
আব্রাহামিক মিথোলজি (Abrahamic Mythology): সৃষ্টি থেকে মহাপ্রলয়, এক অনন্ত আখ্যান
(কোনো ধর্মের মিথোলজি বলতে বোঝানো হয় সেই সব আখ্যান, ঘটনা ও অতীত-বিবরণ, যেগুলো সংশ্লিষ্ট ধর্মের অনুসারীরা সত্য হিসেবে গ্রহণ করে। এই ঘটনাগুলো ঐতিহাসিক হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। কোনটি বাস্তব ইতিহাসের সঙ্গে মেলে আর কোনটি মেলে না – এই বিচার ও বিশ্লেষণের কাজ ইতিহাসের, যা ধর্মের ইতিহাস বা ধর্মীয় ইতিহাসচর্চায় আলোচ্য। এই আর্টিকেলটি আব্রাহামিক ধর্মসমূহের মিথোলজি নিয়ে আলোচনা করে। এখানে আলোচিত কাহিনি বা ধারণাগুলোর কোনটি ঐতিহাসিকভাবে সত্য, আর কোনটি নয় – সে প্রশ্নে প্রবেশ করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। বরং লক্ষ্য হলো, এই ধর্মগুলোর ভেতরে কীভাবে তারা নিজেদের অতীত ও অর্থবহ সত্যকে কল্পনা, বর্ণনা ও সংরক্ষণ করেছে – সেই মিথোলজিকাল কাঠামোটি বোঝা।)
Table of Contents
- 1 ভূমিকা
- 2 মিথ, মিথোলজি ও ইতিহাস: সত্যের বহুমুখী পাঠ (Myth, Mythology, and History)
- 3 সৃষ্টিতত্ত্ব: শূন্য থেকে মহাবিশ্ব (Cosmogony: Creation from Void)
- 4 ইডেন উদ্যান এবং পতনের আখ্যান (The Garden of Eden and The Fall of Man)
- 5 প্রথম রক্তপাত: কেইন এবং অ্যাবেল (The First Murder: Cain and Abel)
- 6 মহাপ্লাবন: নোয়াহ্ বা নূহ এবং তার নৌকা (The Deluge: Noah and the Ark)
- 7 আব্রাহাম: বিশ্বাসের পিতা এবং একটি পরিবারের বিভাজন (Abraham: The Patriarch and the Great Schism)
- 8 সোডম ও গোমোরা: পাপ, আতিথেয়তা এবং আগুনের বৃষ্টি (Sodom and Gomorrah: Sin, Hospitality, and the Rain of Fire)
- 9 মোজেস এবং এক্সোডাস: দাসত্ব থেকে মুক্তি ও আইনের পত্তন
- 10 রাজা, নবী এবং মসিহ-এর ধারণা: গৌরব, পতন এবং অনন্ত প্রতীক্ষা
- 11 যিশু খ্রিস্ট: নতুন এক বাঁক ও রক্তিম চুক্তি
- 12 ইসলাম: শেষ মোহর (Islam: The Final Seal)
- 13 অতিপ্রাকৃত জগত: ফেরেশতা, জিন এবং শয়তান (Angelology and Demonology)
- 14 রহস্যবাদ: সুফিজম, কাবালাহ এবং নস্টিসিজম (Mysticism: Sufism, Kabbalah, and Gnosticism)
- 15 শেষের শুরু: এসকাটোলজি বা কেয়ামততত্ত্ব (Eschatology: The End Times)
- 16 প্রাচীন বিশ্বের কথোপকথন: আব্রাহামিক মিথোলজির ওপর অন্যান্য সভ্যতার প্রভাব (Intertextuality and Syncretism)
- 17 মিথোলজির ব্যবচ্ছেদ: তাত্ত্বিক, দার্শনিক এবং সমালোচকদের দৃষ্টিতে (Theoretical Perspectives on Abrahamic Mythology)
- 17.1 তুলনামূলক মিথোলজি ও মহাজাগতিক নায়কের যাত্রা
- 17.2 মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ: অবচেতন মনের খেলা
- 17.3 সমাজতত্ত্ব এবং পবিত্রতার রাজনীতি
- 17.4 সহিংসতা, বলির পাঁঠা এবং আকাঙ্ক্ষার তত্ত্ব
- 17.5 সাহিত্য সমালোচনা এবং মহৎ কোড
- 17.6 নারীবাদী পাঠ: হারানো স্বর পুনরুদ্ধার
- 17.7 অস্তিত্ববাদ এবং ব্যাখ্যার দ্বন্দ্ব
- 17.8 ইতিহাসের শেষ এবং নতুন ঈশ্বর
- 18 উপসংহার
- 19 তথ্যসূত্র
ভূমিকা
মানুষ বড় অদ্ভুত জীব। তার পেটে ক্ষুধা থাকে, কিন্তু মনের ক্ষুধাটা আরও প্রবল। সে গল্প ভালোবাসে। সৃষ্টির একদম শুরু থেকেই মানুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করেছে – আমি কে? কোথা থেকে এলাম? এই যে অনন্ত নক্ষত্রবীথি, এই বিশাল মহাবিশ্ব, এর উদ্দেশ্যই বা কী? কেবল খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা তো মানুষের কাজ না, তার চাই উত্তর। এই উত্তরের খোঁজ করতে গিয়েই মানুষের মনে জন্ম নিয়েছে মিথোলজি বা পৌরাণিক কাহিনী (Mythology)। মিথোলজিকে অনেকে নিছক ‘গল্পকথা’ বা কুসংস্কার মনে করেন, কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও অত সরল নয়। মিথোলজি হলো একটি জাতি বা সভ্যতার মনের আয়না, তাদের বিশ্বাসের ভিত্তিপ্রস্তর। এটি সেই লেন্স, যা দিয়ে মানুষ তার জগতকে দেখে।
পৃথিবীর ইতিহাসে মিথোলজির কোনো অভাব নেই। গ্রিকরা অলিম্পাস পাহাড়ে তাদের দেবতাদের বসিয়েছে, নর্সরা ভেবেছে ভালহালার কথা, মিশরীয়রা বিশ্বাস করেছে পরকাল ও মমি-তে। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অংশজুড়ে, বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষের চিন্তাধারা, দর্শন, আইন এবং জীবনবোধকে যে মিথোলজিটি সবচেয়ে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে, সেটি কোনো গ্রিক বা রোমান গল্প নয় – তা হলো আব্রাহামিক মিথোলজি (Abrahamic Mythology)।
মধ্যপ্রাচ্যের রুক্ষ মরুভূমি, যেখানে বেঁচে থাকাটাই এক সংগ্রাম, সেখানেই জন্ম নিয়েছে এই বিশাল আখ্যান। ইহুদি (Judaism), খ্রিস্টান (Christianity) এবং ইসলাম (Islam) – আজকের বিশ্বের এই তিনটি প্রধান একেশ্বরবাদী ধর্মকে একত্রে ‘আব্রাহামিক ধর্ম’ বলা হয়। কেন? কারণ, এদের সকলের শেকড় এক জায়গায়। এদের সকলের আধ্যাত্মিক পিতা বা আদিপুরুষ হিসেবে ধরা হয় উর শহরের সেই বৃদ্ধ মানুষটিকে, যার নাম আব্রাহাম বা ইব্রাহিম। মিথোলজির বা সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এই তিনটি ধর্মের গল্পের উৎস, কাঠামো, চরিত্র এবং ঘটনার ঘনঘটায় এক অদ্ভুত মিল এবং ধারাবাহিকতা রয়েছে। মনে হয় যেন একটাই মহাকাব্য, যা ইতিহাসের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে তিনটি ভিন্ন আঙ্গিকে বলা হয়েছে। কখনো হিব্রু ভাষায়, কখনো গ্রিক বা ল্যাটিনে, আবার কখনো আরবিতে।
এই আর্টিকেলে আমরা কোনো ধর্মীয় বিশ্বাস, ভক্তি বা আস্তিক্যবাদী লেন্স দিয়ে এই কাহিনীগুলোকে দেখব না। আমাদের দেখার চোখ হবে সাহিত্যের (Literature), ইতিহাসের (History) এবং নৃতত্ত্বের (Anthropology)। একটি ভালো উপন্যাসে যেমন কেন্দ্রীয় চরিত্র থাকে, নায়ক-খলনায়ক থাকে, ক্লাইম্যাক্স থাকে – আমরা এই মিথোলজিকেও সেভাবেই বিশ্লেষণ করব। আমরা বোঝার চেষ্টা করব, হাজার বছর আগে তপ্ত বালুকণার বুকে জন্ম নেওয়া এই গল্পগুলো কীভাবে আজও আমাদের আধুনিক পৃথিবীকে চালিত করছে। এখানে ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তাকে (God) আমরা দেখতে পাব এই মহাকাব্যের কেন্দ্রীয় চরিত্রের মতো, যিনি কখনো রাগী, কখনো দয়ালু। আর নবী-রাসূলদের দেখব সেই মহাকাব্যের নায়ক বা প্রোটাগনিস্ট (Protagonist) হিসেবে, যারা ঈশ্বরের সাথে মানুষের সেতুবন্ধন তৈরির চেষ্টা করছেন। চলুন, মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং জটিল গল্পের জগতটিতে প্রবেশ করা যাক, যেখানে বিশ্বাস আর যুক্তি হাত ধরাধরি করে চলে।
মিথ, মিথোলজি ও ইতিহাস: সত্যের বহুমুখী পাঠ (Myth, Mythology, and History)
‘মিথ’ (Myth) শব্দটি শুনলেই আমাদের মনে যে ধারণাটি চট করে ভেসে ওঠে, তা হলো – এটি একটি মিথ্যা গল্প, যা কেবল শিশুদের বা কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের জন্য। দৈনন্দিন কথাবার্তায় আমরা প্রায়ই বলি, “ওটা একটা মিথ,” যার অর্থ দাঁড়ায় ওটা সত্য নয়। কিন্তু ধর্মতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব এবং সমাজবিজ্ঞানের বা অ্যাকাডেমিক ডিসকোর্স (Academic Discourse)-এ মিথ বা মিথোলজির সংজ্ঞা সম্পূর্ণ ভিন্ন। গ্রিক শব্দ ‘মিথোস’ (Mythos) থেকে আসা এই শব্দটির আদি অর্থ ছিল ‘গল্প’, ‘প্লট’ বা ‘বক্তব্য’, যার বিপরীতে ছিল ‘লোগোস’ (Logos) বা ‘যৌক্তিক বিবরণ’। প্রাচীনকালে এই দুটির মধ্যে কোনো বিরোধ ছিল না; বরং মিথ ছিল এমন এক ধরণের সত্য প্রকাশ করার মাধ্যম, যা লজিক বা যুক্তি দিয়ে বোঝানো যায় না। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা ধর্মতত্ত্ববিদ এবং মিথোলজি বিশারদ জোসেফ ক্যাম্পবেল (Joseph Campbell) তার টিভি সিরিজ ও বই দ্য পাওয়ার অফ মিথ (The Power of Myth)-এ খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন, “মিথোলজি মিথ্যা নয়। মিথোলজি হলো রূপক (Metaphor), যার মাধ্যমে মানুষ জীবনের এমন সব গভীর সত্য প্রকাশ করে যা সাধারণ ভাষায় বলা সম্ভব নয়।” ক্যাম্পবেলের মতে, মিথ হলো “অন্য মানুষের ধর্ম”, আর ধর্ম হলো “আমার নিজের মিথ”। অর্থাৎ, মিথোলজি কোনো গালি বা নেতিবাচক শব্দ নয়; এটি হলো একটি জনগোষ্ঠীর কালেক্টিভ বিলিফ সিস্টেম (Collective Belief System) বা সমষ্টিগত বিশ্বাস ব্যবস্থা। যখন কোনো গল্প বা ন্যারেটিভ একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতি বা ধর্মের মানুষের কাছে ‘পরম সত্য’ বা স্যাক্রেড ট্রুথ (Sacred Truth) হিসেবে গণ্য হয়, তখন সেটিই মিথোলজি। আব্রাহামিক মিথোলজি বলতে আমরা তাই আব্রাহামিক ধর্মগুলোর (ইহুদি, খ্রিস্টান, ইসলাম) সেই সব পবিত্র আখ্যানকে বোঝাচ্ছি, যা এই ধর্মগুলোর অনুসারীদের কাছে তাদের অস্তিত্বের ভিত্তি এবং তাদের ধর্মীয় মতবাদ বা ডক্ট্রিন (Doctrine)-এর উৎস।
ইতিহাসের সাথে মিথোলজির দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক
অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, আব্রাহাম, মোজেস বা যিশুর কাহিনী কি তাহলে কাল্পনিক? মিথোলজি কি ইতিহাসের বিপরীত? উত্তর হলো – না, এবং হ্যাঁ। মিথোলজি এবং ইতিহাস বা হিস্ট্রি (History) দুটি ভিন্ন ক্যাটাগরি হলেও তারা একে অপরের শত্রু নয়, বরং অনেক সময় একে অপরের পরিপূরক। ইতিহাস খোঁজে ‘ফ্যাক্ট’ বা তথ্য – কবে, কোথায়, কী ঘটেছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ, শিলালিপি বা সমসাময়িক দলিলের ভিত্তিতে ইতিহাস রচিত হয়। অন্যদিকে, মিথোলজি খোঁজে ‘মিনিং’ বা অর্থ – কেন ঘটেছিল, এর তাৎপর্য কী। একটি ঘটনা ঐতিহাসিক হতে পারে, আবার একই সাথে মিথোলজিক্যালও হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যিশু খ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধ হওয়া একটি ঐতিহাসিক ঘটনা (অধিকাংশ ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহাসিক এটা মানেন যে যিশু নামে একজন ব্যক্তি ছিলেন এবং রোমানরা তাকে হত্যা করেছিল)। কিন্তু যিশু যে মানুষের পাপ মোচনের জন্য মারা গেলেন এবং তৃতীয় দিনে পুনরুত্থিত হলেন – এটি হলো মিথোলজিক্যাল বা ধর্মতাত্ত্বিক সত্য। ঐতিহাসিকরা ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার সাল-তারিখ নিয়ে গবেষণা করতে পারেন, কিন্তু পাপ মোচনের বিষয়টি কেবল বিশ্বাসের জগতে বা মিথোলজির জগতেই সত্য। ফরাসি দার্শনিক পল রিকোয়ার (Paul Ricoeur) একে বলেছেন মিথিকো-হিস্ট্রি (Mythico-history), যেখানে ইতিহাস এবং মিথ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। মোজেস লোহিত সাগর পার হয়েছিলেন কি না, তা নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু এই ঘটনাটি ইহুদি জাতির কাছে তাদের স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে যে সত্য, তা তাদের কাছে যেকোনো ঐতিহাসিক তথ্যের চেয়েও শক্তিশালী। অনেক সময় মিথোলজির আড়ালেই ইতিহাস লুকিয়ে থাকে, যেমন ট্রয় নগরীর মিথকে সত্য প্রমাণ করেছিলেন প্রত্নতাত্ত্বিক হাইনরিখ শ্লিম্যান। আবার অনেক সময় ইতিহাস নিজেই মিথোলজিতে পরিণত হয়, যেমন আব্রাহাম লিংকন বা মহাত্মা গান্ধীর জীবনকাহিনী। আব্রাহামিক মিথোলজির অনেক অংশ প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে প্রমাণিত (যেমন – রাজা ডেভিডের অস্তিত্ব বা ব্যবিলনীয় নির্বাসন), আবার অনেক অংশ (যেমন – সৃষ্টিতত্ত্ব বা নূহের প্লাবন) প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে বা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত নয়।
স্যাক্রেড ন্যারেটিভ এবং ওয়ার্ল্ডভিউ
নৃতাত্ত্বিকরা মিথোলজিকে সংজ্ঞায়িত করেন স্যাক্রেড ন্যারেটিভ (Sacred Narrative) বা পবিত্র আখ্যান হিসেবে, যা একটি সংস্কৃতির ওয়ার্ল্ডভিউ (Worldview) বা বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি গঠন করে। মানুষ কেন জন্মায়, কেন মারা যায়, ভালো-মন্দের উৎস কী, এবং মহাবিশ্বের সাথে মানুষের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত – এই সব মৌলিক প্রশ্নের উত্তর মিথোলজিই প্রদান করে। আমেরিকান নৃতাত্ত্বিক ক্লিফোর্ড গিয়ার্টজ (Clifford Geertz) তার দ্য ইন্টারপ্রিটেশন অফ কালচারস (The Interpretation of Cultures) বইয়ে দেখিয়েছেন যে, ধর্মীয় মিথোলজি মানুষকে একটি ‘মডেল অফ রিয়েলিটি’ (বাস্তবতার মডেল) এবং ‘মডেল ফর রিয়েলিটি’ (বাস্তবতার জন্য মডেল) প্রদান করে। অর্থাৎ, মিথোলজি কেবল জগতকে ব্যাখ্যাই করে না, বরং জগতকে কীভাবে সাজাতে হবে তার নির্দেশও দেয়। আব্রাহামিক মিথোলজিতে ইডেনের গল্পটি মানুষকে শেখায় যে পাপের কারণে দুঃখ এসেছে (ব্যাখ্যা), আবার সিনাই পর্বতের আইনের গল্প মানুষকে শেখায় কীভাবে সেই পাপ থেকে মুক্ত হয়ে সমাজ গড়তে হবে (নির্দেশনা)। এই গল্পগুলো সত্য-মিথ্যা যাই হোক, বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষ হাজার বছর ধরে এর ওপর ভিত্তি করে জীবনের অর্থ খুঁজে নিচ্ছে। মিথোলজি বিশারদ ব্রনিস্ল ম্যালিনোস্কি (Bronislaw Malinowski) একে বলেছেন সোশ্যাল চার্টার (Social Charter) বা সামাজিক সনদ। তার মতে, মিথোলজি সমাজকে সংহতি দেয়, আইনকে বৈধতা দেয় এবং নৈতিকতাকে প্রতিষ্ঠা করে। আব্রাহামিক মিথোলজি ঠিক এই কাজটিই করেছে পশ্চিমা এবং মধ্যপ্রাচ্যের সভ্যতার জন্য।
