ত্বিক ম্যানুয়েল ক্যাস্টেলস (Manuel Castells) তার নেটওয়ার্ক সোসাইটি (Network Society) তত্ত্বে দেখিয়েছেন যে, আজকের যুগে ক্ষমতা আর বন্দুকের নলে নেই, ক্ষমতা এখন তথ্যের প্রবাহ এবং নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণে। ফিতনাবাজরা এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সমাজের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় বা রাজনৈতিক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক পোস্ট ছড়িয়ে দিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানো এখন খুব সহজ। মানুষ যখন অনলাইনে কোনো খবর দেখে, তখন সে তার সত্যতা যাচাই বা ফ্যাক্ট চেক (Fact Check) করার ধৈর্য রাখে না; বরং সে তার পূর্বনির্ধারিত ধারণা বা কনফার্মেশন বায়াস (Confirmation Bias) অনুযায়ী সেটা বিশ্বাস করে এবং শেয়ার করে। এই প্রক্রিয়াটি ফিতনার আগুনকে বাতাসের বেগে ছড়িয়ে দেয়। আগে যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রু চেনা যেত, কিন্তু ডিজিটাল ফিতনায় শত্রু অদৃশ্য। কে কোথা থেকে বসে সমাজে বিষ ছড়াচ্ছে, তা ধরা প্রায় অসম্ভব। এই অদৃশ্য যুদ্ধ সমাজকে ভেতর থেকে এমনভাবে ফোঁপরা করে দেয় যে, মানুষ তার প্রতিবেশী, বন্ধু এমনকি পরিবারের সদস্যদেরও বিশ্বাস করতে পারে না। বিশ্বাসের এই সংকট বা ক্রাইসিস অফ ট্রাস্ট (Crisis of Trust) হলো ডিজিটাল ফিতনার সবচেয়ে বড় সাফল্য। (Castells, 2009)।
ডিজিটাল ট্রাইবালিজম: নব্য জাহেলিয়াত ও মেরুকরণ
আধুনিক যুগে ফিতনার আরেকটি উল্লেখযোগ্য মনস্তাত্ত্বিক দিক হলো ডিজিটাল ট্রাইবালিজম (Digital Tribalism) বা ডিজিটাল গোত্রবাদ। প্রাক-ইসলামী আরবে যেমন মানুষ গোত্রে গোত্রে বিভক্ত ছিল এবং সামান্য কারণে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হতো, আজকের সোশ্যাল মিডিয়াতেও মানুষ ছোট ছোট ভার্চুয়াল গোত্র বা ‘ট্রাইব’-এ বিভক্ত হয়ে গেছে। তবে এই গোত্র রক্তের সম্পর্কের ভিত্তিতে নয়, বরং মতাদর্শের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। আমরা অনলাইনে এমন সব মানুষের সাথেই মিশি বা তাদের কন্টেন্টই দেখি, যারা আমাদের মতো চিন্তা করে। একে বলা হয় ইকো চেম্বার (Echo Chamber) বা ফিল্টার বাবল (Filter Bubble)। এই বাবল বা বুদবুদের ভেতরে থাকার ফলে মানুষের মনে হয় তার মতবাদই একমাত্র সত্য এবং বাকি সবাই ভুল। এই মানসিকতা সমাজে চরম মেরুকরণ (Polarization) তৈরি করে। ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা বা সহনশীলতা আজ বিলুপ্তপ্রায়। সোশ্যাল মিডিয়ার কমেন্ট সেকশনগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় সেখানে এক আধুনিক গৃহযুদ্ধ চলছে। গালাগালি, চরিত্রহনন এবং হুমকি – এগুলো ডিজিটাল ফিতনার ভাষা।
এই ডিজিটাল গোত্রবাদের ফলে মানুষ প্রতিপক্ষকে আর মানুষ বলে গণ্য করে না; তাদের ‘বিমানবীকীকরণ’ বা ডিহিউম্যানাইজ (Dehumanize) করা হয়। ধ্রুপদী ফিতনায় খারিজিরা যেমন ভিন্নমতাবলম্বীদের ‘কাফের’ ঘোষণা দিয়ে হত্যা করত, আধুনিক যুগে অনলাইনে চলছে ক্যান্সেল কালচার (Cancel Culture) বা সামাজিক বর্জনের সংস্কৃতি। এটি এক ধরণের আধুনিক তাকাফির বা নব্য তাকাফির (Neo-Takfir)। ভিন্নমত পোষণ করলেই তাকে সামাজিকভাবে মৃত ঘোষণা করা হয়, তার ক্যারিয়ার ধ্বংস করা হয় এবং তাকে একঘরে করে দেওয়া হয়। বিখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক জিগমুন্ট বাউম্যান (Zygmunt Bauman) একে লিকুইড মডার্নিটি (Liquid Modernity)-এর সংকট হিসেবে দেখেছেন, যেখানে মানুষের সম্পর্কগুলো তরল এবং ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু ঘৃণাগুলো কঠিন এবং স্থায়ী। আমরা অনলাইনে একেকটি ‘ডিজিটাল মিলিশিয়া’ বাহিনী গড়ে তুলেছি, যারা সাইবার স্পেসে একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত যুদ্ধে লিপ্ত। এই যুদ্ধে রক্ত ঝরে না ঠিকই, কিন্তু মানুষের মর্যাদা, মানসিক স্বাস্থ্য এবং সামাজিক সংহতি বা সোশ্যাল কোহেশন (Social Cohesion) ধ্বংস হয়ে যায়। এই অবস্থা আমাদের সেই আদিম জাহেলি যুগের কথাই মনে করিয়ে দেয়, যেখানে ‘আসাবিয়্যাহ’ বা অন্ধ গোত্রপ্রীতিই ছিল একমাত্র আইন। আজ আমরা প্রযুক্তির শিখরে পৌঁছেও সেই আদিম অন্ধকারেই ফিরে যাচ্ছি, শুধু মাধ্যমটা বদলেছে। (Bauman, 2000)।
সত্য-উত্তর যুগ ও ফিতনার মনস্তত্ত্ব
