
ইসলামের শাখা ও মতাদর্শসমূহ (Islamic schools and branches): বিশ্বাস ও যুক্তির ঐতিহাসিক আখ্যান
Table of Contents
- 1 ভূমিকা: চিন্তার বিবর্তন ও বিভাজনের মনস্তত্ত্ব
- 2 মতপার্থক্যের মনস্তত্ত্ব ও প্রেক্ষাপট: বিশ্বাস ও যুক্তির দ্বন্দ্বে এক নতুন সভ্যতার জন্ম
- 3 মহাসংকট ও প্রথম বিভাজন: শিয়া ও সুন্নি
- 4 প্রোটো-ধর্মতাত্ত্বিক আন্দোলন: তর্কের সূচনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংঘাত
- 5 কালাম শাস্ত্র ও যুক্তিবাদী লড়াই: দর্শনের আয়নায় বিশ্বাস
- 6 ফালাসিফা: গ্রিক জ্ঞানের সাথে ইসলামের অনন্ত মোলাকাত
- 6.1 আল-কিন্দি: আরবদের প্রথম দার্শনিক
- 6.2 আল-ফারাবি: দ্বিতীয় শিক্ষক ও আদর্শ রাষ্ট্রের স্বপ্ন
- 6.3 ইবনে সিনা: প্রাচ্যের সূর্য ও অস্তিত্বের রহস্য
- 6.4 ইখওয়ান আল-সাফা: রহস্যময় দার্শনিক সংঘ
- 6.5 আন্দালুসিয়ার আলো: ইবনে তোফায়েল ও ইবনে রুশদ
- 6.6 গাজ্জালির আঘাত ও ইবনে রুশদের জবাব
- 6.7 ইশরাকি ও হিকমাহ: দর্শনের মরমী বাঁক
- 7 আইন বা ফিকহী স্কুল: ব্যবহারিক জীবনের আইনি কাঠামো
- 8 সুফিবাদ: অন্তরের খোঁজ ও আধ্যাত্মিক পথ
- 9 আধুনিক আন্দোলন ও সংস্কারবাদ: আত্মজিজ্ঞাসা ও উত্তরণের পথ
- 10 প্রান্তিক মতবাদ, লৌকিক ইসলাম ও সমন্বয়বাদ
- 11 উপসংহার: বৈচিত্র্যের মানচিত্র ও ইতিহাসের আয়না
- 12 তথ্যসূত্র
ভূমিকা: চিন্তার বিবর্তন ও বিভাজনের মনস্তত্ত্ব
মানুষের মন বড়ই বিচিত্র। সে এক জায়গায় স্থির থাকতে পারে না। তাকে প্রশ্ন করতে হয়, উত্তর খুঁজতে হয়। নদীর জল যেমন এক জায়গায় আটকে থাকলে পচে যায়, মানুষের চিন্তাও তেমনি আটকে থাকলে স্থবির হয়ে পড়ে। তাই মানুষ ভাবে। আর যখনই কোনো একটি নির্দিষ্ট মতবাদ (Ideology) বা দর্শনের উত্তরে একাধিক ব্যাখ্যা চলে আসে, তখনই তৈরি হয় বিভাজন। পৃথিবীর যেকোনো বড় মতাদর্শের দিকে তাকালেই দেখবেন, তার ভেতরে অসংখ্য ডালপালা। ইসলাম ধর্মও এর ব্যতিক্রম নয়। বাইরে থেকে দেখলে মনে হতে পারে সব এক, সবাই একই কিতাব পড়ছে, একই দিকে ফিরে উপাসনা করছে। মনে হতে পারে, চৌদ্দশ বছর আগের একটি বিশ্বাস ব্যবস্থা বুঝি একেবারে নিটোল, অপরিবর্তনীয় এক শিলাখণ্ড। কিন্তু ভেতরে উঁকি দিলে দেখা যায় চিন্তার এক বিশাল ও জটিল জগত, যেখানে আছে হাজারো শাখা-প্রশাখা। সেখানে আছে তর্ক, আছে যুক্তি, আছে আবেগের আস্ফালন।
এই শাখাগুলো একদিনে তৈরি হয়নি। এগুলো তৈরি হয়েছে কখনো রাজনীতি থেকে, কখনো বা নিরেট বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই থেকে। কখনো মরুভূমির তপ্ত বালুতে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে, আবার কখনো বাগদাদের ঠান্ডা ঘরে বসে যুক্তির লড়াইয়ে জন্ম নিয়েছে নতুন নতুন দল। সপ্তম শতাব্দীর আরবের সমাজ ব্যবস্থা আর একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক রাষ্ট্রের বাস্তবতা এক নয়। এই দীর্ঘ সময়ের যাত্রাপথে মুসলিম সভ্যতাকে পাড়ি দিতে হয়েছে নানা চড়াই-উতরাই। যখনই নতুন কোনো সমস্যা সামনে এসেছে – হোক তা রাষ্ট্র পরিচালনা নিয়ে কিংবা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা নিয়ে – তখনই পণ্ডিতরা সমাধান খুঁজেছেন। আর এই সমাধানের পথ খুঁজতে গিয়েই জন্ম হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন চিন্তাধারা বা স্কুলের (Schools of Thought)।
আজকের এই লেখাটা কোনো ধর্মীয় বয়ান বা ওয়াজ নয়। এখানে কাউকে সঠিক বা বেঠিক প্রমাণ করার কোনো চেষ্টা নেই। আমরা বরং ইতিহাসের চশমা চোখে দিয়ে দেখার চেষ্টা করব, চৌদ্দশ বছর ধরে কীভাবে একটি বিশ্বাসের ভেতরে নানা স্কুল বা চিন্তাধারার জন্ম হলো। বিষয়টা খটমটে লাগতে পারে, মনে হতে পারে এসব জেনে কী হবে? কিন্তু ইতিহাসের ধুলো ঝেড়ে দেখলে দেখা যাবে – এগুলো আসলে মানুষের চিন্তার বিবর্তনেরই গল্প। মানুষ কীভাবে ঈশ্বরকে, সমাজকে এবং নিজেকে বুঝতে চেয়েছে – এ তারই এক দীর্ঘ আখ্যান।
শুরুতেই একটা বিষয় পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার। ইসলামে এই যে এত দল, উপদল – এগুলোকে প্রধানত দুটো বড় ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যায়। একটা হলো বিশ্বাস বা আকিদাগত (Theological Schools), আর অন্যটা হলো আইনকানুন বা ফিকহী (Schools of Jurisprudence)। অর্থাৎ, স্রষ্টার স্বরূপ কেমন, মানুষের ইচ্ছা স্বাধীন কি না – সেটা নিয়ে এক ধরনের বিতর্ক; আর নামাজে হাত কোথায় বাঁধব বা ব্যবসার নিয়ম কী হবে, উত্তরাধিকারের অঙ্ক কীভাবে মিলবে – সেটা নিয়ে আরেক ধরনের বিতর্ক। সাধারণ মানুষ অনেক সময় এই দুইয়ের পার্থক্য গুলিয়ে ফেলে। কিন্তু ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমাদের বুঝতে হবে, সুন্নি (Sunni) বা শিয়া (Shi’a) বিভাজনটা যতটা না ধর্মীয়, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক ইতিহাসের সাথে জড়িত। আবার মুতাজিলা (Mu’tazila) বা আশারি (Ash’ari) বিতর্কগুলো পুরোপুরি দর্শন ও যুক্তিনির্ভর।
নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর পর (৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ) মুসলিম সমাজ এক বিশাল শূন্যতার মুখোমুখি হলো। যতদিন তিনি ছিলেন, ওহী বা প্রত্যাদেশ (Revelation) আসত, যেকোনো সমস্যার সমাধান ওখানেই হয়ে যেত। কারো মনে কোনো সংশয় জাগলে সরাসরি জিজ্ঞেস করা যেত। কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার পর শুরু হলো আসল পরীক্ষা। এখন সিদ্ধান্ত কে নেবে? নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হলে তার সমাধান কোন পদ্ধতিতে হবে? আর এই ‘কে’ এবং ‘কিভাবে’ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই তৈরি হলো ইসলামের প্রথম বিভাজন। এটাকে অনেকে শুধুই ক্ষমতার লড়াই বলেন, কিন্তু এর গভীরে ছিল এক বিশাল সমাজতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন (Madelung, 1997)। আরবের গোত্রভিত্তিক সমাজ তখন সবেমাত্র একটি বৈশ্বিক সাম্রাজ্যে রূপ নিতে শুরু করেছে। পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যের পতনের ফলে নতুন নতুন সংস্কৃতি ও দর্শনের সাথে মুসলিমদের পরিচয় ঘটছে। এই নতুনের সাথে পুরনোর সংঘাত, আর ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকার বাসনা – সব মিলিয়ে তৈরি হলো এক অভূতপূর্ব বুদ্ধিবৃত্তিক আলোড়ন। এই আলোড়নের গল্পই আমরা আজ বলব।
মতপার্থক্যের মনস্তত্ত্ব ও প্রেক্ষাপট: বিশ্বাস ও যুক্তির দ্বন্দ্বে এক নতুন সভ্যতার জন্ম
শুরুতেই একটা বিষয় পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার। ইসলামে এই যে এত দল, উপদল – এগুলোকে প্রধানত দুটো বড় ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যায়। একটা হলো বিশ্বাস বা আকিদাগত (Theological Schools), আর অন্যটা হলো আইনকানুন বা ফিকহী (Schools of Jurisprudence)। মানুষের চিন্তার জগতটা বড়ই বিচিত্র। সেখানে একই সাথে বাস করে পরম বিশ্বাস এবং তীব্র যুক্তি। অর্থাৎ, স্রষ্টার স্বরূপ কেমন, মানুষের ইচ্ছা স্বাধীন কি না – সেটা নিয়ে এক ধরনের বিতর্ক; আর নামাজে হাত কোথায় বাঁধব বা ব্যবসার নিয়ম কী হবে – সেটা নিয়ে আরেক ধরনের বিতর্ক। সাধারণ দৃষ্টিতে মনে হতে পারে দুটোই এক, কিন্তু এর শেকড় অনেক গভীরে। প্রথমটি হলো তত্ত্বীয় ধর্মতত্ত্ব (Speculative Theology) বা কালাম শাস্ত্রের বিষয়, যা মানুষের বিশ্বাসের ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলে। আর দ্বিতীয়টি হলো ব্যবহারিক জীবন বা অর্থোপ্রাক্সি (Orthopraxy), যেখানে দৈনন্দিন জীবনের নিয়মকানুন মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। ইসলামের ইতিহাসে দেখা গেছে, মানুষ যখনই কোনো জাগতিক সমস্যার সমাধান খুঁজতে গেছে, তখনই অজান্তেই সে জড়িয়ে পড়েছে এক গভীর দার্শনিক জালে। এই যে বিভাজন, এটা কেবল ধর্মীয় বিধানের পার্থক্য নয়, বরং এটি মানুষের মনস্তাত্ত্বিক গঠনের ভিন্নতারই এক প্রতিফলন। কেউ জন্মগতভাবে যুক্তিবাদী, কেউ বা ভাবুক, আবার কেউ নিরেট আক্ষরিকতায় বিশ্বাসী। এই মানসিক ভিন্নতাই কালক্রমে তৈরি করেছে ভিন্ন ভিন্ন স্কুল বা মাযহাব।
নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর পর (৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ) মুসলিম সমাজ এক বিশাল এবং আকস্মিক শূন্যতার মুখোমুখি হলো। এই শূন্যতা কেবল নেতৃত্বের ছিল না, ছিল এক গভীর অস্তিত্বের সংকট। যতদিন তিনি ছিলেন, ওহী বা প্রত্যাদেশ (Revelation) আসত, যেকোনো সমস্যার সমাধান ওখানেই হয়ে যেত। কারো মনে কোনো সংশয় জাগলে সরাসরি জিজ্ঞেস করা যেত। সেখানে ‘ভুল’ হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না, কারণ ওহী এসে সেই ভুল শুধরে দিত। কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার পর শুরু হলো আসল পরীক্ষা। ওহীর দরজা চিরতরের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। এখন সিদ্ধান্ত কে নেবে? নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হলে তার সমাধান কোন পদ্ধতিতে হবে? আর ভূমিকা যেমনটা উল্লেখ করলাম, এই ‘কে’ এবং ‘কিভাবে’ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই তৈরি হলো ইসলামের প্রথম বিভাজন। এটাকে অনেকে শুধুই ক্ষমতার লড়াই বলেন, কিন্তু এর গভীরে ছিল এক বিশাল সমাজতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন (Madelung, 1997)। এই সময়টাকে বলা যেতে পারে ক্যারিশম্যাটিক কর্তৃত্ব (Charismatic Authority) থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বা আইনি-যৌক্তিক কর্তৃত্ব (Legal-Rational Authority)-তে রূপান্তরের এক যন্ত্রণাদায়ক কাল। নবীর ব্যক্তিগত উপস্থিতি যে ঐক্য ধরে রেখেছিল, তার অবর্তমানে সেই ঐক্যের সূত্র খুঁজতে গিয়েই মানুষ ভিন্ন ভিন্ন মতের দিকে ধাবিত হলো।
সামাজিক বিবর্তন ও বুদ্ধিবৃত্তিক অভিঘাত
আরবের গোত্রভিত্তিক সমাজ তখন সবেমাত্র একটি বৈশ্বিক সাম্রাজ্যে রূপ নিতে শুরু করেছে। মদিনার খেজুর বাগানের ছায়াঘেরা পরিবেশ থেকে মুসলিমরা হঠাৎ করেই গিয়ে পড়ল দামেস্ক, বাগদাদ আর মিশরের মতো প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্রগুলোতে। পারস্যের সাসানীয় সাম্রাজ্যের পতন ও পূর্ব রোমান বা বাইজানাইন সাম্রাজ্যের দুর্বলতার ফলে নতুন নতুন সংস্কৃতি ও দর্শনের সাথে মুসলিমদের পরিচয় ঘটছে। এই নতুনের সাথে পুরনোর সংঘাত, আর ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকার বাসনা – সব মিলিয়ে তৈরি হলো এক অভূতপূর্ব বুদ্ধিবৃত্তিক আলোড়ন। আমরা এই আর্টিকেলে ধাপে ধাপে সেই বিবর্তনের দিকে যাব। দেখব সুন্নি ও শিয়াদের মূল পার্থক্য, জানব মুতাজিলাদের যুক্তিবাদ সম্পর্কে, আর উঁকি দেব সুফিদের মরমী জগতে। কিন্তু তার আগে বুঝতে হবে সেই সময়ের মানুষের মনের অবস্থা। মরুভূমির বেদুইনরা ছিল সরল, তাদের ধর্মবোধ ছিল সাদা-কালো। কিন্তু যখনই তারা পারস্যের দ্বৈতবাদ (Dualism) কিংবা গ্রিসের হেলেনিস্টিক দর্শন (Hellenistic Philosophy)-এর মুখোমুখি হলো, তখন তাদের মনে উদয় হলো হাজারো প্রশ্ন। “ঈশ্বর যদি সব জানেন, তবে মন্দের সৃষ্টি কে করল?” কিংবা “কুরআন কি ঈশ্বরের মতোই অনাদি?” – এই প্রশ্নগুলো মরুভূমির বালুতে কখনো ওঠেনি, কিন্তু নগরজীবনের জটিলতায় এগুলোই হয়ে উঠল প্রধান আলোচ্য বিষয়।
সাংস্কৃতিক সংকরায়ন (Cultural Syncretism) এবং বুদ্ধিবৃত্তিক আদান-প্রদান ছিল এই বিভাজনের অন্যতম বড় অনুঘটক। ইসলাম যখন আরব উপদ্বীপের বাইরে ছড়িয়ে পড়ল, তখন সদ্য মুসলিম হওয়া অনারব জনগোষ্ঠী বা মাওয়ালি (Mawali)-রা তাদের সাথে করে নিয়ে এলো হাজার বছরের পুরনো সব দার্শনিক চিন্তা। একজন পারসিক বা একজন গ্রিক বংশোদ্ভূত মুসলিম যখন কুরআন পড়ছেন, তখন তার বোঝার ভঙ্গি আর একজন মক্কার কুরাইশ বংশোদ্ভূত সাহাবীর বোঝার ভঙ্গি এক ছিল না। এই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি বা জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিন্নতা (Epistemological Divergence) জন্ম দিল আকিদার নানা স্কুল। হানাফি ফিকহে যে যুক্তির প্রাধান্য দেখা যায়, তার পেছনে ইরাকের কুফা নগরীর বৌদ্ধিক পরিবেশের বিশাল প্রভাব ছিল। আবার মালিকি মাযহাবে যে মদিনার প্রথার ওপর জোর দেওয়া হয়, তা ছিল সেই অঞ্চলের রক্ষণশীল মানসিকতার প্রতিফলন। অর্থাৎ, ভৌগোলিক অবস্থান এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশ মানুষের ধর্মীয় ব্যাখ্যাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে (Lapidus, 2002)।
পবিত্র গ্রন্থের ব্যাখ্যা ও ভাষাতাত্ত্বিক জটিলতা
ধর্মীয় বিভাজনের আরেকটি বড় মনস্তাত্ত্বিক কারণ ছিল কুরআনকে ব্যাখ্যার ভিন্নতা। কুরআনের আয়াতগুলোকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়: মুহকামাত (Muhkamat) বা সুস্পষ্ট আয়াত এবং মুতাশাবিহাত (Mutashabihat) বা রূপক ও অস্পষ্ট আয়াত। সুস্পষ্ট আয়াতগুলো নিয়ে কারো কোনো দ্বিমত ছিল না। কিন্তু যে আয়াতগুলোতে আল্লাহ রূপক অর্থে কথা বলেছেন – যেমন “আল্লাহর হাত তাদের হাতের ওপর” – সেগুলো নিয়েই শুরু হলো বিপত্তি। একদল মানুষ, যারা আক্ষরিকতাবাদী (Literalist), তারা বলল, “আল্লাহ বলেছেন হাত আছে, মানে হাত আছে। এখানে কোনো প্রশ্ন চলবে না।” এদের মনস্তত্ত্ব হলো সরল বিশ্বাস এবং ওহীর প্রতি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। অন্যদিকে একদল মানুষ, যারা যুক্তিবাদী (Rationalist), তারা বলল, “আল্লাহর হাত থাকা মানে তো তিনি মানুষের মতো হয়ে গেলেন। এটা তো হতে পারে না। এর মানে নিশ্চয়ই আল্লাহর ক্ষমতা।” এই যে শব্দের পেছনের অর্থ খোঁজার প্রচেষ্টা, বা তাকবিল (Allegorical Interpretation), এটিই মুসলিম মানসজগতকে চিরস্থায়ীভাবে বিভক্ত করে দিল।
এই ব্যাখ্যার লড়াই শুধু পণ্ডিত্য দেখানোর জন্য ছিল না, এর সাথে জড়িয়ে ছিল রাজনৈতিক বৈধতা। উমাইয়া শাসকরা যখন বলল, “আমরা যা করছি তা আল্লাহর ইচ্ছাতেই করছি, আমাদের কোনো দোষ নেই” – তখন তারা আসলে জবরিয়া (Jabriya) বা অদৃষ্টবাদী মতবাদকে ব্যবহার করছিল নিজেদের স্বৈরাচারী শাসনকে জায়েজ বা ন্যায্য করার জন্য। তাদের মনস্তত্ত্ব ছিল জনগণকে এটা বোঝানো যে, শাসকের বিরুদ্ধে যাওয়া মানে আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়া। এর ঠিক বিপরীতে দাঁড়িয়ে যারা বলল, “না, মানুষ স্বাধীন, সে তার কর্মের জন্য দায়ী” – সেই কদরিয়া (Qadariya) বা স্বাধীন ইচ্ছায় বিশ্বাসী দলটির উত্থান ছিল আসলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবাদ। এখানে আমরা দেখি, ধর্মতত্ত্ব বা আকিদা কেবল পরকালের মুক্তির বিষয় নয়, বরং এটি ইহকালের রাজনীতি ও সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে (Watt, 1973)। মানুষের মনস্তত্ত্বে তখন এক দ্বন্দ্ব কাজ করছিল – একদিকে শাসকের প্রতি আনুগত্যের ঐতিহ্যগত দায়বদ্ধতা, অন্যদিকে ন্যায়বিচারের প্রতি সহজাত আকাঙ্ক্ষা। এই দ্বন্দ্বই জন্ম দিয়েছে ইসলামের প্রাথমিক রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দলগুলোর।
সত্যের একচ্ছত্র দাবি ও পরমত অসহিষ্ণুতা
মতপার্থক্যের আরেকটি গভীর মনস্তাত্ত্বিক দিক হলো সত্যের একচ্ছত্র দাবি (Exclusive Truth Claim)। প্রতিটি দল মনে করতে শুরু করল যে, তারাই কেবল সঠিক পথের পথিক, আর বাকিরা সবাই পথভ্রষ্ট। এই মানসিকতা থেকেই জন্ম নিল তাকফির (Takfir) বা অন্যকে কাফির ঘোষণা করার প্রবণতা। বিশেষ করে খারিজী (Kharijites)-দের মতো দলগুলো মনে করত, সত্য কেবল একটিই হতে পারে এবং তা সাদা-কালো। তাদের মনস্তত্ত্বে ধূসর কোনো জায়গার অস্তিত্ব ছিল না। কেউ যদি পাপ করে, সে আর মুসলিম থাকে না – এই চরমপন্থা ছিল আসলে এক ধরনের গভীর নিরাপত্তাহীনতা ও পবিত্রতা রক্ষার তীব্র আকাঙ্ক্ষার ফসল। তারা মনে করত, সমাজকে পবিত্র রাখতে হলে পাপীকে সমাজ থেকে বা পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দিতে হবে। এই যে ‘শুদ্ধতম ইসলাম’ পালনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা, এটি অনেক সময় মানুষকে সহনশীলতা থেকে দূরে ঠেলে দেয়। অথচ, উল্টো দিকে মুরজিয়া (Murji’a) মতবাদ আমাদের দেখায় মানুষের মনের আরেকটি দিক – আশা এবং বিচারের ভার স্রষ্টার ওপর ছেড়ে দেওয়ার মানসিক প্রশান্তি। তারা যখন বলল, “কে মুমিন আর কে কাফির, সেই বিচার আমরা করব না, আল্লাহ করবেন” – তখন তারা সমাজে এক ধরনের স্থিতিশীলতা ও সহনশীলতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছিল।
এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েই বিকাশ লাভ করেছে ইলমুল কালাম (Scholastic Theology)। মুসলিম দার্শনিকরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, শুধু বিশ্বাস দিয়ে বাইরের জগতকে মোকাবেলা করা যাবে না। খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্মতাত্ত্বিকরা এবং নাস্তিক দার্শনিকরা যখন ইসলামের মূল ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলছিল, তখন মুসলিমরা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করল অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিদ্যা বা লজিক (Logic)-কে। কিন্তু সমস্যা হলো, ধর্মকে যখনই যুক্তির ছাঁচে ফেলা হয়, তখন তা আর সবার কাছে এক থাকে না। যুক্তি একেকজনকে একেক সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেয়। ইমাম গাজ্জালি (Ghazali)-র বিখ্যাত বই The Incoherence of the Philosophers বা তাহাফুত আল-ফালাসিফা ছিল এই অতিরিক্ত যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে এক বিশাল মনস্তাত্ত্বিক ও দার্শনিক আঘাত। তিনি দেখালেন, শুধু যুক্তি দিয়ে স্রষ্টাকে পাওয়া যায় না, এর জন্য প্রয়োজন অন্তরের উপলব্ধি বা কাশফ (Intuition)। এই বোধ থেকেই আবার শক্ত ভিত্তি পেল সুফিবাদ। অর্থাৎ, মানুষের মন যখন যুক্তির শুষ্কতায় ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন সে আধ্যাত্মিকতার রসে ভিজতে চায়। ইসলামের ইতিহাসে এই যুক্তি বনাম আবেগের দোলাচল বারবার ফিরে এসেছে এবং নতুন নতুন মতপথের জন্ম দিয়েছে (Rahman, 1979)।
পরিশেষে, এই বিভাজন বা মতপার্থক্যকে কেবল নেতিবাচক হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটি প্রমাণ করে যে, মুসলিম সমাজ কোনো স্থবির সমাজ ছিল না। তারা প্রশ্ন করতে জানত, তারা ভাবতে জানত। ইজতিহাদ (Independent Reasoning) বা স্বাধীন গবেষণার যে দরজা খোলা ছিল, তা মানুষকে নতুন নতুন পরিস্থিতিতে ধর্মকে নতুন করে বোঝার সুযোগ করে দিয়েছে। আজকের দিনে আমরা যে মাযহাব বা ফেরকাগুলো দেখি, এগুলো সেই হাজার বছরের পুরনো বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের একেকটি ফসিল বা স্মারক। এই স্মারকগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সত্যের সন্ধান কোনো সহজ পথ নয়; এটি এক দীর্ঘ ও কণ্টকাকীর্ণ যাত্রা, যেখানে মানুষের মনস্তত্ত্ব, রাজনীতি এবং সমাজ – সবই একাকার হয়ে আছে।
মহাসংকট ও প্রথম বিভাজন: শিয়া ও সুন্নি
ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, ইসলামের প্রথম বড় বিভাজনটা কোনো ধর্মীয় মাসআলা বা সূক্ষ্ম ধর্মতত্ত্ব নিয়ে হয়নি, হয়েছিল নিরেট রাজনীতি বা নেতৃত্ব (Leadership) নিয়ে। মানুষের স্বভাবই হলো নেতার খোঁজ করা। নবী মুহাম্মদ যখন ছিলেন, তখন তিনিই ছিলেন একাধারে রাষ্ট্রনায়ক, সেনাপতি এবং আত্মিক পথপ্রদর্শক। কিন্তু ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যুর পর মুসলিম সমাজ এক বিশাল শূন্যতার মুখোমুখি হলো। প্রশ্নটা ছিল খুব সরল অথচ ভয়ঙ্কর জটিল – নবীর পর মুসলিম উম্মাহর নেতা বা খলিফা (Caliph) কে হবেন? এই একটি প্রশ্নকে কেন্দ্র করেই ধুলো ওড়া আরবের ইতিহাসে এমন এক ফাটল তৈরি হলো, যা চৌদ্দশ বছর পরেও জোড়া লাগেনি। এই বিভাজনকে কেবল ক্ষমতার লড়াই বললে ভুল হবে; এর পেছনে ছিল দুটি ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বদর্শন। একদল মনে করল, নবুওয়াত শেষ হয়ে গেছে, এখন দরকার একজন যোগ্য প্রশাসক যিনি সমাজকে পরিচালনা করবেন। আরেকদল মনে করল, নবুওয়াত শেষ হলেও মানুষের আত্মিক গাইডেন্সের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি, তাই এমন একজনকে দরকার যিনি খোদ নবীর রক্ত ও জ্ঞানের ধারক। এই দুই চিন্তাধারার সংঘর্ষই জন্ম দিল ইসলামের প্রধান দুটি শাখা – সুন্নি ও শিয়া।
সাকিফার বিতর্ক ও সুন্নি মতবাদ
নবীর মৃত্যুর পরপরই মদিনার সাকিফা বনি সাঈদা নামক স্থানে আনসার সাহাবীরা সমবেত হলেন পরবর্তী নেতা নির্বাচনের জন্য। সেখানে দীর্ঘ তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনার পর একদল সাহাবী মনে করলেন, নবীর অবর্তমানে নেতৃত্ব নির্বাচনের অধিকার জনগণের বা বিশিষ্ট সাহাবীদের পরামর্শের বা শূরা (Consultation)-এর হাতে থাকা উচিত। আরবের প্রাচীন গোত্রীয় প্রথা অনুযায়ী বয়োজ্যেষ্ঠ, অভিজ্ঞ এবং বিচক্ষণ কাউকেই নেতা মানা হতো। তাদের যুক্তি ছিল, নবী যেহেতু স্পষ্ট করে কাউকে নাম ধরে তার উত্তরাধিকারী বা খলিফা (Caliph) ঘোষণা করে যাননি, তাই উম্মাহর ঐকমত্য বা ইজমা (Consensus)-এর ভিত্তিতেই নেতা নির্বাচন করতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় আবু বকরকে খলিফা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। যারা এই নির্বাচন মেনে নিলেন এবং বিশ্বাস করলেন যে, উম্মাহর ঐক্যই আসল এবং যোগ্যতাই নেতৃত্বের মাপকাঠি, তারাই কালক্রমে ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত’ বা সংক্ষেপে সুন্নি (Sunni) হিসেবে পরিচিতি পান।
‘সুন্নাহ’ মানে হলো রীতি বা পথ, আর ‘জামায়াত’ মানে হলো দল বা সমষ্টি। সুন্নিদের মূল দর্শনের ভিত্তি হলো – নবী মুহাম্মদ ছিলেন শেষ নবী, তার পরে আর কোনো ওহী আসবে না। সুতরাং, পরবর্তী নেতারা হবেন মূলত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অভিভাবক। তারা ধর্মের রক্ষক হবেন ঠিকই, কিন্তু তারা কোনো নতুন ধর্মীয় বিধান তৈরি করতে পারবেন না বা তাদের কোনো অলৌকিক ক্ষমতা থাকবে না। সুন্নিরা মনে করেন, খলিফাকে নবীর বংশধর বা আহলে বাইত (Ahl al-Bayt)-এর সদস্য হতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। কুরাইশ বংশের যোগ্য যে কেউ নেতা হতে পারেন, যদি উম্মাহ তাকে মেনে নেয়। সুন্নি দর্শনে প্রথম চার খলিফাকে বলা হয় খোলাফায়ে রাশেদুন (Rightly Guided Caliphs)। তাদের শাসনকালকে সুন্নিরা ইসলামের স্বর্ণযুগ হিসেবে দেখে। বর্তমান বিশ্বের প্রায় ৮৫-৯০ শতাংশ মুসলিম এই ধারার অনুসারী (Pew Research Center, 2009)। সুন্নি ইসলামের এই গণতান্ত্রিক (যদিও আধুনিক অর্থে নয়) এবং বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গিই পরবর্তীতে উমাইয়া এবং আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেছিল, যেখানে শাসকের বৈধতা আসত জনগণের আনুগত্য এবং শরিয়ত রক্ষার শপথ থেকে।
গাদির খুম ও শিয়া আকিদা
অন্যদিকে, আরেকটা ছোট দল এই নির্বাচন প্রক্রিয়া বা সাকিফার সিদ্ধান্তকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। তারা মনে করত, নবীর পরিবারের বা ‘আহলে বাইত’ (People of the House)-এর রক্ত যার শরীরে, নেতৃত্ব তারই প্রাপ্য। তাদের যুক্তি ছিল, আল্লাহ যেমন নবীকে মনোনীত করেছেন, তেমনি নবীর উত্তরাধিকারী বা ইমাম (Imam)-কেও আল্লাহই মনোনীত করবেন। এটি মানুষের ভোটের বা পছন্দের বিষয় হতে পারে না। তারা বিশ্বাস করতেন, নবী মৃত্যুর কিছুদিন আগে বিদায় হজ্জ থেকে ফেরার পথে গাদির খুম (Ghadir Khumm) নামক স্থানে হাজার হাজার সাহাবীর সামনে আলী -এর হাত উঁচিয়ে ঘোষণা করেছিলেন, “আমি যার মাওলা, আলীও তার মাওলা।” শিয়াদের মতে, এই ঘোষণার মাধ্যমে নবী আলী -কে নিজের উত্তরাধিকারী বা ওয়াসি (Executor) হিসেবে মনোনীত করে গিয়েছিলেন। এই দলটির নাম হলো ‘শিয়াতু আলী’ বা আলীর অনুসারী, যা সংক্ষেপে শিয়া (Shi’a) নামে পরিচিত।
শিয়াদের মূল কনসেপ্ট হলো ‘ইমামত’ (Imamate)। এটি সুন্নিদের ‘খিলাফত‘ ধারণা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সুন্নিদের কাছে খলিফা একজন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতা, তিনি ভুল করতে পারেন, পাপ করতে পারেন এবং তার ভুল শুধরানো যায়। এমনকি যোগ্যতর কেউ থাকলে তাকে অপসারণও করা যায়। কিন্তু শিয়াদের কাছে ইমাম শুধু নেতা নন, তিনি এক পবিত্র সত্তা। তাদের মতে, ইমাম হলেন মাসুম (Infallible) বা নিষ্পাপ। তিনি সকল প্রকার ছোট-বড় পাপ ও ভুলের ঊর্ধ্বে। ইমামের কাছে থাকে কুরআনের গোপন বা বাতেনি (Esoteric) জ্ঞান, যা সাধারণ মানুষের বুদ্ধির অগম্য। শিয়া ধর্মতত্ত্ব অনুযায়ী, পৃথিবী কখনোই ইমাম শূন্য থাকতে পারে না। যদি ইমাম না থাকেন, তবে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে, কারণ ইমাম হলেন আল্লাহর ও মানবতার মাঝখানের যোগসূত্র বা হুজ্জাহ (Proof of God)। এই বিশ্বাস থেকেই শিয়ারা মনে করে, আলী -এর অধিকার হরণ করা হয়েছে এবং প্রথম তিন খলিফার শাসন ছিল অবৈধ বা অনধিকার চর্চা। কারবালার প্রান্তরে ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে ইমাম হুসাইন -এর শাহাদাত বরণ শিয়া মানসজগতে এক চিরস্থায়ী শোক ও বিপ্লবের জন্ম দেয়, যা তাদের পরিচয়কে রাজনৈতিক দল থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্মীয় মাযহাবে রূপান্তরিত করে (Jafri, 1979)।
ইমামতের ধারা ও উপদলের উদ্ভব
কালক্রমে শিয়াদের মধ্যেও নানা বিভাজন তৈরি হয়। এই বিভাজনগুলো মূলত তৈরি হয়েছিল পরবর্তী ইমাম কে হবেন – সেই উত্তরাধিকারের প্রশ্নে। যখনই কোনো ইমাম মারা যেতেন এবং তার একাধিক যোগ্য সন্তান থাকত, তখনই অনুসারীরা বিভক্ত হয়ে পড়ত। এর ফলে শিয়া ইসলামের ভেতরেই তিনটি প্রধান এবং শক্তিশালী ধারার জন্ম হয়।
১. ইতনাশারি বা টুয়েলভার্স (Twelvers):
শিয়াদের মধ্যে এরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং বর্তমানে সবচেয়ে প্রভাবশালী গোষ্ঠী। আধুনিক ইরান, ইরাক, লেবানন, বাহরাইন বা আজারবাইজানে এদের দেখা মেলে। এরা বিশ্বাস করে ১২ জন ইমামে। এই ধারার শুরু হয় আলী-কে দিয়ে এবং শেষ হয় দ্বাদশ ইমাম মুহাম্মদ আল-মাহদির মাধ্যমে। তাদের ইতিহাস বড়ই করুণ ও রহস্যময়। তাদের একাদশ ইমাম হাসান আল-আসকারি ৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে মারা যাওয়ার পর তার শিশুপুত্র ইমাম মাহদি লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। টুয়েলভার শিয়াদের বিশ্বাস মতে, শেষ ইমাম মাহদি মারা যাননি, বরং তিনি আল্লাহর হুকুমে বর্তমানে অদৃশ্য বা গাইব (Occultation) অবস্থায় আছেন। এই অদৃশ্য থাকাকে তারা দুই ভাগে ভাগ করে: গাইবা আল-সুগরা (Minor Occultation) এবং গাইবা আল-কুবরা (Major Occultation)। তারা বিশ্বাস করে, পৃথিবী যখন অন্যায় ও অত্যাচারে ভরে যাবে, তখন তিনি ‘মাহদি’ বা ত্রাণকর্তা হিসেবে ফিরে আসবেন এবং পৃথিবীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন (Momen, 1985)। এই ফিরে আসার অপেক্ষাই টুয়েলভার শিয়াদের ধর্মীয় জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। ইমামের অনুপস্থিতিতে তারা ধর্মীয় ও সামাজিক নির্দেশনার জন্য সর্বোচ্চ আলেম বা মারজা-ই-তাকলিদ (Source of Emulation)-এর অনুসরণ করে, যেমন ইরানের আয়াতুল্লাহরা।
২. ইসমাইলি (Ismailis):
এদের বলা হয় সেভেনার্স (Seveners)। শিয়া ইতিহাসের এক মোড় ঘোরানো বিভাজন এটি। ষষ্ঠ ইমাম জাফর আল-সাদিক ছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক বিশাল সাগর। তার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার নিয়ে বিরোধ বাঁধে। টুয়েলভাররা মনে করে তার ছোট ছেলে মুসা আল-কাজিম হলেন সপ্তম ইমাম। কিন্তু একদল অনুসারী বলল, ইমাম জাফরের বড় ছেলে ইসমাইল ইবনে জাফরই প্রকৃত ইমাম, কারণ বড় ছেলেই বাবার উত্তরাধিকারী হন। যদিও ইসমাইল তার বাবার জীবদ্দশাতেই মারা গিয়েছিলেন (বা মতান্তরে আত্মগোপন করেছিলেন), তার অনুসারীরা তাকেই সপ্তম ইমাম মানল এবং এরপর তার বংশধরদের ইমাম হিসেবে মেনে নিল। বর্তমানে প্রিন্স করিম আগা খান (Aga Khan IV) এই সম্প্রদায়ের নিজারি শাখার ৪৯তম বংশানুক্রমিক ও বর্তমান ইমাম বা হাজির ইমাম (Living Imam)। ইসমাইলিরা দর্শনের দিক থেকে বেশ গূঢ় বা বাতেনি (Esoteric) জ্ঞানের ওপর জোর দেয়। তারা মনে করে কুরআনের প্রতিটি আয়াতের একটি প্রকাশ্য অর্থ আছে, আর একটি গোপন অর্থ আছে যা কেবল ইমাম জানেন। ইতিহাসে এদের অবদান প্রচুর; বিশেষ করে মিশরের ফাতেমি খেলাফত (Fatimid Caliphate) ছিল ইসমাইলিদের স্বর্ণযুগ, যখন তারা কায়রো নগরী ও আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিল। জ্ঞানবিজ্ঞান, দর্শন এবং নব্য-প্লেটোনিক চিন্তাধারার সাথে ইসলামের সমন্বয়ে ইসমাইলিদের ভূমিকা অনস্বীকার্য (Daftary, 1990)।
৩. জাইদি (Zaydis):
ইয়েমেনে এদের প্রধান অবস্থান। শিয়াদের মধ্যে এরা সুন্নিদের চিন্তাধারার সবচেয়ে কাছাকাছি, যে কারণে এদের অনেক সময় ‘পঞ্চম মাযহাব’ হিসেবেও গণ্য করা হয়। এদের বলা হয় ফাইভার্স (Fivers)। চতুর্থ ইমাম জয়নুল আবেদিনের পর তার ছেলে জায়েদ বিন আলীকে তারা পঞ্চম ইমাম হিসেবে মানে। জায়েদ বিন আলী ছিলেন একজন বিপ্লবী এবং উমাইয়া দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তিনি তলোয়ার ধরেছিলেন এবং শহীদ হয়েছিলেন। জাইদিদের দর্শন খুব প্র্যাকটিক্যাল বা বাস্তববাদী। তারা টুয়েলভার বা ইসমাইলিদের মতো ইমামের অলৌকিক ক্ষমতায়, নিষ্পাপ হওয়ায় বা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ায় বিশ্বাস করে না। তাদের মতে, ইমাম হতে হলে তাকে কেবল নবীর বংশধর (ফাতেমা রা.-এর রক্ত) হলেই চলবে না, তাকে হতে হবে জ্ঞানী, ধর্মপরায়ণ এবং অবশ্যই তাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তলোয়ার ধরে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে হবে। অর্থাৎ, ঘরে বসে থাকা কোনো ব্যক্তি জাইদিদের মতে ইমাম হতে পারেন না। এই বিপ্লবী চরিত্রের কারণেই জাইদিরা ঐতিহাসিকভাবে সবসময়ই রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিল। তাদের ফিকহ বা আইনশাস্ত্র সুন্নি হানাফি মাযহাবের সাথে বেশ সাদৃশ্যপূর্ণ।
এই বিভাজনগুলো আমাদের দেখায় যে, ইসলামের শুরুর দিকের ইতিহাস ছিল কতটা গতিশীল। শিয়া ও সুন্নি – উভয় পক্ষই নিজেদের দাবির সপক্ষে কুরআন ও হাদিস থেকে দলিল পেশ করে। সুন্নিরা যেখানে ঐক্যের ওপর জোর দিয়েছে, শিয়ারা সেখানে জোর দিয়েছে রক্তের সম্পর্ক ও ঐশ্বরিক মনোনয়নের ওপর। সুন্নিরা ইতিহাসকে দেখেছে বাস্তবতার নিরিখে, যেখানে খলিফা হলেন একজন মানুষ এবং শাসক। আর শিয়ারা ইতিহাসকে দেখেছে আধ্যাত্মিকতার নিরিখে, যেখানে ইমাম হলেন সত্যের মূর্ত প্রতীক। এই দুই ধারার দ্বন্দ্ব ও সহাবস্থানই গত চৌদ্দশ বছর ধরে মুসলিম বিশ্বের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ধর্মতত্ত্বকে আকার দিয়েছে। কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনা শিয়াদের শিখিয়েছে ত্যাগের মহিমা, আর খিলাফতের বিস্তার সুন্নিদের দিয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা। আধুনিক যুগেও মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতি বুঝতে হলে সপ্তম শতাব্দীর এই গোড়াপত্তনের ইতিহাস বোঝা অত্যন্ত জরুরি (Hazelton, 2009)।
প্রোটো-ধর্মতাত্ত্বিক আন্দোলন: তর্কের সূচনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংঘাত
শিয়া-সুন্নি বিভাজন যখন মুসলিম উম্মাহর রাজনৈতিক মেরুদণ্ডকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলছে, ঠিক সেই সময়েই ইতিহাসের মঞ্চে আবির্ভূত হলো এক নতুন ধরণের লড়াই। এই লড়াই তলোয়ারের চেয়েও ধারালো – এটি ছিল শব্দের লড়াই, বিশ্বাসের লড়াই। উমাইয়া শাসনামলে (৬৬১-৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ) মুসলিম সমাজ যখন ভৌগোলিকভাবে বিস্তৃত হচ্ছে এবং প্রশাসনিকভাবে জটিল হয়ে পড়ছে, তখন মানুষের মনে দানা বাঁধতে শুরু করল এমন সব প্রশ্ন, যা আগে কখনো ওঠেনি। আল্লাহ কি মানুষের সব কাজ আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছেন? পাপ করলে কি মানুষ মুসলিম থাকে? শাসকের অন্যায় মেনে নেওয়া কি ধর্মের অংশ? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়েই জন্ম হলো বেশ কিছু নতুন দলের। এদেরকে পূর্ণাঙ্গ মাযহাব বা স্কুল বলা কঠিন, বরং এদেরকে বলা হয় প্রোটো-ধর্মতাত্ত্বিক আন্দোলন (Proto-theological Movements) বা প্রাথমিক ধর্মতাত্ত্বিক আন্দোলন। এরা কোনো সুশৃঙ্খল একাডেমিক সিলেবাস ধরে তৈরি হয়নি, বরং নির্দিষ্ট কিছু জ্বলন্ত রাজনৈতিক ও দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই এদের আকস্মিক জন্ম হয়েছিল। ইতিহাসের এই অধ্যায়টি বড়ই কৌতুহলুদ্দীপক, কারণ এখানে আমরা দেখি কীভাবে রাজনীতি এবং ধর্মতত্ত্ব একে অপরের হাত ধরে হাঁটছে। কখনো শাসকরা ধর্মকে ব্যবহার করেছে নিজেদের গদি বাঁচাতে, আবার কখনো বিদ্রোহীরা ধর্মতত্ত্বকে ব্যবহার করেছে বিপ্লবের বারুদ হিসেবে।