সত্যের বহুস্তরীয় পাঠ
আধুনিক ধর্মতত্ত্ববিদ এবং সাহিত্য সমালোচকরা বাইবেল বা কুরআনের মতো টেক্সটকে পড়ার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করেন। কেউ একে আক্ষরিক বা লিটারেল (Literal) সত্য মনে করেন (মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গি), আবার কেউ একে রূপক বা অ্যালিগোরিক্যাল (Allegorical) সত্য মনে করেন (উদারপন্থী বা মিস্টিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি)। আব্রাহামিক মিথোলজির আলোচনায় আমরা এই দুই দৃষ্টিভঙ্গিকেই দেখি, কিন্তু আমাদের মূল ফোকাস থাকবে এর সাহিত্যিক এবং দার্শনিক মানের ওপর। বিখ্যাত কানাডিয়ান সমালোচক নর্থরপ ফ্রাই (Northrop Frye) তার দ্য গ্রেট কোড (The Great Code) বইয়ে বলেছেন, বাইবেল হলো এক বিশাল ‘মিথোলজিক্যাল স্ট্রাকচার’, যা পশ্চিমা সাহিত্যের মেরুদণ্ড। শেকসপিয়র, মিল্টন, দান্তে বা তলস্তয় – কারো সাহিত্যই পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয় যদি না আমরা আব্রাহামিক মিথোলজির ভাষা বুঝতে পারি। এই আর্টিকেলে যখন আমরা ‘মিথোলজি’ শব্দটি ব্যবহার করব, তখন একে একটি নিরপেক্ষ এবং একাডেমিক ক্যাটাগরি হিসেবে দেখব, যা আমাদের সাহায্য করে মানুষের বিশ্বাসের এই বিশাল সৌধটিকে বাইরে থেকে এবং ভেতর থেকে – উভয় দিক থেকেই দেখতে। মিথোলজি হলো সেই ভাষা, যা দিয়ে মানুষ অসীমকে সসীম শব্দে বাঁধার চেষ্টা করেছে।
সৃষ্টিতত্ত্ব: শূন্য থেকে মহাবিশ্ব (Cosmogony: Creation from Void)
আব্রাহামিক মিথোলজির মহাকাব্যিক যাত্রার শুরুটাই হয় এক বিশাল, গভীর এবং গা ছমছমে নাটকীয়তা দিয়ে। কল্পনা করুন – কোথাও কিছু নেই। নেই নক্ষত্র, নেই নীহারিকা, এমনকি সময়ের (Time) কোনো অস্তিত্বও নেই। বিরাজ করছে কেবল এক অনন্ত, আদিগন্ত শূন্যতা বা ভয়েড (Void)। হিব্রু বাইবেলে একে বলা হয়েছে ‘তোহু ওয়া-বো’ (Tohu wa-bohu), যার অর্থ আকারহীন বিশৃঙ্খলা বা ‘Formless Void’। এই অসীম অন্ধকারের মধ্যে কেবল একটি সত্তা জাগ্রত – ঈশ্বর, ইয়াহওয়ে বা আল্লাহ (God/Yahweh/Allah)। আব্রাহামিক মিথোলজির এই শুরুর দৃশ্যটি মানুষের চিরকালীন কল্পনার এক চরম রূপ। এখানে কোনো পূর্ববর্তী দেবতার মৃতদেহ বা কোনো মহাজাগতিক ডিমের অস্তিত্ব নেই, যা আমরা অন্যান্য প্রাচীন মিথোলজিতে হরহামেশা দেখি। এখানে যা ঘটে, তা হলো ইচ্ছাশক্তির এক চরম প্রকাশ। জেনেসিস (Genesis) বা আদিপুস্তকের বর্ণনা অনুযায়ী, ঈশ্বর কেবল একটি বাক্য উচ্চারণ করলেন, “আলো হোক” (Let there be light), আর অমনি মহাবিশ্বের প্রথম ফোটন কণাটি জ্বলে উঠল। ব্যাপারটা বেশ জাদুকরী, তাই না? কোনো ভৌত উপাদান ছাড়াই কেবল শব্দের কম্পন বা ‘বাক্য’ (Word/Logos) দিয়ে বস্তু তৈরির এই ধারণাটি আব্রাহামিক দর্শনের অন্যতম শক্তিশালী ভিত্তি।
মিথোলজি বিশারদ জোসেফ ক্যাম্পবেল (Joseph Campbell) তার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, এই সৃষ্টির ধারণাটি মেসোপটেমীয় মিথোলজি, বিশেষ করে ব্যাবিলনীয় মহাকাব্য এনুমা এলিশ (Enuma Elish)-এর সাথে কিছুটা কাঠামোগত মিল রাখে। সেখানেও বিশৃঙ্খল জলরাশি বা ক্যাওস (Chaos) থেকে মহাবিশ্ব তৈরির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ক্যাম্পবেল আব্রাহামিক মিথোলজিতে একটি মৌলিক এবং বিপ্লবী পার্থক্যের কথা উল্লেখ করেছেন (Campbell, 1949)। অন্যান্য মিথোলজিতে সৃষ্টি হয় ‘এক্স ম্যাটেরিয়া’ (Ex materia) বা আগে থেকে বিদ্যমান কোনো পদার্থ থেকে। যেমন, এনুমা এলিশ-এ দেখা যায় দেবতা মারদুক তার পূর্বসুরী দেবী টিয়ামাতের মৃতদেহ চিরে আকাশ ও পৃথিবী বানাচ্ছেন। কিন্তু আব্রাহামিক ঈশ্বর কোনো কিছুর ওপর নির্ভরশীল নন। তিনি সৃষ্টি করেন সম্পূর্ণ শূন্য থেকে, থিওলজির ভাষায় যাকে ল্যাটিনে বলা হয় ক্রিয়েশিও এক্স নিহিলো (Creatio ex nihilo) বা ‘Creation out of nothing’। এই ধারণাটি ঈশ্বরকে প্রকৃতির চেয়েও উঁচুতে বা ‘ট্রান্সসেন্ডেন্ট’ (Transcendent) অবস্থানে নিয়ে যায়। প্রকৃতি বা মহাবিশ্ব ঈশ্বরের অংশ নয়, বরং ঈশ্বরেরই তৈরি এক শিল্পকর্ম।
সৃষ্টির এই বিশাল কর্মযজ্ঞটি সম্পন্ন হয় ছয়টি দিনে বা ছয়টি কালপর্বে। এখানে ‘দিন’ বা ‘ইওম’ (Yom) শব্দটি নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে বিস্তর বিতর্ক আছে। কেউ একে আক্ষরিক অর্থে ২৪ ঘণ্টা মনে করেন, আবার কেউ মনে করেন এটি রূপক অর্থে একেকটি দীর্ঘ যুগ। প্রথম দিনে আলো ও অন্ধকার আলাদা হলো, তৈরি হলো দিন ও রাত। দ্বিতীয় দিনে আকাশ বা ‘ফার্মামেন্ট’ (Firmament) তৈরি করে ওপরের জল ও নিচের জলকে পৃথক করা হলো। তৃতীয় দিনে সমুদ্র ও শুষ্ক স্থলভাগ আলাদা হলো, এবং মাটির বুক চিরে বেরিয়ে এল উদ্ভিদ। চতুর্থ দিনে মহাকাশের বিশাল ক্যানভাসে বসানো হলো সূর্য, চাঁদ এবং নক্ষত্ররাজি। পঞ্চম দিনে জলজ প্রাণী ও পাখিদের সৃষ্টি, এবং ষষ্ঠ দিনে সৃষ্টি হলো স্থলচর প্রাণী। এই যে ধাপে ধাপে ‘বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলা’ (Chaos to Order) তৈরির প্রক্রিয়া, এটি বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক মানুষের কাছেও বিবর্তনের ক্রমবিকাশের একটি আদিম রূপক বলে মনে হতে পারে। তবে মিথোলজির মূল ফোকাস বিজ্ঞানে নয়, অর্থে। এই পুরো সাজসজ্জা আসলে একটি মঞ্চ তৈরির প্রস্তুতি, যেখানে প্রবেশ করবেন গল্পের মূল নায়ক – মানুষ।
আদম: মাটির মানুষ এবং প্রাণের ফুঁ
সব আয়োজন শেষ। মঞ্চ প্রস্তুত। এবার ঈশ্বর সিদ্ধান্ত নিলেন এমন কাউকে তৈরি করবেন, যে এই সৃষ্টির ওপর কর্তৃত্ব করবে, যার মধ্যে থাকবে স্বয়ং ঈশ্বরের ছায়া বা ইমাগো দেই (Imago Dei)। মাটির তাল দিয়ে কুমোর যেভাবে পুতুল বানায়, ঠিক সেভাবেই ঈশ্বর মাটি বা ধুলো দিয়ে অবয়ব তৈরি করলেন। বাইবেলে তাকে বলা হলো আদম বা অ্যাডাম (Adam)। এই নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তার উৎস। হিব্রু ভাষায় ‘আদামা’ (Adamah) মানে হলো মাটি বা ভূমি। অর্থাৎ, আদম হলেন ‘মাটির সন্তান’ বা ‘আর্থলিং’ (Earthling)। ইসলামি মিথোলজিতে এই গল্পে আরও বিস্তারিত রঙ চড়ানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়, ঈশ্বর বা আল্লাহ ফেরেশতাদের নির্দেশ দিলেন পৃথিবী থেকে মাটি সংগ্রহ করতে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন রঙের (লাল, সাদা, কালো) মাটি আনা হলো, যার কারণে আদমের বংশধরদের গায়ের রঙ ভিন্ন ভিন্ন হয়। মাটির এই অবয়বটি তৈরি করার পর সেটি অনেকদিন পড়ে ছিল প্রাণহীন ভাস্কর্য হয়ে। এখানে প্রবেশ করে ‘রুহ’ বা আত্মার ধারণা। ঈশ্বর আদমের নাকে ফুঁ দিলেন, আর সাথে সাথে সেই মাটির পুতুল জীবন্ত হয়ে উঠল। এই ‘ফুঁ’ বা ব্রেথ অফ লাইফ (Breath of Life) কেবল অক্সিজেন নয়, এটি হলো ডিভাইন স্পার্ক বা ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গ, যা মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা করে।
এই সৃষ্টি প্রক্রিয়ার সাথে গ্রিক মিথোলজির বেশ মিল পাওয়া যায়। গ্রিক মিথোলজিতে টাইটান প্রমিথিউস (Prometheus)-ও কাদা দিয়ে মানুষ তৈরি করেছিলেন। আবার মিশরীয় মিথোলজিতে দেবতা খ্নুম (Khnum) তার কুমোরের চাকা ঘুরিয়ে কাদা দিয়ে মানুষের শরীর তৈরি করতেন। কিন্তু আব্রাহামিক মিথোলজিতে ঈশ্বর ও মানুষের সম্পর্কটি অনেক বেশি ব্যক্তিগত বা পার্সোনাল। এখানে ঈশ্বর দূরবর্তী কোনো কারিগর নন, তিনি একেবারে কাছে এসে নিজের সত্তা থেকে ফুঁ দিয়ে প্রাণসঞ্চার করছেন। এই ঘটনাটি মানুষের অস্তিত্বের দ্বান্দ্বিক রূপটি প্রকাশ করে – একদিকে সে মাটির তৈরি নশ্বর ও তুচ্ছ প্রাণী, অন্যদিকে সে ঈশ্বরের নিঃশ্বাস ধারণকারী এক অবিনশ্বর সত্তা। বিখ্যাত ইহুদি দার্শনিক ফাইলো অফ আলেকজান্দ্রিয়া (Philo of Alexandria) মনে করতেন, আদমের এই সৃষ্টি আসলে মানুষের দ্বৈত সত্তার প্রতীক – তার দেহ মাটির দিকে টানে, আর তার আত্মা স্বর্গের দিকে টানে (Philo, 1st Century/1993)।
ইভ এবং লিলিথ: সঙ্গীর সন্ধান ও আদিম সংঘাত
ইডেন উদ্যানে আদম ছিলেন একা। এই বিশাল সুন্দর বাগানে তিনি পশু-পাখিদের নাম রাখলেন, তাদের পর্যবেক্ষণ করলেন, কিন্তু নিজের মতো কাউকে খুঁজে পেলেন না। তার নিঃসঙ্গতা দেখে ঈশ্বর বললেন, “মানুষের একা থাকা ভালো নয়।” এবার মিথোলজিতে আসে এক নাটকীয় বাঁক। আদমকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন করা হলো। ঘুমের মধ্যেই তার পাঁজরের একটি হাড় বা ‘রিব’ (Rib) তুলে নিয়ে তা থেকে তৈরি করা হলো তার সঙ্গী – ইভ বা হাওয়া (Eve)। আদম জেগে উঠে তাকে দেখে বললেন, “ইনি আমার হাড়ের হাড়, মাংসের মাংস।” হিব্রু শব্দ ‘তজেলা’ (Tzela)-র অর্থ কেবল হাড় নয়, এর অর্থ ‘পার্শ্ব’ বা ‘Side’-ও হতে পারে। অর্থাৎ, নারীকে পুরুষের পাশ থেকে তৈরি করা হয়েছে, যাতে তারা সমান্তরালভাবে চলতে পারে। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত নারীবাদী তাত্ত্বিক এলিজাবেথ ক্যাডি স্ট্যান্টন (Elizabeth Cady Stanton) তার যুগান্তকারী বই দ্য ওম্যান্স বাইবেল (The Woman’s Bible)-এ এই মিথটিকে তীব্রভাবে সমালোচনা করেছেন। তিনি মনে করেন, এই গল্পটি পিতৃতান্ত্রিক সমাজের একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার, যেখানে নারীকে দেখানো হয়েছে পুরুষের একটি ‘আফটার-থট’ (Afterthought) বা অংশ হিসেবে, পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন সত্তা হিসেবে নয় (Stanton, 1895)। নারীর সৃষ্টি যে পুরুষের প্রয়োজনে – এই ন্যারেটিভটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জেন্ডার পলিটিক্সকে প্রভাবিত করেছে।
তবে আব্রাহামিক মিথোলজির মূলধারার বাইরে ইহুদি লোককথা বা ফোকলোর (Folklore)-এ আদমের প্রথম স্ত্রী হিসেবে আরেকটি চরিত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়, যার নাম লিলিথ (Lilith)। মধ্যযুগীয় গ্রন্থ আলফাবেট অফ বেন সিরা (Alphabet of Ben Sira) অনুযায়ী, লিলিথকে আদমের মতো একই মাটি থেকে তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু সমস্যা বাধল যখন লিলিথ আদমের বশ্যতা স্বীকার করতে চাইলেন না। লিলিথের যুক্তি ছিল, “আমরা দুজনেই একই মাটি থেকে তৈরি, তাই আমরা সমান।” আদম যখন জোর করতে চাইলেন, লিলিথ ঈশ্বরের গোপন নাম উচ্চারণ করে ইডেন থেকে পালিয়ে গেলেন এবং পরে তাকে এক ডিমন বা দানবী হিসেবে চিত্রিত করা হলো (Patai, 1967)। লিলিথের এই গল্পটি মূল ধর্মগ্রন্থগুলোতে (ক্যানন) জায়গা না পেলেও, এটি মিথোলজির জগতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি প্রমাণ করে যে, প্রাচীনকালেও নারী-পুরুষের সমতার প্রশ্নটি মানুষের অবচেতনে ছিল। ইভ বা হাওয়া যেখানে নমনীয়তার প্রতীক, লিলিথ সেখানে বিদ্রোহের প্রতীক।
দুটি ভিন্ন আখ্যানের রহস্য
বাইবেল বা তোরাহ গভীরভাবে পাঠ করলে দেখা যায়, জেনেসিস বা আদিপুস্তকে সৃষ্টির গল্প আসলে একটি নয়, দুটি। প্রথম অধ্যায়ে (Genesis 1) ঈশ্বর মহাজাগতিক শক্তিতে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করছেন ধাপে ধাপে, ছয় দিনে, এবং শেষে নারী ও পুরুষকে একসাথে সৃষ্টি করছেন। এখানে ঈশ্বরের নাম ‘এলোহিম’ (Elohim)। কিন্তু দ্বিতীয় অধ্যায়ে (Genesis 2) গল্পটি আবার নতুন করে শুরু হয়। সেখানে পৃথিবী রুক্ষ ও শুকনো, ঈশ্বর প্রথমে আদমকে বানাচ্ছেন, তারপর ইডেন উদ্যান, এবং শেষে ইভকে। এখানে ঈশ্বরের নাম ‘ইয়াহওয়ে’ (Yahweh)। আধুনিক বাইবেল বিশারদ এবং তাত্ত্বিকরা ডকুমেন্টারি হাইপোথিসিস (Documentary Hypothesis) তত্ত্বের মাধ্যমে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বিখ্যাত তাত্ত্বিক রিচার্ড এলিয়ট ফ্রিডম্যান (Richard Elliott Friedman) তার বই হু রোড দ্য বাইবেল? (Who Wrote the Bible?)-এ দেখিয়েছেন যে, এই দুটি গল্প আসলে দুটি ভিন্ন উৎস থেকে এসেছে। একটিকে বলা হয় প্রিস্টলি সোর্স (Priestly Source) বা ‘P’ সোর্স, যারা নিয়ম ও রিচুয়ালের ওপর জোর দিত। অন্যটি হলো ইয়াহউইস্ট সোর্স (Jahwist Source) বা ‘J’ সোর্স, যারা গল্প বলায় পটু ছিল এবং ঈশ্বরকে অনেক বেশি মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন হিসেবে দেখাত (Friedman, 1987)। মিথোলজির পাঠকদের কাছে এই দ্বৈততা কোনো বিভ্রান্তি নয়, বরং এটি প্রমাণ করে যে আব্রাহামিক মিথোলজি কোনো একক লেখকের নিটোল উপন্যাস নয়; এটি হাজার বছরের মানুষের বিশ্বাস, লোককথা এবং স্মৃতির এক জটিল কোলাজ বা সংকলন।