আমরা বর্তমানে এমন এক যুগে বাস করছি যাকে অক্সফোর্ড ডিকশনারি নাম দিয়েছে পোস্ট-ট্রুথ ইরা (Post-Truth Era) বা সত্য-উত্তর যুগ। এই যুগে সত্য বা তথ্যের চেয়ে আবেগ এবং বিশ্বাস বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফিতনার মনস্তত্ত্ব বুঝতে হলে এই বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। ফিতনা তখনই সফল হয় যখন মানুষ সত্যকে মিথ্যা থেকে আলাদা করতে পারে না। আধুনিক প্রোপাগান্ডা মেশিন এবং সার্ভেল্যান্স ক্যাপিটালিজম (Surveillance Capitalism) বা নজরদারি পুঁজিবাদের প্রবক্তা শোনা জুবফ (Shoshana Zuboff) দেখিয়েছেন যে, বড় বড় টেক কোম্পানিগুলো আমাদের আচরণের ডেটা ব্যবহার করে আমাদের মনস্তত্ত্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা জানে কী ধরণের কন্টেন্ট আমাদের রাগান্বিত করবে বা ভয় দেখাবে। আর ফিতনা তো ভয় এবং রাগেরই ফসল। মানুষের মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা (Amygdala) – যা ভয় ও আবেগের কেন্দ্র – সেটিকে উত্তেজিত করে মানুষকে দিয়ে এমন সব কাজ করানো হয় যা সে স্বাভাবিক অবস্থায় করত না।
ডিজিটাল ফিতনার এই যুগে মানুষ এক ধরণের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে – তা হলো ‘আউত্রেজ’ বা ক্ষোভের নেশা। প্রতিদিন নতুন কোনো ইস্যু, নতুন কোনো বিতর্ক এবং নতুন কোনো ফিতনা ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়া অচল। এই অস্থিরতা বা ভলাটিলিটি (Volatility) সমাজকে স্থিতিশীল হতে দেয় না। আজ এক গুজব, কাল আরেক কেলেঙ্কারি – এই চক্রের মধ্যে পড়ে মানুষ তার মূল লক্ষ্য এবং নৈতিকতা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। ধ্রুপদী যুগে ফিতনা শেষ হলে সমাজ আবার শান্ত হতো, কিন্তু ডিজিটাল ফিতনা কখনো শেষ হয় না; এটি ২৪/৭ চলতে থাকে। এটি একটি অনন্ত দহনকাল, যেখানে আমাদের স্নায়ুগুলো প্রতিনিয়ত পুড়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় মানুষের পক্ষে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করা বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে আধুনিক সমাজ প্রযুক্তির দিক দিয়ে উন্নত হলেও, নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে এক গভীর শূন্যতার গহ্বরে পতিত হয়েছে।
উপসংহার: আগুনের বৃত্তে সভ্যতার ভবিষ্যৎ
ইতিহাসের পাঠ এবং আধুনিক বাস্তবতার এই তুলনামূলক বিশ্লেষণ শেষে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, ফিতনা কোনো নির্দিষ্ট শতাব্দীর ঘটনা নয়; এটি মানব সমাজের এক চিরস্থায়ী চ্যালেঞ্জ। সপ্তম শতাব্দীর মদিনা থেকে একবিংশ শতাব্দীর সাইবার স্পেস – পথটা অনেক দীর্ঘ, কিন্তু গন্তব্য সেই একই গোলকধাঁধাঁ। আধুনিক যুগে আমরা ‘সভ্য’ হয়েছি বলে যে দাবি করি, ফিতনার উপস্থিতি তা নস্যাৎ করে দেয়। আমাদের ব্যর্থ রাষ্ট্রগুলো, আমাদের প্রক্সি যুদ্ধগুলো এবং আমাদের ডিজিটাল ঘৃণা প্রমাণ করে যে, মানুষের ভেতরের সেই আদিম হিংস্রতা আজও মরে যায়নি, বরং প্রযুক্তির ছোঁয়ায় তা আরও শক্তিশালী ও বিধ্বংসী হয়েছে। সিরিয়ার ধ্বংসস্তূপ বা ইয়েমেনের দুর্ভিক্ষ কেবল রাজনৈতিক ব্যর্থতা নয়, এগুলো আমাদের নৈতিক দেউলিয়াত্বের স্মারক। আর আমাদের স্মার্টফোনের স্ক্রিনে যে ঘৃণার চাষাবাদ চলছে, তা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য এক অশনিসংকেত।
ফিতনার ধাতুগত অর্থ ছিল সোনা গলিয়ে খাঁটি করা। কিন্তু আজকের এই আধুনিক ফিতনার আগুনে আমরা কি খাঁটি হচ্ছি, নাকি পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের প্রযুক্তির দিকে তাকালে চলবে না, তাকাতে হবে নিজেদের বিবেকের দিকে। ফিতনার এই আগুন নেভানোর জন্য কোনো অ্যাপ বা সফটওয়্যার নেই; এর জন্য প্রয়োজন ডিজিটাল লিটারেসি (Digital Literacy) বা ডিজিটাল সাক্ষরতা, সহনশীলতা এবং সত্যের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা। আমাদের বুঝতে হবে, অপর পাশের স্ক্রিনে থাকা মানুষটি আমার শত্রু নয়, সেও কোনো না কোনো ফিতনার শিকার। আধুনিক যুগে ফিতনা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো ‘ক্রিটিক্যাল থিংকিং’ বা সমালোচনামূলক চিন্তার বিকাশ এবং অন্ধ আবেগের লাগাম টেনে ধরা। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে হলে আমাদের ইতিহাসের শিক্ষা নিতে হবে – নতুবা আমরা এক উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন কিন্তু আত্মঘাতী জাতি হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান পাব, যারা নিজেদের তৈরি ডিজিটাল আগুনে নিজেরাই পুড়ে মরেছে।