খারিজী: ইতিহাসের প্রথম বিদ্রোহী ও পবিত্রতার সংকট
ইসলামের ইতিহাসের প্রথম এবং সম্ভবত সবচেয়ে উগ্র বিদ্রোহী দলটির নাম খারিজী (Kharijites)। তাদের উদ্ভবের প্রেক্ষাপটটি বড়ই নাটকীয় এবং রক্তাক্ত। ৬৫৭ খ্রিষ্টাব্দে সিফফিনের যুদ্ধে যখন চতুর্থ খলিফা আলী এবং সিরিয়ার গভর্নর মুয়াবিয়া -এর মধ্যে তুমুল লড়াই চলছে এবং মুয়াবিয়ার পরাজয় প্রায় নিশ্চিত, তখন মুয়াবিয়ার সৈন্যরা ধূর্ততার আশ্রয় নিয়ে বর্শার আগায় কুরআনের পাতা গেঁথে সন্ধির প্রস্তাব দিল। আলী দূরদর্শী ছিলেন, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এটি একটি ফাঁদ, কিন্তু তার দলের অনেকেই ভাবল কুরআনের আহ্বান অগ্রাহ্য করা যাবে না। অগত্যা আলী সালিশি বা মধ্যস্থতা (Arbitration) মেনে নিলেন। ঠিক এই মুহূর্তেই আলীর দলের ভেতর থেকে একদল লোক ক্ষিপ্ত হয়ে বেরিয়ে গেল। তাদের স্লোগান ছিল – “আল্লাহ ছাড়া কোনো ফয়সালাকারী নেই” বা লা হুকমা ইল্লা লিল্লাহ (No judgment but God’s)। তাদের যুক্তি ছিল সরল কিন্তু মারাত্মক – মানুষের সালিশ মানা মানে আল্লাহর বিধানকে অপমান করা এবং এটি স্পষ্ট কুফরি। তারা আলী এবং মুয়াবিয়া উভয়কেই কাফির ঘোষণা করে দলত্যাগ করল। আরবি ‘খারাজা’ মানে বেরিয়ে যাওয়া, সেখান থেকেই তাদের নাম হলো খারিজী।
খারিজীদের মানসিক গঠন ছিল অত্যন্ত কঠোর এবং আপোষহীন। তারা ছিল মরুভূমির রুক্ষতার প্রতীক। তাদের ধর্মতত্ত্বে ঈমান (Faith) এবং আমল (Deeds)-এর মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। তাদের লজিক খুব ভয়ঙ্কর – কেউ যদি কবীরা গুনাহ (Major Sin) করে, তবে সে আর মুসলিম থাকে না, সে মুরতাদ বা কাফির হয়ে যায় এবং তাকে হত্যা করা বৈধ। তাদের মতে, মুসলিম হতে হলে মানুষকে হতে হবে ফেরেশতার মতো নিষ্পাপ। একজন মুসলিম যদি মিথ্যা বলে বা ব্যভিচার করে, তবে সে চিরস্থায়ী জাহান্নামী। এই চরমপন্থী মতবাদের কারণে তারা মুসলিম সমাজের জন্য এক বিশাল আতঙ্কে পরিণত হলো। তারা মনে করত, খলিফা বা নেতা হওয়ার জন্য কুরাইশ বংশের হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। একজন কৃষ্ণাঙ্গ দাসও খলিফা হতে পারেন যদি তিনি পরহেজগার হন। কিন্তু সেই খলিফা যদি বিন্দুমাত্র ভুল করেন, তবে তাকে গদি থেকে নামিয়ে দেওয়া বা হত্যা করা ওয়াজিব। এই মতবাদের বশবর্তী হয়েই ইবনে মুলজাম নামক এক খারিজী আলীকে হত্যা করেছিল।
আধুনিক যুগে আমরা যে উগ্রবাদী বা জিহাদি গোষ্ঠীগুলোকে দেখি, যারা খুব সহজেই অন্য মুসলিমদের কাফির ঘোষণা করে বা বোমা মেরে মানুষ হত্যা করাকে জায়েজ মনে করে, গবেষকরা তাদের মতাদর্শের শেকড় এই আদি খারিজী চিন্তাধারার মধ্যে খুঁজে পান (Kenney, 2006)। খারিজীরা ছিল ইতিহাসের প্রথম তাকফিরি (Takfiri) গোষ্ঠী। তবে ইতিহাসের নির্মম পরিহাস হলো, তাদের এই উগ্রতার কারণেই মূলধারা থেকে তারা হারিয়ে গেছে। আদি উগ্র খারিজী দলগুলো (যেমন আজারিকা) এখন আর নেই, তবে তাদের একটি অত্যন্ত নমনীয়, উদার ও সহনশীল শাখা ইবাদি (Ibadi) বর্তমানে ওমানে এবং উত্তর আফ্রিকার কিছু অংশে টিকে আছে। ওমানের ইবাদিরা আদি খারিজীদের রাজনৈতিক মতবাদ ধরে রাখলেও, তাদের উগ্রতা বর্জন করেছে এবং তারা অন্যান্য মুসলিমদের কাফির মনে করে না।
মুরজিয়া: স্থগিতকরণ ও আশার বাণী
খারিজীদের এই রক্তক্ষয়ী বিচার ব্যবস্থার ঠিক বিপরীতে একদল লোক দাঁড়াল, যারা চাইল সমাজে শান্তি ফিরিয়ে আনতে। এদের নাম মুরজিয়া (Murji’a)। শব্দটি এসেছে আরবি ‘ইরজা’ থেকে, যার অর্থ পিছিয়ে দেওয়া বা স্থগিত রাখা (Postponement)। সেই উত্তাল সময়ে যখন মুসলমানরা একে অপরকে কাফির বলছে, তলোয়ার দিয়ে একে অপরের মুণ্ডু কাটছে, তখন মুরজিয়ারা নিয়ে এলো এক শীতল ও সহনশীল বার্তা। তারা বলল, “কে মুমিন আর কে কাফির, এই বিচার করার অধিকার আমাদের নেই। মানুষের মনের খবর শুধু আল্লাহ জানেন। তাই আমরা এই বিচার পরকালের জন্য আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিলাম বা স্থগিত রাখলাম।” তাদের এই অবস্থান ছিল তৎকালীন সমাজের জন্য এক বিশাল স্বস্তি।
মুরজিয়াদের ধর্মতাত্ত্বিক ভিত্তি ছিল বেশ চমকপ্রদ। তারা বলল, ঈমান বা বিশ্বাস হলো অন্তরের বিষয়। বাহ্যিক কাজকর্ম বা আমল (Action) ঈমানের মূল অংশ নয়, বরং শাখা। তাই কেউ যদি অন্তরে আল্লাহ ও রাসূলকে বিশ্বাস করে কিন্তু কাজে পাপ করে (যেমন মদ পান করে বা নামাজ কাজা করে), তবুও সে মুসলিমই থাকে। তাকে ‘পাপী মুসলিম’ বা ফাসিক (Sinner) বলা যেতে পারে, কিন্তু কাফির বলা যাবে না। তার বিচার পরকালে আল্লাহ করবেন – চাইলে মাফ করবেন, চাইলে শাস্তি দেবেন। দুনিয়াতে তাকে কাফির বলে হত্যা করা যাবে না। এই দর্শনটি ইসলামের ইতিহাসে অন্তর্ভুক্তিবাদ (Inclusivism)-এর প্রথম পাঠ ছিল। তারা বিশ্বাস করত, যেখানে সন্দেহ আছে, সেখানে মানুষকে ঈমানের গণ্ডি থেকে বের না করে ভেতরে রাখাই উত্তম (Izutsu, 2006)।
তবে এই মতবাদের একটি বড় রাজনৈতিক উপযোগিতা ছিল, যা উমাইয়া শাসকরা লুফে নিয়েছিল। উমাইয়া খলিফারা অনেকেই ব্যক্তিগত জীবনে অধার্মিক ছিলেন এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় অনৈসলামিক কাজ করতেন। খারিজীরা তাদের বিরুদ্ধে তলোয়ার ধরেছিল। কিন্তু মুরজিয়া মতবাদ অনুযায়ী, শাসকরা পাপী হলেও যেহেতু তারা কালেমা পড়েছে, তাই তারা মুসলিম এবং তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে না। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় এবং গৃহযুদ্ধ এড়াতে এই মতবাদ বড় ভূমিকা রেখেছিল (Watt, 1973)। পরবর্তীতে ইমাম আবু হানিফা এই মুরজিয়া মতবাদের কিছু ইতিবাচক দিক (যেমন – পাপীকে কাফির না বলা) গ্রহণ করেছিলেন, যা সুন্নি আকিদার মূলভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য ফিকহ শাস্ত্রে তাকে অনেক সময় ‘মুরজিই আল-ফুকাহা’ বা ফকিহদের মধ্যে মুরজিয়া ভাবাপন্ন বলা হতো, যদিও তিনি রাজনৈতিক মুরজিয়া ছিলেন না।
কদরিয়া: স্বাধীন ইচ্ছা ও অন্যায়ের প্রতিবাদ
উমাইয়া শাসনের অন্যায্যতা যখন চরমে পৌঁছাল, তখন তারা নিজেদের কাজকে জায়েজ করার জন্য এক অদ্ভুত ধর্মতত্ত্ব প্রচার করতে লাগল। তারা বলত, “আমরা যা করছি, তা আল্লাহর ইচ্ছাতেই করছি। আল্লাহ কপালে লিখে রেখেছেন বলেই আমরা শাসক, আর তোমরা শাসিত। আমাদের অত্যাচার আসলে আল্লাহরই ফয়সালা।” এই ধরনের অদৃষ্টবাদী কথাবার্তা সচেতন মানুষদের বিবেকে আঘাত করল। এর বিরুদ্ধে যে বুদ্ধিবৃত্তিক দলটি প্রতিবাদী হয়ে উঠল, তারা ইতিহাসে কদরিয়া (Qadariya) নামে পরিচিত। এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার থাকা দরকার – এই কদরিয়া কোনো সুফি তরিকা (যেমন কাদেরিয়া তরিকা) নয়, বরং এটি একটি আদি ধর্মতাত্ত্বিক মতবাদ যা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা (Free Will) নিয়ে কথা বলত।
কদরিয়ারা বলল, “না, আল্লাহ মানুষকে পাপ কাজ করতে বাধ্য করেন না। মানুষ তার নিজের কাজের জন্য দায়ী। আল্লাহ মানুষকে ভালো ও মন্দ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা বা ইখতিয়ার দিয়েছেন। মানুষ নিজের কর্মের স্রষ্টা।” তাদের মতে, যদি আল্লাহই মানুষকে দিয়ে পাপ করান এবং পরে সেই পাপের জন্য মানুষকে জাহান্নামে শাস্তি দেন, তবে তা আল্লাহর ন্যায়বিচার বা আদল (Divine Justice)-এর পরিপন্থী হয়। আর আল্লাহ তো জালিম নন। তাই মানুষের কাজের দায়ভার মানুষের নিজের। মা’বাদ আল-জুহানি এবং গাইলান আল-দিমাশকি ছিলেন এই মতবাদের প্রবক্তা। তারা উমাইয়া শাসকদের মুখের ওপর বলেছিলেন যে, তাদের অত্যাচার আল্লাহর ইচ্ছা নয়, বরং তাদের নিজেদের শয়তানি। এটি ছিল স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী বুদ্ধিবৃত্তিক বিদ্রোহ। শাসকরা এই মতবাদকে ভয় পেত, কারণ মানুষ যদি বিশ্বাস করে যে তার ভাগ্য সে নিজে গড়তে পারে, তবে সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। একারণেই কদরিয়া নেতাদের অনেককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল।
জবরিয়া: অদৃষ্টবাদের চরম সীমা
কদরিয়াদের ঠিক উল্টো মেরুর লোক হলো জবরিয়া (Jabriya)। আরবি ‘জবর’ মানে বাধ্য করা বা জোর করা। এরা ছিল চরম অদৃষ্টবাদী (Fatalists)। এদের দর্শন ছিল মানুষের অস্তিত্ব ও ক্ষমতাকে পুরোপুরি অস্বীকার করা। এদের কথা হলো, মানুষ আসলে সুতার টানে চলা পুতুলের মতো। তার নিজস্ব কোনো ক্ষমতা, ইচ্ছা বা পছন্দ নেই। মানুষ যা করে, সবই আল্লাহ তাকে দিয়ে করান। বাতাসের তোড়ে গাছের পাতা যেমন নড়ে, মানুষের হাত-পা নড়াও তেমনি। মানুষ মনে করে সে নিজের ইচ্ছায় কাজ করছে, কিন্তু এটা তার ভ্রম। জাহম বিন সাফওয়ান ছিলেন এই মতের অন্যতম প্রবক্তা, যার নামানুসারে এদের অনেক সময় জাহমিয়া (Jahmiyya)-ও বলা হয়।
জবরিয়াদের এই দর্শন আপাতদৃষ্টিতে আল্লাহর সর্বময় ক্ষমতার স্বীকৃতি মনে হলেও, এর দার্শনিক সমস্যা ছিল গুরুতর। যদি মানুষের কোনো স্বাধীনতাই না থাকে, তবে জান্নাত বা জাহান্নামের অর্থ কী? আল্লাহ কেন নবী পাঠালেন? কেন কিতাব দিলেন? রোবটকে তো আর শাস্তি দেওয়া যায় না। জবরিয়ারা এসব প্রশ্নের উত্তরে বলত, আল্লাহর কাজের কারণ খোঁজার অধিকার মানুষের নেই। তাদের এই মতবাদ উমাইয়া রাজনীতির জন্য আশীর্বাদ ছিল। কারণ জনগণ যদি বিশ্বাস করে যে, শাসকের চাবুক আসলে আল্লাহরই হুকুম, তবে তারা আর বিদ্রোহ করবে না, বরং নীরবে সব সহ্য করে নেবে। এই মনস্তত্ত্ব মানুষকে নিষ্ক্রিয় এবং অলস করে দিয়েছিল।
এই চারটি দল – খারিজী, মুরজিয়া, কদরিয়া এবং জবরিয়া – ছিল ইসলামের ধর্মতত্ত্বের প্রাথমিক বা প্রোটো পর্যায়। এদের বিতর্কগুলো ছিল অনেকটা কাঁচা এবং আবেগনির্ভর। কিন্তু এদের তর্ক-বিতর্ক থেকেই মুসলিম মানসজগতে যুক্তির দুয়ার খুলে যায়। পরবর্তীতে যখন গ্রিক দর্শন আরবিতে অনুবাদ হলো, তখন এই কাঁচা বিতর্কগুলোই মুতাজিলা (Mu’tazila) এবং আশারি (Ash’ari)-দের মতো সুশৃঙ্খল এবং জটিল দার্শনিক স্কুলে রূপ নেয়। কদরিয়াদের ‘স্বাধীন ইচ্ছা’ এবং ‘ন্যায়বিচার’-এর ধারণা মুতাজিলারা গ্রহণ করে, আর মুরজিয়াদের ‘ঈমানের সংজ্ঞা’ সুন্নিরা গ্রহণ করে। ইতিহাসের এই বাঁকগুলো আমাদের দেখায় যে, ধর্ম কোনো স্থির জলাশয় নয়, বরং এটি এক প্রবহমান নদী যা সময়ের সাথে সাথে মানুষের চিন্তার সাথে মিথস্ক্রিয়া করে নতুন পথে মোড় নেয়।
কালাম শাস্ত্র ও যুক্তিবাদী লড়াই: দর্শনের আয়নায় বিশ্বাস
সময় বড় অদ্ভুত জাদুকর। এটি মানুষকে কখনো থামতে দেয় না। সপ্তম শতাব্দীর শেষে এবং অষ্টম শতাব্দীর শুরুতে মুসলিম সাম্রাজ্য যখন আরব উপদ্বীপের বালুকাময় প্রান্তর ছাড়িয়ে পারস্য, সিরিয়া, মিশর এবং স্পেনের উর্বর জমিতে ছড়িয়ে পড়ল, তখন এক নতুন চ্যালেঞ্জ সামনে এসে দাঁড়াল। এই চ্যালেঞ্জ তলোয়ারের নয়, এই চ্যালেঞ্জ ছিল বুদ্ধির। বাগদাদের ‘বাইতুল হিকমাহ’ বা ‘জ্ঞানের ঘর’-এ তখন গ্রিক দর্শন, বিশেষ করে অ্যারিস্টটল (Aristotle) ও প্লেটো (Plato)-এর বইগুলো দেদারসে আরবিতে অনুবাদ হচ্ছে। মুসলিমরা হঠাৎ করেই এক বিশাল ও জটিল যুক্তিবাদী দর্শনের মুখোমুখি হলো। খ্রিস্টান ধর্মতাত্ত্বিকরা, পারস্যের দ্বৈতবাদীরা এবং ভারতীয় নিরীশ্বরবাদী দার্শনিকরা মুসলিমদের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছিল একের পর এক কঠিন প্রশ্ন। “ঈশ্বর যদি সব জানেন, তবে মানুষকে কেন পরীক্ষা করেন?” “মানুষের পাপের জন্য ঈশ্বর কেন দায়ী নন?” “কুরআন কি ঈশ্বরের মতোই অনাদি, নাকি এটি কোনো এক সময় সৃষ্টি করা হয়েছে?” – এই প্রশ্নগুলোর উত্তর এতদিন ধরে চলে আসা সরল বিশ্বাস বা “কুরআনে আছে তাই মানি” – এই কথা দিয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। বিশ্বাসের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ল যুক্তির ঢাল। আর এই প্রয়োজন থেকেই জন্ম হলো ‘ইলমুল কালাম’ (Ilm al-Kalam) বা তাত্ত্বিক ধর্মতত্ত্ব (Speculative Theology)-এর। কালাম শাস্ত্র হলো ধর্মকে যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করে প্রতিপক্ষের যুক্তি খণ্ডন করার বিদ্যা।
মুতাজিলা: যুক্তির পূজারি ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব
ইসলামের ইতিহাসে প্রথম যারা বিশ্বাসকে পুরোপুরি যুক্তির ওপর দাঁড় করাতে চাইল, তাদের নাম মুতাজিলা (Mu’tazila)। এদের বলা হয় ইসলামের র্যাশনালিষ্ট (Rationalist) বা যুক্তিবাদী গোষ্ঠী। আব্বাসীয় খেলাফতের স্বর্ণযুগে, বিশেষ করে খলিফা আল-মামুন, আল-মুতাসিম এবং আল-ওয়াসিকের সময় এই মতবাদ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায় এবং অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। মুতাজিলাদের দর্শনের মূল কথা ছিল – যুক্তি বা আকল (Reason) এবং ওহী বা নাকল (Revelation) কখনো সাংঘর্ষিক হতে পারে না। কারণ, আল্লাহ মানুষকে বুদ্ধি দিয়েছেন তাকে চেনার জন্যই। যদি কুরআনের কোনো আয়াতের সাথে সাধারণ যুক্তির সংঘর্ষ হয়, তবে যুক্তির আলোকেই সেই আয়াতের ব্যাখ্যা করতে হবে, আয়াতের আক্ষরিক অর্থ নেওয়া যাবে না। ওয়াসিল ইবনে আতা ছিলেন এই মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি তার ওস্তাদ হাসান আল-বসরির মজলিস থেকে মতপার্থক্যের কারণে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন বলে তাদের নাম হয় মুতাজিলা, যার অর্থ ‘যারা আলাদা হয়ে গেছে’।
মুতাজিলাদের চিন্তাধারা পাঁচটি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে ছিল, যার মধ্যে প্রধান দুটি হলো ‘তাওহীদ’ (Divine Unity) বা আল্লাহর একত্ববাদ এবং ‘আদল’ (Divine Justice) বা ন্যায়বিচার। তাওহীদ নিয়ে তাদের ব্যাখ্যা ছিল খুব কঠোর। তারা বলত, আল্লাহর কোনো গুণ বা সিফাত (যেমন – হাত, মুখ, দেখা, শোনা) আল্লাহর সত্তা থেকে আলাদা কিছু নয়। যদি আমরা বলি আল্লাহর ‘জ্ঞান’ আছে যা তার সত্তা থেকে আলাদা, তবে তা বহু-ঈশ্বরবাদের দিকে নিয়ে যায়। তাই তারা আল্লাহর গুণাবলীকে রূপক অর্থে ব্যাখ্যা করত। তাদের মতে, আল্লাহকে পরকালে চর্মচক্ষে দেখা সম্ভব নয়। আর ‘আদল’ বা ন্যায়বিচারের প্রশ্নে তারা কদরিয়াদের মতোই স্বাধীন ইচ্ছায় বিশ্বাসী ছিল। তারা বলত, আল্লাহ যেহেতু ন্যায়বিচারক, তাই তিনি মানুষকে দিয়ে জোর করে পাপ করিয়ে আবার মানুষকে শাস্তি দিতে পারেন না। এটা আল্লাহর শানের খেলাফ। সুতরাং, মানুষ তার নিজের কাজের পূর্ণ মালিক এবং তার স্বাধীন ইচ্ছা (Free Will) আছে।
কিন্তু মুতাজিলাদের সবচেয়ে বিতর্কিত মতবাদ ছিল ‘কুরআন সৃষ্টি’ (Createdness of the Quran)–এর তত্ত্ব। তারা বলত, আল্লাহ অনাদি ও অনন্ত। কিন্তু কুরআন যদি আল্লাহর কালাম হিসেবে অনাদি হয়, তবে তো আল্লাহর সাথে আরেকটি অনাদি সত্তার অস্তিত্ব মেনে নেওয়া হলো, যা শিরক। তাই তারা বিশ্বাস করত, কুরআন আল্লাহর বাণী ঠিকই, কিন্তু এটি একটি নির্দিষ্ট সময়ে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। এই মতবাদটি আব্বাসীয় শাসকরা রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে চাইল। খলিফা আল-মামুন ৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে এই মতবাদকে রাষ্ট্রীয় আকিদা ঘোষণা করলেন এবং যারা এর বিরোধিতা করত, তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালাতেন। ইতিহাসের এই কলঙ্কজনক অধ্যায়কে বলা হয় ‘মিহনা’ (Mihna) বা পরীক্ষা। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল ছিলেন এই নির্যাতনের অন্যতম শিকার, যিনি চাবুকের আঘাত সহ্য করেও বলেছিলেন, “কুরআন আল্লাহর কালাম, তা সৃষ্টি নয়।” এই বাড়াবাড়ির কারণেই সাধারণ মানুষের কাছে মুতাজিলা মতবাদ জনপ্রিয়তা হারায় এবং পরবর্তীতে হারিয়ে যায়। তবে আধুনিক যুগে অনেক সংস্কারপন্থী বা নব্য-মুতাজিলা (Neo-Mu’tazila) চিন্তাবিদ আবার সেই যুক্তিবাদী ধারাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন (Griffel, 2009)।
আশারি: মধ্যপন্থা ও সুন্নি ধর্মতত্ত্বের ভিত্তি