এভাবেই শূন্য থেকে মহাবিশ্ব, মাটি থেকে মানুষ, এবং পাঁজর থেকে নারীর সৃষ্টির মাধ্যমে আব্রাহামিক মিথোলজির মঞ্চটি প্রস্তুত হয়। ইডেন উদ্যান এখন সাজানো, সাপটি গাছের আড়ালে অপেক্ষা করছে, আর নিষিদ্ধ ফলটি ডালে দুলছে। মানুষের মহাজাগতিক শৈশব শেষ হয়ে আসছে, সামনে অপেক্ষা করছে এক কঠিন এবং দীর্ঘ যাত্রা।
ইডেন উদ্যান এবং পতনের আখ্যান (The Garden of Eden and The Fall of Man)
সৃষ্টির বিশাল কর্মযজ্ঞ শেষে ঈশ্বর তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে রাখলেন এক পরম শান্তির আশ্রয়ে, যার নাম ইডেন উদ্যান বা গার্ডেন অফ ইডেন (Garden of Eden)। বাইবেলের জেনেসিস বা আদিপুস্তকের বর্ণনা অনুযায়ী, এই উদ্যানটি ছিল পৃথিবীর পূর্বদিকে। এর অবস্থান নিয়ে ভূগোলবিদ এবং ধর্মতাত্ত্বিকদের মধ্যে হাজার বছর ধরে তর্ক চলছে। কেউ বলেন এটি ছিল মেসোপটেমিয়ার টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর সংযোগস্থলে, আবার কেউ বা এর অবস্থান খোঁজেন আর্মেনিয়া কিংবা পারস্য উপসাগরের গভীরে। তবে মিথোলজির দৃষ্টিকোণ থেকে ইডেন কোনো ভৌগোলিক স্থান নয়, বরং এটি হলো মানুষের আদিম, নিষ্পাপ এবং দুঃখহীন অবস্থার প্রতীক, যাকে ল্যাটিনে বলা হয় ইলো টেম্পোর (Illo Tempore) বা ‘সেই স্বর্ণালী সময়’। এই বাগানে ঈশ্বরের উপস্থিতিতে আদম এবং হাওয়া (ইভ) ঘুরে বেড়াতেন। তাদের কোনো অভাব ছিল না, কোনো লজ্জা ছিল না, আর ছিল না মৃত্যুর ভয়। বাগানের মাঝখানে ছিল দুটি বিশেষ গাছ। একটি হলো জীবনবৃক্ষ (Tree of Life), যার ফল খেলে মানুষ অমর হয়। আর অন্যটি হলো সেই রহস্যময় ভালো ও মন্দের জ্ঞানবৃক্ষ (Tree of Knowledge of Good and Evil)। ঈশ্বর আদমকে স্পষ্ট নির্দেশ দিলেন, “তুমি বাগানের যেকোনো গাছের ফল খেতে পারো, কেবল এই জ্ঞানবৃক্ষটি ছাড়া। যেদিন তুমি এর ফল খাবে, সেদিনই তোমার মৃত্যু হবে।” এই একটিমাত্র নিষেধাজ্ঞাই আব্রাহামিক মিথোলজির ড্রামা বা নাটকীয়তার মূল চাবিকাঠি। এটি কেবল একটি ফলের গল্প নয়, এটি মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা (Free Will) এবং আনুগত্যের প্রথম পরীক্ষা।
ইডেনের এই প্রশান্তিময় পরিবেশে হঠাৎ করেই আগমন ঘটে এক অশুভ ছায়ার। সাপ বা সারপেন্ট (Serpent)। হিব্রু ভাষায় একে বলা হয় ‘নাহাশ’ (Nahash)। আধুনিক ধর্মতাত্ত্বিকরা বা সাধারণ বিশ্বাসীরা চট করে বলে দেন যে এই সাপটিই হলো শয়তান। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, জেনেসিসের মূল টেক্সটে কোথাও সরাসরি বলা হয়নি যে এই সাপটিই শয়তান বা লুসিফার (Lucifer)। সেখানে সাপকে বর্ণনা করা হয়েছে “মাঠের সব প্রাণীর চেয়ে ধূর্ত” (More crafty than any of the wild animals) হিসেবে। সাপ এবং শয়তানের এই একীভূতকরণ ঘটেছে অনেক পরে, বিশেষ করে খ্রিস্টান থিওলজি এবং জন মিল্টন (John Milton)-এর মহাকাব্য প্যারাডাইস লস্ট (Paradise Lost)-এর মতো সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে (Milton, 1667)। সাপ ইভের কাছে এসে এক অদ্ভুত দার্শনিক তর্কের অবতারণা করল। সে সরাসরি ঈশ্বরের আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে বসল। সে বলল, “তোমরা মরবে না। বরং ঈশ্বর জানেন যে, যেদিন তোমরা ওই ফল খাবে, সেদিন তোমাদের চোখ খুলে যাবে এবং তোমরা ঈশ্বরের মতো ভালো-মন্দ বুঝতে শিখবে।” সাপের এই প্রলোভনটি ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক। সে ইভকে কোনো ধনসম্পদ বা ক্ষমতার লোভ দেখায়নি, দেখিয়েছিল জ্ঞানের লোভ, ঈশ্বরের সমকক্ষ হওয়ার লোভ। গ্রিক মিথোলজিতে যেমন প্রমিথিউস (Prometheus) দেবতাদের আগুন চুরি করে মানুষকে দিয়েছিলেন, এখানে সাপ মানুষকে ‘জ্ঞান’ নামক আগুনটি তুলে নেওয়ার প্ররোচনা দিল।
নিষিদ্ধ ফল এবং আদি পাপের জন্ম
ইভ ফলের দিকে তাকালেন। ফলটি দেখতে সুস্বাদু এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য লোভনীয়। তিনি ফলটি ছিঁড়লেন এবং খেলেন। এরপর আদমকেও দিলেন, আদমও খেলেন। জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে বা পেইন্টিংয়ে আমরা এই ফলটিকে আপেল হিসেবে দেখি। কিন্তু বাইবেল বা কুরআনে কোথাও ফলের নাম নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। এটি আপেল হওয়ার ধারণাটি এসেছে ল্যাটিন ভাষার একটি শব্দের খেলার কারণে। ল্যাটিনে ‘ম্যালাস’ (Malus) শব্দটির দুটি অর্থ – একটি হলো ‘আপেল’, আর অন্যটি হলো ‘মন্দ’ (Evil)। মধ্যযুগের শিল্পীরা এই দ্ব্যর্থতাবোধক শব্দটিকে ব্যবহার করেই আপেলকে নিষিদ্ধ ফলের প্রতীক বানিয়ে ফেলেন। ইহুদি অনেক ব্যাখ্যা বা মিদরাশ (Midrash) অনুযায়ী, এটি ছিল ডুমুর, আঙ্গুর, গম কিংবা ইট্রোগ (এক ধরণের সাইট্রাস ফল)। যাই হোক, ফল খাওয়ার সাথে সাথেই এক অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটল। আকাশ ভেঙে পড়ল না, বজ্রপাত হলো না, কিন্তু তাদের মানসিক জগত সম্পূর্ণ বদলে গেল। তাদের চোখ খুলে গেল। তারা প্রথমবারের মতো বুঝতে পারলেন যে তারা নগ্ন। এই যে হঠাৎ করে অর্জিত ‘লজ্জা’ (Shame), এটিই হলো মিথোলজির ভাষায় মানুষের ‘শৈশব’ থেকে ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ হওয়ার মুহূর্ত। এতকাল তারা ছিল শিশুর মতো নিষ্পাপ, নিজের শরীর নিয়ে তাদের কোনো সংকোচ ছিল না। কিন্তু জ্ঞানবৃক্ষের ফল তাদের দিল আত্মসচেতনতা বা সেলফ-কনশাসনেস (Self-Consciousness)। তারা ডুমুর পাতা দিয়ে নিজেদের শরীর ঢাকলেন এবং বাগানের ঝোপের আড়ালে লুকালেন। ঈশ্বর যখন সন্ধ্যায় বাগানে হাঁটতে হাঁটতে ডাকলেন, “আদম, তুমি কোথায়?” তখন আদম উত্তর দিলেন, “আমি তোমার পায়ের শব্দ শুনে ভয় পেয়েছি, কারণ আমি নগ্ন।”
ঈশ্বর বুঝতে পারলেন কী ঘটেছে। শুরু হলো দোষারোপের পালা বা ব্লেম গেম (Blame Game)। আদম দোষ চাপালেন ইভের ওপর (এবং পরোক্ষভাবে ঈশ্বরের ওপর, কারণ ঈশ্বরই ইভকে তার সঙ্গী করেছিলেন), আর ইভ দোষ চাপালেন সাপের ওপর। এই ঘটনা থেকেই জন্ম নেয় আব্রাহামিক ধর্মতত্ত্বের অন্যতম বিতর্কিত এবং প্রভাবশালী ধারণা – আদি পাপ (Original Sin)। খ্রিস্টান ধর্মতাত্ত্বিক সেন্ট অগাস্টিন (Saint Augustine) চতুর্থ শতাব্দীতে এই তত্ত্বটিকে সুসংহত করেন। তার মতে, আদমের এই পাপের কারণে মানবজাতির স্বভাব বা প্রকৃতি জন্মগতভাবেই কলুষিত। প্রতিটি শিশু এই পাপের বোঝা নিয়ে জন্মায় এবং এর থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হলো যিশু খ্রিস্টের প্রতি বিশ্বাস এবং চার্চের অনুগ্রহ (Augustine, 426)। তবে ইহুদি ধর্ম এবং ইসলাম এই বিষয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন মত পোষণ করে। ইসলামি ভাষ্যমতে, আদমের এই কাজটি ছিল একটি বিচ্যুতি বা ভুল, কোনো অমোচনীয় পাপ নয়। আদম অনুতপ্ত হয়েছিলেন এবং ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। ইসলামে প্রতিটি শিশু নিষ্পাপ বা ফিতরা (Fitra) নিয়ে জন্মায়, কেউ জন্মগতভাবে পাপী নয়। ইহুদি ধর্মেও মানুষের মধ্যে ‘ইয়েৎজার হাহা’ (মন্দ প্রবৃত্তি) এবং ‘ইয়েৎজার হাতোভ’ (ভালো প্রবৃত্তি) – উভয়ই থাকে এবং মানুষ তার কর্মের মাধ্যমে নিজেকে সংজ্ঞায়িত করে।
স্বর্গচ্যুতি এবং মর্ত্যের সংগ্রাম
পাপ বা ভুলের শাস্তি হিসেবে নেমে এল এক বিশাল বিপর্যয়। একে থিওলজির ভাষায় বলা হয় দ্য ফল (The Fall)। ঈশ্বর সাপকে অভিশাপ দিলেন বুকে ভর দিয়ে চলার এবং ধুলো খাওয়ার। নারীকে অভিশাপ দেওয়া হলো প্রসব বেদনার এবং পুরুষের অধীন থাকার। আর আদমকে, অর্থাৎ মানবজাতিকে দেওয়া হলো সবচেয়ে কঠিন শাস্তি – শ্রম। ঈশ্বর বললেন, “মাটি তোমার জন্য অভিশপ্ত হলো। জীবনভরের শ্রমে তুমি তা থেকে আহার জোগাবে… তুমি ধুলো, এবং ধুলোতেই ফিরে যাবে।” নৃতাত্ত্বিকরা এই মিথটিকে মানব সভ্যতার ইতিহাসের এক বিশাল পরিবর্তনের রূপক হিসেবে দেখেন। মানুষ যখন শিকারি-সংগ্রাহক (Hunter-gatherer) জীবন ছেড়ে কৃষিভিত্তিক সমাজে প্রবেশ করল, তখন তাদের জীবন অনেক বেশি কঠিন ও শ্রমসাধ্য হয়ে পড়েছিল। প্রকৃতির অঢেল ভাণ্ডার (ইডেন) ছেড়ে হাড়ভাঙা খাটুনির এই জীবনকে ব্যাখ্যা করার জন্যই সম্ভবত এই মিথটির জন্ম। জেমস জর্জ ফ্রেজার (James George Frazer) তার বিখ্যাত বই দ্য গোল্ডেন বাউ (The Golden Bough)-এ দেখিয়েছেন যে, পৃথিবীর বহু আদিম সংস্কৃতিতেই এমন গল্প আছে, যেখানে মানুষ আগে অমর ছিল বা দেবতাদের সাথে থাকত, কিন্তু কোনো একটি ভুলের কারণে তারা মৃত্যুকে বরণ করে নেয় (Frazer, 1890)। যেমন, সুমেরীয় গিলগামেশ মহাকাব্যেও একটি সাপ যৌবন ধরে রাখার বিশেষ উদ্ভিদটি চুরি করে নিয়ে যায়, যার ফলে মানুষ অমরত্ব হারায়।
অবশেষে এল সেই করুণ দৃশ্য – স্বর্গ থেকে বিতাড়ন বা এক্সপালশন (Expulsion)। ঈশ্বর তাদের চামড়ার পোশাক পরিয়ে দিলেন এবং ইডেন উদ্যান থেকে বের করে দিলেন, যাতে তারা আবার হাত বাড়িয়ে জীবনবৃক্ষের ফল খেয়ে অমর না হয়ে যায়। কারণ, পাপের সাথে অমরত্ব যুক্ত হলে তা হতো এক অনন্ত বিভীষিকা। ইডেনের পূর্বদিকে পাহারায় বসানো হলো করূব বা কেরুবীম (Cherubim) – এক ধরণের শক্তিশালী ফেরেশতা, এবং একটি ঘূর্ণায়মান আগুনের তলোয়ার। মানুষের জন্য স্বর্গের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। মিথোলজি বিশারদ মিরচা এলিয়াদ (Mircea Eliade) এই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করেছেন মানুষের অবচেতন মনের এক চিরস্থায়ী হাহাকার হিসেবে। তিনি একে বলেছেন নস্টালজিয়া ফর প্যারাডাইস (Nostalgia for Paradise)। মানুষ তার সমগ্র ইতিহাস জুড়ে আসলে সেই হারানো ইডেনকেই খুঁজছে। আমাদের সব ইউটোপিয়া, সব আদর্শ সমাজ গড়ার স্বপ্ন আসলে অবচেতনে সেই আদিম বাগানে ফিরে যাওয়ারই আকাঙ্ক্ষা (Eliade, 1959)।
নারীবাদ এবং জ্ঞানতত্ত্বের ভিন্ন পাঠ
ইডেন উদ্যানের এই গল্পটি হাজার বছর ধরে নারীকে দমিয়ে রাখার একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ইভ বা হাওয়াকে দেখানো হয়েছে দুর্বলচিত্ত, প্রলুব্ধ এবং পাপের প্রবেশদ্বার হিসেবে। টারটুলিয়ান (Tertullian)-এর মতো আদি চার্চ ফাদাররা নারীকে ‘শয়তানের প্রবেশপথ’ (The Devil’s Gateway) বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু আধুনিক যুগে এসে এই মিথোলজির নতুন পাঠ বা রি-ইন্টারপ্রিটেশন (Re-interpretation) শুরু হয়েছে। নারীবাদী বাইবেল বিশারদ ফিলিস ট্রিবল (Phyllis Trible) তার বই গড অ্যান্ড দ্য রেটোরিক অফ সেক্সুয়ালিটি (God and the Rhetoric of Sexuality)-এ যুক্তি দিয়েছেন যে, জেনেসিসের গল্পে ইভ আসলে আদমের চেয়ে বেশি বুদ্ধিবৃত্তিক এবং ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনার ক্ষমতা রাখতেন। সাপ যখন কথা বলতে এল, সে আদমের সাথে কথা বলেনি, বলেছিল ইভের সাথে। ইভ অন্ধভাবে ফল খাননি, তিনি বিচার-বিবেচনা করেছিলেন। বাইবেলে বলা আছে, তিনি দেখলেন ফলটি “জ্ঞান অর্জনের জন্য কাঙ্ক্ষিত” (Desirable for gaining wisdom)। অর্থাৎ, ইভ ছিলেন প্রথম মানুষ যিনি নিছক আদেশের চেয়ে জ্ঞান বা প্রজ্ঞাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন (Trible, 1978)। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, ইভ কোনো খলনায়িকা নন, বরং তিনি মানবজাতির জ্ঞানতাত্ত্বিক অগ্রযাত্রার বা এপিস্টেমোলজিক্যাল জার্নি (Epistemological Journey)-র পথিকৃৎ।