ফিতনার তাত্ত্বিক ব্যবচ্ছেদ: ধ্রুপদী মুসলিম দর্শন থেকে আধুনিক সমাজবিজ্ঞান
ফিতনার রক্তাক্ত ইতিহাসকে কেবল ঘটনাপ্রবাহের সমষ্টি হিসেবে পাঠ করলে তার গভীরতা এবং পুনরাবৃত্তির কারণ অধরাই থেকে যায়। এটি নিছক ক্ষমতার লড়াই ছিল না; বরং এটি ছিল মানব সমাজের অন্তর্নিহিত সংকটগুলোর এক নির্মম প্রদর্শনী। এই সংকটগুলোকে বুঝতে হলে আমাদের প্রয়োজন তাত্ত্বিক লেন্স বা থিওরিটিক্যাল লেন্স (Theoretical Lens), যা আমাদের ঘটনার পেছনের কার্যকারণ সম্পর্ক, মনস্তাত্ত্বিক চালিকাশক্তি এবং সামাজিক কাঠামোকে বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করে। ফিতনার এই জটিল ধাঁধাকে বোঝার জন্য আমরা দুই ধারার চিন্তাবিদদের শরণাপন্ন হতে পারি। প্রথমত, ধ্রুপদী মুসলিম পণ্ডিতরা, যারা ফিতনার ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করে রাষ্ট্র, সমাজ এবং নৈতিকতা নিয়ে গভীর দর্শন নির্মাণ করেছিলেন। তাদের তত্ত্বগুলো ছিল মূলত প্রেসক্রিপটিভ (Prescriptive) বা নিদানমূলক – কীভাবে ফিতনা থেকে বাঁচা যায়, তার পথনির্দেশক। দ্বিতীয়ত, আধুনিক পশ্চিমা সমাজবিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা, যাদের তত্ত্বগুলো সরাসরি ফিতনা নিয়ে না হলেও, মানব আচরণ, ক্ষমতা, সংঘাত এবং সামাজিক পরিবর্তনের যে সার্বভৌম সূত্রগুলো তারা আবিষ্কার করেছেন, তা ফিতনার ঘটনাগুলোকে ব্যবচ্ছেদ করার জন্য অপরিহার্য। তাদের তত্ত্বগুলো ডেসক্রিপটিভ (Descriptive) বা বর্ণনামূলক – কেন এবং কীভাবে ফিতনা ঘটে, তার সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেয়। এই দুই ধারার মেলবন্ধন আমাদের ফিতনার এক পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে সাহায্য করে।
ধ্রুপদী মুসলিম তাত্ত্বিক: স্থিতিশীলতার সন্ধানে
ফিতনার আগুনে পুড়তে থাকা মুসলিম সভ্যতাকে রক্ষা করার তাগিদে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী মুসলিম চিন্তাবিদ তাদের রাজনৈতিক ও সমাজতাত্ত্বিক দর্শন নির্মাণ করেছিলেন। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল বিশৃঙ্খলা বা অ্যানার্কি (Anarchy) পরিহার করে কীভাবে একটি স্থিতিশীল ও কার্যকর রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়, তার পথ অনুসন্ধান করা।
ইবনে খালদুন ও আসাবিয়্যাহর চক্র
চতুর্দশ শতাব্দীর ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানের জনক ইবনে খালদুন (Ibn Khaldun) ফিতনা এবং রাজবংশের উত্থান-পতনের পেছনে এক যুগান্তকারী তত্ত্ব প্রদান করেন, যা আসাবিয়্যাহ (Asabiyyah) বা গোষ্ঠী সংহতি নামে পরিচিত। তার বিখ্যাত গ্রন্থ আল-মুকাদ্দিমা (Al-Muqaddimah)-তে তিনি যুক্তি দেন যে, একটি রাজবংশ বা রাষ্ট্রের ভিত্তি হলো তার জনগণের মধ্যকার ‘আসাবিয়্যাহ’ বা সামাজিক সংহতি, ঐক্য এবং দলীয় চেতনা। যাযাবর বা গ্রামীণ জীবনে এই আসাবিয়্যাহ থাকে সবচেয়ে শক্তিশালী, কারণ সেখানে টিকে থাকার জন্য পারস্পরিক নির্ভরতা অপরিহার্য। এই শক্তিশালী আসাবিয়্যাহর জোরেই নতুন রাজবংশগুলো পুরনো, বিলাসী এবং দুর্বল হয়ে পড়া শাসকদের উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে। কিন্তু ক্ষমতা দখলের পর যখন তারা শহরে স্থায়ী হয় এবং বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন তাদের আসাবিয়্যাহ ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে শুরু করে। পরবর্তী প্রজন্মগুলো আর সেই পুরনো কষ্ট ও ঐক্যের কথা মনে রাখে না; তারা আরাম-আয়েশে বড় হয় এবং তাদের মধ্যে বিভেদ দেখা দেয়। ইবনে খালদুনের মতে, একটি রাজবংশের আসাবিয়্যাহ সাধারণত তিন থেকে চার প্রজন্মের (প্রায় ১২০ বছর) বেশি টেকে না। এরপরই শুরু হয় পতন বা ফিতনা, এবং তখন নতুন কোনো শক্তিশালী আসাবিয়্যাহ সম্পন্ন গোষ্ঠী এসে তাদের হটিয়ে দেয়।