মুতাজিলাদের অতিরিক্তি যুক্তিবাদের বাড়াবাড়ি এবং সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের ওপর আঘাতের জবাবে এক নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক ধারার জন্ম হলো, যার নাম আশারি (Ash’ari)। এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আবুল হাসান আল-আশারি (মৃ. ৯৩৬ খ্রি.) ছিলেন এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব। তিনি তার জীবনের প্রথম চল্লিশ বছর ছিলেন কট্টর মুতাজিলা এবং বিখ্যাত মুতাজিলা পণ্ডিত আল-জুব্বাইয়ের প্রধান শিষ্য। কিন্তু একদিন স্বপ্নে বা কোনো এক মানসিক পরিবর্তনের ফলে তিনি মুতাজিলা মতবাদ ত্যাগ করেন। তিনি বসৎরার এক মসজিদে জুমার দিন মিম্বরে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন যে, তিনি মুতাজিলা মতবাদ থেকে তওবা করছেন এবং তিনি এখন থেকে সুন্নাহর পথে চলবেন। তবে তিনি মুতাজিলাদের অস্ত্র অর্থাৎ কালাম বা যুক্তিবিদ্যাকেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
আশারি মতবাদ হলো যুক্তি ও ওহীর এক চমৎকার সমন্বয় বা সিন্থেসিস (Synthesis)। বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ সুন্নি মুসলিম (বিশেষ করে শাফিঈ ও মালিকি মাযহাবের অনুসারীরা) এই আকিদার অনুসারী। আশারিরা মুতাজিলাদের মতো পুরোপুরি যুক্তিনির্ভর নয়, আবার হাম্বলিদের মতো অন্ধ বিশ্বাসীও নয়। তারা বলে, যুক্তি ব্যবহার করতে হবে, তবে তা ওহীকে বোঝার জন্য, ওহীকে বিচার করার জন্য নয়। স্বাধীন ইচ্ছার প্রশ্নে তারা এক মধ্যবর্তী অবস্থান নিল, যার নাম কাসব (Acquisition)। তাদের মতে, সব কাজের প্রকৃত স্রষ্টা আল্লাহ। মানুষের নিজের কোনো কিছু সৃষ্টি করার ক্ষমতা নেই। কিন্তু মানুষের একটি ইচ্ছা বা পছন্দ করার ক্ষমতা আছে। মানুষ যখন কোনো কাজ করার ইচ্ছা করে, আল্লাহ তখন সেই কাজের ক্ষমতা বা কুদরত সৃষ্টি করে দেন। মানুষ সেই কাজটিকে ‘অর্জন’ করে। অর্থাৎ, আপনি হাত নাড়াতে চাইলেন (ইচ্ছা), আর আল্লাহ আপনার হাতে শক্তি দিলেন (ক্ষমতা)। এতে মানুষের দায়বদ্ধতাও থাকল, আবার আল্লাহর সর্বময় ক্ষমতাও অক্ষুণ্ণ থাকল।
কুরআনের ব্যাপারে আশারিরা বিশ্বাস করে যে, কুরআন আল্লাহর কালামে নাফসি (Inner Speech) বা শাশ্বত বাণী হিসেবে অনাদি বা অসৃষ্ট (Uncreated)। তবে আমরা যে বই বা মুসহাফ পড়ি, যে শব্দগুলো উচ্চারণ করি, সেগুলো সৃষ্টি। আল্লাহর সিফাত বা গুণের ব্যাপারে তারা বিশ্বাস করে যে, কুরআনে আল্লাহর হাত বা চোখের কথা বলা হয়েছে, তা সত্য। কিন্তু তা মানুষের হাত-পায়ের মতো নয় এবং তা রূপকও নয়। বরং তা কেমন তা আমরা জানি না – একে বলা হয় বিলা কাইফা (Without How)। আশারি ধর্মতত্ত্ব ইমাম গাজ্জালি এবং ফখরুদ্দিন আল-রাযির মতো দার্শনিকদের হাতে পূর্ণতা পায় এবং সুন্নি ইসলামের প্রধান বুদ্ধিবৃত্তিক খুঁটিতে পরিণত হয় (Frank, 1994)।
মাতুরিদি: সমরখন্দের জ্ঞানতাপস
আশারিদের সমসাময়িক সময়ে, আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের পূর্ব প্রান্তে মধ্য এশিয়ার সমরখন্দে আবু মনসুর আল-মাতুরিদি (মৃ. ৯৪৪ খ্রি.) আরেকটা ধর্মতাত্ত্বিক স্কুলের পত্তন করেন। ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে আশারি এবং মাতুরিদিরা একে অপরের কাজ সম্পর্কে খুব একটা জানতেন না, কিন্তু বিস্ময়করভাবে তারা প্রায় একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন। মাতুরিদি (Maturidi) মতবাদ হানাফি ফিকহ বা আইনের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। যেহেতু তুর্কি শাসক এবং মুঘলরা হানাফি ছিলেন, তাই অটোমান সাম্রাজ্য, মুঘল সাম্রাজ্য এবং মধ্য এশিয়ায় মাতুরিদি মতবাদ ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক ও বলকানের অধিকাংশ সুন্নি মুসলিম আকিদাগতভাবে মাতুরিদি।
মাতুরিদি চিন্তাধারা আশারিদের মতোই মধ্যপন্থী, তবে কিছু কিছু জায়গায় সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। মাতুরিদিরা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা (Free Will)-এর ওপর আশারিদের চেয়ে আরেকটু বেশি জোর দিয়েছেন। আশারিরা যেখানে আল্লাহর কুদরতের ওপর বেশি জোর দেন, মাতুরিদিরা সেখানে মানুষের বিবেক বা হিকমাহ (Wisdom)-এর ওপর জোর দেন। মাতুরিদিরা বলেন, ওহী না আসলেও মানুষ তার নিজের বুদ্ধি দিয়ে এটা বুঝতে সক্ষম যে ঈশ্বর একজন আছেন এবং ভালো কাজ ভালো আর মন্দ কাজ মন্দ। অর্থাৎ, নৈতিকতা বা নৈতিক বস্তুনিষ্ঠতা (Ethical Objectivism)-এ তারা বিশ্বাসী। অন্যদিকে আশারিরা মনে করেন, ওহী ছাড়া মানুষ ভালো-মন্দ বুঝতে পারে না; আল্লাহ যা ভালো বলেছেন তাই ভালো, যা মন্দ বলেছেন তাই মন্দ। মাতুরিদিদের এই দৃষ্টিভঙ্গি হানাফি ফিকহের নমনীয়তা এবং যুক্তিবাদী মানসিকতার সাথে খুব ভালোভাবে খাপ খেয়ে যায়।
আথারি বা সালাফি: আদি উৎসে ফেরার ডাক
এই সব দার্শনিক কচকচানি এবং কালাম শাস্ত্রের ঘোর বিরোধী ছিল একটি দল, যাদের বলা হয় আথারি (Athari) বা টেক্সচুয়ালিস্ট (Textualist)। ‘আসার’ মানে হলো বর্ণনা বা হাদিস। এদের মূল কথা হলো – কুরআন ও হাদিসে যা আছে, ঠিক তাই বিশ্বাস করতে হবে। কোনো ধরনের দার্শনিক ব্যাখ্যা, রূপক অর্থ বা যুক্তি দিয়ে একে জটিল করা যাবে না। এদের দর্শন হলো সরল বিশ্বাস বা ফিডেইজম (Fideism)-এর কাছাকাছি, যদিও পুরোপুরি এক নয়। এই মতবাদের পুরোধা ছিলেন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (মৃ. ৮৫৫ খ্রি.)। মিহনার সময়ে তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল, তবুও তিনি তার অবস্থান থেকে সরেননি। তার এই দৃঢ়তাই আথারি মতবাদকে সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তোলে।
আথারিরা আল্লাহর গুণাবলী বা সিফাত নিয়ে কোনো ধরনের প্রশ্ন তোলায় বিশ্বাসী নয়। আল্লাহ বলেছেন তিনি আরশের ওপর সমাসীন, তারা বিশ্বাস করে তিনি আরশের ওপর আছেন। কিন্তু ‘কীভাবে’ আছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন করাকে তারা বিদআত (Innovation) মনে করে। তারা বলে, এর অর্থ আল্লাহই ভালো জানেন। মুতাজিলা, আশারি বা মাতুরিদি – সবাইকে তারা কালামপন্থী বা দার্শনিক বলে সমালোচনা করে। আধুনিক যুগে সৌদি আরব কেন্দ্রিক সালাফি (Salafi) বা ওয়াহাবি (Wahhabi) আন্দোলন এবং উপমহাদেশের আহলে হাদিস (Ahl-i Hadith) আন্দোলন মূলত এই আথারি আকিদারই আধুনিক সংস্করণ। তারা ইবনে তাইমিয়া (মৃ. ১৩২৮ খ্রি.)-এর লেখার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত, যিনি কালাম শাস্ত্র এবং গ্রিক দর্শনের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। তাদের মতে, ইসলামকে বুঝতে হলে সাহাবীদের যুগের সরলতায় ফিরে যেতে হবে, পরবর্তী যুগের পণ্ডিতদের ব্যাখ্যা মানা যাবে না।
এই চারটি প্রধান ধর্মতাত্ত্বিক ধারা – মুতাজিলা, আশারি, মাতুরিদি এবং আথারি – গত হাজার বছর ধরে মুসলিম মানসজগতকে শাসন করেছে। এদের মধ্যকার বিতর্কগুলো অনেক সময় তিক্ত হয়েছে, কিন্তু এগুলোই প্রমাণ করে যে, ইসলামে চিন্তার স্বাধীনতা এবং বৈচিত্র্যের এক বিশাল পরিসর ছিল। কেউ যুক্তি দিয়ে স্রষ্টাকে খুঁজেছে, কেউ অন্ধ বিশ্বাসে শান্তি পেয়েছে, আবার কেউ মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছে। এই বৈচিত্র্যই ইসলামি সভ্যতার বুদ্ধিবৃত্তিক সমৃদ্ধির পরিচায়ক।
ফালাসিফা: গ্রিক জ্ঞানের সাথে ইসলামের অনন্ত মোলাকাত
কালাম শাস্ত্রের পণ্ডিতরা যখন ধর্মকে রক্ষা করার জন্য যুক্তির তলোয়ার শানাচ্ছিলেন, ঠিক তার সমান্তরালে মুসলিম বিশ্বে গড়ে উঠছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন এক বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎ। এরা নিজেদের ধর্মতাত্ত্বিক বা মুতাকাল্লিমুন বলতে নারাজ ছিলেন, এদের পরিচয় ছিল ফালাসিফা (Falasifa) বা দার্শনিক হিসেবে। গ্রিক শব্দ ‘ফিলোসোফিয়া’ থেকে আরবিতে এর রূপান্তর। নবম ও দশম শতাব্দীতে বাগদাদের বাইতুল হিকমাহ (House of Wisdom)-কে কেন্দ্র করে যখন অনুবাদের মহাযজ্ঞ শুরু হলো, তখন এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটল। অ্যারিস্টটল, প্লেটো, গ্যালেন এবং প্লোটিনাসের লেখাগুলো মুসলিম চিন্তাবিদদের হাতে এসে পড়ল। এই জীর্ণ পাণ্ডুলিপিগুলো পড়ার পর একদল মুসলিম চিন্তাবিদ ভাবলেন, সত্য তো কেবল ওহীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না, সত্যকে বিশুদ্ধ বুদ্ধি বা আকল (Intellect) দিয়েও খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
কালাম শাস্ত্রের সাথে ফালাসিফার মূল পার্থক্যটা এখানেই – কালাম শুরু হয় বিশ্বাস দিয়ে এবং সেই বিশ্বাসকে প্রমাণ করতে যুক্তি ব্যবহার করে; আর ফালাসিফা শুরু হয় সন্দেহ বা জিজ্ঞাসা দিয়ে এবং যুক্তি যেদিকে নিয়ে যায়, সেদিকেই হাঁটে, তা সেটা ধর্মের প্রচলিত ব্যাখ্যার সাথে মিলুক বা না মিলুক। এই দার্শনিকরা মূলত গ্রিক দর্শন, বিশেষ করে নব্য-প্লেটোবাদ (Neoplatonism) এবং অ্যারিস্টটলের পেরিপেটেটিক (Peripatetic) বা মাশশায়ি চিন্তাধারার সাথে ইসলামের একেশ্বরবাদের এক অদ্ভুত ও চমৎকার সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছিলেন। যদিও রক্ষণশীল আলেম সমাজ এদের বাঁকা চোখে দেখতেন এবং অনেক সময় ধর্মচ্যুত মনে করতেন, তবুও মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগে বিজ্ঞান, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা ও চিকিৎসাবিদ্যায় এদের অবদান ছিল আকাশচুম্বী। তারা বিশ্বাস করতেন, “দর্শন হলো মানুষের সাধ্যমতো বস্তুর প্রকৃত স্বরূপ জানা।”
আল-কিন্দি: আরবদের প্রথম দার্শনিক
মুসলিম দর্শনের ইতিহাসের প্রথম পাতাটি যার নামে লেখা, তিনি হলেন আবু ইউসুফ ইয়াকুব আল-কিন্দি (মৃ. ৮৭৩ খ্রি.)। তাকে বলা হয় ‘আরবদের দার্শনিক’। তিনি ছিলেন অভিজাত আরব বংশোদ্ভূত, যা তৎকালীন অনারব প্রভাবিত বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজে ছিল বিরল। আল-কিন্দি বুক ফুলিয়ে বলেছিলেন, “সত্য যেখান থেকেই আসুক, তা গ্রহণ করতে আমাদের লজ্জা পাওয়া উচিত নয়, এমনকি তা যদি ভিন্ন ধর্মের বা ভিন্ন জাতির কাছ থেকেও আসে। কারণ সত্যের চেয়ে দামি আর কিছু নেই।” তিনি গ্রিক দর্শনের সাথে কুরআনের বাণীর কোনো বিরোধ নেই – এটা প্রমাণ করতে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন।
আল-কিন্দি এরিস্টটলের কার্যকারণ তত্ত্ব (Causality) এবং কুরআনের সৃষ্টিতত্ত্বের মধ্যে মিল খোঁজার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, আল্লাহ হলেন সত্য বা আল-হক (The Truth) এবং তিনি মহাবিশ্বের পরম কারণ। তার মতে, দর্শন হলো সর্বোচ্চ পর্যায়ের জ্ঞান কারণ তা ‘প্রথম কারণ’ বা আল্লাহকে নিয়ে আলোচনা করে। তিনি আত্মার পরিশুদ্ধির ওপর জোর দিতেন এবং বিশ্বাস করতেন যে, দর্শন চর্চার মাধ্যমে মানুষ ইহকাল ও পরকালে সুখ লাভ করতে পারে। গণিত ও সংগীতেও তার ছিল গভীর দখল। তিনি বলতেন, “যে গণিত জানে না, তার পক্ষে দর্শন বোঝা সম্ভব নয়” (Adamson, 2007)।
আল-ফারাবি: দ্বিতীয় শিক্ষক ও আদর্শ রাষ্ট্রের স্বপ্ন
আল-কিন্দির পর দর্শনের জগতকে যিনি সত্যিকারের একটি সুশৃঙ্খল কাঠামো দিয়েছিলেন, তিনি হলেন আল-ফারাবি (মৃ. ৯৫০ খ্রি.)। দর্শনের ইতিহাসে এরিস্টটলকে বলা হয় ‘প্রথম শিক্ষক’, আর আল-ফারাবিকে বলা হয় মুয়াল্লিমুস সানি (The Second Teacher)। তিনি ছিলেন একজন পলিম্যাথ – একই সাথে সুরকার, গণিতবিদ, যুক্তিবিদ ও দার্শনিক। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, প্লেটোর রাজনৈতিক দর্শন ইসলামের খিলাফত ব্যবস্থার সাথে প্রাসঙ্গিক হতে পারে।
প্লেটোর রিপাবলিক (The Republic) দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আল-ফারাবি একটি আদর্শ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার বিখ্যাত বই আরা আহল আল-মদিনা আল-ফাদিলা (Opinions of the Inhabitants of the Virtuous City)-তে তিনি দেখান যে, একটি রাষ্ট্র তখনই পুণ্যবান বা ‘ফাদিলা’ হতে পারে, যখন তার নেতা হবেন জ্ঞানী। তিনি বলেন, একটি আদর্শ রাষ্ট্রের প্রধানকে হতে হবে দার্শনিক-নবী (Philosopher-Prophet)। অর্থাৎ, যার মধ্যে দুটি গুণ থাকবে: ১. তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক ধ্যানের মাধ্যমে পরম সত্য বা ‘অ্যাক্টিভ ইন্টেলেক্ট’-এর সাথে যুক্ত হবেন (দার্শনিক সত্তা), এবং ২. তিনি তার কল্পনাশক্তি বা ইমাজিনেশন (Imagination) ব্যবহার করে সেই জটিল সত্যকে সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায় বা রূপক আকারে প্রকাশ করবেন (নবী সত্তা)। আল-ফারাবিই প্রথম ইমানেশন (Emanation) বা ফায়েজ তত্ত্বের মাধ্যমে সৃষ্টিতত্ত্ব ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, আল্লাহ সরাসরি এই বহুত্বময় জগত সৃষ্টি করেননি, বরং তার সত্তা থেকে ধাপে ধাপে দশটি বুদ্ধি বা টেন ইন্টেলেক্টস (Ten Intellects) নির্গত হয়েছে, যা থেকে এই নশ্বর জগতের সৃষ্টি। এই তত্ত্বটি পরে সুফি ও ইসমাইলি শিয়াদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
ইবনে সিনা: প্রাচ্যের সূর্য ও অস্তিত্বের রহস্য
আল-ফারাবির পর দর্শনের আকাশে যে ধ্রুবতারা উদিত হলো, তার নাম ইবনে সিনা বা পাশ্চাত্যে যিনি আভিসেনা (মৃ. ১০৩৭ খ্রি.) নামে পরিচিত। তাকে বলা হয় শায়খ আল-রইস (The Chief Master)। মাত্র দশ বছর বয়সে কুরআন মুখস্ত করা এবং ষোল বছর বয়সে চিকিৎসাবিদ্যায় পাণ্ডিত্য অর্জন করা এই বিস্ময়বালক শুধু চিকিৎসক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন পূর্ণাঙ্গ দার্শনিক ব্যবস্থা বা সিস্টেমের নির্মাতা। তার দর্শন এতই প্রভাবশালী ছিল যে, পরবর্তী কয়েকশ বছর ধরে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মাদরাসায় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নাম ছিল অবিসংবাদিত।
ইবনে সিনার দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল অস্তিত্ব বা উজুদ (Being) নিয়ে আলোচনা। তিনি অস্তিত্ব ও সারবস্তু বা মাহিয়া (Quiddity)-এর মধ্যে পার্থক্য করেন। তিনি অস্তিত্বকে তিন ভাগে ভাগ করেন, যার মধ্যে প্রধান দুটি হলো:
১. ওয়াজিব আল-উজুদ (Necessary Being): যার অস্তিত্ব থাকাটা অপরিহার্য, যার না থাকাটা অসম্ভব। তিনি হলেন আল্লাহ। তার অস্তিত্বের জন্য অন্য কারো প্রয়োজন নেই।
২. মুমকিন আল-উজুদ (Contingent Being): বা সম্ভাব্য অস্তিত্ব – যা হতেও পারে, নাও হতে পারে। এই মহাবিশ্বের সব কিছুই ‘মুমকিন’।
তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, এই সম্ভাব্য জগতের অস্তিত্বের জন্য একজন ‘ওয়াজিব আল-উজুদ’ বা আবশ্যিক সত্তা থাকা জরুরি, যিনি এই সম্ভাব্যদের অস্তিত্ব দান করবেন। তার এই কসমোলজিক্যাল আর্গুমেন্ট (Cosmological Argument) আজও দর্শনের ক্লাসে পড়ানো হয়। ইবনে সিনা আত্মা বা নফসের অমরত্ব ও স্বাতন্ত্র্য প্রমাণ করার জন্য ‘উড়ন্ত মানুষ’ বা ফ্লোটিং ম্যান (Floating Man) নামক এক বিখ্যাত মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষার কথা বলেন। তিনি বলেন, কল্পনা করুন একজন মানুষ শূন্যে ভাসছে, তার চোখ বন্ধ, সে তার হাত-পা বা শরীরের কোনো অঙ্গের স্পর্শ পাচ্ছে না। এমনকি সে তার শরীর আছে কি না তাও জানে না। তবুও সে একটি বিষয়ে নিশ্চিত – সে জানে যে ‘আমি আছি’ বা ‘আমার অস্তিত্ব আছে’। এই ‘আমি’-বোধটাই হলো আত্মা, যা শরীর থেকে ভিন্ন এবং শরীর ধ্বংস হলেও তা টিকে থাকে। তার লেখা কিতাব আল-শিফা (The Book of Healing) দর্শনের ইতিহাসে এক মাইলফলক (Gutas, 2014)।
ইখওয়ান আল-সাফা: রহস্যময় দার্শনিক সংঘ
দশম শতাব্দীতে ইরাকের বসরা শহরে এক গোপন দার্শনিক সংঘ গড়ে ওঠে, যাদের নাম ইখওয়ান আল-সাফা (Brethren of Purity)। এরা কারা ছিল, তা সঠিকভাবে জানা যায় না, তবে তারা ৫২টি দীর্ঘ প্রবন্ধ বা ‘রাসায়েল’ লিখে রেখে গেছে। তাদের দর্শন ছিল পিথাগোরাস, প্লেটো এবং ইসলামের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। তারা মনে করত সংখ্যা বা নাম্বার (Number)-এর মধ্যে মহাবিশ্বের সব রহস্য লুকিয়ে আছে। তাদের লক্ষ্য ছিল আত্মশুদ্ধি এবং কুসংস্কারমুক্ত সমাজ গঠন। তারা বলত, “শরিয়ত হলো অসুস্থ মানুষের জন্য ওষুধ, আর দর্শন হলো সুস্থ মানুষের জন্য পুষ্টিকর খাবার।” ইসমাইলি শিয়া মতবাদের ওপর এদের গভীর প্রভাব ছিল।
আন্দালুসিয়ার আলো: ইবনে তোফায়েল ও ইবনে রুশদ
প্রাচ্যে যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা, তখন মুসলিম স্পেন বা আন্দালুসিয়ায় দর্শনের মশাল জ্বলছিল। সেখানে জন্ম নিলেন ইবনে তোফায়েল (মৃ. ১১৮৫ খ্রি.)। তিনি একটি অসাধারণ দার্শনিক উপন্যাস লেখেন, যার নাম হাই ইবনে ইয়াকজান (Hayy ibn Yaqzan) বা ‘জাগ্রত সত্তার সন্তান’। এটি একটি জনমানবহীন দ্বীপে একা বড় হওয়া এক শিশুর গল্প (রবিনসন ক্রুসোর অনেক আগে লেখা)। শিশুটি কোনো ধর্মগ্রন্থ বা নবী ছাড়াই শুধুমাত্র নিজের পর্যবেক্ষণ এবং যুক্তি (Reason) ব্যবহার করে আল্লাহকে খুঁজে পায়। ইবনে তোফায়েল দেখাতে চাইলেন যে, ওহী ছাড়াই বিশুদ্ধ বুদ্ধির মাধ্যমে সত্যে পৌঁছানো সম্ভব।