অন্যদিকে, নস্টিসিজম (Gnosticism) বা জ্ঞানবাদী দর্শনে এই পুরো গল্পটিকে উল্টে দেওয়া হয়েছে। নস্টিক টেক্সটগুলোতে (যেমন ‘দ্য হাইপোস্ট্যাসিস অফ দ্য আরকনস’) জ্ঞানবৃক্ষ কোনো নিষিদ্ধ বা খারাপ কিছু নয়, বরং এটি হলো মুক্তির উৎস। আর সাপ সেখানে শয়তান নয়, বরং সে হলো সত্যের বার্তাবাহক বা ইন্সট্রাক্টর (Instructor), যে মানুষকে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিল। নস্টিকরা মনে করতেন, যেই ঈশ্বর মানুষকে জ্ঞান থেকে দূরে রাখতে চান, তিনি প্রকৃত সর্বোচ্চ ঈশ্বর হতে পারেন না; তিনি বরং এক ঈর্ষাপরায়ণ এবং নিম্নস্তরের দেবতা বা ডেমিয়ার্জ (Demiurge)। তাদের মতে, জ্ঞান অর্জন বা নসিস (Gnosis)-এর মাধ্যমেই মানুষ তার প্রকৃত ঐশ্বরিক সত্তাকে চিনতে পারে। ইলেং পেগেলস (Elaine Pagels) তার দ্য নস্টিক গসপেলস (The Gnostic Gospels) বইয়ে দেখিয়েছেন কীভাবে এই বিকল্প ব্যাখ্যাগুলো মূলধারার চার্চ দ্বারা দমিত হয়েছে, কিন্তু এগুলো আব্রাহামিক মিথোলজির এক অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক সমান্তরাল স্রোত (Pagels, 1979)। পতনের এই আখ্যান তাই কেবল একটি পাপের গল্প নয়, এটি মানুষের চেতনা, স্বাধীনতা এবং অস্তিত্বের সংকটের এক কালজয়ী উপাখ্যান।
প্রথম রক্তপাত: কেইন এবং অ্যাবেল (The First Murder: Cain and Abel)
ইডেন উদ্যান বা জান্নাত থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর মানুষের জীবন আর আগের মতো রইল না। যেখানে ফলের জন্য হাত বাড়ালেই চলত, সেখানে এখন হাড়ভাঙা খাটুনি। রুক্ষ মাটি খুঁড়ে ফসল ফলাতে হয়, পশু শিকার করতে হয়। বেঁচে থাকাটাই এক অনন্ত সংগ্রাম। আদম আর ইভ এই কঠিন পৃথিবীতে সংসার পাতলেন। তাদের ঘরে জন্ম নিল দুই ছেলে – বড় ছেলের নাম কেইন বা কাবিল (Cain) এবং ছোট ছেলের নাম অ্যাবেল বা হাবিল (Abel)। বাইবেল বা হিব্রু মিথোলজি অনুযায়ী, ‘কেইন’ নামের অর্থ হলো ‘অর্জন করা’ বা ‘মালিক হওয়া’ (Acquisition), আর ‘অ্যাবেল’ নামের অর্থ হলো ‘নিঃশ্বাস’ বা ‘বাষ্প’ (Breath/Vapor), যা জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্বের ইঙ্গিত দেয়। এই দুই ভাইয়ের গল্প দিয়েই মানব ইতিহাসের এক নতুন ও অন্ধকার অধ্যায় শুরু হয়। এটি কেবল দুই ভাইয়ের ঝগড়া নয়; এটি মানব চরিত্রের হিংসা, ক্ষোভ এবং সহিংসতার আদিম দলিল। মিথোলজি এখানে আমাদের দেখাচ্ছে যে, স্বর্গের পবিত্রতা হারানোর পর পৃথিবীতে সহিংসতা বা ভায়োলেন্স (Violence) ছিল অনিবার্য।
দুই ভাই বড় হলো এবং জীবনধারণের জন্য দুটি ভিন্ন পেশা বেছে নিল। কেইন হলেন কৃষক বা এগ্রিকালচারালিস্ট (Agriculturalist), যিনি মাটির সাথে লড়াই করে ফসল ফলান। আর অ্যাবেল হলেন মেষপালক বা প্যাস্টরালিস্ট (Pastoralist), যিনি পশুপালন করেন। মিথোলজির এই অংশটি খুবই প্রতীকী। প্রাচীন পৃথিবীতে কৃষিভিত্তিক সমাজ এবং পশুপালনকারী যাযাবর সমাজের মধ্যে যে চিরায়ত দ্বন্দ্ব ছিল, এই দুই ভাই যেন তারই প্রতিচ্ছবি। একটা নির্দিষ্ট সময় পর দুজনেই ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে উপহার বা স্যাক্রিফাইস (Sacrifice) নিয়ে এল। কেইন আনলেন তার জমির কিছু ফসল, আর অ্যাবেল আনলেন তার পালের প্রথম জন্মানো কয়েকটি হৃষ্টপুষ্ট ভেড়া এবং তাদের চর্বি।
ঈশ্বরের প্রত্যাখ্যান ও ঈর্ষার আগুন
নাটকীয় মুহূর্তটি উপস্থিত হলো যখন ঈশ্বর উপহার গ্রহণ করলেন। জেনেসিসের বর্ণনা অনুযায়ী, ঈশ্বর অ্যাবেলের উপহারের দিকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকালেন, কিন্তু কেইনের ফসলের দিকে তাকালেন না। কেন? এই ‘কেন’ প্রশ্নের কোনো স্পষ্ট উত্তর মূল টেক্সটে নেই। আর ঠিক এই অস্পষ্টতা বা অ্যাম্বিগুইটি (Ambiguity)-ই গল্পটিকে আরও রহস্যময় ও গভীর করে তুলেছে। হতে পারে অ্যাবেলের উপহার ছিল রক্তমাখা, যা ত্যাগের প্রতীক, আর কেইনের উপহার ছিল কেবলই কর্তব্যের খাতিরে দেওয়া। অথবা, ঈশ্বর হয়তো মানুষের মনের খবর জানতেন। হিব্রু পণ্ডিতরা বা রাব্বিনিক লিটারেচার (Rabbinic Literature) মনে করে, অ্যাবেল তার সেরা জিনিসটি দিয়েছিলেন, কিন্তু কেইন দিয়েছিলেন সাধারণ বা নিম্নমানের শস্য। কারণ যাই হোক, কেইনের মন ভেঙে গেল। তার মুখ কালো হয়ে গেল। এখানেই জন্ম নিল মানুষের আদিমতম এবং ধ্বংসাত্মক আবেগ – ঈর্ষা বা এনভি (Envy)।
ঈশ্বর কেইনকে সাবধান করলেন। মিথোলজির ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো ঈশ্বর মানুষকে নৈতিক পছন্দের সুযোগ দিচ্ছেন। তিনি বললেন, “কেন তোমার মুখ কালো? তুমি যদি ভালো কাজ করো, তবে কি তুমি গৃহীত হবে না? আর যদি ভালো না করো, তবে পাপ দরজায় ওত পেতে আছে। সে তোমাকে গ্রাস করতে চায়, কিন্তু তোমাকে তাকে জয় করতে হবে।” এই সংলাপটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে পাপ বা সিন (Sin)-কে কোনো বিমূর্ত ধারণা হিসেবে নয়, বরং দরজায় ওঁৎ পেতে থাকা কোনো হিংস্র শিকারি পশুর মতো বর্ণনা করা হয়েছে, যাকে হিব্রু ভাষায় বলা হয়েছে ‘রোবেৎজ’ (Rovetz)। কিন্তু কেইন সেই সাবধানবাণী শুনলেন না। তার ভেতরে তখন জ্বলছে দাউ দাউ আগুন – ভাইয়ের প্রতি ঘৃণা, আর ঈশ্বরের অবিচারের প্রতি ক্ষোভ।
ক্ষেতের মাঝে প্রথম খুন
একদিন কেইন তার ভাই অ্যাবেলকে বললেন, “চলো, আমরা মাঠে যাই।” (যদিও মাসোরিটিক টেক্সটে এই বাক্যটি অসম্পূর্ণ, কিন্তু সামারিটান এবং সেপ্টুয়াজিন্ট সংস্করণে এই কথোপকথনটি পাওয়া যায়)। তারা যখন খোলা মাঠে একা, তখন কেইন তার নিজের ভাই অ্যাবেলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং তাকে হত্যা করলেন। এটি মানব ইতিহাসের প্রথম হত্যাকাণ্ড, এবং আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে – ভ্রাতৃহত্যা বা ফ্র্যাট্রিসাইড (Fratricide)। ভাবা যায়? পৃথিবীতে তখন মানুষই আছে মাত্র চারজন, আর এর মধ্যেই একজন আরেকজনকে খুন করে ফেলল! মাটি ভিজল মানুষের রক্তে। মিথোলজি বলছে, এই ঘটনার মাধ্যমে মানুষ এবং মাটির সম্পর্কের মধ্যেও এক চিরস্থায়ী ফাটল ধরল। যে মাটি মানুষকে শস্য দিত, সেই মাটি এখন মানুষের রক্ত শুষে নিল।
ফরাসি তাত্ত্বিক এবং দার্শনিক রেনে জিরার্ড (René Girard) তার বিখ্যাত বই ভায়োলেন্স অ্যান্ড দ্য স্যাক্রেড (Violence and the Sacred)-এ এই ঘটনাটিকে মিমেটিক ডিজায়ার (Mimetic Desire) বা অনুকরণমূলক আকাঙ্ক্ষার চূড়ান্ত উদাহরণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। জিরার্ডের মতে, কেইন আসলে ঈশ্বরের ভালোবাসা চেয়েছিলেন। যখন তিনি দেখলেন ঈশ্বর অ্যাবেলকে পছন্দ করছেন, তখন তার আকাঙ্ক্ষা অ্যাবেলের প্রতি হিংসায় রূপ নিল। এই হিংসা প্রশমনের জন্য দরকার ছিল একটি বলির পাঁঠা বা স্কেপগোট (Scapegoat), এবং অ্যাবেল নিজেই সেই বলির শিকারে পরিণত হলেন (Girard, 1972)। জিরার্ড মনে করেন, মানুষের সমাজ এবং ধর্ম গড়ে উঠেছে এই আদিম সহিংসতার ওপর ভিত্তি করেই।
আমি কি আমার ভাইয়ের রক্ষক?
খুনের পর ঈশ্বর আবার কেইনের মুখোমুখি হলেন। তিনি প্রশ্ন করলেন, “তোমার ভাই অ্যাবেল কোথায়?” সর্বজ্ঞানী ঈশ্বর অবশ্যই জানতেন অ্যাবেল কোথায়, কিন্তু তিনি কেইনকে স্বীকারোক্তির সুযোগ দিচ্ছিলেন। কেইন তখন এক ঔদ্ধত্যপূর্ণ এবং কালজয়ী উত্তর দিলেন, “আমি জানি না। আমি কি আমার ভাইয়ের রক্ষক?” (Am I my brother’s keeper?)। এই একটি বাক্য পশ্চিমা সাহিত্য এবং নৈতিকতার ইতিহাসে হাজার বছর ধরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এটি কেবল একটি অজুহাত নয়, এটি সামাজিক দায়বদ্ধতা অস্বীকার করার চূড়ান্ত রূপ। কেইন কেবল তার ভাইকে হত্যাই করেননি, তিনি তাদের মধ্যকার রক্তের বন্ধন এবং দায়িত্বকেও অস্বীকার করলেন।
তখন ঈশ্বর বললেন, “তুমি এ কী করলে? তোমার ভাইয়ের রক্ত মাটি থেকে আমার কাছে চিৎকার করছে।” শাস্তি হিসেবে কেইনকে অভিশাপ দেওয়া হলো। ঈশ্বর বললেন, “তুমি যখন মাটিতে চাষ করবে, মাটি আর তোমাকে ফসল দেবে না। তুমি পৃথিবীতে পলাতক এবং ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়াবে।” কৃষিভিত্তিক সমাজের প্রতিনিধি কেইনের জন্য এর চেয়ে বড় শাস্তি আর হতে পারে না – তার জীবিকার উৎস, তার মাটি, তাকে প্রত্যাখ্যান করল। কেইন ভয় পেলেন। তিনি বললেন, “আমার শাস্তি আমার সহ্যের বাইরে। আমাকে যে কেউ পাবে, সেই আমাকে হত্যা করবে।” কেইনের এই আর্তনাদ প্রমাণ করে যে, তৎকালীন পৃথিবীতে হয়তো আরও মানুষ ছিল (যা মিথোলজির লজিক বা যুক্তিতে একটি ফাঁক বা প্লট হোল (Plot Hole) তৈরি করে), অথবা তিনি ভবিষ্যতের প্রজন্মের কথা ভাবছিলেন।
কেইনের চিহ্ন এবং সভ্যতার পত্তন
কেইনকে রক্ষা করার জন্য ঈশ্বর তাকে একটি চিহ্ন দিলেন, যা মার্ক অফ কেইন (Mark of Cain) নামে পরিচিত। এটি কোনো অভিশাপের দাগ নয়, বরং এটি ছিল একটি ঐশ্বরিক সুরক্ষা বা ডিভাইন প্রোটেকশন (Divine Protection)। ঈশ্বর ঘোষণা করলেন, “যে কেউ কেইনকে হত্যা করবে, তাকে সাতগুণ প্রতিশোধের শিকার হতে হবে।” এই চিহ্নটি কী ছিল, তা নিয়ে ইহুদি ও খ্রিস্টান ঐতিহ্যে নানা মত আছে – কেউ বলেন এটি কপালে একটি শিং, কেউ বলেন একটি বিশেষ অক্ষর, আবার কেউ বলেন এটি ছিল কুষ্ঠরোগের দাগ। তবে সাহিত্যিক অর্থে, এটি পাপীর কপালে কলঙ্কের দাগ, যা তাকে সমাজের অন্য সবার থেকে আলাদা করে রাখে।
গল্পের সবচেয়ে আইরনিক বা শ্লেষাত্মক অংশটি ঘটে এর পরে। ভবঘুরে জীবন কাটানোর অভিশাপ পেলেও, কেইন নড (Nod) নামের দেশে গিয়ে বসতি স্থাপন করলেন, বিয়ে করলেন এবং একটি নগর বা সিটি (City) নির্মাণ করলেন। তিনি তার ছেলের নামে সেই শহরের নাম রাখলেন হনোক বা ইনক (Enoch)। এটি একটি গভীর দার্শনিক বার্তা বহন করে। মিথোলজি আমাদের বলছে, মানব সভ্যতার প্রথম শহরটি গড়ে তুলেছিলেন একজন খুনি। অর্থাৎ, আমাদের এই যে জাঁকজমকপূর্ণ সভ্যতা, নগরজীবন, এর ভিত্তিমূলে মিশে আছে সহিংসতা এবং রক্ত। বিখ্যাত সাহিত্যিক জন স্টেইনবেক (John Steinbeck) তার মহাকাব্যিক উপন্যাস ইস্ট অফ ইডেন (East of Eden)-এ এই থিমটিকেই ব্যবহার করেছেন। স্টেইনবেক দেখিয়েছেন যে, প্রতিটি মানুষের ভেতরেই কেইন এবং অ্যাবেলের দ্বন্দ্ব চলছে, এবং মানুষের হাতে সবসময়ই ‘টিমসেল’ (Timshel) বা ‘বেছে নেওয়ার ক্ষমতা’ থাকে – সে কি পাপকে জয় করবে, নাকি পাপের দাস হবে (Steinbeck, 1952)।
নৃতাত্ত্বিক এবং সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
কেন ঈশ্বর মেষপালক অ্যাবেলকে পছন্দ করলেন এবং কৃষক কেইনকে প্রত্যাখ্যান করলেন? নৃতাত্ত্বিকরা এর একটি ধর্মনিরপেক্ষ বা সেক্যুলার (Secular) ব্যাখ্যা দেন। জেমস জর্জ ফ্রেজার (James George Frazer) তার ফোক-লোর ইন দি ওল্ড টেস্টামেন্ট (Folk-lore in the Old Testament)-এ উল্লেখ করেছেন যে, এই গল্পটি আসলে প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যের সেমেটিক জাতিগুলোর সাংস্কৃতিক স্মৃতির প্রতিফলন। হিব্রু বা ইস্রায়েলীয়রা মূলত ছিল মেষপালক জাতি। তাদের কাছে কৃষিভিত্তিক জীবন ছিল অপেক্ষাকৃত নতুন এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের প্রতিবেশী ক্যানানাইট বা কেনানীয়দের সংস্কৃতি। কেনানীয়রা ছিল কৃষক এবং তারা উর্বরতার দেবদেবীর পূজা করত। তাই মেষপালক হিব্রুদের দৃষ্টিতে কৃষিকাজ বা ভূমির মালিকানা ছিল সন্দেহজনক এবং ঈশ্বরের কাছে কম গ্রহণযোগ্য (Frazer, 1918)।
আবার রেজিনা শোয়ার্টজ (Regina Schwartz) তার বই দ্য কার্স অফ কেইন (The Curse of Cain)-এ একটি ভিন্ন তাত্ত্বিক দিক তুলে ধরেছেন। তিনি একে বলেছেন স্কেয়ারসিটি প্রিন্সিপাল (Scarcity Principle) বা অভাবের নীতি। ঈশ্বরের আশীর্বাদ কি অঢেল নয়? কেন একজনকে পেতে হলে আরেকজনকে বঞ্চিত হতে হবে? মিথোলজিতে দেখা যায়, ঈশ্বরের অনুগ্রহ যেন একটি সীমিত সম্পদ – যা কেবল একজনই পাবে। এই যে ‘একজনই পাবে’ মানসিকতা, এটিই ভাইয়ে-ভাইয়ে দ্বন্দ্বের মূল কারণ। একেশ্বরবাদী মিথোলজিগুলোতে এই ‘এক্সক্লুসিভিটি’ বা একচেটিয়াবাদ বারবার ফিরে আসে – ইসহাক বনাম ইসমাইল, যাকোব বনাম এষৌ, এবং কেইন বনাম অ্যাবেল। শোয়ার্টজ যুক্তি দেন যে, এই অভাববোধ এবং একচেটিয়া অধিকারের ধারণাটিই পশ্চিমা সমাজে সহিংসতার জন্ম দিয়েছে (Schwartz, 1997)।
অবশেষে, কেইন এবং অ্যাবেলের গল্প কেবল একটি হত্যাকাণ্ডের বিবরণ নয়। এটি মানব প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার এক অনবদ্য আখ্যান। আমরা সবাই অ্যাবেলের মতো নির্দোষ হতে চাই, কিন্তু আমাদের সবার অবচেতনে একজন কেইন লুকিয়ে আছে – যে ঈর্ষা করে, যে নিজের ব্যর্থতার জন্য অন্যকে দায়ী করে, এবং যে সুযোগ পেলে প্রতিদ্বন্দ্বীকে সরিয়ে দিতে চায়। মিথোলজি আমাদের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় এবং প্রশ্ন করে – তুমি কি তোমার ভাইয়ের রক্ষক হতে প্রস্তুত, নাকি তুমিও কেইনের মতো মুখ ফিরিয়ে নেবে?