প্রথম ফিতনার প্রেক্ষাপটে আমরা দেখি, প্রাথমিক মুসলিমদের মধ্যে যে প্রচণ্ড আসাবিয়্যাহ ছিল, তা সাম্রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথে বিভিন্ন গোত্রীয় ও আঞ্চলিক স্বার্থের সংঘাতে দুর্বল হতে শুরু করে। উমাইয়াদের উত্থান ছিল মূলত সিরীয় আরবদের শক্তিশালী আসাবিয়্যাহর ফল। কিন্তু পরবর্তীতে যখন তাদের মধ্যে কায়স বনাম ইয়ামান গোত্রীয় সংঘাত শুরু হলো, তখন তাদের আসাবিয়্যাহ ভেঙে পড়ে, যা তৃতীয় ফিতনায় আব্বাসীয়দের উত্থানের পথ সুগম করে। আব্বাসীয়রাও খোরাসানিদের শক্তিশালী আসাবিয়্যাহর ওপর ভর করে ক্ষমতায় এসেছিল, কিন্তু পঞ্চম ফিতনার সময় তারাও অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং তুর্কি সৈন্যদের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে তাদের মূল আসাবিয়্যাহ হারিয়ে ফেলে। ইবনে খালদুনের তত্ত্ব আমাদের শেখায় যে, ফিতনা কেবল নৈতিক অবক্ষয় নয়, এটি একটি সামাজিক-রাজনৈতিক চক্র বা সাইকেল (Cycle), যেখানে সংহতির উত্থান-পতনের সাথেই রাষ্ট্রের ভাগ্য জড়িত। (Khaldun, 1958)।
আল-মাওয়ার্দি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার আবশ্যকতা
একাদশ শতাব্দীর শাফি’ঈ ফকিহ আল-মাওয়ার্দি (Al-Mawardi) ছিলেন ফিতনার যুগে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক। তিনি যখন তার বিখ্যাত গ্রন্থ আল-আহকাম আস-সুলতানিয়া (Al-Ahkam al-Sultaniyya) বা ‘রাষ্ট্রীয় বিধান’ রচনা করেন, তখন আব্বাসীয় খলিফা ছিলেন শিয়া বুইয়িদ আমিরদের হাতের পুতুল। এই অরাজকতা দেখে তিনি খিলাফত বা ইমামতের পদকে একটি সুসংহত আইনগত কাঠামোর মধ্যে আনার চেষ্টা করেন। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল, যেভাবেই হোক খলিফার পদটিকে টিকিয়ে রাখা, কারণ খলিফাই হলেন উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক। মাওয়ার্দির মতে, খলিফার প্রধান দায়িত্ব হলো দশটি, যার মধ্যে অন্যতম হলো ধর্মরক্ষা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রের সীমানা রক্ষা করা। কিন্তু তিনি বাস্তবতাকে অস্বীকার করেননি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, খলিফার হাতে আর প্রকৃত ক্ষমতা নেই। তাই তিনি তত্ত্ব দেন যে, যদি কোনো সেনাপতি বা আমির শক্তি প্রয়োগ করে ক্ষমতা দখলও করে নেয় (যাকে তিনি বলেন ‘ইস্তিলা’ (Istila) বা জবরদখল), এবং সে যদি খলিফার নামমাত্র আনুগত্য স্বীকার করে এবং শরিয়াহ অনুযায়ী শাসন পরিচালনা করার প্রতিশ্রুতি দেয়, তবে খলিফার উচিত তাকে স্বীকৃতি দেওয়া। এটি ছিল বিশৃঙ্খলা এড়ানোর একটি বাস্তবসম্মত বা প্র্যাগম্যাটিক (Pragmatic) সমাধান। এর মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, একটি বিভক্ত কিন্তু শরিয়াহ-শাসিত ব্যবস্হা একটি অরাজক বা ফিতনাগ্রস্ত ব্যবস্থার চেয়ে উত্তম। মাওয়ার্দির দর্শন ছিল মূলত ফিতনার বিস্তার রোধ করার একটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টা, যা পরবর্তীতে সুন্নি রাজনৈতিক চিন্তাধারার ভিত্তি স্থাপন করে। (Al-Mawardi, 1996)।
আল-গাজালি ও নৈরাজ্যের চেয়ে স্বৈরাচার শ্রেয়
দ্বাদশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী মুসলিম দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক ইমাম আল-গাজালি (Al-Ghazali) ফিতনার ভয়াবহতা দেখে রাজনৈতিক দর্শনে এক চরম সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। সেলজুক সুলতানদের শাসনামলে বাতিনিয়া বা অ্যাসাসিনদের গুপ্তহত্যা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা তাকে এতটাই শঙ্কিত করেছিল যে, তিনি স্থিতিশীলতা বা অর্ডার (Order)-কে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক গুণ হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেন। তার মতে, ধর্মের অনুশীলন এবং আধ্যাত্মিক জীবনযাপনের জন্য একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্র অপরিহার্য। যদি রাষ্ট্রই না থাকে, যদি রাস্তায় নিরাপত্তা না থাকে, তবে মানুষ ধর্মকর্ম করবে কীভাবে? এই যুক্তি থেকে তিনি তার বিখ্যাত তত্ত্ব প্রদান করেন: “ষাট বছরের স্বৈরাচারী শাসন এক রাতের অরাজকতার চেয়ে উত্তম।” তিনি মনে করতেন, একজন জালিম বা অত্যাচারী শাসকও যদি অন্ততপক্ষে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারে, তবে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে না। কারণ বিদ্রোহ মানেই ফিতনা, আর ফিতনা মানেই আরও বড় ধ্বংস। আল-গাজালির এই দর্শনকে বলা হয় রাজনৈতিক নীরবতা (Political Quietism)। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, শাসকের ব্যক্তিগত নৈতিকতা যা-ই হোক না কেন, তার আনুগত্য করা আবশ্যক, যতক্ষণ না তিনি ইসলামের মৌলিক বিধানগুলোকে অস্বীকার করেন। এই তত্ত্ব মুসলিম বিশ্বে শত শত বছর ধরে শাসকদের ক্ষমতার বৈধতা দিয়েছে এবং সাধারণ মানুষকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। ফিতনার ভয় এতটাই গভীর ছিল যে, মুসলিম পণ্ডিতরা ন্যায়বিচারের আদর্শের চেয়ে স্থিতিশীলতার বাস্তবতাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