এর পরেই আসেন কর্ডোভার ইবনে রুশদ বা এভেরোজ (মৃ. ১১৯৮ খ্রি.)। তাকে বলা হয় ‘দ্য কমেন্টেটর’ বা ব্যাখ্যাকার, কারণ অ্যারিস্টটলের দর্শনের ওপর তার ব্যাখ্যা ছিল অতুলনীয়। তিনি ছিলেন একজন খাঁটি অ্যারিস্টটলিয়ান এবং যুক্তিবাদী। তিনি সমসাময়িক ধর্মতাত্ত্বিকদের সমালোচনার জবাবে বোঝাতে চাইলেন যে, ধর্ম এবং দর্শন আসলে একই সত্যের দুটি ভিন্ন ভাষা। সাধারণ মানুষের জন্য ধর্ম বলে রূপক ভাষায় বা রেটোরিক (Rhetoric), আর জ্ঞানীদের জন্য দর্শন বলে প্রমাণের ভাষায় বা ডেমোনস্ট্রেশন (Demonstration)। তিনি ইউরোপীয় রেনেসাঁস এবং টমাস একুইনাসের ওপর বিশাল প্রভাব ফেলেছিলেন, যদিও মুসলিম বিশ্বে তার প্রভাব ছিল সীমিত (Fakhry, 2001)।
গাজ্জালির আঘাত ও ইবনে রুশদের জবাব
দর্শনের এই জয়রথ কিন্তু বিনা বাধায় চলেনি। একাদশ শতাব্দীতে নিজামিয়া মাদ্রাসার প্রধান অধ্যাপক ইমাম গাজ্জালি (মৃ. ১১১১ খ্রি.) দার্শনিকদের বিরুদ্ধে কলম ধরলেন। তিনি তার বিখ্যাত বই তাহাফুত আল-ফালাসিফা (The Incoherence of the Philosophers)-এ ইবনে সিনা ও আল-ফারাবির দর্শনকে তুলাধোনা করলেন। তিনি দেখালেন যে, দার্শনিকরা যুক্তির নামে যা বলছেন, তা অনেক ক্ষেত্রেই স্ববিরোধী এবং প্রমাণহীন। গাজ্জালি মূলত তিনটি বিষয়ে দার্শনিকদের কাফির বা ধর্মত্যাগী বলে ফতোয়া দিলেন:
১. দার্শনিকরা বলতেন বিশ্বজগত অনাদি (অর্থাৎ আল্লাহ যেমন অনাদি, বিশ্বও তেমন), যা সৃষ্টির ধারণার বিরোধী।
২. আল্লাহ কেবল সার্বজনীন বিষয় (Universals) জানেন, খুটিনাটি বিষয় (Particulars) জানেন না।
৩. পরকালে কেবল আত্মার পুনরুত্থান হবে, শরীরের নয়।
গাজ্জালির এই আঘাত ছিল মারাত্মক। এর ফলে সুন্নি বিশ্বে দর্শনের উন্মুক্ত চর্চা অনেকটাই কমে যায় এবং তা কালাম শাস্ত্রের ভেতরে ঢুকে পড়ে। প্রায় এক শতাব্দী পর ইবনে রুশদ গাজ্জালির জবাব দিলেন তার তাহাফুত আল-তাহাফুত (The Incoherence of the Incoherence) বইতে। তিনি বললেন, গাজ্জালি দার্শনিকদের কথাই ঠিকমতো বোঝেননি। তবে ইবনে রুশদের এই প্রতিরক্ষা মুসলিম বিশ্বে দর্শনের পতন ঠেকাতে পারেনি।
ইশরাকি ও হিকমাহ: দর্শনের মরমী বাঁক
ইবনে রুশদের পর বিশুদ্ধ পেরিপেটেটিক বা অ্যারিস্টটলীয় দর্শনের ধারা সুন্নি বিশ্বে স্তিমিত হয়ে এলেও, ইরানে বা শিয়া বলয়ে দর্শনের এক নতুন ধারার জন্ম হয়। দ্বাদশ শতাব্দীতে শিহাব আল-দিন সুহরাওয়ার্দী (মৃ. ১১৯১ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন ইশরাকি (Illuminationist) বা আলোকিত দর্শন। তিনি যুক্তি এবং আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা বা কাশফ (Intuition)-এর সংমিশ্রণ ঘটাতে চেয়েছিলেন। তার মতে, জ্ঞান শুধু বই পড়ে বা মগজ খাটিয়ে হয় না, জ্ঞান হলো আলোর মতো যা সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে মানুষের পবিত্র অন্তরে এসে পড়ে। এই দর্শন প্লেটো এবং প্রাচীন পারস্যের জরথুস্ট্রবাদী আলোর ধারণার মিশ্রণ ছিল।
এই ধারাটি চূড়ান্ত পরিণতি পায় সপ্তদশ শতাব্দীতে সাফাভিদ আমলে। মোল্লা সদরা (মৃ. ১৬৪০ খ্রি.) ইবনে সিনার দর্শন, সুহরাওয়ার্দীর ইশরাকি তত্ত্ব এবং ইবনে আরাবির সুফিবাদের সমন্বয় করে এক নতুন এবং অত্যন্ত শক্তিশালী দার্শনিক স্কুল তৈরি করেন, যার নাম আল-হিকমাহ আল-মুতা’আলিয়া (Transcendent Theosophy)। মোল্লা সদরা দর্শনের মোড় ঘুরিয়ে দেন তার আসালত আল-উজুদ (Primacy of Existence) বা অস্তিত্বের প্রাধান্য তত্ত্ব দিয়ে। তিনি বলেন, অস্তিত্ব কোনো স্থির বিষয় নয়, এটি প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল এবং প্রবহমান। তার হারাকা জাওহারিয়া (Substantial Motion) তত্ত্ব অনুযায়ী, মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তিত হয়ে পূর্ণতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। এটি অনেকটা আধুনিক অস্তিত্ববাদ (Existentialism) এবং প্রসেস ফিলোসফির পূর্বসূরী। ইরানি মাদ্রাসায় আজও মোল্লা সদড়ার দর্শন প্রধান পাঠ্য বিষয় (Rizvi, 2009)।
সুতরাং, যারা মনে করেন গাজ্জালির পর ইসলামে দর্শন মরে গেছে, তারা ভুল ভাবেন। দর্শন মরে যায়নি, বরং তা রূপ পরিবর্তন করে সুফিবাদ ও ধর্মতত্ত্বের সাথে মিশে এক নতুন আধ্যাত্মিক দর্শনে পরিণত হয়েছে। ফালাসিফারা প্রমাণ করেছেন যে, মুসলিম মানসজগত কেবল অন্ধ আবেগের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল না; সেখানে ছিল মহাবিশ্বের অস্তিত্ব, আত্মা এবং স্রষ্টার রহস্য ভেদ করার এক অদম্য দার্শনিক তৃষ্ণা।
আইন বা ফিকহী স্কুল: ব্যবহারিক জীবনের আইনি কাঠামো
ইসলাম কেবল বিশ্বাসের নাম নয়, এটি একটি সম্পূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। একজন মুসলিমের সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রতিটি কাজের একটি নির্দিষ্ট নিয়ম বা আদব আছে। স্রষ্টার সাথে বান্দার সম্পর্ক বা ইবাদত (Worship) এবং মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক বা মুয়ামালাত (Transactions) – সবকিছুই একটি কাঠামোর মধ্যে চলে। এই কাঠামোটি তৈরি হয় যে শাস্ত্রের মাধ্যমে, তার নাম ফিকহ (Jurisprudence)। ফিকহ মানে হলো গভীর বোধ বা উপলব্ধি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ফিকহ কেন দরকার? কারণ কুরআন ও হাদিসে সব সমস্যার সরাসরি বা Explicit সমাধান নেই। সমাজ পরিবর্তনশীল, নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হয়। যেমন, নবীর যুগে বিটকয়েন বা টেস্ট টিউব বেবি ছিল না, তাই এসব বিষয়ে সরাসরি কোনো বিধান নেই। এই নতুন সমস্যার সমাধান বের করতে হলে পণ্ডিতদের গবেষণা বা ইজতিহাদ (Independent Reasoning) করতে হয়। আর এই গবেষণার পদ্ধতি বা মেথডোলজি (Methodology) একেক জনের একেক রকম। কারো কাছে যুক্তি বড়, কারো কাছে প্রথা, আবার কারো কাছে হাদিসের আক্ষরিক অর্থ। এই পদ্ধতির ভিন্নতা থেকেই সুন্নি ইসলামে প্রধানত চারটি ফিকহী মাযহাব তৈরি হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, এই চারটি মাযহাবের মধ্যে কিছু মতপার্থক্য থাকলেও, তারা একে অপরকে ‘ভুল’ বলে না, বরং সবাই সবাইকে সঠিক বা বৈধ (Valid) মনে করে। এটি ইসলামি আইনের এক অনন্য বহুত্ববাদী বা প্লুরালিস্টিক (Pluralistic) বৈশিষ্ট্য।
হানাফি: যুক্তির উন্মুক্ত প্রান্তর
সুন্নি মাযহাবগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন, বৃহত্তম এবং উদারপন্থী হিসেবে পরিচিত হলো হানাফি (Hanafi) মাযহাব। এর প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবু হানিফা (মৃ. ৭৬৭ খ্রি.), যাকে সম্মানের সাথে ‘ইমাম আজম’ বা মহান ইমাম বলা হয়। তিনি ছিলেন ইরাকের কুফা নগরীর একজন সফল রেশম ব্যবসায়ী এবং একই সাথে এক ক্ষুরধার বুদ্ধিজীবী। কুফা তখন ছিল বিভিন্ন জাতি, ধর্ম ও দর্শনের এক মিলনমেলা। সেখানে প্রতিদিন এমন সব নতুন আইনি ও সামাজিক সমস্যা আসত, যা মদিনার শান্ত সমাজে চিন্তাও করা যেত না। এই জটিল সমাজের চাহিদা মেটাতেই আবু হানিফা এবং তার দুই প্রধান শিষ্য – ইমাম আবু ইউসুফ এবং ইমাম মুহাম্মদ আল-শাইবানি – আইনের এক অসাধারণ কাঠামো দাঁড় করান। হানাফি ফিকহের মূল শক্তি হলো এর নমনীয়তা এবং রায় (Juristic Discretion) বা সুচিন্তিত মতামতের ব্যবহার।
হানাফি ফিকহ একটি সমস্যার সমাধানে কুরআনের পর হাদিস দেখে। কিন্তু যদি হাদিস না থাকে, তবে তারা কিয়াস (Analogy) বা উপমার আশ্রয় নেয়। যেমন – কুরআনে বলা হয়েছে মদ হারাম কারণ এতে মাদকতা আছে। এখন নতুন কোনো পানীয় যদি নেশা তৈরি করে, তবে কিয়াসের মাধ্যমে সেটাও হারাম হবে। তারা আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ টুল ব্যবহার করে, যার নাম ইস্তিসান (Juristic Preference)। এর মানে হলো, যদি কিয়াসের মাধ্যমে পাওয়া কোনো আইন জনস্বার্থের বিরুদ্ধে যায় বা কঠোর হয়ে যায়, তবে জনকল্যাণের বা মাসলাহা (Public Interest)-এর স্বার্থে বিচারক তার নিজস্ব বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে ভিন্ন রায় দিতে পারেন। এই উদারতার কারণেই হানাফি মাযহাব অনারব দেশগুলোতে, বিশেষ করে যেখানে স্থানীয় প্রথা বা উরফ (Custom) শক্তিশালী, সেখানে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আব্বাসীয়, অটোমান এবং মুঘল সাম্রাজ্যের মতো বড় বড় সাম্রাজ্যগুলো হানাফি আইনকে তাদের রাষ্ট্রীয় আইন হিসেবে গ্রহণ করেছিল। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়া (বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান), তুরস্ক, মধ্য এশিয়া, বলকান অঞ্চল এবং মিশরের একাংশে এই মাযহাবের প্রাধান্য দেখা যায় (Hallaq, 2005)।
মালিকি: মদিনার জীবন্ত ঐতিহ্য
হানাফিদের ঠিক উল্টো পরিবেশে, মদিনার শান্ত ও রক্ষণশীল সমাজে গড়ে ওঠে মালিকি (Maliki) মাযহাব। এর প্রতিষ্ঠাতা ইমাম মালিক ইবনে আনাস (মৃ. ৭৯৫ খ্রি.), যিনি সারা জীবন মদিনাতেই কাটিয়েছেন এবং তাকে ‘মদিনার ইমাম’ বলা হতো। ইমাম মালিকের আইনতত্ত্বের মূল ভিত্তি ছিল একটি অনন্য ধারণা, যাকে বলা হয় ‘আমাল আহল আল-মদিনা’ (Practice of the People of Medina)। তার যুক্তি ছিল খুব সরল ও শক্তিশালী – মদিনা হলো নবীর শহর। এখানের মানুষরা পুরুষানুক্রমে নবীর জীবনযাপন পদ্ধতি দেখে আসছে। দাদা তার বাবার কাছে, বাবা তার ছেলের কাছে এই প্রথা বা আমল হস্তান্তর করেছেন। তাই মদিনার হাজার হাজার মানুষের সম্মিলিত কাজ বা আমল, একজন বর্ণনাকারীর বর্ণিত একক হাদিস বা খবরে ওয়াহিদ (Isolated Report)-এর চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী প্রমাণ।
মালিকি মাযহাব জনস্বার্থ বা মাসলাহা (Public Interest)-এর ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। তাদের একটি বিখ্যাত নীতি হলো ‘সাদ্দ আল-জারাই’ (Blocking the Means) – অর্থাৎ, কোনো কাজ যদি বৈধও হয় কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত কোনো হারামের দিকে নিয়ে যায়, তবে সেই বৈধ কাজটিকেও নিষিদ্ধ করা হবে। যেমন, আঙ্গুর বিক্রি করা হালাল, কিন্তু কেউ যদি ওয়াইন তৈরির কারখানায় আঙ্গুর বিক্রি করে, তবে মালিকি মতে তা হারাম হতে পারে। মালিকি ফিকহ খুব বাস্তববাদী এবং সামাজিকভাবে সংবেদনশীল। এই মাযহাবটি মূলত উত্তর আফ্রিকা (মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, লিবিয়া), পশ্চিম আফ্রিকা, সুদান এবং এক সময় মুসলিম স্পেনে বা আন্দালুসিয়ায় প্রবল ছিল। স্পেনের বিখ্যাত কর্ডোভা এবং গ্রানাডার আইন ব্যবস্থা ছিল মালিকি ফিকহের ওপর ভিত্তি করে। তাদের বিখ্যাত গ্রন্থ আল-মুয়াত্তা হলো হাদিস ও ফিকহের সমন্বয়ে লেখা প্রথম প্রামাণ্য বইগুলোর একটি।
শাফিঈ: সমন্বয় ও পদ্ধতির স্থপতি
ইমাম মালিক এবং ইমাম আবু হানিফার ছাত্রদের মৃত্যুর পর ফিকহ জগতে কিছুটা বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। একদল শুধু হাদিস মানত (আহলুল হাদিস), আরেকদল যুক্তির ওপর বেশি জোর দিত (আহলুল রায়)। এই দুই পক্ষের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করতে এগিয়ে এলেন এক অসাধারণ প্রতিভাবান ব্যক্তি – ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইদ্রিস আল-শাফিঈ (মৃ. ৮২০ খ্রি.)। তিনি ছিলেন ইমাম মালিকের ছাত্র, আবার হানাফি ইমাম মুহাম্মদ আল-শাইবানির কাছেও পড়েছেন। তিনি বুঝেছিলেন যে, আইন বের করার একটি সুনির্দিষ্ট ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি দরকার, যাতে কেউ নিজের ইচ্ছামতো ফতোয়া দিতে না পারে। এজন্য তাকে বলা হয় উসূল আল-ফিকহ (Principles of Jurisprudence) বা ফিকহ শাস্ত্রের জনক। তার বিখ্যাত বই আল-রিসালা-তে তিনি আইনের উৎসগুলোকে ক্রম অনুসারে সাজান: প্রথমে কুরআন, তারপর সুন্নাহ, তারপর ইজমা (ঐকমত্য) এবং শেষে কিয়াস (Schacht, 1950)।
শাফিঈ মাযহাবের দর্শন হলো – আইন হতে হবে টেক্সট বা নস-নির্ভর। তিনি হানাফিদের ইস্তিসান বা ব্যক্তিগত পছন্দকে প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি বললেন, “যে ইস্তিসান করল, সে যেন নতুন শরিয়ত তৈরি করল।” তার মতে, যদি সহীহ হাদিস থাকে, তবে মানুষের যুক্তি বা মদিনার আমল – কোনোটিই গ্রাহ্য হবে না। তিনি খবরে ওয়াহিদ বা একক বর্ণনাকারীর হাদিসকেও আইনের উৎস হিসেবে গ্রহণ করলেন, যদি বর্ণনাকারী বিশ্বস্ত হন। শাফিঈ মাযহাব যুক্তি ও আবেগের এক চমৎকার ভারসাম্য বজায় রাখে। মিশরের কায়রোতে তার শেষ জীবন কাটে এবং সেখানেই তার মাযহাবের চূড়ান্ত রূপ পায়। বর্তমানে পূর্ব আফ্রিকা (সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, তানজানিয়া), ইয়েমেন, দক্ষিণ ভারত (কেরালা), শ্রীলঙ্কা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া (ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ব্রুনেই)-এর অধিকাংশ মুসলিম শাফিঈ মাযহাবের অনুসারী। কুর্দিস্তানের কুর্দিরাও মূলত শাফিঈ।
হাম্বলি: হাদিসের প্রতি অবিচল আনুগত্য
চারটি সুন্নি মাযহাবের মধ্যে সবচেয়ে ছোট কিন্তু বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে বেশ প্রভাবশালী হলো হাম্বলি (Hanbali) মাযহাব। এর প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (মৃ. ৮৫৫ খ্রি.)। তিনি ছিলেন মূলত একজন হাদিস বিশারদ বা মুহাদ্দিস, ফকিহ হিসেবে তিনি নিজেকে পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন না। তার বিখ্যাত হাদিস সংকলন মুসনাদ আহমদ-এ প্রায় ত্রিশ হাজার হাদিস আছে। ইমাম আহমদ বিশ্বাস করতেন যে, মানুষের যুক্তি বা রায় (Opinion) হলো ধর্মের বিকৃতির মূল কারণ। তিনি মুতাজিলাদের হাতে চরম নিগৃহীত হয়েছিলেন, তাই যুক্তিবাদী যেকোনো পদ্ধতির প্রতি তার ছিল প্রচণ্ড অনীহা। তিনি বলতেন, “আল্লাহর রাসূলের একটি দুর্বল হাদিসও মানুষের শক্তিশালী যুক্তির চেয়ে উত্তম।”
হাম্বলি ফিকহ অত্যন্ত টেক্সচুয়ালিস্ট (Textualist) বা আক্ষরিকতাবাদী। তারা ইজমা বা কিয়াসের ব্যবহার খুব সীমিত ক্ষেত্রে করে। তাদের মতে, যেখানে কুরআন বা হাদিসে কোনো বিধান নেই, সেখানে সাহাবীদের মতামতের ওপর নির্ভর করতে হবে। হাম্বলি মাযহাব ঐতিহাসিকভাবে খুব রক্ষণশীল এবং শরিয়তের বিধানে কঠোর হিসেবে পরিচিত। তবে ইবাদতের ক্ষেত্রে কঠোর হলেও, বাণিজ্যিক লেনদেনের ক্ষেত্রে তারা বেশ উদার। তাদের নীতি হলো – চুক্তির শর্তে যদি শরিয়তের সরাসরি লঙ্ঘন না থাকে, তবে যেকোনো শর্তই বৈধ। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাবের সংস্কার আন্দোলনের (যা ওয়াহাবি বা সালাফি আন্দোলন নামে পরিচিত) মাধ্যমে হাম্বলি মাযহাব নতুন জীবন পায়। বর্তমানে সৌদি আরব, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের কিছু অংশে এই মাযহাব রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুসৃত হয়। আধুনিক সালাফি আন্দোলনগুলো ফিকহের ক্ষেত্রে হাম্বলি মাযহাবের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত।
জাফরি: শিয়া ফিকহের স্বাতন্ত্র্য
সুন্নি মাযহাবগুলোর বাইরে শিয়াদের নিজস্ব একটি সমৃদ্ধ আইনি ব্যবস্থা আছে, যার নাম জাফরি (Ja’fari) মাযহাব। এটি দ্বাদশ ইমাম শিয়াদের (Twelver Shia) প্রধান ফিকহী স্কুল। এর নামকরণ করা হয়েছে ষষ্ঠ ইমাম জাফর আল-সাদিক (মৃ. ৭৬৫ খ্রি.)-এর নামে, যিনি ছিলেন ইমাম আবু হানিফা এবং ইমাম মালিকের শিক্ষক। জাফরি ফিকহ সুন্নি ফিকহের চেয়ে কিছু মৌলিক জায়গায় আলাদা। এর প্রধান উৎস হলো কুরআন, সুন্নাহ (যা ইমামদের মাধ্যমে বর্ণিত), ইজমা এবং আকল (Intellect)। সুন্নিরা যেখানে কিয়াস বা উপমা ব্যবহার করে, শিয়ারা সেখানে আকল বা বিশুদ্ধ যুক্তি ব্যবহার করে।
জাফরি ফিকহের কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো:
১. মুতাহ বিয়ে (Temporary Marriage): তারা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চুক্তিভিত্তিক বিবাহকে বৈধ মনে করে, যা সুন্নিরা হারাম মনে করে।
২. খুমস (Khums): যাকাতের পাশাপাশি আয়ের এক-পঞ্চমাংশ ইমাম বা তার প্রতিনিধির (মারজা) কাছে দান করা বাধ্যতামূলক।
৩. ইজতিহাদের দরজা খোলা: সুন্নিদের মধ্যে অনেকে মনে করেন ইজতিহাদের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু শিয়াদের মধ্যে মুজতাহিদ বা আয়াতুল্লাহরা যেকোনো সময় নতুন সমস্যার নতুন সমাধান দিতে পারেন।