মহাপ্লাবন: নোয়াহ্ বা নূহ এবং তার নৌকা (The Deluge: Noah and the Ark)
পাপের পৃথিবী ও ঐশ্বরিক অনুশোচনা
মানুষ যখন ইডেন থেকে বের হয়ে এল, তখন আশা করা হয়েছিল যে হয়তো কষ্টের জীবনে তারা শোধরানো শুরু করবে। কিন্তু ঘটল উল্টোটা। আদমের পরবর্তী দশটি প্রজন্মের ইতিহাস হলো কেবলই অধঃপতনের ইতিহাস। পৃথিবী ভরে গেল পাপে, অনাচারে এবং চরম সহিংসতায়। হিব্রু বাইবেলে এই সহিংসতাকে বোঝাতে ‘হামাস’ (Hamas) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, যার অর্থ অকারন ধ্বংসলীলা। পরিস্থিতি এতটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল যে, স্বয়ং স্রষ্টা বা ঈশ্বর তার নিজের সৃষ্টিকে দেখে অনুতপ্ত হলেন। জেনেসিসের ভাষায়, “ঈশ্বরের মন বেদনায় ভারাক্রান্ত হলো।” এটি মিথোলজির এক অদ্ভুত মুহূর্ত – যে ঈশ্বর সর্বজ্ঞানী, তিনি কীভাবে ভুল করতে পারেন বা অনুতাপ করতে পারেন? থিওলজিতে একে বলা হয় অ্যান্থ্রোপমরফিজম (Anthropomorphism) বা ঈশ্বরে মানবিক গুণের আরোপ। ঈশ্বর দেখলেন, মানুষের মনের চিন্তাভাবনা কেবলই মন্দের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তখন তিনি এক কঠোর সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি ভাবলেন, এই হার্ড ড্রাইভটি ভাইরাসে ভরে গেছে, একে আর মেরামত করা সম্ভব নয়। তাই তিনি পুরো সিস্টেমকে ‘ফরম্যাট’ বা রিসেট করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি বললেন, “আমি মানুষ এবং পশু সব ধ্বংস করব।” একে তাত্ত্বিক ভাষায় বলা হয় আনক্রিয়েশন (Uncreation)। সৃষ্টির সময় ঈশ্বর জলরাশি বা ‘কেওয়াস’ (Chaos) থেকে শৃঙ্খলা বা কসমস তৈরি করেছিলেন; এবার তিনি সেই জলরাশিকে আবার উন্মুক্ত করে দিয়ে পৃথিবীকে আদিম বিশৃঙ্খল অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করলেন।
বিশ্বাসের পরীক্ষা: বিশাল নৌকা নির্মাণ
এই ঘোর অন্ধকারের মধ্যে কেবল একটি প্রদীপ জ্বলছিল। তিনি হলেন নোয়াহ বা নূহ (Noah)। বাইবেল তাকে বলেছে “তার প্রজন্মের মধ্যে একমাত্র ধার্মিক ব্যক্তি” (Righteous in his generation)। ঈশ্বর নূহকে ডেকে তার গোপন পরিকল্পনার কথা জানালেন। তিনি নূহকে আদেশ দিলেন একটি বিশাল নৌকা বা আর্ক (Ark) তৈরি করতে। এই নৌকাটি কোনো সাধারণ জলযান ছিল না। এর নকশা বা ব্লু-প্রিন্ট স্বয়ং ঈশ্বর দিয়েছিলেন। এটি তৈরি হবে গোফর কাঠ (Gopher wood) দিয়ে, এর ভেতরে ও বাইরে আলকাতরা বা পিচ (Pitch) লাগাতে হবে যাতে জল না ঢোকে। এর দৈর্ঘ্য হবে ৩০০ হাত, প্রস্থ ৫০ হাত এবং উচ্চতা ৩০ হাত। আধুনিক মাপে এটি প্রায় একটি টাইটানিক জাহাজের অর্ধেক বা তার চেয়েও বড়। ভাবুন তো, নূহ বাস করতেন মরুভূমি বা সমতল এলাকায়, যেখানে ধারের কাছে কোনো সমুদ্র নেই। সেখানে বসে তিনি বানাচ্ছেন এক বিশাল জাহাজ! তার প্রতিবেশী এবং সমসাময়িকরা নিশ্চয়ই তাকে পাগল ভেবেছিল। কুরআন এবং ইহুদি মিদরাশ (Midrash)-এর বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, মানুষ নূহকে নিয়ে কী প্রচণ্ড উপহাস করত। কিন্তু নূহ ছিলেন তার বিশ্বাসেস বা ফেইথ (Faith)-এর ওপর অটল। এটি আব্রাহামিক মিথোলজির একটি কেন্দ্রীয় থিম – ঈশ্বরের আদেশ যুক্তির বাইরে মনে হলেও তা পালন করা।
ভাসমান চিড়িয়াখানা এবং একটি পরিবারের ট্র্যাজেডি
নৌকা তৈরির কাজ শেষ হলো। এবার এল যাত্রী তোলার পালা। ঈশ্বর আদেশ দিলেন, “তুমি তোমার পরিবার এবং পৃথিবীর প্রতিটি জীবজন্তুর এক জোড়া করে (পুরুষ ও স্ত্রী) নৌকায় তোলো।” পবিত্র বা ‘কোশার’ (Kosher) প্রাণীদের ক্ষেত্রে সাত জোড়া এবং অপবিত্রদের ক্ষেত্রে এক জোড়া নেওয়ার নির্দেশ ছিল। জীবজন্তুদের এই বিশাল সংগ্রহশালা বা ভাসমান চিড়িয়াখানার ধারণাটি জীববিজ্ঞান বা ট্যাক্সোনমি (Taxonomy)-র দৃষ্টিতে অসম্ভব মনে হলেও, মিথোলজির জগতে এটি একটি শক্তিশালী প্রতীক। এই আর্ক বা নৌকাটি হয়ে উঠল একটি ‘মাইক্রোকসম’ (Microcosm) বা ক্ষুদ্র পৃথিবী। বাইরের জগত যখন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তখন এই কাঠের বাক্সের ভেতরে জীবনের বীজ সংরক্ষিত থাকছে। নূহ, তার স্ত্রী, তার তিন ছেলে – শেম, হাম এবং ইয়াফেস – এবং তাদের স্ত্রীরা নৌকায় উঠলেন। তবে কুরআনের বর্ণনায় এখানে একটি ট্র্যাজিক দৃশ্য আছে। নূহের এক ছেলে (যাকে প্রথাগতভাবে কেনান বা ইয়াম বলা হয়) নৌকায় উঠতে অস্বীকার করল। সে বলল, “আমি পাহাড়ে আশ্রয় নেব, জল আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না।” নূহ তাকে মিনতি করলেন, কিন্তু সে শুনল না এবং শেষ পর্যন্ত ডুবে মারা গেল। এই ঘটনাটি শেখায় যে, রক্তের সম্পর্কের চেয়ে বিশ্বাসের সম্পর্ক বা আদর্শিক বন্ধন আব্রাহামিক ধর্মে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
জলরাশির তাণ্ডব এবং পৃথিবীর শুদ্ধিকরণ
অবশেষে এল সেই ভয়াল দিন। মহাপ্লাবন বা দ্য ডেলিউজ (The Deluge) শুরু হলো। বাইবেলের ভাষায়, “মহাকাশের বাতায়নগুলো (Windows of Heaven) খুলে গেল এবং মাটির নিচের সব ঝর্ণা ফেটে পড়ল।” অর্থাৎ জল শুধু আকাশ থেকে পড়েনি, মাটি ফুঁড়েও বের হয়েছে। টানা ৪০ দিন ও ৪০ রাত বৃষ্টি হলো। জল বাড়তে বাড়তে পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়াটিও ডুবে গেল। পৃথিবীর বুকে শ্বাস নেওয়া প্রতিটি প্রাণী – পাখি, পশু, সরীসৃপ এবং মানুষ – সব ধ্বংস হয়ে গেল। চারপাশে কেবল জল আর জল। কোথাও কোনো জীবনের স্পন্দন নেই, শুধু কাঠের ওই নৌকাটি ভেসে আছে অনন্ত জলরাশির ওপর। এই দৃশ্যটি একাধারে ভীতিকর এবং প্রশান্তিময়। এটি যেন এক দীর্ঘ নীরবতা, যেখানে ঈশ্বর পৃথিবীকে ধুয়ে-মুছে পবিত্র করছেন বা পিউরিফিকেশন (Purification) চালাচ্ছেন। প্রায় এক বছর ধরে নৌকাটি জলে ভাসল। এরপর ঈশ্বর বাতাসের গতি পরিবর্তন করলেন এবং জল কমতে শুরু করল। নৌকাটি গিয়ে ঠেকল আরারাত পর্বত (বাইবেল মতে) বা জুদি পাহাড়ে (কুরআন মতে)।
রংধনুর চুক্তি: ঐশ্বরিক করুণার প্রতিশ্রুতি
জল সরে গেছে কি না, তা পরীক্ষা করার জন্য নূহ প্রথমে একটি দাঁড়কাক বা রেভেন (Raven) পাঠালেন। কাকটি উড়ে গেল এবং মরা পশুপাখির দেহাবশেষ খেয়ে ওখানেই থেকে গেল, ফিরে এল না। এরপর নূহ পাঠালেন একটি ঘুঘু বা ডাভ (Dove)। প্রথমবার ঘুঘুটি বসার জায়গা না পেয়ে ফিরে এল। সাত দিন পর আবার পাঠানো হলো। এবার ঘুঘুটি ফিরে এল ঠোঁটে করে একটি জলপাই গাছের পাতা (Olive leaf) নিয়ে। এই দৃশ্যটি – সাদা পায়রা এবং জলপাই পাতা – আজও সারা বিশ্বে শান্তির প্রতীক বা সিম্বল অফ পিস (Symbol of Peace) হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মিথোলজিতে এর অর্থ হলো, ঈশ্বরের ক্রোধ প্রশমিত হয়েছে, পৃথিবী আবার বাসযোগ্য হয়েছে। তৃতীয়বার পাঠানো হলে ঘুঘুটি আর ফিরে এল না। নূহ বুঝলেন, এবার নামার সময় হয়েছে। নৌকা থেকে নেমে নূহ প্রথমেই ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে একটি যজ্ঞবেদি তৈরি করলেন এবং পশু উৎসর্গ করলেন। ঈশ্বর সেই উৎসর্গের সুগন্ধে প্রীত হলেন এবং মনে মনে বললেন, “মানুষের কারণে আমি আর কখনো পৃথিবীকে অভিশাপ দেব না, যদিও মানুষের মনের প্রবৃত্তি ছোটবেলা থেকেই মন্দের দিকে ধাবিত হয়।”
এখানেই আব্রাহামিক মিথোলজিতে ঈশ্বর এবং মানুষের সম্পর্কের সমীকরণে একটি বিশাল পরিবর্তন আসে। ঈশ্বর মানুষের সাথে একটি চুক্তি বা কোভেন্যান্ট (Covenant) করলেন। তিনি কথা দিলেন, আর কখনো তিনি জল দিয়ে পুরো পৃথিবী ধ্বংস করবেন না। এই চুক্তির সাক্ষী বা স্বাক্ষর হিসেবে তিনি আকাশে রংধনু বা রেইনবো (Rainbow) স্থাপন করলেন। হিব্রু ভাষায় রংধনু এবং যুদ্ধের ধনুক – উভয়ের জন্যই ‘কেশেত’ (Qeshet) শব্দটি ব্যবহৃত হয়। প্রাচীনকালে রাজারা যুদ্ধ শেষে তাদের ধনুক উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখতেন শান্তির প্রতীক হিসেবে। ঈশ্বরও যেন তার যুদ্ধের ধনুকটি (রংধনু) মেঘের গায়ে ঝুলিয়ে দিলেন, যার মুখটা পৃথিবীর দিকে নয়, বরং আকাশের দিকে। এটি ঈশ্বরের আত্মসংযম বা ডিভাইন মার্সি (Divine Mercy)-র এক অপূর্ব নিদর্শন।
মিথোলজির শেকড়: গিলগামেশ থেকে জেনেসিস
মহাপ্লাবনের এই কাহিনীটি কেবল আব্রাহামিক ধর্মের সম্পত্তি নয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে যখন প্রত্নতাত্ত্বিকরা প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার ধ্বংসাবশেষ খুঁড়ছিলেন, তখন তারা এমন কিছু মাটির ফলক বা কিউনিফর্ম ট্যাবলেট (Cuneiform Tablet) খুঁজে পান, যা পুরো পশ্চিমা জগতকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। ১৮৭২ সালে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের অ্যাসিস্ট্যান্ট জর্জ স্মিথ (George Smith) পাঠোদ্ধার করেন যে, ওই ফলকগুলোতে বাইবেলের বন্যার গল্পের হুবহু বর্ণনা আছে, কিন্তু তা লেখা হয়েছে বাইবেলের বহু শতাব্দী আগে! এটি ছিল বিখ্যাত সুমেরীয় মহাকাব্য দ্য এপিক অফ গিলগামেশ (The Epic of Gilgamesh)। সেখানে দেখা যায়, অমরত্বের সন্ধানে গিলগামেশ দেখা করেন উতনাপিশতিম (Utnapishtim) নামের এক ব্যক্তির সাথে, যিনি দেবতাদের আদেশে একটি বিশাল নৌকা বানিয়ে মহাপ্লাবন থেকে বেঁচেছিলেন। উতনাপিশতিমের গল্পের সাথে নূহের গল্পের মিল এতই বেশি যে, একে কাকতালীয় বলা অসম্ভব – নৌকার মাপ, পশুপাখি তোলা, এমনকি কাক ও ঘুঘু পাখি পাঠানোর ঘটনাও সেখানে আছে।
সম্প্রতি ব্রিটিশ মিউজিয়ামের কিউরেটর এবং লিপিবিশারদ আরভিং ফিনকেল (Irving Finkel) তার যুগান্তকারী গবেষণাপত্র ও বই দ্য আর্ক বিফোর নোয়াহ (The Ark Before Noah)-তে একটি নতুন ব্যবিলনীয় ফলকের কথা উল্লেখ করেছেন। সেখানে বন্যার আগে নৌকা তৈরির নির্দেশাবলী আরও বিস্তারিতভাবে দেওয়া আছে। ফিনকেলের গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার নৌকাটি ছিল আসলে একটি বিশাল গোলাকার ভেলার মতো, যাকে বলা হয় কোরাকল (Coracle), যা স্থানীয় নদীতে ব্যবহৃত হতো (Finkel, 2014)। ফিনকেল এবং অন্যান্য ঐতিহাসিকরা মনে করেন, টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর অববাহিকায় প্রাচীনকালে প্রায়ই বিধ্বংসী বন্যা হতো। এমনই কোনো এক প্রলয়ঙ্করী বন্যা মানুষের মনে এতটাই গভীর দাগ কেটেছিল যে, তা মানুষের কালেক্টিভ মেমোরি (Collective Memory) বা সমষ্টিগত স্মৃতির অংশ হয়ে যায়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মুখে মুখে ফিরতে ফিরতে সেই স্থানীয় বন্যা এক মহাজাগতিক রূপক বা কসমিক মেটাফোর (Cosmic Metaphor)-এ পরিণত হয়। ইহুদিরা যখন ব্যবিলনীয় নির্বাসনে (Babylonian Exile) ছিল, তখন তারা সম্ভবত এই সুমেরীয় আখ্যানের সংস্পর্শে আসে এবং তাদের নিজস্ব একেশ্বরবাদী দর্শনের আলোকে গল্পটিকে নতুন করে সাজিয়ে নেয়। গিলগামেশের গল্পে বন্যা ছিল দেবতাদের খেয়ালখুশি ও ঝগড়ার ফল, আর আব্রাহামিক গল্পে বন্যা হলো মানুষের পাপের নৈতিক বিচার।
হামের অভিশাপ: একটি বিতর্কিত আখ্যান
তবে বন্যার পরবর্তী অধ্যায়ে একটি বিতর্কিত এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘটনা আছে, যা ‘হামের অভিশাপ’ বা কার্স অফ হাম (Curse of Ham) নামে পরিচিত। বন্যা শেষে নূহ আঙুর চাষ শুরু করেন এবং একদিন নিজের তৈরি মদ খেয়ে মাতাল হয়ে তাঁবুর ভেতরে নগ্ন অবস্থায় পড়ে থাকেন। তার ছোট ছেলে হাম (Ham) বাবাকে এই অবস্থায় দেখে এবং বাইরে গিয়ে ভাইদের বলে। কিন্তু অন্য দুই ভাই, শেম এবং ইয়াফেস, পেছনের দিকে হেঁটে গিয়ে বাবার গায়ে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়, যাতে বাবার নগ্নতা দেখতে না হয়। নূহ জেগে উঠে যখন সব জানতে পারেন, তখন তিনি হামের ছেলে কেনানকে (Canaan) অভিশাপ দেন: “কেনান অভিশপ্ত হোক; সে তার ভাইদের দাসদের দাস হবে।” এই অদ্ভুত গল্পটি কেন বাইবেলে এল, তা নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। তবে দুঃখজনকভাবে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বর্ণবাদী তাত্ত্বিকরা এই মিথোলজিটিকে ব্যবহার করে কালো মানুষদের দাসত্বকে ধর্মীয়ভাবে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, যদিও আধুনিক বাইবেল বিশারদ এবং ঐতিহাসিক নরমান কোহন (Norman Cohn) তার বই নোয়াহ’স ফ্লাড: দ্য জেনেসিস স্টোরি ইন ওয়েস্টার্ন থট (Noah’s Flood: The Genesis Story in Western Thought)-এ প্রমাণ করেছেন যে, এই অভিশাপের সাথে গায়ের রঙের কোনো সম্পর্ক বাইবেলের মূল টেক্সটে ছিল না (Cohn, 1996)। এটি ছিল মূলত ইস্রায়েলীয়দের দ্বারা কেনানীয়দের ভূমি দখলের একটি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অলিবি বা অজুহাত।