আধুনিক তাত্ত্বিক: ক্ষমতার ব্যবচ্ছেদ
আধুনিক পশ্চিমা সমাজবিজ্ঞানীরা মুসলিম বিশ্বের ফিতনা নিয়ে সরাসরি কাজ না করলেও, তাদের সংঘাত, ক্ষমতা এবং মানব আচরণ সম্পর্কিত তত্ত্বগুলো ফিতনার ঘটনাগুলোকে এক নতুন আলোতে বুঝতে সাহায্য করে। এই তাত্ত্বিকরা আমাদের ঘটনার গভীরে প্রবেশ করে সেইসব সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোকে উন্মোচন করার সরঞ্জাম দেন, যা ধ্রুপদী ঐতিহাসিক বর্ণনায় অনেক সময় উহ্য থেকে যায়। তাদের তত্ত্বগুলো যেন এক ধরণের এক্স-রে, যা সমাজের বাইরের আবরণের নিচে লুকিয়ে থাকা ভাঙন, ক্ষমতার বিন্যাস এবং আদর্শিক লড়াইয়ের কঙ্কালসার রূপটিকে আমাদের সামনে তুলে ধরে। এই আধুনিক লেন্স দিয়ে ফিতনাকে দেখলে তা আর নিছক কিছু মানুষের ভালো-মন্দের লড়াই থাকে না, বরং হয়ে ওঠে মানব সভ্যতার চিরন্তন সংকটগুলোর এক একটি কেস স্টাডি।
ম্যাক্স ওয়েবার ও বৈধতার সংকট
জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber)-এর রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব ফিতনার মূল চালিকাশক্তিকে বোঝার জন্য এক অপরিহার্য কাঠামো প্রদান করে। ওয়েবারের মতে, কোনো শাসনব্যবস্থা কেবল বলপ্রয়োগ বা ক্ষমতা (Power)-এর ওপর ভিত্তি করে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন কর্তৃত্ব (Authority), যা হলো সেই ক্ষমতা যা জনগণ বৈধ বা লেজিটিমেট (Legitimate) বলে মনে করে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নেয়। ওয়েবার তিন ধরণের বৈধ কর্তৃত্বের কথা বলেছেন, এবং ফিতনার ইতিহাসে আমরা এই তিনটিরই সংকট ও রূপান্তর দেখতে পাই।
১. ক্যারিশম্যাটিক কর্তৃত্ব (Charismatic Authority): এই কর্তৃত্বের ভিত্তি হলো নেতার অসাধারণ ব্যক্তিগত গুণাবলি, পবিত্রতা বা বীরত্ব। নবী মুহাম্মদ ছিলেন এর সর্বোচ্চ উদাহরণ। তার মৃত্যুর পর খুলাফায়ে রাশেদীন (Rashidun Caliphs)-এর কর্তৃত্বের মধ্যেও এই ক্যারিশমার একটি উত্তরাধিকার ছিল, কারণ তারা ছিলেন নবীর নিকটতম সাহাবী। জনগণ তাদের আনুগত্য করত কেবল পদের জন্য নয়, বরং তাদের ব্যক্তিগত তাকওয়া এবং নবীর সাথে তাদের সম্পর্কের কারণে। প্রথম ফিতনার সূচনা হয় মূলত এই ক্যারিশম্যাটিক কর্তৃত্বের অবক্ষয়ের মাধ্যমে। খলিফা উসমানের বিরুদ্ধে যখন স্বজনপ্রীতি এবং অযোগ্য ব্যক্তিদের গভর্নর নিয়োগের অভিযোগ ওঠে, তখন জনগণের চোখে তার সেই পবিত্র ভাবমূর্তি বা ক্যারিশমা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বিদ্রোহীরা তাকে আর সেই আদর্শ নেতা হিসেবে দেখতে পারছিল না, যার হাতে উম্মাহর ভার নিরাপদে ছেড়ে দেওয়া যায়। এই ক্যারিশমার সংকটই তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নৈতিক ভিত্তি তৈরি করে দেয়।
২. ঐতিহ্যবাহী কর্তৃত্ব (Traditional Authority): এই কর্তৃত্বের ভিত্তি হলো প্রথা, ঐতিহ্য এবং বংশানুক্রমিক অধিকার, যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। আরবের গোত্রীয় সমাজ মূলত এই ঐতিহ্যবাহী কর্তৃত্বের ওপরই চলত, যেখানে শেখ বা নেতা নির্বাচিত হতেন প্রথা অনুযায়ী। ইসলাম ‘শুরা’ বা পরামর্শভিত্তিক একটি নতুন ঐতিহ্য চালু করলেও, গোত্রীয় আনুগত্যের পুরনো প্রথা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়নি। দ্বিতীয় ফিতনার বিস্ফোরণ ঘটেছিল সরাসরি এই ঐতিহ্যবাহী কর্তৃত্বের সংকট থেকে। মুয়াবিয়া যখন তার পুত্র ইয়াজিদকে উত্তরাধিকারী মনোনয়ন দেন, তখন তিনি ইসলামি ‘শুরা’ প্রথা এবং আরবের ঐতিহ্যবাহী নির্বাচন পদ্ধতি – উভয়কেই লঙ্ঘন করেন। তিনি একটি রাজতান্ত্রিক বা ডাইনাস্টিক (Dynastic) ঐতিহ্য চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন, যা মদিনার সাহাবী এবং সাধারণ মুসলিমদের কাছে ছিল সম্পূর্ণ অবৈধ। হুসাইন ইবনে আলী বা আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের বিদ্রোহ ছিল এই অবৈধভাবে চাপিয়ে দেওয়া নতুন ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে পুরনো এবং অধিকতর বৈধ ঐতিহ্যের লড়াই।