এই পাঁচটি ফিকহী স্কুল (চারটি সুন্নি ও একটি শিয়া) আসলে ইসলামি আইনের পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন জানালা। প্রতিটি জানালা দিয়ে একই সত্যকে ভিন্ন ভিন্ন কোণ থেকে দেখা যায়। এই বৈচিত্র্য মুসলিম সমাজকে স্থবিরতা থেকে রক্ষা করেছে এবং বিভিন্ন সংস্কৃতি ও পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করেছে। ইমাম শাফিঈর মিশরে গিয়ে মত পরিবর্তন করা কিংবা ইমাম আবু হানিফার ছাত্রদের তার মৃত্যুর পর কিছু রায়ের বিরোধিতা করা – এ সবই প্রমাণ করে যে, ফিকহ হলো এক গতিশীল ও জীবন্ত বিজ্ঞান।
সুফিবাদ: অন্তরের খোঁজ ও আধ্যাত্মিক পথ
ইসলামের ইতিহাসকে যদি শুধু যুদ্ধবিগ্রহ, সাম্রাজ্য বিস্তার, রাজনৈতিক কূটকৌশল আর ফতোয়ার কিতাব দিয়ে বিচার করেন, তবে আপনি মুদ্রার এক পিঠ দেখলেন মাত্র। এর সমান্তরালে, হইচই আর কোলাহলের আড়ালে, এক শান্ত ও গভীর নদী সবসময় বয়ে গেছে। এই নদীর নাম তাসাউফ (Tasawwuf) বা সুফিবাদ (Sufism)। এটি ইসলামের বাতেনি বা গূঢ়বাদী (Esoteric) দিক। সুফিরা আইনের শুষ্ক খুঁটিনাটির চেয়ে হৃদয়ের শুদ্ধি বা তাজকিয়া (Purification)-এর ওপর জোর দেন বেশি। তাদের কাছে ধর্ম কোনো ভয়ের বস্তু নয়, বরং প্রেমের এক মহাকাব্য। তারা বলেন, শরীয়ত হলো শরীরের মতো, একটি কাঠামো; আর তরিকত হলো তার আত্মা বা প্রাণ। প্রাণ ছাড়া শরীর যেমন লাশ, তেমনি আধ্যাত্মিকতা ছাড়া ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানও প্রাণহীন ব্যায়াম মাত্র। সুফিদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ফানা (Annihilation in God) এবং বাকা (Subsistence in God) – অর্থাৎ নিজের ক্ষুদ্র ‘আমিত্ব’ বা ইগোকে বিলীন করে আল্লাহর মাঝে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া। এটি এমন এক অবস্থা যখন বান্দা নিজের ইচ্ছাকে আল্লাহর ইচ্ছার সাথে এক করে ফেলে।
সুফিবাদ কোনো আলাদা মাযহাব বা ফিরকা নয়, বরং এটি ইসলাম পালনের একটি আধ্যাত্মিক মাত্রা বা ডাইমেনশন। তবে কালক্রমে গুরু-শিষ্য পরম্পরায় এর নিজস্ব তরিকা (Orders) বা সংগঠন তৈরি হয়েছে। এই তরিকাগুলো একেকটি স্কুলের মতো, যেখানে একজন মুর্শিদ (Spiritual Guide) বা পীরের অধীনে শিষ্যরা দীক্ষা নেয় এবং আত্মশুদ্ধির চর্চা করে। আসুন, আমরা এই মরমী জগতের অলিগলিতে একটু হাঁটি এবং দেখি মানুষ কীভাবে স্রষ্টাকে প্রেমের মাধ্যমে পেতে চেয়েছে।
সুফি দর্শনের ভিত্তি: প্রেম ও সত্তার একত্ব
সুফিবাদের জগতটা অনুভূতির জগত। এখানে ২+২=৪ নাও হতে পারে, আবার ১-এর ভেতর সব সংখ্যা লুকিয়ে থাকতে পারে। সুফি দর্শনের বিকাশে দু’টি ধারা খুব প্রবল। একটি হলো ‘সুকর’ (Intoxication) বা মত্ততা, আর অন্যটি হলো ‘সাহ্ও’ (Sobriety) বা সজ্ঞানতা। বাইজিদ বোস্তামী বা মনসুর হাল্লাজের মতো সুফিরা ছিলেন প্রেমের নেশায় মত্ত। হাল্লাজ যখন আনাল হক (I am the Truth) বলেছিলেন, তখন তিনি আসলে নিজেকে খোদা দাবি করেননি, বরং নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ বা ফকিহরা সেটা বোঝেননি, ফলে তাকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। অন্যদিকে, জুনায়েদ বাগদাদীর মতো সুফিরা ছিলেন সজ্ঞান ধারার। তারা শরীয়ত ও মারেফতের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতেন।
সুফি দর্শনের সবচেয়ে জটিল এবং প্রভাবশালী তত্ত্বটি হলো ওয়াহদাতুল ওজুদ (Unity of Being)। এর প্রবক্তা ছিলেন শায়খুল আকবর ইবনে আরাবি (মৃ. ১২৪০ খ্রি.)। তার বিখ্যাত বই ফুসুস আল-হিকাম-এ তিনি এই দর্শন ব্যাখ্যা করেছেন। সহজ কথায় এর মানে হলো – মহাবিশ্বে প্রকৃত অস্তিত্ব একমাত্র আল্লাহর। আমরা যা কিছু দেখি, তা আল্লাহর অস্তিত্বের ছায়া বা প্রতিফলন মাত্র। আয়নায় যেমন মানুষের প্রতিবিম্ব দেখা যায়, কিন্তু প্রতিবিম্বটি নিজে মানুষ নয়, আবার মানুষটি থেকে আলাদাও নয় – সৃষ্টিজগতও তেমনি স্রষ্টার গুণাবলীর প্রকাশ। তবে এই দর্শনের সমালোচনাও হয়েছে প্রচুর। বিশেষ করে মুঘল আমলে শেখ আহমদ সিরহিন্দি (মৃ. ১৬২৪ খ্রি.) এর বিপরীতে ওয়াহদাতুল শুহুদ (Unity of Witness) তত্ত্ব দাঁড় করান। তিনি বলেন, সৃষ্টি আর স্রষ্টা এক নয়। স্রষ্টা হলেন অনন্ত, আর সৃষ্টি হলো নশ্বর। ছায়াকে কায়া মনে করা ভুল। এই দার্শনিক বিতর্ক সুফি জগতকে সর্বদা প্রাণবন্ত করে রেখেছে (Chittick, 1989)।
প্রধান সুফি তরিকাসমূহ: আধ্যাত্মিকতার ভিন্ন ভিন্ন পাঠশালা
সুফিবাদ কোনো বিশৃঙ্খল ব্যবস্থা নয়। দ্বাদশ শতাব্দী থেকে এটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিতে শুরু করে। গড়ে ওঠে খানকা বা দরগাহ। তৈরি হয় সুনির্দিষ্ট তরিকা। প্রতিটি তরিকার নিজস্ব জিকিরের পদ্ধতি, নিজস্ব পোশাক এবং নিজস্ব সাধনার স্তর আছে। নিচে প্রধান এবং প্রভাবশালী কয়েকটি তরিকা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
১. কাদিরিয়া (Qadiriyya):
বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন, বিস্তৃত এবং প্রভাবশালী তরিকা হলো কাদিরিয়া। এর প্রতিষ্ঠাতা বড় পীর হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (মৃ. ১১৬৬ খ্রি.)। তার মাজার বাগদাদে অবস্থিত। তিনি ছিলেন হাম্বলি মাযহাবের একজন বড় আলেম। কাদিরিয়া তরিকার মূল বৈশিষ্ট্য হলো শরীয়তের প্রতি কঠোর আনুগত্য এবং আধ্যাত্মিকতার সমন্বয়। তারা বিশ্বাস করে, শরীয়ত বাদ দিয়ে কোনো মারেফত হতে পারে না। এই তরিকায় উচ্চস্বরে জিকির বা জিকির বিল-জাহর (Vocal Dhikr)-এর প্রচলন আছে। আফ্রিকা থেকে এশিয়া – সব জায়গায় এর অনুসারী পাওয়া যায়। তাদের শিক্ষা হলো – নফসের বা প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করাই হলো বড় জিহাদ। আব্দুল কাদির জিলানী তার ওয়াজে বলতেন, “তোমার নফসকে এমনভাবে পদদলিত করো যেন সে আর মাথা তুলতে না পারে।”
২. চিশতিয়া (Chishtiyya):
উপমহাদেশের (বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান) ইসলাম প্রচারে ও সুফি সংস্কৃতিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছে চিশতিয়া তরিকা। আফগানিস্তানের চিশত নামক গ্রামে এর উৎপত্তি হলেও, এটি পূর্ণতা পায় ভারতে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (মৃ. ১২৩৬ খ্রি.)-এর মাধ্যমে। তিনি আজমিরে বসতি স্থাপন করেন। চিশতিয়া তরিকার মূল দর্শন হলো ‘খিদমত ই খালক’ (Service to Creation) বা সৃষ্টির সেবা। তারা বলত, আল্লাহর ভালোবাসা পেতে হলে তার সৃষ্টির সেবা করতে হবে। এই তরিকার সুফিরা শাসকদের কাছ থেকে দূরে থাকতেন, কোনো রাজকীয় অনুদান নিতেন না। তাদের খানকায় লঙ্গরখানা (Community Kitchen) চালু থাকত, যেখানে হিন্দু-মুসলিম, রাজা-প্রজা সবাই এক পাতে খেত।
চিশতিয়া তরিকার আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো সামা (Spiritual Music) বা কাওয়ালির প্রতি অনুরাগ। তারা মনে করে, সুমধুর সুর ও সংগীতের মাধ্যমে মানুষের মনে আল্লাহর প্রেম জাগ্রত হয় এবং অন্তরের কঠিনতা দূর হয়। আমির খসরু এবং নিজামুদ্দিন আউলিয়ার সময়ে এই সংগীত এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছায়। চিশতিয়ারা ওয়াহদাতুল ওজুদ দর্শনে বিশ্বাসী, তাই তারা সব মানুষের মধ্যে স্রষ্টার আলো দেখতে পায়, যা তাদের অত্যন্ত অসাম্প্রদায়িক ও পরমত সহিষ্ণু করে তুলেছিল।
৩. নকশবন্দিয়া (Naqshbandiyya):
অন্যান্য তরিকা থেকে নকশবন্দিয়া তরিকা একটু আলাদা। এর প্রতিষ্ঠাতা খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দ (মৃ. ১৩৮৯ খ্রি.), যিনি মধ্য এশিয়ার বুখারার মানুষ ছিলেন। এই তরিকার বিশেষত্ব হলো এরা নীরব জিকির (Silent Dhikr) বা জিকির-ই-খফি-তে বিশ্বাসী। তারা মনে করে, জিকির হবে অন্তরে, জিহ্বায় নয়। লোক দেখানো ইবাদত বা অতিরিক্ত আবেগ তারা পছন্দ করে না। তাদের একটি বিখ্যাত নীতি হলো ‘খালওয়াত দার আনজুমান’ (Solitude in the Crowd) – অর্থাৎ, তুমি ভিড়ের মধ্যে থাকবে, বাজারে ব্যবসা করবে, কিন্তু তোমার অন্তর থাকবে আল্লাহর সাথে একাকী।
নকশবন্দিয়া তরিকা শরীয়ত পালনে অত্যন্ত কঠোর এবং বিদআত বিরোধী। এরা রাজনীতি বা রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে দূরে থাকে না, বরং শাসকদের সঠিক পথে রাখার জন্য রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে। অটোমান সুলতান এবং মুঘল সম্রাটদের (বিশেষ করে আওরঙ্গজেব) ওপর এই তরিকার ব্যাপক প্রভাব ছিল। নকশবন্দিয়া সিলসিলা বা চেইন হযরত আবু বকর-এর সাথে যুক্ত বলে দাবি করা হয়, যেখানে অন্য সব তরিকা আলী-এর সাথে যুক্ত। এই তরিকার মুজাদ্দিদিয়া শাখাটি উপমহাদেশে বেশ শক্তিশালী।
৪. মৌলভী (Mevlevi):
এই তরিকাটি পশ্চিম বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পরিচিত এর প্রতিষ্ঠাতা জালালুদ্দিন রুমির (মৃ. ১২৭৩ খ্রি.) কারণে। রুমি ছিলেন বর্তমান আফগানিস্তানের বলখ অঞ্চলের মানুষ, কিন্তু মঙ্গোল আক্রমণের ভয়ে পালিয়ে তুরস্কে (তৎকালীন আনাতোলিয়া) চলে যান এবং কোনিয়া শহরে স্থায়ী হন। তার বিখ্যাত গ্রন্থ মসনবী-কে ফারসি ভাষার কুরআন বলা হয়, যেখানে তিনি গল্পের ছলে গভীর আধ্যাত্মিক তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন।
মৌলভী তরিকার সুফিদের বলা হয় ঘূর্ণায়মান দরবেশ (Whirling Dervishes)। তারা এক ধরণের বিশেষ ‘সামা‘ বা নাচের আয়োজন করে। তাদের পোশাকের বিশেষ অর্থ আছে – মাথায় লম্বা টুপি কবরের পাথরের প্রতীক, আর সাদা আলখিল্লা কাফনের কাপড়ের প্রতীক। তারা যখন ঘোরে, তখন তারা ডান হাত আকাশের দিকে রাখে (আল্লাহর রহমত পাওয়ার জন্য) আর বাম হাত মাটির দিকে রাখে (সেই রহমত পৃথিবীতে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য)। তাদের এই ঘূর্ণন আসলে গ্রহ-নক্ষত্রের মহাজাগতিক ঘূর্ণন এবং আল্লাহর প্রেমে বিলীন হওয়ার প্রতীক। এই তরিকাটি একসময় অটোমান সাম্রাজ্যের অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে খুব জনপ্রিয় ছিল।
৫. সোহরাওয়ার্দীয়া (Suhrawardiyya):
এই তরিকার প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আবু নজিব সোহরাওয়ার্দী এবং তার ভাতিজা শায়খ শিহাবউদ্দিন সোহরাওয়ার্দী (মৃ. ১২৩৪ খ্রি.)। বাগদাদে এর জন্ম হলেও এটি ভারতীয় উপমহাদেশে, বিশেষ করে মুলতান এবং বাংলায় খুব প্রভাবশালী ছিল। সোহরাওয়ার্দী তরিকা চিশতিয়াদের মতো এত বেশি ত্যাগী ছিল না। তারা মনে করত, সম্পদ বা ক্ষমতা থাকলেই যে মানুষ খারাপ হয়ে যাবে তা নয়। যদি অন্তর ঠিক থাকে, তবে রাজপ্রাসাদে থেকেও ফকির হওয়া সম্ভব। তাই তারা শাসকদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখত এবং প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় পদ গ্রহণ করত। বাংলাদেশে সিলেটে হযরত শাহজালাল-এর সাথে এই তরিকার আধ্যাত্মিক সংযোগ পাওয়া যায় (যদিও তিনি নিজে কোন তরিকায় বায়াত ছিলেন তা নিয়ে ভিন্ন মত আছে, তবে তার সঙ্গীদের মধ্যে সোহরাওয়ার্দী প্রভাব ছিল)। তাদের সাধনা পদ্ধতি বেশ সুশৃঙ্খল এবং তারা নামাজ ও রোজার ওপর খুব জোর দেয়।
৬. শাযিলিয়া (Shadhiliyya):
উত্তর আফ্রিকা, বিশেষ করে মরক্কো, তিউনিসিয়া এবং মিশরে এই তরিকা অত্যন্ত জনপ্রিয়। এর প্রতিষ্ঠাতা আবুল হাসান আল-শাযিলি (মৃ. ১২৫৮ খ্রি.)। এটি একটি অত্যন্ত বৌদ্ধিক (Intellectual) বা জ্ঞানগর্ভ তরিকা। শাযিলিয়া তরিকা বলে, আল্লাহকে পাওয়ার জন্য জঙ্গল বা পাহাড়ে যাওয়ার দরকার নেই, দুনিয়া ছাড়ারও দরকার নেই। তুমি ভালো পোশাক পরবে, ভালো খাবে, আল্লাহর নিয়ামত ভোগ করবে এবং তার শুকরিয়া আদায় করবে – এভাবেই আল্লাহকে পাওয়া সম্ভব। তারা বলে, “জলের ওপর হাঁটা বা বাতাসে ওড়া কোনো কারামতি নয়, ওটা তো পাখি আর ব্যাঙও পারে। আসল কারামতি হলো সঠিক পথে অটল থাকা।” আধুনিক যুগে পশ্চিমা বিশ্বে, বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকায় যারা ইসলাম গ্রহণ করে সুফিবাদের দিকে ঝুঁকছেন, তাদের মধ্যে শাযিলিয়া তরিকার (বিশেষ করে শায়খ আব্দুল কাদির আস-সুফি বা রেনে গেনোঁর অনুসারী) প্রভাব বেশি দেখা যায়। তাদের দর্শন আধুনিক শিক্ষিত মানুষের কাছে বেশ গ্রহণযোগ্য।
৭. তিজানিয়া (Tijaniyya):
এটি তুলনামূলকভাবে নতুন একটি তরিকা, যার উদ্ভব অষ্টাদশ শতাব্দীতে উত্তর আফ্রিকায়। এর প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আহমদ আল-তিজানি (মৃ. ১৮১৫ খ্রি.)। বর্তমানে পশ্চিম আফ্রিকা (সেনেগাল, নাইজেরিয়া, ঘানা) এবং সুদানে এটি সবচেয়ে বড় গণ-আন্দোলন। তিজানিয়া তরিকা খুব সামাজিক এবং সঙ্ঘবদ্ধ। তারা দাবি করে যে, তাদের প্রতিষ্ঠাতা সরাসরি নবী মুহাম্মদের কাছ থেকে স্বপ্নে বা বিশেষ অবস্থায় ওজিফা বা জিকির পেয়েছেন। এই তরিকাটি আফ্রিকান সমাজে ইসলাম প্রচারে এবং ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে বড় ভূমিকা রেখেছে। তারা তাদের নির্দিষ্ট কিছু ওজিফা বা জিকির (যেমন সালাত আল-ফাতিহ) নিয়মিত পাঠ করার ওপর খুব জোর দেয়।
৮. বেকতাশি (Bektashi):
অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে এই তরিকার গুরুত্ব অপরিসীম। হাজী বেকতাশ ভেলি (ত্রয়োদশ শতাব্দী) এর প্রতিষ্ঠাতা। এটি একটি অত্যন্ত সমন্বয়বাদী (Syncretic) তরিকা, যেখানে শিয়া বিশ্বাস, সুফিবাদ এবং প্রাক-ইসলামি তুর্কি ও বলকান প্রথার মিশ্রণ ঘটেছে। অটোমান সেনাবাহিনীর এলিট ফোর্স জেনিসারি (Janissaries)-রা সবাই এই তরিকার অনুসারী ছিল। বেকতাশিরা শরিয়তের নিয়মকানুনের চেয়ে বাতেনি অর্থের ওপর বেশি জোর দেয়। তারা নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশায় বিশ্বাসী ছিল এবং তাদের অনুষ্ঠানে মদ পানেরও (রূপক বা আক্ষরিক) রেওয়াজ ছিল বলে জানা যায়। ১৮২৬ সালে সুলতান মাহমুদ দ্বিতীয় জেনিসারি বাহিনীকে ধ্বংস করার সময় এই তরিকাকেও নিষিদ্ধ করেছিলেন, তবে বলকান অঞ্চলে (বিশেষ করে আলবেনিয়ায়) এটি এখনো টিকে আছে।
সুফিবাদের কাঠামো ও প্রভাব: পীর, মুরিদ ও খানকা
সুফিবাদের প্রাণভোমরা হলো পীর-মুরিদ (Master-Disciple) সম্পর্ক। সুফিরা বিশ্বাস করে, বই পড়ে ডাক্তার হওয়া যায়, কিন্তু ডাক্তার না হলে যেমন অপারেশন শেখা যায় না, তেমনি বই পড়ে আল্লাহকে পাওয়া যায় না। এর জন্য দরকার একজন পথপ্রদর্শক বা ‘রাহবার’। মুরিদকে হতে হয় পীরের হাতে ‘মৃত লাশের মতো’ – অর্থাৎ গোসল করানোর সময় লাশ যেমন নড়াচড়া করে না, মুরিদও পীরের নির্দেশের সামনে কোনো প্রশ্ন করবে না। একে বলা হয় ফানা ফিল শায়খ (Annihilation in the Sheikh), যা শেষ পর্যন্ত ফানা ফিল্লাহ (Annihilation in God)-তে নিয়ে যায়।
সুফিদের কেন্দ্রবিন্দু হলো খানকা (Lodge) বা দরগাহ। মধ্যযুগে এই খানকাগুলো ছিল সমাজসেবার কেন্দ্র। সেখানে পথিকরা আশ্রয় পেত, ক্ষুধার্তরা খাবার পেত। ইসলাম যখন নতুন কোনো অঞ্চলে ছড়িয়েছে, তখন তলোয়ারের চেয়ে এই খানকাগুলোর ভূমিকা ছিল বেশি। বাংলায় ইসলাম প্রচারে সুফিদের ভূমিকা ঐতিহাসিক। এখানকার জেলেরা, কৃষকরা সুফিদের অলৌকিক ক্ষমতা বা কারামাত (Miracles) দেখে নয়, বরং তাদের চরিত্র, সাম্য ও ভালোবাসা দেখেই দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। সুফিরা স্থানীয় সংস্কৃতিকে ইসলামের সাথে মিশিয়ে নিয়েছিলেন। তারা স্থানীয় ভাষায় কবিতা লিখেছেন, গান গেয়েছেন। যেমন – বাংলার বাউল দর্শনের সাথে সুফিবাদের এক গভীর মিতালী তৈরি হয়েছে, যার প্রমাণ লালন সাইয়ের গান।
আধুনিক যুগে সুফিবাদ: সংকট ও সম্ভাবনা
ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে সুফিবাদ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। একদিকে পশ্চিমা আধুনিকতা ও বস্তুবাদ, অন্যদিকে ওহাবি বা সালাফি আন্দোলনের মতো সংস্কারবাদী ধারা সুফিবাদের কঠোর সমালোচনা শুরু করে। সংস্কারবাদীরা বলতে শুরু করেন যে, পীর পূজা, মাজার জিয়ারত এবং কাওয়ালি – এসব হলো বিদআত ও শিরক। তারা ইসলামের ‘বিশুদ্ধ’ রূপে ফেরার ডাক দেয়, যেখানে সুফিবাদের মরমী বা আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যার কোনো স্থান নেই। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে সুফিদের প্রভাব কিছুটা কমে যায়।
তবে মজার ব্যাপার হলো, প্রাচ্যে কমলেও পাশ্চাত্যে সুফিবাদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। আধুনিক মানুষ যান্ত্রিক জীবনে হাঁপিয়ে উঠে শান্তির খোঁজে রুমির কবিতা পড়ছে, ইবনে আরাবির দর্শন বুঝছে। পশ্চিমা পণ্ডির্ডরা সুফিবাদকে ইসলামের ‘সফট পাওয়ার’ হিসেবে দেখছেন। তাছাড়া মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশে (যেমন মরক্কো, তুরস্ক, চেচনিয়া) রাষ্ট্র এখন উগ্রবাদ দমনের হাতিয়ার হিসেবে সুফিবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে। কারণ, সুফিবাদ সহজাতভাবেই সহনশীল, অহিংস এবং বহুলত্ববাদী।