মহাপ্লাবনের গল্পটি শেষ হয় এক নতুন পৃথিবী ও নতুন মানবতার সূচনার মধ্য দিয়ে। নূহের তিন ছেলে – শেম, হাম এবং ইয়াফেস – থেকেই পৃথিবীর সমস্ত জাতিগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে বলে আব্রাহামিক মিথোলজিতে বিশ্বাস করা হয়। একে বলা হয় টেবিল অফ নেশন্স (Table of Nations)। মহাপ্লাবন আমাদের শেখায় যে, প্রকৃতি ও ঈশ্বরের রুদ্রমূর্তির সামনে মানুষ কত অসহায়, কিন্তু একই সাথে এটি আশা বা হোপ (Hope)-এর গল্প। রংধনু আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ধ্বংসের শেষেই আছে নতুন সৃষ্টি। ঝড় যত প্রবলই হোক, একদিন আকাশ পরিষ্কার হবেই, আর কোনো এক জুদি পাহাড়ে জীবনের তরী এসে ভিড়বে।
আব্রাহাম: বিশ্বাসের পিতা এবং একটি পরিবারের বিভাজন (Abraham: The Patriarch and the Great Schism)
আব্রাহামিক মিথোলজির বিশাল মহাকাব্যের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছেন একজন মানুষ – আব্রাহাম বা ইব্রাহিম। তাকে বলা হয় ‘বিশ্বাসের পিতা’ বা ফাদার অফ ফেইথ (Father of Faith)। কেন? কারণ তিনি এমন এক সময়ে এক অদৃশ্য ঈশ্বরের ডাক শুনেছিলেন, যখন পৃথিবী ছিল বহুদেববাদী বা পলিথিস্টিক (Polytheistic)। উর (Ur) শহরের (বর্তমান ইরাক) এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি চন্দ্রদেবতা নান্নার উপাসনা ছেড়ে এক অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন। মিথোলজির ইতিহাসে এই যাত্রাটি লেচ লেচা (Lech Lecha) বা ‘তোমার নিজের দেশ ছেড়ে যাও’ নামে পরিচিত। এটি কেবল ভৌগোলিক যাত্রা নয়, এটি ছিল মানুষের চেতনার এক বিশাল উল্লম্ফন – দৃশ্যমান মূর্তি বা প্রকৃতি পূজা থেকে অদৃশ্য এক সত্তার দিকে যাত্রা। আব্রাহাম তার স্ত্রী সারা (Sarah), ভ্রাতুষ্পুত্র লুত এবং কিছু অনুসারীকে নিয়ে রওনা হলেন প্রতিশ্রুত ভূমি বা প্রমিসড ল্যান্ড (Promised Land)-এর দিকে, যা আজকের কেনান বা ফিলিস্তিন অঞ্চল। ঈশ্বরের সাথে আব্রাহামের সম্পর্কটি দাঁড়িয়ে আছে একটি আইনি ও আধ্যাত্মিক চুক্তির ওপর, যাকে হিব্রু ভাষায় বলা হয় বেরিত (Berit) বা কোভেন্যান্ট (Covenant)। ঈশ্বর তাকে কথা দিলেন, “আমি তোমাকে এক মহান জাতির পিতা করব, এবং তোমার বংশধররা আকাশের তারার মতো অসংখ্য হবে।” শুনতে খুব চমৎকার লাগছে, তাই না? কিন্তু মিথোলজির প্রতিটি বড় গল্পের মতো এখানেও একটি ট্র্যাজিক সমস্যা বা প্লট কনফ্লিক্ট (Plot Conflict) আছে। আব্রাহাম এবং তার স্ত্রী সারা বার্ধক্যে পৌঁছে গেছেন, কিন্তু তাদের কোনো সন্তান নেই। এই নিঃসন্তান দম্পতির হাহাকার এবং বংশরক্ষার তাগিদ থেকেই জন্ম নেয় আব্রাহামিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নাটক এবং বিভাজন।
হাগার এবং ইসমাইল: পারিবারিক রাজনীতির সূত্রপাত
ঈশ্বর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু বাস্তবে তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। সারার বয়স বাড়ছে, গর্ভধারণের সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। এই পরিস্থিতিতে সারা নিজেই একটি প্রাগম্যাটিক বা বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রাচীন মেসোপটেমীয় আইন, যেমন কোড অফ হাম্মুরাবি (Code of Hammurabi) অনুযায়ী, একজন বন্ধ্যা স্ত্রী তার স্বামীকে বৈধ উত্তরাধিকারীর জন্য নিজের দাসীকে উপপত্নী হিসেবে দিতে পারতেন। সারা তার মিশরীয় দাসী হাগার বা হাজেরাকে (Hagar) আব্রাহামের হাতে তুলে দিলেন। আব্রাহাম হাগারের সাথে মিলিত হলেন এবং হাগার গর্ভবতী হলেন। এই মুহূর্ত থেকেই আব্রাহামের তাঁবুর ভেতরে শুরু হলো এক মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। হাগার যখন বুঝতে পারলেন তিনি তার মনিব-পত্নীর চেয়ে একধাপ এগিয়ে গেছেন (কারণ তিনি মা হতে পারছেন), তখন তার আচরণের পরিবর্তন এল। বাইবেলের ভাষায়, “তিনি তার কর্ত্রীকে তুচ্ছজ্ঞান করতে লাগলেন।” অন্যদিকে, সারা তীব্র ঈর্ষা বা জেলাসি (Jealousy) এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করলেন। অবশেষে হাগারের গর্ভে জন্ম নিল আব্রাহামের প্রথম পুত্র – ইসমাইল (Ishmael)। ইসমাইল নামের অর্থ হলো ‘ঈশ্বর শুনেছেন’। আব্রাহামের বয়স তখন ছিয়াশি বছর। স্বাভাবিকভাবেই আব্রাহাম ভাবলেন, এই ইসমাইলই সেই প্রতিশ্রুত সন্তান, যার মাধ্যমে ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতি পূরণ হবে।
কিন্তু গল্পের মোড় ঘুরে গেল তেরো বছর পর। নিরানব্বই বছর বয়সে ঈশ্বর আবার আব্রাহামের সামনে আবির্ভূত হলেন এবং বললেন, “না, ইসমাইল নয়। তোমার স্ত্রী সারার গর্ভেই জন্ম নেবে তোমার মূল উত্তরাধিকারী।” এই ঘোষণাটি ছিল অবিশ্বাস্য। বৃদ্ধ আব্রাহাম হেসে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন, বাইবেলে বলা হয়েছে সারাও তাঁবুর আড়ালে দাঁড়িয়ে হেসেছিলেন। এই হাসির কারণেই শিশুটির নাম রাখা হলো আইজ্যাক বা ইসহাক (Isaac), হিব্রু ভাষায় যার অর্থ ‘সে হাসবে’ বা ‘হাসি’। অলৌকিকভাবে বৃদ্ধ বয়সে সারার গর্ভে আইজ্যাকের জন্ম হলো। এখন আব্রাহামের দুই ছেলে – একদিকে দাসী হাগারের গর্ভজাত প্রথম সন্তান ইসমাইল, অন্যদিকে স্বাধীন স্ত্রী সারার গর্ভজাত অলৌকিক সন্তান আইজ্যাক। মিথোলজিক্যাল কাঠামোতে এই দুই ভাইয়ের অবস্থান তৈরি করল এক চিরস্থায়ী দ্বন্দ্ব বা রাইভালরি (Rivalry)। আইজ্যাকের দুধ ছাড়ানোর উৎসবের দিন সারা দেখলেন ইসমাইল আইজ্যাককে নিয়ে মশকরা করছে (বা খেলছে)। সারার মাতৃত্ব এবং অধিকারবোধ জেগে উঠল। তিনি আব্রাহামকে কঠিন নির্দেশ দিলেন, “এই দাসী ও তার পুত্রকে বের করে দাও। কারণ এই দাসীর পুত্র আমার পুত্র আইজ্যাকের সাথে উত্তরাধিকারী হবে না।”
মহাবিভাজন: এক পিতা, দুই জাতি
আব্রাহামের জন্য এটি ছিল এক চরম সংকট। একদিকে তার প্রথম সন্তান ইসমাইল, যার প্রতি তার পিতার ভালোবাসা রয়েছে; অন্যদিকে তার স্ত্রী সারার দাবি এবং ঈশ্বরের পরিকল্পনা। ঈশ্বর আব্রাহামকে বললেন সারার কথা শুনতে। ফলে, এক সকালে আব্রাহাম কিছু রুটি আর এক মশক জল ইসমাইল ও হাগারের কাঁধে তুলে দিয়ে তাদের মরুভূমিতে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিলেন। এই ঘটনাটি আব্রাহামিক পরিবারের ভাঙন এবং দুটি ভিন্ন সভ্যতার উৎপত্তির ভিত্তিপ্রস্তর। হাগার ও ইসমাইল বিয়ার-শেবা বা আরবের মরুভূমিতে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। জল ফুরিয়ে গেল। তৃষ্ণায় ইসমাইল যখন মুমূর্ষু, তখন হাগার ছেলেকে এক ঝোপের নিচে রেখে দূরে গিয়ে কাঁদলেন, কারণ তিনি ছেলের মৃত্যু দেখতে পারছিলেন না। ঠিক এই মুহূর্তে ঈশ্বরের দূত এসে হাগারকে আশ্বস্ত করলেন এবং অলৌকিকভাবে একটি জলের উৎস বা কূপ সৃষ্টি করে দিলেন। ইহুদি-খ্রিস্টান ঐতিহ্যে একে বলা হয় ‘বিয়ার-লাহাই-রোই’, আর ইসলামি ঐতিহ্যে এটিই পবিত্র জমজম (Zamzam) কূপ।
নারীবাদী ধর্মতাত্ত্বিক ফিলিস ট্রিবল (Phyllis Trible) তার বিখ্যাত গ্রন্থ টেক্সট অফ টেরর (Texts of Terror)-এ হাগারের এই আখ্যানকে বাইবেলের অন্যতম করুণ এবং শক্তিশালী গল্প হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ট্রিবল দেখিয়েছেন যে, হাগারই পুরো বাইবেলে একমাত্র নারী যিনি ঈশ্বরকে একটি নাম দিয়েছেন – এল রয় (El Roi) বা ‘যে ঈশ্বর আমাকে দেখেন’। একজন নিগৃহীত, নির্বাসিত মিশরীয় দাসী ঈশ্বরের দর্শন পাচ্ছেন এবং তার সাথে কথা বলছেন – এটি মিথোলজির প্রচলিত কাঠামোর (যেখানে কেবল পুরুষরাই প্রফেসি পান) এক বিশাল ব্যতিক্রম (Trible, 1984)। হাগার ও ইসমাইল মরুভূমিতেই রয়ে গেলেন। ইসমাইল বড় হয়ে একজন দক্ষ তীরন্দাজ হলেন এবং আরবের এক নারীকে বিয়ে করলেন। ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী, আব্রাহাম পরবর্তীতে মক্কায় গিয়ে ইসমাইলকে সাথে নিয়ে কাবা ঘর পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। এই ইসমাইলের বংশধর থেকেই পরবর্তীতে জন্ম নেন ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মুহাম্মদ। অন্যদিকে, আইজ্যাক কেনান দেশে আব্রাহামের উত্তরাধিকারী হিসেবে রয়ে গেলেন, এবং তার বংশধর (যাকোব বা ইস্রায়েল) থেকেই উৎপত্তি হলো ইহুদি জাতির এবং পরবর্তীতে যিশু খ্রিস্টের। আব্রাহামিক মিথোলজির এই সন্ধিক্ষণটিই আজকের বিশ্বের ভূ-রাজনীতি এবং ধর্মীয় মানচিত্রের প্রধান কারণ।
আকিদাহ: বিশ্বাসের চূড়ান্ত পরীক্ষা
আব্রাহামের জীবনের ক্লাইম্যাক্স বা চূড়ান্ত নাটকীয় মুহূর্তটি আসে আরও পরে। ঈশ্বর আব্রাহামকে যাচাই করতে চাইলেন। তিনি বললেন, “আব্রাহাম, তোমার ছেলেকে, তোমার একমাত্র ছেলেকে, যাকে তুমি ভালোবাসো… তাকে নিয়ে মোরিয়া পাহাড়ে যাও এবং সেখানে তাকে আমার উদ্দেশ্যে কোরবানি বা বার্নট অফারিং (Burnt Offering) হিসেবে উৎসর্গ করো।” বাইবেলের জেনেসিস ২২ অধ্যায়ের এই ঘটনাটি ‘আকিদাহ’ (The Binding) নামে পরিচিত। লক্ষ্য করুন, আদেশে ‘একমাত্র ছেলে’ বলা হয়েছে, যদিও তখন আব্রাহামের দুই ছেলে ছিল। ইহুদি ও খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করেন এই ছেলেটি ছিল আইজ্যাক। অন্যদিকে, মুসলিমরা বিশ্বাস করেন এটি ছিল ইসমাইল, কারণ ইসমাইলই ছিলেন জ্যেষ্ঠ এবং আইজ্যাকের জন্মের আগে তিনিই ছিলেন ‘একমাত্র’ ছেলে। তবে নাম বা পরিচয় যা-ই হোক, মিথোলজির মূল ফোকাস হলো পিতার মানসিক অবস্থা এবং বিশ্বাসের বা ফেইথ (Faith)-এর প্রকৃতির ওপর।
আব্রাহাম কোনো তর্ক করলেন না। তিনি পরদিন ভোরে গাধার পিঠে কাঠ চাপিয়ে ছেলেকে নিয়ে রওনা দিলেন। তিন দিনের পথ। এই তিন দিন আব্রাহামের মনের ভেতর কী ঝড় বয়ে যাচ্ছিল, তা কোনো ধর্মগ্রন্থেই বিস্তারিত লেখা নেই। এই নীরবতাই এই গল্পটিকে সাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম শক্তিশালী আখ্যান বা ন্যারেটিভ (Narrative) করে তুলেছে। পাহাড়ের নিচে পৌঁছে আব্রাহাম অনুসারীদের রেখে ছেলেকে নিয়ে ওপরে উঠলেন। ছেলে বাবাকে জিজ্ঞেস করল, “বাবা, আগুন আছে, কাঠ আছে, কিন্তু কোরবানির পশু কোথায়?” আব্রাহাম শান্তভাবে উত্তর দিলেন, “ঈশ্বর নিজেই তার কোরবানির পশুর ব্যবস্থা করবেন, বাবা।” এই উত্তরে একাধারে মিথ্যা সান্ত্বনা এবং গভীর বিশ্বাস – দুটোই লুকিয়ে আছে। পাহাড়ে উঠে আব্রাহাম বেদি সাজালেন, ছেলেকে বাঁধলেন এবং ছুরি তুললেন। ঠিক সেই মুহূর্তে – যখন ছুরিটি গলার কাছে – ঈশ্বরের দূত আকাশ থেকে ডাক দিলেন, “আব্রাহাম! থামো! ছেলের গায়ে হাত দিও না। এখন আমি জানলাম তুমি ঈশ্বরকে ভয় করো, কারণ তুমি তোমার ছেলেকে আমার জন্য দিতে কুণ্ঠাবোধ করোনি।” আব্রাহাম চোখ তুলে দেখলেন ঝোপের মধ্যে একটি পুরুষ ভেড়া বা র্যাম (Ram) আটকে আছে। ছেলের বদলে সেই ভেড়াটি কোরবানি দেওয়া হলো।
কিয়ের্কেগার্ড এবং বিশ্বাসের উল্লম্ফন
ঊনবিংশ শতাব্দীর ড্যানিশ দার্শনিক সোরেন কিয়ের্কেগার্ড (Søren Kierkegaard) তার কালজয়ী বই ফিয়ার অ্যান্ড ট্রেমলিং (Fear and Trembling)-এ আব্রাহামের এই ঘটনাটি নিয়ে এক গভীর দার্শনিক বিশ্লেষণ দাঁড় করিয়েছেন। কিয়ের্কেগার্ড ছদ্মনামে (জোহানেস ডি সিলেনশিও) লিখলেন যে, আব্রাহামের এই কাজটিকে সাধারণ নৈতিকতার বা এথিক্স (Ethics)-এর মানদণ্ডে বিচার করা যায় না। সামাজিকভাবে বা নৈতিকভাবে নিজের ছেলেকে হত্যা করা একটি জঘন্য অপরাধ। কিন্তু আব্রাহাম সেই নৈতিকতাকে সাময়িকভাবে স্থগিত বা সাসপেন্ড (Suspend) করেছিলেন এক উচ্চতর উদ্দেশ্যের জন্য। কিয়ের্কেগার্ড একে বলেছেন টেলিওলজিক্যাল সাসপেনশন অফ দি ইথিক্যাল (Teleological Suspension of the Ethical)। আব্রাহাম জানতেন যে হত্যা করা পাপ, তবুও তিনি ঈশ্বরের আদেশে তা করতে যাচ্ছিলেন। এটি কোনো পাগলামি নয়, বরং এটি হলো বিশ্বাসের এক চরম অবস্থা।
কিয়ের্কেগার্ড আব্রাহামকে বলেছেন নাইট অফ ফেইথ (Knight of Faith)। একজন ট্র্যাজিক হিরো (যেমন আগামেমনন, যিনি যুদ্ধের জন্য মেয়েকে বলি দিয়েছিলেন) সমাজের মঙ্গলের জন্য নিজের আবেগকে বিসর্জন দেন, যা মানুষ বুঝতে পারে। কিন্তু আব্রাহামের কাজ কেউ বুঝবে না; মানুষ তাকে খুনি ভাববে। আব্রাহাম সম্পূর্ণ একা। এই একাকীত্ব এবং অনিশ্চয়তার মধ্যেও তিনি ঈশ্বরের ওপর যে আস্থা রেখেছিলেন, তাকে কিয়ের্কেগার্ড বলেছেন লিপ অফ ফেইথ (Leap of Faith)। যুক্তিতে যা অসম্ভব (ছেলেকে মারলে বংশধর হবে কীভাবে?), বিশ্বাসে তা সম্ভব (ঈশ্বর হয়তো ছেলেকে আবার জীবিত করবেন)। আব্রাহামের এই বিশ্বাস কোনো সরল বিশ্বাস নয়; এটি ছিল ভয় এবং কম্পনের (Fear and Trembling) মধ্য দিয়ে অর্জিত এক অস্তিত্ববাদী বা এক্সিস্টেনশিয়াল (Existential) সংকট উত্তরণের পথ (Kierkegaard, 1843)।