৩. যুক্তিসিদ্ধ-আইনি কর্তৃত্ব (Rational-Legal Authority): এটি আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য, যেখানে কর্তৃত্বের ভিত্তি হলো আইন, সংবিধান এবং নিরপেক্ষ আমলাতন্ত্র। যদিও মধ্যযুগে এই ধারণাটি আজকের মতো ছিল না, তবুও আব্বাসীয় খিলাফতের বিশাল আমলাতান্ত্রিক কাঠামো এবং ইসলামি আইনশাস্ত্র বা ফিকহ (Fiqh)-এর বিকাশকে এর একটি আদি রূপ হিসেবে দেখা যেতে পারে। রাষ্ট্র চলত নির্দিষ্ট নিয়মকানুন এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে। পঞ্চম ফিতনার সময় স্যামারার নৈরাজ্য (Anarchy at Samarra) ছিল এই যুক্তিসিদ্ধ-আইনি কর্তৃত্বের চূড়ান্ত পতন। যখন তুর্কি সেনাপতিরা নিজেদের ইচ্ছেমতো খলিফাকে হত্যা বা নিয়োগ করতে শুরু করল, তখন রাষ্ট্রের আইন বা প্রতিষ্ঠানের আর কোনো মূল্য রইল না। খলিফার পদেরও আর মূল্য থাকল না। এটা তখন সামরিক শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। ওয়েবারের তত্ত্ব অনুযায়ী, যখন একটি শাসনব্যবস্থা তার বৈধতার সবকটি উৎস – ক্যারিশমা, ঐতিহ্য এবং আইন – হারিয়ে ফেলে, তখন তার পতন বা ফিতনা অনিবার্য হয়ে ওঠে। (Weber, 1978)।
কার্ল মার্ক্স ও শ্রেণি সংগ্রামের প্রতিধ্বনি
কার্ল মার্ক্স (Karl Marx) এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস (Friedrich Engels)-এর ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বাহিস্টোরিক্যাল ম্যাটেরিয়ালিজম (Historical Materialism) অনুযায়ী, মানব ইতিহাস হলো বিভিন্ন শ্রেণিসমূহের (Class) মধ্যকার অর্থনৈতিক স্বার্থের সংঘাতের ইতিহাস। যদিও মার্ক্সীয় মডেলটি মূলত ইউরোপীয় পুঁজিবাদের বিকাশের ওপর ভিত্তি করে তৈরি, কিন্তু এর মূলনীতিগুলো – শোষক ও শোষিতের দ্বন্দ্ব – ফিতনার কিছু ঘটনাকে এক নতুন এবং শক্তিশালী দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করে। অনেক ফিতনার পেছনে ধর্মীয় বা রাজনৈতিক আদর্শের যে বয়ান দেওয়া হয়, তার আড়ালে লুকিয়ে ছিল তীব্র অর্থনৈতিক বঞ্চনা এবং শ্রেণিগত অসমতা।
তৃতীয় ফিতনায় উমাইয়াদের পতন এবং আব্বাসীয়দের উত্থানকে একটি শ্রেণি-ভিত্তিক বিপ্লব হিসেবে দেখা যেতে পারে। উমাইয়া শাসনামলে আরব মুসলিমরা ছিল শাসক শ্রেণি, যারা রাষ্ট্রের প্রায় সমস্ত সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। অন্যদিকে, অনারব নবদীক্ষিত মুসলিম বা মাওয়ালি (Mawali)-রা ছিল দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। তারা সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনী, প্রশাসন এবং অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখলেও তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার ছিল সীমিত। আব্বাসীয়রা খুব চতুরতার সাথে এই বঞ্চিত মাওয়ালি শ্রেণির পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে কাজে লাগিয়েছিল। আব্বাসীয় বিপ্লব তাই কেবল এক রাজবংশের পতন ছিল না, এটি ছিল একটি বঞ্চিত শ্রেণির দ্বারা পুরনো শাসক শ্রেণিকে উৎখাত করার লড়াই।
এই শ্রেণি সংগ্রামের সবচেয়ে নগ্ন রূপটি আমরা দেখি জাঞ্জ বিদ্রোহ (Zanj Rebellion)-এর মধ্যে। দক্ষিণ ইরাকের লবণাক্ত জলাভূমিতে কর্মরত পূর্ব আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসরা ছিল আক্ষরিক অর্থেই উৎপাদনের উপকরণ। তাদের কোনো মানবিক বা অর্থনৈতিক অধিকার ছিল না। তাদের বিদ্রোহ ছিল সরাসরি উৎপাদন সম্পর্কের (Relations of Production) বিরুদ্ধে এক সশস্ত্র সংগ্রাম। তারা কেবল মুক্তিই চায়নি, তারা চেয়েছিল সেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটাকেই ধ্বংস করে দিতে যা তাদের ওপর এই শোষণ চাপিয়ে দিয়েছিল। একইভাবে, কারমাতিয়ান (Qarmatian) আন্দোলন, যারা ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ সাধন করে এক ধরণের সাম্যবাদী বা কমিউনাল (Communal) সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিল, তাদের উত্থানও ছিল আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের চরম অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক উগ্র প্রতিক্রিয়া। তাদের মক্কা আক্রমণ এবং হাজীদের হত্যা করাকে কেবল ধর্মীয় বিচ্যুতি হিসেবে দেখলে ভুল হবে; এটি ছিল সেই ধনী অভিজাতদের প্রতীকগুলোর ওপর আক্রমণ, যারা হজ্জের মাধ্যমে তাদের সম্পদ এবং ধার্মিকতার প্রদর্শন করত। মার্ক্সীয় লেন্স আমাদের দেখায় যে, অনেক সময় ধর্ম বা আদর্শ হলো শ্রেণিগত স্বার্থের একটি মোড়ক মাত্র, এবং ফিতনার আগুন জ্বলে ওঠে মূলত ক্ষুধার্ত ও বঞ্চিত মানুষের পেট থেকে। (Marx & Engels, 1848)।