সুফিবাদ আমাদের শেখায় যে, ধর্মের বহিরাবরণ বা খোসা নিয়ে মারামারি করা বোকামি, আসল হলো শাঁস বা অন্তরের নির্যাস। খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি বলতেন, “সূর্যের মতো প্রখর স্নেহ, নদীর মতো উদারতা এবং মাটির মতো আতিথেয়তা – যার মধ্যে এই তিনটি গুণ আছে, সেই আল্লাহর বন্ধু।” এই বাণীই সুফিবাদের সারকথা। যতক্ষণ মানুষের মনে ভালোবাসার তৃষ্ণা থাকবে, অজানাকে জানার আগ্রহ থাকবে, ততক্ষণ সুফিবাদ তার নিজস্ব মহিমায় বেঁচে থাকবে – খানকার জিকিরে, দরবেশের নাচে কিংবা কোনো এক বাউলের একতারায়।
আধুনিক আন্দোলন ও সংস্কারবাদ: আত্মজিজ্ঞাসা ও উত্তরণের পথ
অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দী মুসলিম বিশ্বের জন্য ছিল এক গভীর বিষাদ ও বিস্ময়ের কাল। যে সভ্যতা একসময় জ্ঞান-বিজ্ঞান আর শৌর্যবীর্যে পৃথিবীকে শাসন করেছে, যাদের তলোয়ারের ঝলকানিতে পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত কম্পিত হতো, তারা হঠাৎ দেখল তাদের পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে। একদিকে অটোমান সাম্রাজ্য বা ‘তুরস্কের রুগ্ন মানুষ’ ধুঁকছে, অন্যদিকে ভারতের মুঘল সূর্য অস্তমিত। ইউরোপের শিল্প বিপ্লব আর আধুনিক সমরাস্ত্রের সামনে মুসলিমরা তখন অসহায়। তারা শুধু হারছেই না, বরং মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে। ঠিক এই ক্রান্তিলগ্নে মুসলিম মানসজগতে এক বিশাল আত্মজিজ্ঞাসা (Self-Introspection) তৈরি হলো – কেন আমাদের এই পতন? আল্লাহ কি আমাদের ওপর অসন্তুষ্ট? নাকি আমরা ইসলামকে ভুলভাবে পালন করছি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই মুসলিম বিশ্ব তোলপাড় হলো নানা সংস্কার আন্দোলনে। কেউ বলল, “আমরা মূল থেকে সরে গেছি, তাই শেকড়ে ফিরতে হবে।” আবার কেউ বলল, “না, আমরা সময়ের সাথে তাল মেলাতে পারিনি, তাই আধুনিক হতে হবে।” এই দ্বিমুখী স্রোত থেকেই জন্ম নিল আধুনিক যুগের প্রধান ইসলামি আন্দোলনগুলো। এই আন্দোলনগুলো কেবল ধর্মীয় বিতর্ক ছিল না, এগুলো ছিল অস্তিত্ব রক্ষার একেকটি মরিয়া প্রচেষ্টা।
ওয়াহাবি ও সালাফি আন্দোলন: শুদ্ধতাবাদের কঠোর আহ্বান
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, আরবের রুক্ষ ও শুষ্ক নজদ মালভূমি থেকে এক নতুন আওয়াজ উঠল। এই আওয়াজের কারিগর ছিলেন মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব (১৭০৩-১৭৯২)। তিনি দেখলেন, তার চারপাশের মানুষ কালেমা পড়লেও তাদের জীবনাচরণে ঢুকে গেছে শিরক বা বহুঈশ্বরবাদ। মানুষ কবরে গিয়ে সাহায্য চাইছে, পীর-ফকিরদের কাছে সন্তান কামনা করছে, গাছ ও পাথরকে পবিত্র মনে করছে। তিনি ডাক দিলেন এক কঠোর একেশ্বরবাদ বা তাওহীদ (Monotheism)-এর দিকে। তার আন্দোলনের মূল কথা ছিল – কুরআন ও সুন্নাহর আক্ষরিক ও আদি রূপে ফিরে যাওয়া। তিনি সুফিবাদ (Sufism), মাজার জিয়ারত, নবীর শাফায়াত বা সুপারিশ চাওয়া এবং মাযহাবের অন্ধ অনুকরণকে ইসলাম বহির্ভূত বিদআত (Innovation) বলে ঘোষণা করলেন। তার মতে, মুসলিমদের পতনের মূল কারণ হলো তারা ইসলামের বিশুদ্ধতা হারিয়ে ফেলেছে।
এই আন্দোলনটি কেবল ধর্মীয় বয়ানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, এটি দ্রুতই রাজনৈতিক রূপ নিল। ১৭৪৪ সালে ইবনে আব্দুল ওয়াহাব স্থানীয় গোত্রপতি মুহাম্মদ বিন সৌদের সাথে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি করেন। সৌদ দিলেন তলোয়ার বা রাজনৈতিক সুরক্ষা, আর আব্দুল ওয়াহাব দিলেন মতাদর্শ বা ধর্মীয় বৈধতা। এই জোটের ভিত্তিতেই আজকের সৌদি আরব রাষ্ট্রের জন্ম। তারা মক্কা ও মদিনা দখল করে অনেক ঐতিহাসিক মাজার ও গম্বুজ ভেঙে ফেলল, যা মুসলিম বিশ্বের বাকি অংশের জন্য ছিল এক বিশাল ধাক্কা। তাদের বিরোধীরা তাদের ‘ওয়াহাবি’ বলে ডাকলেও, তারা নিজেদের পরিচয় দেয় মুওয়াহহিদুন (Unitarians) বা একত্ববাদী হিসেবে। আধুনিক যুগে এই চিন্তাধারার একটি পরিশীলিত ও বিস্তৃত রূপ হলো সালাফি (Salafi) আন্দোলন। ‘সালাফ’ মানে হলো পূর্বসূরী। তারা বলে, আমরা পরবর্তী যুগের কোনো ইমাম বা পণ্ডিতের ব্যাখ্যা মানি না, আমরা সরাসরি সাহাবী ও তাবেঈদের বা ‘সালাফ আস-সালেহীন’-এর পথ অনুসরণ করি। বিংশ শতাব্দীতে পেট্রো-ডলারের প্রভাবে এই মতবাদটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে সংঘাতে লিপ্ত হয় (Commins, 2006)।
দেওবন্দি আন্দোলন: ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও শিক্ষার দুর্গ
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব ছিল ভারতের মুসলিমদের জন্য এক চূড়ান্ত বিপর্যয়। মুঘল সাম্রাজ্যের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া হলো। হাজার হাজার আলেমকে ব্রিটিশরা ফাঁসি দিল। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ভারতের আলেম সমাজ বুঝতে পারলেন, তলোয়ার দিয়ে ব্রিটিশদের হারানো এখন সম্ভব নয়। এখন দরকার মুসলিমদের ঈমান ও সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা। এই লক্ষ্য নিয়েই ১৮৬৬ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের দেওবন্দ নামক স্থানে একটি মাদ্রাসার গোড়াপত্তন হয় – দারুল উলুম দেওবন্দ। মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতুবি এবং রশিদ আহমদ গাঙ্গোহির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই আন্দোলনটি ছিল মূলত একটি শিক্ষাকেন্দ্রিক সংস্কার আন্দোলন।
দেওবন্দি (Deobandi) মতাদর্শ হলো সুন্নি ইসলামের একটি অনন্য মিশ্রণ। ফিকহ বা আইনের ক্ষেত্রে তারা কঠোরভাবে হানাফি (Hanafi) মাযহাব মেনে চলে। আকিদা বা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তারা মাতুরিদি (Maturidi)। আর আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে তারা সুফিবাদের বিরোধী নয়, বরং চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া, কাদিরিয়া ও সোহরাওয়ার্দীয়া – এই চার তরিকার চর্চা করে। তবে তাদের সুফিবাদ হলো সংস্কারকৃত সুফিবাদ (Reformed Sufism)। তারা পীর-মুরিদি মানে, কিন্তু মাজার জিয়ারত, উরস, কাওয়ালি বা গান-বাজনা এবং মিলাদ পড়াকে বিদআত মনে করে। দেওবন্দের মূল লক্ষ্য ছিল এমন একদল আলেম তৈরি করা, যারা ব্রিটিশ শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে। তারা দরসে নিজামি (Dars-e-Nizami) সিলেবাসের মাধ্যমে ধ্রুপদী ইসলামি শিক্ষার প্রসার ঘটায়। দেওবন্দিরা ঐতিহাসিকভাবে ব্রিটিশ বিরোধী ছিল এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের বিশাল ভূমিকা ছিল। তাবলিগ জামাত মূলত এই দেওবন্দি চিন্তাধারারই একটি প্রচারমুখী শাখা। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়া (বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান) এবং আফগানিস্তানের অধিকাংশ মাদ্রাসা এই মতাদর্শের অনুসারী (Reetz, 2006)।
বেরলভি আন্দোলন: প্রেমের প্লাবন ও নূরের বিশ্বাস
দেওবন্দিরা যখন ইসলামকে যুক্তিনির্ভর এবং আচার-সর্বস্ব বিদআত থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছিল, তখন তার তীব্র প্রতিক্রিয়া হিসেবে আরেকটি দলের জন্ম হলো। ভারতের বেরেলি জেলার মাওলানা আহমদ রেজা খান (১৮৫৬-১৯২১) এর নেতৃত্ব দিলেন। এই আন্দোলনের নাম বেরলভি (Barelvi), যদিও তারা নিজেদের পরিচয় দেয় ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত’ হিসেবে। বেরলভিদের মূল দর্শন দাঁড়িয়ে আছে নবী মুহাম্মদের প্রতি অত্যধিক ভক্তি ও ভালোবাসার ওপর। তারা মনে করে, দেওবন্দি ও ওয়াহাবিরা নবীর সম্মান কমিয়ে তাকে সাধারণ মানুষের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে, যা ঈমানের জন্য ধ্বংসাত্মক।
বেরলভি ধর্মতত্ত্বের কেন্দ্রে রয়েছে নূর-ই-মুহাম্মদি (Light of Muhammad) ধারণা। তারা বিশ্বাস করে নবীজি মাটির তৈরি নন, তিনি নূরের তৈরি এবং তিনি আল্লাহর হাবিব। তাদের আরেকটি বিতর্কিত আকিদা হলো হাজির ও নাজির (Omnipresent Witness) – অর্থাৎ নবীজি আধ্যাত্মিকভাবে সর্বত্র উপস্থিত থাকতে পারেন এবং উম্মতের অবস্থা দেখতে পান। তারা আরও বিশ্বাস করে নবীজির ইলমুল গায়েব (Knowledge of the Unseen) বা অদৃশ্যের জ্ঞান ছিল। বেরলভিরা সুফিবাদের আচার-অনুষ্ঠান যেমন – মাজারে উরস করা, মিলাদ ও কিয়াম (দাঁড়িয়ে নবীর শানে দুরুদ পড়া), জশনে জুলুস এবং পীরদের শাফায়াতে গভীরভাবে বিশ্বাসী। তাদের কাছে ধর্ম হলো আবেগের বিষয়, তর্কের নয়। দক্ষিণ এশিয়ার গ্রাম-বাংলায় এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে এই মতবাদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। সুন্নি ও সুফি ঘরানার অধিকাংশ মানুষই এই মতের অনুসারী, যদিও তারা হয়তো ‘বেরলভি’ নামটা ব্যবহার করে না (Sanyal, 1996)।
ইসলামি আধুনিকতাবাদ: যুক্তি ও বিজ্ঞানের সাথে মিতালী
একদিকে যখন রক্ষণশীলরা অতীতকে আঁকড়ে ধরছিল, অন্যদিকে একদল বুদ্ধিজীবী বুঝলেন যে, পশ্চিমা বিজ্ঞান ও দর্শনকে পুরোপুরি অস্বীকার করে মুসলিমরা এগোতে পারবে না। তারা চাইলেন ইসলামের সাথে আধুনিকতার একটা সন্ধি করতে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে জামালুদ্দিন আফগানি, মিশরের মুফতি মুহাম্মদ আবদুহু এবং ভারতের স্যার সৈয়দ আহমদ খান ছিলেন এই ধারার অগ্রপথিক। একে বলা হয় ইসলামি আধুনিকতাবাদ (Islamic Modernism)। তাদের মূল বক্তব্য ছিল – ইসলামের মূল স্পিরিট বা নির্যাস আধুনিক বিজ্ঞান, যুক্তি ও গণতন্ত্রের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। সংঘাত যা আছে, তা হলো মধ্যযুগীয় ভুল ব্যাখ্যার সাথে।
আধুনিকতাবাদীরা বললেন, যুগের প্রয়োজনে আমাদের তাকলিদ (Taqlid) বা অন্ধ অনুকরণ বাদ দিয়ে ইজতিহাদ (Ijtihad) বা নতুন করে গবেষণার দরজা খুলতে হবে। জামালুদ্দিন আফগানি ডাক দিলেন প্যান-ইসলামিজম (Pan-Islamism)-এর, অর্থাৎ সব মুসলিম দেশকে এক হয়ে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। মুহাম্মদ আবদুহু আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে বিজ্ঞান ও দর্শন অন্তর্ভুক্ত করলেন। আর স্যার সৈয়দ আহমদ খান আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে বললেন, “এক হাতে কুরআন, আর এক হাতে বিজ্ঞান” – এটাই হবে মুসলিমদের উন্নতির চাবিকাঠি। তারা ব্যাখ্যা দিলেন যে, কুরআনের জিন বা ফেরেশতা সংক্রান্ত আয়াতগুলো রূপক হতে পারে, এবং আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকেই ধর্মকে বুঝতে হবে। যদিও রক্ষণশীল আলেম সমাজ তাদের ‘পাশ্চাত্যের দালাল’ বা ধর্মহীন বলে সমালোচনা করেছিল, তবুও আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর গঠনতন্ত্র ও শিক্ষাব্যবস্থায় তাদের চিন্তার প্রভাব অপরিসীম (Hourani, 1983)।
রাজনৈতিক ইসলাম বা ইসলামিজম: রাষ্ট্র যখন ধর্ম
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে, বিশেষ করে ১৯২৪ সালে কামাল আতাতুর্ক যখন আনুষ্ঠানিকভাবে খিলাফত প্রথা বিলুপ্ত করলেন, তখন মুসলিম বিশ্বে এক বিশাল রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হলো। এতদিন মুসলিমরা জানত তাদের একজন খলিফা আছেন, কিন্তু এখন তারা এতিম হয়ে গেল। এই প্রেক্ষাপটে ইসলামকে নিছক ধর্ম হিসেবে নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক মতবাদ বা আইডিওলজি (Ideology) হিসেবে দেখার প্রবণতা শুরু হলো। একে বলা হয় রাজনৈতিক ইসলাম (Political Islam) বা ইসলামিজম (Islamism)। এর মূল কথা হলো – ইসলাম শুধু মসজিদে নামাজ পড়ার নাম নয়, বরং রাষ্ট্র পরিচালনা, অর্থনীতি ও বিচার ব্যবস্থার নাম।
মিশরে হাসান আল-বান্না ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন মুসলিম ব্রাদারহুড (Muslim Brotherhood)। শুরুতে এটি একটি সমাজসেবামূলক সংগঠন থাকলেও পরে এটি বিশাল রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। বান্নার পরে সাইয়েদ কুতুব এই আন্দোলনকে আরও তাত্ত্বিক রূপ দেন। তার বিখ্যাত বই মাইলস্টোনস (Ma’alim fi al-Tariq)-এ তিনি আধুনিক মুসলিম সমাজকে জাহিলিয়াত (Jahiliyyah) বা প্রাক-ইসলামি মূর্খতার যুগের সাথে তুলনা করেন। তিনি বলেন, আল্লাহর আইন ছাড়া মানুষের তৈরি আইনে দেশ চালানো মানে খোদাদ্রোহিতা। তার হাকিমিয়্যাহ (Sovereignty of God) বা আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ধারণা পরবর্তীতে অনেক বিপ্লবী ও জিহাদি গোষ্ঠীকে অনুপ্রাণিত করে। অন্যদিকে, উপমহাদেশে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী ১৯৪১ সালে জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ‘থিও-ডেমোক্রেসি’ বা ধর্মীয় গণতন্ত্রের কথা বলেন, যেখানে শাসকরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবে ঠিকই, কিন্তু তারা আল্লাহর দেওয়া আইনের বাইরে যেতে পারবে না। রাজনৈতিক ইসলামের এই ধারাগুলো আধুনিক বিশ্বে ইসলামি দলগুলোর জন্ম দিয়েছে, আবার এর উগ্র ব্যাখ্যা থেকে জন্ম নিয়েছে আল-কায়েদা বা আইসিসের মতো ধ্বংসাত্মক গোষ্ঠী, যারা মনে করে বলপ্রয়োগ করে হলেও ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করতে হবে (Esposito, 1997)।
এই পাঁচটি ধারা – ওয়াহাবিবাদের শুদ্ধতা, দেওবন্দের ঐতিহ্যরক্ষা, বেরলভিদের প্রেম, আধুনিকতাবাদীদের যুক্তি এবং রাজনৈতিক ইসলামের রাষ্ট্রচিন্তা – আজকের মুসলিম বিশ্বের মানচিত্র তৈরি করেছে। একজন আধুনিক মুসলিমের চিন্তাজগতে এদের কোনো না কোনোটির প্রভাব অবশ্যই আছে, তা তিনি জানুন বা না জানুন।
প্রান্তিক মতবাদ, লৌকিক ইসলাম ও সমন্বয়বাদ
ইসলাম যখন আরব উপদ্বীপ থেকে বেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল, তখন তা কেবল একটি ধর্ম হিসেবে থাকেনি, বরং স্থানীয় সংস্কৃতি, প্রথা এবং বিশ্বাসের সাথে মিশে নতুন নতুন রূপ পরিগ্রহ করেছে। মূলধারার সুন্নি বা শিয়া মতবাদের বাইরেও এমন কিছু দল ও উপদল তৈরি হয়েছে, যারা ইসলামকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছে। কখনো রাজনৈতিক প্রয়োজনে, কখনো আধ্যাত্মিক পিপাসায়, আবার কখনো বা ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতিক্রিয়ায় এসব মতবাদের জন্ম। এদের কাউকে মূলধারা গ্রহণ করেছে, কাউকে বা ধর্মচ্যুত বলে ঘোষণা করেছে। এই অংশটি সেই বিতর্কিত এবং বৈচিত্র্যময় জগত নিয়ে, যা মূলধারার ইতিহাসের বইতে অনেক সময় উপেক্ষিত থাকে।
আহমদিয়া আন্দোলন: নবীত্বের বিতর্কিত দাবি
উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ব্রিটিশ শাসিত ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে এক নতুন ধর্মীয় আন্দোলনের জন্ম হয়, যা মুসলিম বিশ্বে তীব্র বিতর্কের ঝড় তোলে। ১৮৮৯ সালে মির্জা গোলাম আহমদ (১৮৩৫-১৯০৮) নিজেকে মুজাদ্দিদ (সংস্কারক) এবং পরবর্তীতে প্রতিশ্রুত মসীহ ও মাহদি হিসেবে দাবি করেন। তার এই আন্দোলন আহমদিয়া (Ahmadiyya) জামাত নামে পরিচিত, যদিও বিরোধীরা তাদের কাদিয়ানি (মির্জার জন্মস্থান কাদিয়ানের নামানুসারে) বলে ডাকে। আহমদিয়াদের সাথে মূলধারার মুসলিমদের বিরোধের প্রধান কারণ হলো ‘খতমে নবুওয়াত’ বা নবুওয়াতের সমাপ্তির ধারণা। মূলধারার মুসলিমরা বিশ্বাস করে মুহাম্মদ হলেন শেষ নবী এবং তার পরে আর কোনো নবী আসবেন না। কিন্তু মির্জা গোলাম আহমদ দাবি করেন যে, তিনি একজন উম্মতি নবী (Subordinate Prophet), অর্থাৎ তিনি নতুন কোনো শরিয়ত আনেননি, বরং মুহাম্মদের শরিয়তকেই পুনরুজ্জীবিত করতে এসেছেন। তার এই দাবিকে সুন্নি ও শিয়া – উভয় দলই কুফরি বলে প্রত্যাখ্যান করে।
আহমদিয়া সম্প্রদায় আবার দুই ভাগে বিভক্ত। একদল হলো কাদিয়ানি (Qadiani) অংশ, যারা বিশ্বাস করে মির্জা গোলাম আহমদ সত্যিই নবী ছিলেন (যদিও উম্মতি নবী)। বর্তমানে তাদের খলিফা লন্ডন থেকে বিশ্বব্যাপী কার্যক্রম পরিচালনা করেন। অন্য দলটি হলো লাহোরি (Lahori) অংশ, যারা মির্জা গোলাম আহমদকে নবী মনে করে না, বরং একজন মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক মনে করে। আহমদিয়ারা নিজেদের মুসলিম দাবি করলেও পাকিস্তানসহ অনেক মুসলিম দেশে তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘অমুসলিম’ ঘোষণা করা হয়েছে। তবুও বিশ্বব্যাপী তাদের সুশৃঙ্খল মিশনারি কার্যক্রম এবং শান্তিপূর্ণ প্রচারণার কারণে তারা একটি উল্লেখযোগ্য সম্প্রদায় হিসেবে টিকে আছে (Friedmann, 1989)।