আব্রাহামের এই গল্পটি আমাদের শেখায় যে, আব্রাহামিক মিথোলজিতে ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য যুক্তি, আবেগ, এমনকি নৈতিকতারও ঊর্ধ্বে। আব্রাহাম তার পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করলেন যে তিনি যেকোনো কিছুর বিনিময়ে ঈশ্বরের সাথে সেই চুক্তি রক্ষা করতে প্রস্তুত। তার এই ত্যাগের কারণেই তাকে তিনটি ধর্মেরই ‘পিতা’ হিসেবে সম্মান করা হয়। কিন্তু একই সাথে, তার জীবনের ঘটনাগুলো – হাগারের নির্বাসন এবং ইসমাইল ও আইজ্যাকের বিচ্ছেদ – মানব ইতিহাসের এক দীর্ঘস্থায়ী বিভাজনের ক্ষত তৈরি করে গেছে। এক পিতার দুই সন্তান আজ হাজার বছর ধরে একে অপরের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, অথচ তাদের শেকড় সেই একই তাঁবুর নিচে, একই মরুভূমির বালুকণায় প্রোথিত। আব্রাহামিক মিথোলজির সৌন্দর্য এবং ট্র্যাজেডি ঠিক এখানেই – এটি একাধারে মিলনের এবং বিচ্ছেদের মহাকাব্য।
সোডম ও গোমোরা: পাপ, আতিথেয়তা এবং আগুনের বৃষ্টি (Sodom and Gomorrah: Sin, Hospitality, and the Rain of Fire)
আব্রাহামিক মিথোলজির মহাকাব্যিক বুননে সোডম এবং গোমোরার আখ্যান কেবল দুটি শহরের ধ্বংসের গল্প নয়; এটি ঐশ্বরিক ন্যায়বিচার, মানবিক নৈতিকতা এবং ‘অপর’-এর প্রতি আমাদের আচরণের এক চরম পরীক্ষা। জর্ডান নদীর উর্বর সমভূমিতে অবস্থিত এই শহরগুলো ছিল প্রাচুর্য ও বিলাসের কেন্দ্র, কিন্তু মিথোলজিতে তারা অমর হয়ে আছে মানুষের অধঃপতনের চূড়ান্ত প্রতীক হিসেবে। এই কাহিনীর শুরু হয় এক অলস দুপুরের দৃশ্যে, যখন আব্রাহাম তার তাঁবুর দরজায় বসে ছিলেন এবং তিনজন আগন্তুক তার কাছে এলেন। এই আগন্তুকরা সাধারণ কেউ ছিলেন না; তারা ছিলেন ঈশ্বরের দূত বা স্বয়ং ঈশ্বরেরই মানবিক রূপ। আব্রাহাম তাদের রাজকীয় আতিথেয়তা প্রদান করলেন, যা প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতিতে এক পবিত্র দায়িত্ব বা স্যাক্রেড ডিউটি (Sacred Duty) হিসেবে গণ্য হতো। খাওয়ার পরে আগন্তুকরা জানালেন যে তারা সোডম ও গোমোরার দিকে যাচ্ছেন, কারণ সেখানকার পাপের চিৎকার আকাশ পর্যন্ত পৌঁছেছে এবং ঈশ্বর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শহর দুটিকে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন। এই ঘোষণা শুনে আব্রাহাম কেবল মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন না, বরং তিনি ঈশ্বরের সাথে এক নজিরবিহীন তর্কে লিপ্ত হলেন। মিথোলজির ইতিহাসে এই প্রথম কোনো মানুষ ঈশ্বরের বিচারিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নৈতিক যুক্তি দাঁড় করাল। আব্রাহাম প্রশ্ন করলেন, “আপনি কি দুষ্টদের সাথে ধার্মিকদেরও ধ্বংস করবেন? যদি সেই শহরে পঞ্চাশ জন ধার্মিক লোক থাকে, তবুও কি আপনি তাদের খাতিরে পুরো স্থানটি ক্ষমা করবেন না?” ঈশ্বর রাজি হলেন। আব্রাহাম তখন দর কষাকষি বা বারগেইনিং (Bargaining) শুরু করলেন – পঞ্চাশ থেকে পঁয়তাল্লিশ, তারপর চল্লিশ, ত্রিশ, বিশ এবং শেষে দশ। ঈশ্বর কথা দিলেন, যদি মাত্র দশজন ভালো মানুষও পাওয়া যায়, তবে তিনি শহর ধ্বংস করবেন না। এই কথোপকথনটি ধর্মতত্ত্বের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারণা প্রতিষ্ঠা করে, যা হলো কালেক্টিভ পানিশমেন্ট (Collective Punishment) বা সমষ্টিগত শাস্তির বিরোধিতা এবং ইনডিভিজুয়াল জাস্টিস (Individual Justice) বা ব্যক্তিগত ন্যায়বিচারের দাবি। আব্রাহাম এখানে দেখাচ্ছেন, ঈশ্বরের ন্যায়বিচার অন্ধ হতে পারে না; তা অবশ্যই বাছবিচারমূলক হতে হবে।
আতিথেয়তা বনাম লাঞ্ছনা: পাপের প্রকৃত স্বরূপ
সোডম শহরের পাপ আসলে কী ছিল? হাজার বছর ধরে জনপ্রিয় সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় বয়ানে একে সমকামিতা বা হোমোসেক্সুয়ালিটি (Homosexuality)-র সাথে এক করে দেখা হয়েছে, যেখান থেকে ‘সোডমি’ শব্দটির উৎপত্তি। কিন্তু আধুনিক বাইবেল বিশারদ এবং ঐতিহাসিকরা মূল টেক্সট এবং তৎকালীন সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে ভিন্ন এক চিত্র তুলে ধরেছেন। ধর্মতত্ত্ববিদ ডেরিক শেরউইন বেইলি (Derrick Sherwin Bailey) তার যুগান্তকারী গবেষণাগ্রন্থ হোমোসেক্সুয়ালিটি অ্যান্ড দ্য ওয়েস্টার্ন ক্রিশ্চিয়ান ট্র্যাডিশন (Homosexuality and the Western Christian Tradition)-এ দেখিয়েছেন যে, সোডমের মূল অপরাধ ছিল যৌনতা নয়, বরং আতিথেয়তার লঙ্ঘন বা ইনহসপিটালিটি (Inhospitality)। প্রাচীন বিশ্বে, যেখানে মরুভূমিতে একা থাকা মানে মৃত্যু, সেখানে আগন্তুককে আশ্রয় দেওয়া ছিল টিকে থাকার অলিখিত আইন। গ্রিকরা একে বলত জেনিয়া (Xenia)। আব্রাহামের ভ্রাতুষ্পুত্র লট বা লুত (Lot), যিনি সোডমে বাস করতেন, তিনি যখন সন্ধ্যাবেলায় আগন্তুকদের (ফেরেশতাদের) দেখলেন, তিনি তাদের জোর করে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন, কারণ তিনি জানতেন রাতের সোডম কতটা বিপজ্জনক। কিন্তু রাতের অন্ধকারে শহরের পুরুষরা – আবালবৃদ্ধবনিতা – লটের বাড়ি ঘেরাও করল। তারা লতকে বলল, “তোমার কাছে যে লোকরা এসেছে, তাদের আমাদের কাছে বের করে দাও, আমরা তাদের সাথে মিলিত হবো (Know/Yada)।” হিব্রু শব্দ ‘ইয়াদিয়া’ (Yada)-র অর্থ ‘জানা’। বাইবেলে এটি যৌন মিলনের অর্থে ব্যবহৃত হয় ঠিকই, কিন্তু এর প্রাথমিক অর্থ পরিচয় জানা বা জিজ্ঞাসাবাদ করা। অনেক তাত্ত্বিক মনে করেন, সোডমবাসীরা বহিরাগতদের প্রতি ছিল জেনোফোবিক বা জেনোফোবিয়া (Xenophobia)-তে আক্রান্ত। তারা আগন্তুকদের ধর্ষণ বা লাঞ্ছিত করার মাধ্যমে তাদের আধিপত্য জাহির করতে চেয়েছিল এবং তাদের তাড়িয়ে দিতে চেয়েছিল।
পরবর্তীকালের ইহুদি নবী ইজিকিয়েল (Ezekiel) সোডমের পাপের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা যৌনতার সাথে সম্পর্কিত নয়। তিনি বলেছেন, “তোমার বোন সোডমের অপরাধ ছিল এই: সে এবং তার কন্যারা ছিল অহংকারী, তারা প্রচুর খেত এবং অলস সময় কাটাত, কিন্তু তারা গরিব ও দুঃখীদের সাহায্য করত না” (ইজিকিয়েল ১৬:৪৯)। অর্থাৎ, সোডমের পাপ ছিল সামাজিক অবিচার, ঔদ্ধত্য এবং দুর্বলের প্রতি নিষ্ঠুরতা। লটের বাড়ির সামনে যখন জনতা উন্মত্ত হয়ে উঠল, তখন লত তার অতিথিদের বাঁচাতে এক ভয়াবহ প্রস্তাব দিলেন। তিনি বললেন, “আমার দুই কুমারী মেয়ে আছে, তাদের তোমাদের কাছে দিচ্ছি, কিন্তু এই আগন্তুকদের কিছু করো না, কারণ তারা আমার ছাদের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে।” লতের এই আচরণ আধুনিক পাঠকের কাছে জঘন্য এবং অমার্জনীয় মনে হতে পারে। নারীবাদী তাত্ত্বিকরা, যেমন ফিলিস ট্রিবল (Phyllis Trible), একে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের এক চরম নিষ্ঠুরতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যেখানে নারীর সম্ভ্রম বা জীবনকে পুরুষের সম্মানের (অতিথি রক্ষা) চেয়ে তুচ্ছ মনে করা হতো। লটের কাছে তার কন্যারা ছিল বিনিময়যোগ্য পণ্য, কিন্তু অতিথি বা পুরুষ আগন্তুকরা ছিল পবিত্র আমানত। মিথোলজির এই অংশটি আমাদের সেই সময়ের কঠোর অনার-শেম কালচার বা সম্মান-লজ্জার সংস্কৃতি (Honor-Shame Culture)-র এক অন্ধকার দিক উন্মোচন করে। ফেরেশতারা লটের এই আত্মঘাতী প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন এবং অলৌকিক আলো দিয়ে আক্রমণকারী জনতাকে অন্ধ করে দিলেন। তারা লটকে জানালেন যে, শহর ধ্বংস আসন্ন, তাকে এবং তার পরিবারকে অবিলম্বে পালাতে হবে।
আগুনের বৃষ্টি এবং লবণস্তম্ভের ট্র্যাজেডি
ভোর হওয়ার সাথে সাথে ঈশ্বর আকাশ থেকে সোডম ও গোমোরার ওপর গন্ধক (সালফার) ও আগুন বর্ষণ করলেন। মিথোলজির বর্ণনায় এটি কোনো সাধারণ অগ্নিকাণ্ড নয়, এটি ছিল এক মহাজাগতিক বিপর্যয় বা কসমিক ক্যাটাস্ট্রফি (Cosmic Catastrophe)। শহরগুলো, সমভূমির সমস্ত গাছপালা এবং মানুষ নিমিষেই ভস্মীভূত হয়ে গেল। প্রত্নতাত্ত্বিক স্টিভেন কলিন্স (Steven Collins) জর্ডান উপত্যকার তাল আল-হম্মাম (Tall el-Hammam) নামক স্থানে খননকার্য চালিয়ে এমন একটি ব্রোঞ্জ যুগের শহরের ধ্বংসাবশেষ পেয়েছেন, যা প্রচণ্ড তাপে গলে কাঁচ হয়ে গিয়েছিল। কলিন্স এবং তার দল প্রস্তাব করেছেন যে, হয়তো কোনো উল্কাপাত বা কসমিক এয়ারবার্স্ট (Cosmic Airburst)-এর (যেমন – টুঙ্গুস্কা ইভেন্ট) ফলে এই ধ্বংসযজ্ঞ ঘটেছিল, যা পরবর্তীকালে মানুষের স্মৃতিতে ঐশ্বরিক শাস্তির মিথ হিসেবে গেঁথে গেছে (Collins & Scott, 2013)। লট, তার স্ত্রী এবং দুই মেয়ে ধ্বংসের ঠিক আগে পালাতে সক্ষম হন। ফেরেশতারা তাদের কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন, “জীবন বাঁচাতে পালাও, পেছনে তাকিও না।” আব্রাহামিক মিথোলজিতে ‘পেছনে তাকানো’ বা লুকিং ব্যাক (Looking Back) একটি শক্তিশালী রূপক। এটি কেবল শারীরিক তাকানো নয়; এটি হলো অতীতের প্রতি আসক্তি, যা ছেড়ে আসা হয়েছে তার প্রতি মোহ। লটের স্ত্রী (যাকে ইহুদি ঐতিহ্যে অনেক সময় ‘এডিথ’ বলা হয়) সেই নির্দেশ মানতে পারেননি। তিনি দৌড়াতে দৌড়াতে পেছনে ফিরে জ্বলন্ত শহরের দিকে তাকালেন এবং সাথে সাথে তিনি একটি লবণের স্তম্ভে বা পিলার অফ সল্ট (Pillar of Salt)-এ পরিণত হলেন।
লটের স্ত্রীর এই পরিণতি নিয়ে সাহিত্য ও দর্শনে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। রাশিয়ান কবি আনা আখমাতোভা (Anna Akhmatova) তার কবিতায় লটের স্ত্রীকে এক ট্র্যাজিক চরিত্র হিসেবে এঁকেছেন, যিনি তার ঘর, তার বাগান এবং তার স্মৃতির মায়ায় পেছনে তাকিয়েছিলেন। আখমাতোভা তাকে অবাধ্য হিসেবে নয়, বরং একজন মানুষ হিসেবে দেখেছেন, যে তার অতীতকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে পারেনি। মিথোলজিক্যাল দৃষ্টিতে, লটের স্ত্রী হলেন সেই ব্যক্তি যিনি পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হন, যিনি ভবিষ্যতের দিকে না তাকিয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত অতীতের দিকে তাকিয়ে থাকেন এবং ফলে তিনি নিজেই স্থবির হয়ে যান। যিশু খ্রিস্টও লটের স্ত্রীর কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, “লটের স্ত্রীকে স্মরণ করো” – যার অর্থ হলো, যখন চূড়ান্ত সময় আসবে, তখন পার্থিব কোনো কিছুর মায়ায় আটকে থেকো না। লত এবং তার কন্যারা সোয়ার নামক একটি ছোট শহরে আশ্রয় নিলেন, কিন্তু ভয়ে সেখানে না থেকে পাহাড়ে গিয়ে একটি গুহায় বসবাস শুরু করলেন।
গুহার অন্ধকার এবং জাতির উৎপত্তি
সোডম ও গোমোরার আখ্যানের শেষ অধ্যায়টি আরও বেশি বিতর্কিত এবং অস্বস্তিকর। গুহায় আশ্রয় নেওয়া লতের দুই কন্যা মনে করলেন, পুরো পৃথিবী আগুনে ধ্বংস হয়ে গেছে এবং মানবজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে (ঠিক নূহের প্লাবনের মতো)। তারা ভাবলেন, বংশরক্ষা করার জন্য পৃথিবীতে আর কোনো পুরুষ অবশিষ্ট নেই, কেবল তাদের বৃদ্ধ পিতা ছাড়া। তাই তারা এক পরিকল্পনা করলেন। তারা দুই রাতে লটকে মদ খাইয়ে মাতাল করলেন এবং তার সাথে মিলিত হলেন। লট এতটাই মাতাল ছিলেন যে তিনি কিছুই টের পেলেন না। এই অজাচার বা ইনসেস্ট (Incest)-এর ফলে বড় মেয়ের গর্ভে জন্ম নিল মোয়াব (Moab) এবং ছোট মেয়ের গর্ভে জন্ম নিল বেন-আম্মি (Ben-Ammi)। এই মোয়াব থেকেই মোয়াবীয় জাতি এবং বেন-আম্মি থেকে আম্মোনীয় জাতির উৎপত্তি। বাইবেল বিশারদ জেমস কুগেল (James Kugel) তার বই হাউ টু রিড দ্য বাইবেল (How to Read the Bible)-এ ব্যাখ্যা করেছেন যে, এই গল্পটি আসলে একটি এটিওলজিক্যাল মিথ (Etiological Myth) বা উৎপত্তি সংক্রান্ত মিথ, যা ইস্রায়েলীয়রা তাদের প্রতিবেশী ও চিরশত্রু মোয়াবীয় এবং আম্মোনীয়দের হেয় করার জন্য তৈরি করেছিল। এই গল্পের মাধ্যমে ইস্রায়েলীয়রা বলতে চেয়েছিল, “দেখো, আমাদের শত্রুরা কত জঘন্য সম্পর্কের ফসল।” এটি ছিল প্রাচীনকালের এক ধরণের রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা বা পলিটিক্যাল স্যাটায়ার (Political Satire)।
সোডম ও গোমোরার এই পুরো আখ্যানটি আব্রাহামিক মিথোলজিতে ঈশ্বরের ক্রোধ এবং করুণার এক জটিল সমীকরণ উপস্থাপন করে। একদিকে আমরা দেখি আব্রাহামের সেই সাহসী দর কষাকষি, যা প্রমাণ করে ঈশ্বর ন্যায়বিচারক; অন্যদিকে আমরা দেখি লটের স্ত্রীর করুণ পরিণতি এবং দুটি শহরের সম্পূর্ণ বিনাশ। এই গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সমাজের ভিত্তি যদি অবিচার এবং নিষ্ঠুরতার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, তবে তা যত সমৃদ্ধশালীই হোক না কেন, তার পতন অনিবার্য। সোডমের আগুন কেবল পাপীদের পুড়িয়ে মারেনি, তা ভবিষ্যতের মানুষের জন্য এক চিরস্থায়ী সতর্কবার্তা বা মনুমেন্ট (Monument) হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কুরআনেও এই ঘটনাকে লট বা লুত নবীর কওমের ধ্বংস হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং একে ‘পথিকদের জন্য চিহ্ন’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মৃত সাগর বা ডেড সি-এর লোনা জল এবং এর আশেপাশের ঊষর প্রান্তর আজও সেই প্রাচীন ধ্বংসযজ্ঞের নীরব সাক্ষী হয়ে আছে, যেখানে মিথোলজি এবং ভূগোল একাকার হয়ে গেছে।