মিশেল ফুকো ও জ্ঞান-ক্ষমতার খেলা
ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো (Michel Foucault) ক্ষমতাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। তার মতে, ক্ষমতা কেবল দমন, পীড়ন বা আইনের মাধ্যমে কাজ করে না। ক্ষমতার সবচেয়ে সূক্ষ্ম এবং শক্তিশালী রূপটি কাজ করে ‘জ্ঞান’ এবং ‘সত্য’ উৎপাদনের মাধ্যমে। ফুকোর বিখ্যাত ধারণা হলো জ্ঞান-ক্ষমতা (Power/Knowledge), যার অর্থ হলো – ক্ষমতা সত্যকে উৎপাদন করে, এবং সেই ‘সত্য’ আবার ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখে এবং বৈধতা দেয়। সমাজে কোনটি স্বাভাবিক, কোনটি অস্বাভাবিক, কোনটি পাপ, কোনটি পুণ্য – এই ধারণাগুলো কোনো নিরপেক্ষ জ্ঞান নয়, বরং এগুলো ক্ষমতার দ্বারা নির্মিত ডিসকোর্স (Discourse) বা বয়ান। ফিতনার ইতিহাস এই জ্ঞান-ক্ষমতার লড়াইয়ের এক রক্তাক্ত প্রান্তর।
চতুর্থ ফিতনার পর খলিফা মামুনের শাসনামলে শুরু হওয়া মিহনা (Mihna) বা ইনকুইজিশন ছিল জ্ঞান-ক্ষমতার এই খেলার এক নিখুঁত উদাহরণ। ‘কুরআন সৃষ্ট নাকি অসৃষ্ট’ – এই বিতর্কটি আপাতদৃষ্টিতে একটি বিমূর্ত ধর্মতাত্ত্বিক বিষয় মনে হতে পারে। কিন্তু ফুকোর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এটি ছিল ‘ইসলামের সত্য’ কী হবে, তা নির্ধারণ করার ক্ষমতার লড়াই। মামুন এবং মুতাজিলারা চেয়েছিলেন রাষ্ট্রের ক্ষমতা ব্যবহার করে একটি যুক্তিবাদী ‘সত্য’ প্রতিষ্ঠা করতে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল খলিফাকে কেবল রাজনৈতিক নেতাই নয়, বরং ধর্মের চূড়ান্ত ব্যাখ্যাকার বা আর্বিটার অফ ট্রুথ (Arbiter of Truth) হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। এর মাধ্যমে তারা ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় পণ্ডিত বা ওলামা (Ulama)-দের জ্ঞান উৎপাদনের ক্ষমতাকে খর্ব করতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের প্রতিরোধ ছিল কেবল একটি ধর্মতাত্ত্বিক মতবাদকে রক্ষা করার জন্য নয়; এটি ছিল রাষ্ট্রের এই জ্ঞানতাত্ত্বিক আধিপত্য বা এপিস্টেমিক ডমিনেশন (Epistemic Domination)-এর বিরুদ্ধে এক লড়াই। তার বিজয় সুন্নি ইসলামে ওলামাদের জ্ঞানতাত্ত্বিক কর্তৃত্বকে চিরতরে প্রতিষ্ঠা করে দেয়।
ফিতনার প্রতিটি দলেই আমরা এই ডিসকোর্স নির্মাণের খেলা দেখতে পাই। খারিজি (Kharijites)-রা “লা হুকমা ইল্লা লিল্লাহ” (আল্লাহ ছাড়া কারো বিধান নেই) স্লোগানের মাধ্যমে এক নতুন এবং উগ্র ‘সত্য’ নির্মাণ করেছিল, যা তাদের প্রতিপক্ষকে ‘কাফের’ ঘোষণা করার এবং হত্যা করার ক্ষমতা দিয়েছিল। শিয়া (Shia)-রা ‘ইমামত’ এবং ‘আহল আল-বাইত’-এর ডিসকোর্সের মাধ্যমে খিলাফতের বিকল্প এক বৈধতার বয়ান তৈরি করেছিল। ফুকোর তত্ত্ব আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে, ফিতনার যুদ্ধক্ষেত্রে কেবল তলোয়ারই চলে না, সেখানে চলে বয়ান এবং পাল্টা-বয়ানের লড়াই। যে পক্ষ নিজের ‘সত্য’কে সমাজের ওপর প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তারাই চূড়ান্তভাবে বিজয়ী হয়। ফিতনা তাই কেবল ভূখণ্ডের লড়াই নয়, এটি মানুষের মন এবং বিশ্বাস দখলেরও লড়াই। (Foucault, 1980)।
উপসংহার: ছাইয়ের নিচে আগুনের খোঁজ
ইতিহাসের এই দীর্ঘ যাত্রাপথ আমাদের সামনে একটি আয়না ধরে দেয়। সেই আয়নায় আমরা দেখি, সভ্যতা আসলে খুব ভঙ্গুর। হাজার বছরের গড়ে তোলা বিশ্বাস ও সম্পর্ক মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে ক্ষমতার লোভ আর অসহিষ্ণুতার আঘাতে। মদিনার শান্ত সমাজ থেকে বাগদাদের রাজপথ, কারবালার প্রান্তর থেকে সামারার প্রাসাদ – সর্বত্রই আমরা দেখেছি মানুষের হাহাকার।
ফিতনা শব্দটির ধাতুগত অর্থ ছিল সোনাকে আগুনে পুড়িয়ে খাঁটি করা। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী দেয়, ফিতনার আগুনে সমাজ পুড়লে সবসময় খাঁটি সোনা বের হয় না। অনেক সময় শুধুই ছাই আর ধ্বংসস্তূপ অবশিষ্ট থাকে। প্রথম ফিতনা মুসলিম ঐক্য ভেঙেছে, দ্বিতীয় ফিতনা পবিত্র স্থানগুলোকে রক্তাক্ত করেছে, তৃতীয় ও চতুর্থ ফিতনা শহর ও সভ্যতা ধ্বংস করেছে, আর পঞ্চম ফিতনা রাষ্ট্রযন্ত্রকেই অকার্যকর করে দিয়েছে। বাগদাদ পুড়েছে, দামেস্ক পুড়েছে, আলেপ্পো পুড়েছে। এই পোড়ার কি কোনো শেষ আছে?