লৌকিক ইসলাম: কিতাবের বাইরে জীবনের ধর্ম
বইয়ের পাতায় লেখা ইসলাম বা অর্থোডক্সি (Orthodoxy) আর গ্রামের সাধারণ মানুষের পালন করা ইসলামের মধ্যে অনেক সময় ফারাক দেখা যায়। একে সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন লৌকিক ইসলাম (Folk Islam) বা জনপ্রিয় ইসলাম (Popular Islam)। এখানে ধর্মতত্ত্বের চেয়ে প্রথা, বিশ্বাস এবং দৈনন্দিন জীবনের সংকট নিরসন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। লৌকিক ইসলামে আল্লাহ অনেক দূরের সত্তা, তাই মানুষ তার কাছে পৌঁছানোর জন্য মাধ্যম খোঁজে। এই মাধ্যম হলো পীর, ফকির, দরবেশ বা তাদের মাজার। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে এই লৌকিক ইসলামের প্রভাব প্রবল। এখানে মানুষ রোগমুক্তির জন্য মাজারে সুতো বাঁধে, মানত করে, জিনের আছর থেকে বাঁচতে তাবিজ ব্যবহার করে। ইন্দোনেশিয়ায় আবাঙান (Abangan) নামে এক বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠী আছে, যারা ইসলামি শরিয়তের সাথে সাথে প্রাচীন জাভানিজ প্রথা এবং পূর্বপুরুষের পূজাকে মিলিয়ে একধরনের লৌকিক ধর্ম পালন করে (Geertz, 1960)।
সিনক্রেটিজম বা সমন্বয়বাদ: ধর্মের মিথস্ক্রিয়া
যখন দুটি ভিন্ন ধর্ম বা সংস্কৃতি দীর্ঘদিন পাশাপাশি বসবাস করে, তখন তাদের মধ্যে আদান-প্রদান হয় এবং জন্ম নেয় নতুন এক মতবাদ। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় সিনক্রেটিজম (Syncretism) বা সমন্বয়বাদ। ইসলামের ইতিহাসে এর ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে।
১. বাউল দর্শন (Baul Tradition):
বাংলার বাউল দর্শন হলো সিনক্রেটিজমের এক অনন্য উদাহরণ। এখানে ইসলামি সুফিবাদ এবং হিন্দু বৈষ্ণব সহজিয়া মতবাদের এক অপূর্ব মিলন ঘটেছে। লালন সাই, হাসন রাজা বা শাহ আব্দুল করিমের গানে আমরা দেখি আল্লাহ এবং কৃষ্ণের প্রেমের একাকার রূপ। বাউলরা মসজিদে বা মন্দিরে যায় না, তারা ‘মনের মানুষ’-কে নিজের দেহের ভেতরে খোঁজে। তাদের দর্শন হলো দেহকেন্দ্রিক সাধনা (Corporeal Spirituality)। তারা বলে, “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।” রক্ষণশীল আলেম সমাজ বাউলদের ইসলাম বহির্ভূত মনে করে, কিন্তু বাংলার মুসলিম সংস্কৃতিতে এদের প্রভাব অনস্বীকার্য।
২. দ্রুজ (Druze):
একাদশ শতাব্দীতে মিশরের ফাতেমি খলিফা আল-হাকিম বি-আমরিল্লাহকে কেন্দ্র করে ইসমাইলি শিয়া মতবাদ থেকে বেরিয়ে আসা একটি দল। এরা লেবানন, সিরিয়া ও ইসরায়েলে বসবাস করে। দ্রুজরা নিজেদের ‘মুওয়াহহিদুন’ বা একত্ববাদী বলে, কিন্তু তাদের বিশ্বাস মূলধারার ইসলাম থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। তারা পুনর্জন্ম বা মেটামসাইকোসিস (Metempsychosis)-এ বিশ্বাস করে। তাদের ধর্মবিশ্বাস খুবই গোপন, কেবল নির্দিষ্ট বয়সের পর নির্বাচিত ব্যক্তিরাই বা ‘উক্কাল’-রাই ধর্মের সব রহস্য জানতে পারে।
৩. আলাউই (Alawite):
সিরিয়ার বর্তমান শাসকগোষ্ঠী এই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। এরাও শিয়া মতবাদের একটি অতি-বাতেনি শাখা। নবম শতাব্দীতে ইবনে নুসায়ের এর প্রবর্তন করেন। আলাউইরা আলীকে ঐশ্বরিক সত্তা বা আল্লাহর অবতারের মতো মনে করে। তাদের বিশ্বাসে খ্রিস্টধর্মের ট্রিনিটি, পারসিক ধর্মের আলোর ধারণা এবং ইসলামের ইমামত একাকার হয়ে গেছে। তারা মদ পানকে বৈধ মনে করে এবং তাদের নারীরা পর্দা করে না।
৪. ইয়েজিদি (Yezidi):
ইরাকের কুর্দিস্তান অঞ্চলে বসবাসরত এই গোষ্ঠীটি আন্তর্জাতিক নজরে আসে আইসিসের হাতে নির্যাতিত হওয়ার পর। ইয়েজিদি ধর্ম আসলে প্রাচীন মেসোপটেমীয় ধর্ম, জরথুস্ট্রবাদ এবং সুফিবাদের (বিশেষ করে শেখ আদি ইবনে মুসাফির-এর তরিকত) এক জটিল মিশ্রণ। তারা ‘তাউস মালেক’ বা ময়ূর ফেরেশতার পূজা করে। বাইরের অনেকে ভুল করে তাদের ‘শয়তানের পূজারি’ বলে, যা তাদের ওপর নির্যাতনের কারণ হয়েছে।
৫. শিখ ধর্ম (Sikhism):
পঞ্চদশ শতাব্দীতে ভারতের পাঞ্জাবে গুরু নানক যে ধর্ম প্রচার শুরু করেন, তাকে অনেকে হিন্দু ভক্তি আন্দোলন এবং ইসলামি সুফিবাদের এক সফল সিনক্রেটিজম বা সমন্বয় হিসেবে দেখেন। শিখ ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ গুরু গ্রন্থ সাহেব-এ বাবা ফরিদ নামের এক সুফি সাধকের অনেক শ্লোক অন্তর্ভুক্ত আছে। শিখরা মূর্তিপূজা করে না, তারা এক নিরাকার ঈশ্বরের (এক ওমকার) উপাসনা করে, যা ইসলামের তাওহীদের খুব কাছাকাছি।
৬. দীন-ই-ইলাহি (Din-i Ilahi):
মুঘল সম্রাট আকবর ১৫৮২ সালে বিভিন্ন ধর্মের সারবস্তু নিয়ে একটি নতুন নৈতিক ব্যবস্থা বা মতবাদ চালু করার চেষ্টা করেন। একে ধর্ম না বলে একটি ‘সুফি ভ্রাতৃত্ব’ বলাই শ্রেয়। এখানে ইসলাম, হিন্দু ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্ম, জৈন ধর্ম এবং জরথুস্ট্রবাদের উপাদান ছিল। আকবর চেয়েছিলেন তার বৈচিত্র্যময় সাম্রাজ্যের প্রজাদের এক সুতোয় বাঁধতে।
নেশন অফ ইসলাম: আমেরিকার কৃষ্ণ মুসলিম আন্দোলন
বিংশ শতাব্দীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকান-আমেরিকানদের মধ্যে এক অদ্ভুত ইসলামি আন্দোলনের জন্ম হয়, যার নাম নেশন অফ ইসলাম (Nation of Islam)। ১৯৩০ সালে ওয়ালেস ফার্ড মুহাম্মদ এটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরে এলিজা মুহাম্মদ এর নেতৃত্ব দেন। তাদের মূল বক্তব্য ছিল শ্বেতাঙ্গরা হলো শয়তান এবং কৃষ্ণাঙ্গরাই হলো আদি মানুষ ও আল্লাহর প্রিয়পাত্র। তারা আল্লাহকে মানুষরূপে কল্পনা করত এবং এলিজা মুহাম্মদকে আল্লাহর রাসূল মনে করত। ম্যালকম এক্স (Malcolm X) শুরুতে এই দলের মুখপাত্র ছিলেন এবং এর মাধ্যমেই তিনি ইসলামে আসেন। কিন্তু পরে তিনি হজ্জ করতে গিয়ে সাচ্চা ইসলামের বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ব দেখে নেশন অফ ইসলামের বর্ণবাদী দর্শন ত্যাগ করেন এবং মূলধারার সুন্নি ইসলাম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে এলিজা মুহাম্মদের ছেলে ওয়ারিথ দ্বীন মুহাম্মদও নেশন অফ ইসলামকে ভেঙে দিয়ে মূলধারার ইসলামের সাথে মিশিয়ে দেন। তবে লুইস ফারাকানের নেতৃত্বে একটি ছোট অংশ এখনো পুরনো বর্ণবাদী মতবাদ ধরে রেখেছে (Curtis, 2006)।
এই সব প্রান্তিক বা সমন্বয়বাদী আন্দোলনগুলো প্রমাণ করে যে, ধর্ম কোনো বদ্ধ পুকুর নয়, বরং এটি একটি প্রবহমান নদী। এই নদী যখন যে জনপদের ওপর দিয়ে গেছে, সেখানকার মাটি ও জল ধারণ করে নিজের রঙ বদলেছে। কেউ কেউ হয়তো এগুলোকে বিকৃতি বলবেন, আবার সমাজবিজ্ঞানীরা বলবেন অভিযোজন। কিন্তু ইতিহাসের ক্যানভাসে এরা প্রত্যেকেই তাদের নিজস্ব রঙে ইসলামের এক বিচিত্র ও বহুমাত্রিক ছবি এঁকেছে।
উপসংহার: বৈচিত্র্যের মানচিত্র ও ইতিহাসের আয়না
আমরা এতক্ষণ ধরে যে লম্বা ভ্রমণটা করলাম, তাতে একটা বিষয় পরিষ্কার – ইসলাম কোনো একরৈখা বা মনোলিথিক (Monolithic) সত্তা নয়। এটি একটি বিশাল বটবৃক্ষের মতো, যার শেকড় এক হলেও ডালপালা ছড়িয়েছে বহু দিকে। কাল, পাত্র এবং পরিবেশ ভেদে মানুষ ধর্মকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করেছে। এই ব্যাখ্যাগুলো আকাশ থেকে পড়েনি, এগুলো তৈরি হয়েছে মানুষের প্রয়োজনেই। কখনো রাজনৈতিক প্রয়োজনে, কখনো দার্শনিক তৃষ্ণা মেটাতে, আবার কখনো বা আধ্যাত্মিক শান্তির খোঁজে।
ইতিহাস বড়ই অদ্ভুত জিনিস। সপ্তম শতাব্দীর আরবের মরুভূমিতে যে ধর্মটি এসেছিল, তা যখন পারস্যের কার্পেট, স্পেনের স্থাপত্য, তুরস্কের কফি হাউজ আর বাংলার ধানের ক্ষেতের ওপর দিয়ে বয়ে গেল, তখন তা স্থানীয় সংস্কৃতি আর মানুষের চিন্তার রঙের সাথে মিশে নতুন নতুন রূপ নিল। শিয়া-সুন্নির (Shi’a-Sunni) বিভেদ যেমন রাজনৈতিক উচ্চাশা ও উত্তরাধিকারের দ্বন্দ্ব থেকে এসেছে, তেমনি মুতাজিলা (Mu’tazila) বা আশারিদের (Ash’ari) বিতর্ক এসেছে মানুষের চিরন্তন জিজ্ঞাসু মন থেকে। মানুষ জানতে চেয়েছে, আমার কি স্বাধীনতা আছে? নাকি সব আগে থেকেই লেখা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই মুসলিম মানসজগতে তৈরি হয়েছে বিশাল সব দর্শনের স্কুল। আবার প্রোটো-ধর্মতাত্ত্বিক আন্দোলন (Proto-theological Movements) – যেমন খারিজী (Kharijites) বা মুরজিয়া (Murji’a) – আমাদের দেখায় যে, একেবারে শুরুর দিকেও মুসলিম সমাজ কতটা বিভক্ত এবং একই সাথে প্রাণবন্ত ছিল। তারা অন্ধের মতো সব মেনে নেয়নি, বরং তলোয়ার এবং কলম – উভয় মাধ্যমেই নিজেদের মত প্রকাশ করেছে।
কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল – সেই বিচারে না গিয়ে একজন নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক হিসেবে দেখলে বোঝা যায়, এই বিভাজন বা স্কুলগুলো আসলে প্রমাণ করে যে, এই সভ্যতার ভেতরে একসময় প্রচুর বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা (Intellectual Discourse) ছিল। মানুষ শুধু মেনে নেয়নি, প্রশ্ন করেছে, তর্ক করেছে এবং নিজের মতো করে সত্যকে বোঝার চেষ্টা করেছে। হানাফি ফিকহ (Hanafi Fiqh) যদি যুক্তির দুয়ার না খুলত, কিংবা সুফিরা যদি প্রেমের কথা না বলত, তবে হয়তো ইসলামের ইতিহাস এত দীর্ঘ ও বৈচিত্র্যময় হতো না। এই যে এত মাযহাব, এত তরিকা, এত দল – এগুলোকে অনেকে দুর্বলতা হিসেবে দেখেন। মনে করেন, সবাই এক থাকলে কতই না ভালো হতো! কিন্তু মুদ্রার উল্টো পিঠটাও দেখা দরকার। এই বৈচিত্র্য বা প্লুরালিজম (Pluralism) একটি ধর্মের অভিযোজন ক্ষমতার (Adaptability) প্রমাণ। একটি কঠোর, অনমনীয় কাঠামো হাজার বছর ধরে টিকে থাকতে পারে না; তাকে টিকে থাকার জন্য নমনীয় হতে হয়, বিভিন্ন মতকে জায়গা দিতে হয়।
আজকের পৃথিবীতে আমরা প্রায়ই দেখি ভিন্ন মতের প্রতি অসহিষ্ণুতা। একদল আরেক দলকে বাতিল বলে ঘোষণা দিচ্ছে। কিন্তু ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি, ইমাম আবু হানিফা (Imam Abu Hanifa) এবং ইমাম মালিকের (Imam Malik) মধ্যে মতের অমিল ছিল, কিন্তু শ্রদ্ধার অভাব ছিল না। সুফিদের খানকা আর ফকিহদের মাদ্রাসার মধ্যে বিরোধ ছিল, আবার সমন্বয়ও ছিল। এই ঐতিহাসিক সহনশীলতা বা ‘Agree to Disagree’-এর মানসিকতা আধুনিক যুগে বড় বেশি প্রয়োজন। দিনশেষে, এই স্কুলগুলো বা শাখা-প্রশাখাগুলো মানুষেরই তৈরি করা বাউন্ডারি বা মানচিত্র। সবাই একই গন্তব্যে পৌঁছাতে চায়, শুধু পথের ম্যাপটা তাদের হাতে আলাদা। কেউ পাহাড় ডিঙিয়ে যেতে চায়, কেউ নদী পার হয়ে, আবার কেউ বা সমতল পথ খোঁজে।
ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমাদের কাজ হলো এই মানচিত্রগুলোকে বোঝা, বিচার করা নয়। কারণ, বিশ্বাস মানুষের একান্তই ব্যক্তিগত অনুভূতির জায়গা, আর ইতিহাস হলো সেই অনুভূতির সামষ্টিক প্রকাশ। এই হাজারো মতপথের গল্প আমাদের শেখায় যে, সত্যকে দেখার দৃষ্টি ভঙ্গি অনেক রকম হতে পারে, এবং সেই ভিন্নতাকে স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যেই রয়েছে সভ্যতার প্রকৃত সৌন্দর্য।
তথ্যসূত্র
- Adamson, P. (2007). Al-Kindi. Oxford University Press.
- Chittick, W. C. (1989). The Sufi Path of Knowledge: Ibn al-Arabi’s Metaphysics of Imagination. SUNY Press.
- Commins, D. (2006). The Wahhabi Mission and Saudi Arabia. I.B. Tauris.
- Corbin, H. (1993). History of Islamic Philosophy. Kegan Paul International.
- Curtis, E. E. (2006). Black Muslim Religion in the Nation of Islam, 1960-1975. University of North Carolina Press.
- Daftary, F. (1990). The Isma’ilis: Their History and Doctrines. Cambridge University Press.
- Ernst, C. W. (1997). The Shambhala Guide to Sufism. Shambhala Publications.
- Esposito, J. L. (1997). Political Islam: Revolution, Radicalism, or Reform? Lynne Rienner Publishers.
- Fakhry, M. (2001). Averroes (Ibn Rushd): His Life, Works and Influence. Oneworld.
- Frank, R. M. (1994). Al-Ghazali and the Ash’arite School. Duke University Press.
- Friedmann, Y. (1989). Prophecy Continuous: Aspects of Ahmadi Religious Thought and Its Medieval Background. University of California Press.
- Geertz, C. (1960). The Religion of Java. University of Chicago Press.
- Goldziher, I. (1981). Introduction to Islamic Theology and Law. Princeton University Press.
- Griffel, F. (2009). Al-Ghazali’s Philosophical Theology. Oxford University Press.
- Gutas, D. (2014). Avicenna and the Aristotelian Tradition: Introduction to Reading Avicenna’s Philosophical Works. Brill.
- Hallaq, W. B. (2005). The Origins and Evolution of Islamic Law. Cambridge University Press.
- Halm, H. (1991). Shi’ism. Edinburgh University Press.
- Halverson, J. (2010). Theology and Creed in Sunni Islam: The Muslim Brotherhood, Ash’arism, and Political Sunnism. Palgrave Macmillan.
- Hazelton, L. (2009). After the Prophet: The Epic Story of the Shia-Sunni Split in Islam. Doubleday.
- Hodgson, M. G. S. (1974). The Venture of Islam: Conscience and History in a World Civilization (Vol. 1). University of Chicago Press.
- Hourani, A. (1983). Arabic Thought in the Liberal Age, 1798–1939. Cambridge University Press.
- Izutsu, T. (2006). The Concept of Belief in Islamic Theology. The Other Press.
- Jackson, S. A. (2009). Islam and the Problem of Black Suffering. Oxford University Press.
- Jafri, S. H. M. (1979). Origins and Early Development of Shi’a Islam. Longman.
- Kamali, M. H. (2008). Shari’ah Law: An Introduction. Oneworld Publications.
- Karamustafa, A. T. (2007). Sufism: The Formative Period. Edinburgh University Press.
- Kenney, J. T. (2006). Muslim Rebels: Kharijites and the Politics of Extremism in Egypt. Oxford University Press.
- Knysh, A. (2000). Islamic Mysticism: A Short History. Brill.
- Lapidus, I. M. (2002). A History of Islamic Societies. Cambridge University Press.
- Leaman, O. (2002). An Introduction to Classical Islamic Philosophy. Cambridge University Press.
- Madelung, W. (1997). The Succession to Muhammad: A Study of the Early Caliphate. Cambridge University Press.
- Martin, R. C., Woodward, M. R., & Atmaja, D. S. (1997). Defenders of Reason in Islam: Mu’tazilism from Medieval School to Modern Symbol. Oneworld Publications.
- Metcalf, B. D. (1982). Islamic Revival in British India: Deoband, 1860–1900. Princeton University Press.
- Momen, M. (1985). An Introduction to Shi’i Islam. Yale University Press.
- Nasr, S. H. (2006). Islamic Philosophy from Its Origin to the Present: Philosophy in the Land of Prophecy. SUNY Press.
- Pew Research Center. (2009). Mapping the Global Muslim Population. Pew Forum on Religion & Public Life.
- Rahman, F. (1979). Islam. University of Chicago Press.
- Reetz, D. (2006). Islam in the Public Sphere: Religious Groups in India, 1900-1947. Oxford University Press.
- Rizvi, S. H. (2009). Mulla Sadra and Metaphysics: Modulation of Being. Routledge.
- Sanyal, U. (1996). Devotional Islam and Politics in British India: Ahmad Riza Khan Barelwi and His Movement, 1870-1920. Oxford University Press.
- Schacht, J. (1950). The Origins of Muhammadan Jurisprudence. Clarendon Press.
- Schimmel, A. (1975). Mystical Dimensions of Islam. University of North Carolina Press.
- Tabatabai, M. H. (1975). Shi’ite Islam. SUNY Press.
- Trimingham, J. S. (1998). The Sufi Orders in Islam. Oxford University Press.
- Van Ess, J. (2017). Theology and Society in the Second and Third Centuries of the Hijra (Vol. 1-2). Brill.
- Vikør, K. S. (2005). Between God and the Sultan: A History of Islamic Law. C. Hurst & Co.
- Watt, W. M. (1973). The Formative Period of Islamic Thought. Edinburgh University Press.