তবে অন্ধকারের মধ্যেও আলো থাকে। ফিতনার এই ইতিহাস আমাদের শেখায় সহনশীলতা ও সংলাপে গুরুত্ব। এটি আমাদের সতর্ক করে দেয় যে, আবেগের চেয়ে যুক্তি, এবং সংঘাতের চেয়ে সমঝোতা অনেক বেশি জরুরি। ফিতনা আমাদের চরিত্র উন্মোচন করে দেয়। এটি আমাদের প্রশ্ন করে – সংকটের সময় আমরা কোন দিকে থাকব? আমরা কি আগুনের ইন্ধন জোগাব, নাকি জল ঢালব?
মানুষ হিসেবে আমাদের ট্র্যাজেডি হলো, আমরা ইতিহাস পড়ি কিন্তু ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিই না। আমরা বারবার একই গর্তে পা দিই। পৃথিবীটা ভাঙা-গড়ার এক অনন্ত খেলা। ফিতনা আসে, ঝড় আসে, আবার শান্ত হয়। ধ্বংসস্তূপের ওপর নতুন ঘাস গজায়, ফুল ফোটে। কিন্তু সেই ঝড়ে যারা হারিয়ে যায়, তাদের আর ফিরে পাওয়া যায় না। আগুনের কাজ পোড়ানো, কিন্তু সেই আগুনে পুড়ে আমরা ছাই হবো নাকি সোনা হবো – সেটা ঠিক করার ক্ষমতা ইতিহাস বা ভাগ্য নয়, বরং আমাদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ফিতনার এই অনন্ত চক্র ভাঙার চাবিকাঠি আমাদের সংযম, ন্যায়বিচার এবং বিবেকের কাছেই গচ্ছিত।
তথ্যসূত্র
- Al-Mawardi, A. H. (1996). The Ordinances of Government (Al-Ahkam al-Sultaniyya) (W. H. Wahba, Trans.). Garnet Publishing.
- Asad, M. (1980). The Message of the Qur’an. Gibraltar: Dar al-Andalus.
- Badawi, E. M., & Haleem, M. A. (2008). Arabic-English Dictionary of Qur’anic Usage. Brill.
- Bauman, Z. (2000). Liquid Modernity. Polity Press.
- Bosworth, C. E. (1996). The New Islamic Dynasties: A Chronological and Genealogical Manual. Columbia University Press.
- Castells, M. (2009). Communication Power. Oxford University Press.
- Cooperson, M. (2005). Al-Ma’mun. Oneworld Publications.
- Daftary, F. (2007). The Isma’ilis: Their History and Doctrines. Cambridge University Press.
- Donner, F. M. (2010). Muhammad and the Believers: At the Origins of Islam. Harvard University Press.
- El-Cheikh, N. M. (2004). Byzantium Viewed by the Arabs. Harvard University Press.
- El-Hibri, T. (1999). Reinterpreting Islamic Historiography: Harun al-Rashid and the Narrative of the Abbasid Caliphate. Cambridge University Press.
- Foucault, M. (1980). Power/Knowledge: Selected Interviews and Other Writings, 1972-1977. Pantheon Books.
- Gordon, M. S. (2001). The Breaking of a Thousand Swords: A History of the Turkish Military of Samarra. SUNY Press.
- Gurr, T. R. (1970). Why Men Rebel. Princeton University Press.
- Halm, H. (1996). The Empire of the Mahdi: The Rise of the Fatimids. Brill.
- Hawting, G. R. (2000). The First Dynasty of Islam: The Umayyad Caliphate AD 661-750. Routledge.
- Hodgson, M. G. S. (1974). The Venture of Islam: Conscience and History in a World Civilization. University of Chicago Press.
- Hurvitz, N. (2002). The Formation of Hanbalism: Piety into Power. Routledge.
- Kaegi, W. E. (1992). Byzantium and the Early Islamic Conquests. Cambridge University Press.
- Kennedy, H. (2001). The Armies of the Caliphs: Military and Society in the Early Islamic State. Routledge.
- Kennedy, H. (2004). The Prophet and the Age of the Caliphates: The Islamic Near East from the 6th to the 11th Century. Pearson Longman.
- Khaldun, I. (1958). The Muqaddimah: An Introduction to History (F. Rosenthal, Trans.). Princeton University Press.
- Kraemer, J. L. (1992). Humanism in the Renaissance of Islam: The Cultural Revival during the Buyid Age. Brill.
- Lambton, A. K. S. (1981). State and Government in Medieval Islam: An Introduction to the Study of Islamic Political Theory. Oxford University Press.
- Lane, E. W. (1863). An Arabic-English Lexicon. Williams and Norgate.
- Lapidus, I. M. (2002). A History of Islamic Societies. Cambridge University Press.
- Le Bon, G. (1895). The Crowd: A Study of the Popular Mind. T. Fisher Unwin.
- Lewis, B. (1988). The Political Language of Islam. University of Chicago Press.
- Madelung, W. (1997). The Succession to Muhammad: A Study of the Early Caliphate. Cambridge University Press.
- Marx, K., & Engels, F. (1848). The Communist Manifesto. (Various publishers).
- Popovic, A. (1999). The Revolt of African Slaves in Iraq in the 3rd/9th Century. Markus Wiener Publishers.
- Rotberg, R. I. (2004). When States Fail: Causes and Consequences. Princeton University Press.
- Tabari, A. J. (1990). The History of al-Tabari (Ta’rikh al-rusul wa’l-muluk) (Vol. 15-30). SUNY Press.
- Theophanes. (1883). The Chronicle of Theophanes Confessor: Byzantine and Near Eastern History, AD 284–813 (C. Mango & R. Scott, Trans., 1997 ed.). Clarendon Press.
- Watt, W. M. (1973). The Formative Period of Islamic Thought. Oneworld Publications.
- Weber, M. (1978). Economy and Society: An Outline of Interpretive Sociology. University of California Press.
- Whittow, M. (1996). The Making of Orthodox Byzantium, 600–1025. University of California Press.
- Zuboff, S. (2019). The Age of Surveillance Capitalism: The Fight for a Human Future at the New Frontier of Power. PublicAffairs.