মোজেস এবং এক্সোডাস: দাসত্ব থেকে মুক্তি ও আইনের পত্তন
আব্রাহামিক মিথোলজির মহাকাব্যিক যাত্রাপথে জেনেসিস বা আদিপুস্তক ছিল মূলত একটি পরিবারের গল্প – আব্রাহাম, আইজ্যাক এবং যাকোবের পারিবারিক ড্রামা। কিন্তু এক্সোডাস বা যাত্রাপুস্তক-এ এসে গল্পের ক্যানভাস হঠাৎ করেই বিশাল হয়ে যায়। এটি আর কোনো ব্যক্তি বা পরিবারের গল্প থাকে না, এটি হয়ে ওঠে একটি জাতির জন্ম-ইতিহাস এবং দাসত্ব থেকে মুক্তির এক চিরকালীন দলিল। জোসেফ বা ইউসুফের সময় ইস্রায়েলীয়রা মিশরে গিয়েছিল রাজকীয় অতিথি হিসেবে, কিন্তু সময়ের চাকা ঘুরল নির্মমভাবে। মিশরের সিংহাসনে বসলেন এক নতুন ফারাও, যিনি “জোসেফকে চিনতেন না।” রাজনৈতিক সমীকরণের পরিবর্তন এবং জনমিতিক ভয়ের কারণে হিব্রু বা ইস্রায়েলীয়রা পরিণত হলো রাষ্ট্রীয় দাসে। তাদের জীবন হয়ে উঠল দুর্বিষহ – পিরামিড বা ইমারত তৈরির জন্য ইট ভাটার ধোঁয়ায় এবং চাবুকের আঘাতে তাদের আর্তনাদ আকাশ বাতাস ভারী করে তুলল। মিথোলজির এই পর্যায়ে আমরা পরিচিত হই এমন এক বাস্তবতার সাথে, যাকে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় প্রাতিষ্ঠানিক দাসত্ব (Institutional Slavery)। মিশরের এই সময়কালটিকে ইহুদি স্মৃতিতে ‘লোহার হাপর’ বা আয়ন ফার্নেস (Iron Furnace) হিসেবে অভিহিত করা হয়, যেখানে পুড়ে পুড়ে একটি জাতি ইস্পাতের মতো শক্ত হয়ে উঠেছিল। ঠিক এই চরম হাহাকারের মাঝেই মঞ্চে প্রবেশ করেন আব্রাহামিক ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী এবং জটিল চরিত্র – মোজেস বা মুসা (Moses)। তাকে কেবল একজন নবী বললে কম বলা হবে; তিনি ছিলেন একাধারে বিদ্রোহী নেতা, আইনপ্রণেতা এবং ঈশ্বরের মুখোমুখি হওয়া এক নিঃসঙ্গ মানুষ।
নীল নদের কান্না এবং নায়কের জন্মবৃত্তান্ত
মোজেসের জন্মের সময়টা ছিল ভয়াবহ। ফারাও এক নিষ্ঠুর ফরমান জারি করলেন – হিব্রু পরিবারে জন্ম নেওয়া প্রতিটি পুত্র সন্তানকে নীল নদে ফেলে হত্যা করতে হবে। এটি ছিল একটি পরিকল্পিত গণহত্যা (Genocide), যার উদ্দেশ্য ছিল একটি জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অঙ্কুরেই বিনাশ করা। এই মৃত্যু উপত্যকায় মোজেসের জন্ম। তার মা জোকাবেদ তাকে তিন মাস লুকিয়ে রাখলেন, কিন্তু যখন আর সম্ভব হলো না, তখন তিনি এক অদ্ভুত কাজ করলেন। প্যাপিরাস নলখাগড়া দিয়ে একটি ঝুড়ি বা ছোট নৌকা বানালেন, তাতে আলকাতরা মাখিয়ে জলনিরোধক করলেন এবং শিশুটিকে শুইয়ে নীল নদে ভাসিয়ে দিলেন। মিথোলজিক্যাল দৃষ্টিকোণ থেকে এই ‘ঝুড়ি’ বা আর্ক (Ark) শব্দটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। নূহ যেমন নৌকার মাধ্যমে মানবজাতিকে বাঁচিয়েছিলেন, এখানেও সেই একই শব্দ ব্যবহার করে মোজেসকে বাঁচানো হলো। নদীর স্রোতে ভাসতে ভাসতে শিশুটি গিয়ে পৌঁছাল ফারাওয়ের প্রাসাদের ঘাটে। ফারাওয়ের মেয়ে তাকে তুলে নিলেন এবং তার নাম রাখলেন ‘মোজেস’। হিব্রু ভাষায় মোজেস নামের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ‘জল থেকে তোলা’, কিন্তু প্রাচীন মিশরীয় ভাষায় ‘মোস’ বা ‘মেস’ শব্দের অর্থ ‘সন্তান’ বা ‘পুত্র’ (যেমন – থুতমোস, রামিসেস)। এই নামকরণের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মোজেসের দ্বৈত সত্তা (Dual Identity)। তিনি হিব্রু রক্ত বহন করছেন, কিন্তু বড় হচ্ছেন মিশরীয় রাজপ্রাসাদের ঐশ্বর্য ও শিক্ষার মধ্যে।
মোজেসের এই জন্মকাহিনীর সাথে প্রাচীন মেসোপটেমীয় মিথোলজির এক বিস্ময়কর মিল পাওয়া যায়। আক্কাদীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সারগন অফ আক্কাদ (Sargon of Akkad)-এর জন্মবৃত্তান্তেও দেখা যায় যে, তার মা তাকে একটি ঝুড়িতে করে ইউফ্রেটিস নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন এবং এক মালী তাকে উদ্ধার করে বড় করেছিলেন। অস্ট্রিয়ান মনোবিজ্ঞানী অটো র্যাঙ্ক (Otto Rank) তার বিখ্যাত বই The Myth of the Birth of the Hero-তে দেখিয়েছেন যে, পৃথিবীর প্রায় সব বড় মিথোলজিতেই নায়কের জন্ম হয় এক প্রতিকূল পরিবেশে, তাকে পরিত্যক্ত হতে হয় এবং পরে রাজকীয় বা অলৌকিক উপায়ে সে ফিরে আসে। র্যাঙ্কের মতে, এই এক্সপোজার মিথ (Exposure Myth) আসলে মানুষের অবচেতনে পিতামাতার প্রতি বিদ্রোহ এবং নিজের ভাগ্য নিজে গড়ার আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। মোজেস রাজপ্রাসাদে বড় হলেন ঠিকই, কিন্তু তার বুকের ভেতর হিব্রু সত্তাটি সুপ্ত ছিল। একদিন তিনি দেখলেন এক মিশরীয় প্রহরী এক হিব্রু দাসকে নির্মমভাবে প্রহার করছে। মুহূর্তের ক্রোধে মোজেস সেই প্রহরীকে হত্যা করে বালির নিচে লুকিয়ে ফেললেন। এই একটি ঘটনা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। তিনি আর রাজপুত্র রইলেন না, হয়ে গেলেন ফেরারী আসামী। তিনি পালিয়ে গেলেন সিনাই উপদ্বীপের বা সিনাই মরুভূমির রুক্ষ প্রান্তর মিডিয়ানে। রাজপ্রাসাদ থেকে একেবারে মেষপালক – নায়কের যাত্রাপথে এই পতন বা ডিসেন্ট (Descent) অপরিহার্য, কারণ এখান থেকেই তার আধ্যাত্মিক পুনর্জন্ম হবে।
জ্বলন্ত ঝোপ এবং অস্তিত্বের ঘোষণা
মিডিয়ানে দীর্ঘকাল নির্বাসনে থাকার পর, মোজেস যখন হোরেব পাহাড়ের (সিনাই পর্বত) কাছে মেষ চড়াচ্ছিলেন, তখন তিনি এক অতিপ্রাকৃত দৃশ্য দেখলেন। একটি ঝোপের মধ্যে আগুন জ্বলছে, কিন্তু ঝোপটি পুড়ে ছাই হচ্ছে না। একে বলা হয় থিওফ্যানি (Theophany) বা ঈশ্বরের চাক্ষুষ প্রকাশ। আগুনের ভেতর থেকে একটি কন্ঠস্বর ভেসে এল, “মোজেস! তোমার পায়ের জুতা খুলে ফেলো, কারণ তুমি যে মাটিতে দাঁড়িয়ে আছো তা পবিত্র ভূমি।” এখানে ঈশ্বর মোজেসকে দায়িত্ব দিলেন মিশরে ফিরে গিয়ে তার জনগণকে মুক্ত করার। কিন্তু মোজেস ছিলেন দ্বিধান্বিত। তিনি তোতলামি বা জড়তার অজুহাত দেখালেন এবং প্রশ্ন করলেন, “মানুষ যদি জিজ্ঞেস করে কে আমাকে পাঠিয়েছে, আমি কী নাম বলব?” এর উত্তরে ঈশ্বর যা বললেন, তা ধর্মতত্ত্ব এবং দর্শনের ইতিহাসে এক বিপ্লব। ঈশ্বর বললেন, “আমি যে আমি” বা “আই এম হু আই এম” (I AM WHO I AM)। হিব্রু ভাষায় এটি হলো ‘এহিয়েহ আশের এহিয়েহ’ (Ehyeh asher Ehyeh)। এখান থেকেই ঈশ্বরের পবিত্র নাম ‘YHWH’ বা টেট্রাগ্রামাটন (Tetragrammaton)-এর উৎপত্তি।
জার্মান দার্শনিক মার্টিন বুবার (Martin Buber) তার Moses: The Revelation and the Covenant বইয়ে ব্যাখ্যা করেছেন যে, এই নামকরণের মাধ্যমে ঈশ্বর নিজেকে আর দশটা সাধারণ দেবতার মতো কোনো নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক শক্তি (যেমন সূর্য বা ঝড়) হিসেবে পরিচয় দেননি। বরং তিনি নিজেকে প্রকাশ করলেন এক শাশ্বত অস্তিত্ব বা অনটোলজিক্যাল রিয়েলিটি (Ontological Reality) হিসেবে। তিনি কোনো ‘বস্তু’ নন, তিনি হলেন ‘হওয়া’ বা ‘বিইং’ (Being) নিজেই। মোজেসের এই অভিজ্ঞতা কেবল একজন নবীর অভিজ্ঞতা নয়, এটি মানুষের চেতনার এক উল্লম্ফন – যেখানে মানুষ সসীম হয়েও অসীমের সাথে কথোপকথন চালায়। এই জ্বলন্ত ঝোপের ঘটনাটি মোজেসকে রূপান্তরিত করল। তিনি আর সেই পলাতক খুনি নন, তিনি এখন ঈশ্বরের প্রতিনিধি। তার হাতে দেওয়া হলো একটি লাঠি, যা কেবল মেষ চড়ানোর লাঠি নয়, বরং ঈশ্বরের ক্ষমতার প্রতীক বা স্টাফ অফ গড (Staff of God)।
দশটি আঘাত: কসমিক যুদ্ধ এবং পলিথিজমের বিনির্মাণ
মোজেস মিশরে ফিরে এলেন এবং তার ভাই অ্যারন বা হারুনকে সাথে নিয়ে ফারাওয়ের দরবারে দাঁড়িয়ে বললেন সেই ঐতিহাসিক বাক্য – “আমার জনগণকে যেতে দাও” (Let my people go)। কিন্তু ফারাও, যিনি নিজেকেই ঈশ্বর মনে করতেন, তিনি সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করলেন। শুরু হলো এক মহাজাগতিক দ্বন্দ্ব। মিথোলজির পাঠক হিসেবে আমাদের বুঝতে হবে, এটি কেবল মোজেস বনাম ফারাওয়ের লড়াই নয়; এটি ছিল আব্রাহামিক ঈশ্বর ইয়াহওয়ে বনাম মিশরীয় প্যানথিয়ন বা দেবমন্ডলীর লড়াই। একে তাত্ত্বিক ভাষায় বলা হয় থিওম্যাকি (Theomachy) বা দেবতাদের যুদ্ধ। ঈশ্বর মিশরের ওপর একে একে দশটি মহামারী বা প্লেগ (Plagues) নামিয়ে আনলেন। গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতিটি প্লেগ আসলে মিশরের এক-একজন নির্দিষ্ট দেবতাকে চ্যালেঞ্জ বা অপমান করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল।
প্রথম আঘাতে নীল নদের জল রক্ত হয়ে গেল। নীল নদ ছিল মিশরীয়দের কাছে দেবতা ‘হাপি’ (Hapi)-র প্রতীক এবং জীবনের উৎস। সেই নদের রক্তস্রোত প্রমাণ করল যে হাপি পরাজিত। এরপর এল ব্যাঙের উৎপাত। মিশরে ‘হেকুৎ’ (Heqet) নামে এক দেবী ছিলেন যার মাথা ব্যাঙের মতো, যিনি উর্বরতার প্রতীক। অগণিত ব্যাঙের মৃত্যু এবং পচাগলা দেহ সেই দেবীর অক্ষমতাকে প্রকট করল। যখন আকাশ অন্ধকার হয়ে গেল (নবম আঘাত), তখন তা ছিল মিশরের প্রধান সূর্যদেবতা ‘রা’ (Ra)-এর বিরুদ্ধে সরাসরি আঘাত। আর সর্বশেষ এবং সবচেয়ে ভয়াবহ আঘাত – মিশরের প্রতিটি প্রথমজাত সন্তানের মৃত্যু – ছিল স্বয়ং ফারাওয়ের দেবত্বের ওপর চরম আঘাত, কারণ ফারাওয়ের পুত্রও ছিল ভবিষ্যৎ দেবতা। আব্রাহামিক মিথোলজি এখানে পলিথিজম (Polytheism) বা বহুদেববাদকে পদ্ধতিগতভাবে বিনির্মাণ বা ডিকনস্ট্রাকশন (Deconstruction) করছে। এই দশটি আঘাতের মাধ্যমে প্রমাণ করা হলো যে, প্রকৃতির প্রতিটি শক্তির ওপর আলাদা আলাদা কোনো দেবতা নেই, বরং একজনই সর্বশক্তিমান ঈশ্বর আছেন যিনি প্রকৃতির নিয়মকে ইচ্ছেমতো পরিবর্তন করতে পারেন।
লোহিত সাগর এবং জাতীয়তাবাদের জন্ম
অবশেষে ফারাও নতি স্বীকার করলেন এবং ইস্রায়েলীয়রা মিশর ত্যাগ করল। এই যাত্রার নামই এক্সোডাস (Exodus) বা নির্গমন। কিন্তু ফারাও মত পাল্টে তাদের ধাওয়া করলেন। সামনে লোহিত সাগর বা রেড সি (Red Sea), পেছনে মিশরের বিশাল রথবাহিনী। এই চরম সংকটময় মুহূর্তে মোজেস তার লাঠি উঁচিয়ে ধরলেন এবং সমুদ্র দুভাগ হয়ে গেল। জলের দেয়ালের মাঝখান দিয়ে শুকনো পথে লাখ লাখ মানুষ পার হয়ে গেল। ফারাওয়ের বাহিনী যখন নামল, জল আবার এক হয়ে তাদের গ্রাস করল। এই ঘটনাটি আব্রাহামিক স্মৃতির সবচেয়ে শক্তিশালী এবং আইকনিক দৃশ্য। সিগমুন্ড ফ্রয়েড (Sigmund Freud) তার জীবনের শেষ বই Moses and Monotheism-এ এই ঘটনা এবং মোজেসের চরিত্র নিয়ে এক বিতর্কিত কিন্তু গভীর বিশ্লেষণ দাঁড় করিয়েছেন। ফ্রয়েড দাবি করেছিলেন যে মোজেস সম্ভবত একজন মিশরীয় ছিলেন এবং তিনি ফারাও আখেনাতেনের (Akhenaten) একেশ্বরবাদী সূর্যপূজার ধারণাটিই হিব্রুদের মধ্যে প্রবর্তন করেছিলেন। যদিও ঐতিহাসিকরা ফ্রয়েডের সব কথা মানেন না, কিন্তু ফ্রয়েড একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন – তা হলো ট্রমা এবং স্মৃতি (Trauma and Memory)। লোহিত সাগর পার হওয়ার এই ঘটনাটি একটি জাতির জন্মের স্মারক। এটি যেন এক বিশাল ব্যাপটিজম (Baptism) বা অবগাহন, যার মাধ্যমে একটি দাস জাতি সমুদ্রের জরায়ু থেকে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে পুনর্জন্ম লাভ করল।
সিনাই পর্বত এবং আইনের শাসন
সমুদ্র পার হওয়ার পর ইস্রায়েলীয়রা সিনাই মরুভূমিতে পৌঁছাল। এখানে মোজেস পাহাড়ে উঠলেন এবং ঈশ্বরের কাছ থেকে দুটি পাথরের ফলকে খোদাই করা দশটি আজ্ঞা বা টেন কমান্ডমেন্টস (Ten Commandments) বা ‘ডেকালগ’ নিয়ে এলেন। আব্রাহামিক মিথোলজিতে এটি একটি বিশাল প্যারাডাইম শিফট। এর আগে ঈশ্বর এবং মানুষের সম্পর্ক ছিল ব্যক্তিগত প্রতিশ্রুতির ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু সিনাই পর্বতে যা হলো, তা হলো একটি সামাজিক চুক্তি (Social Contract) বা কোভেন্যান্ট। এই আইনগুলো কেবল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; এতে বলা হলো – “হত্যা করো না”, “চুরি করো না”, “মিথ্যা সাক্ষ্য দিও না”, “প্রতিবেশীর সম্পদে লোভ করো না”। প্রাচীন বিশ্বে, যেমন হাম্মুরাবির আইন সংহিতা বা Code of Hammurabi-তে আইন ছিল রাজার তৈরি এবং তা ছিল শ্রেণিভেদে ভিন্ন। কিন্তু মোজেসের আইনে নৈতিকতা এবং ধর্মকে একীভূত করা হলো। একে বলা হয় নৈতিক একেশ্বরবাদ (Ethical Monotheism)। এখানে ঈশ্বর কেবল পূজা চান না, তিনি চান মানুষ যেন একে অপরের প্রতি ন্যায়পরায়ণ হয়। ঈশ্বরকে খুশি করার পথ হলো মানুষের প্রতি সুবিচার করা। এটি পশ্চিমা সভ্যতা এবং আইনের শাসনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে।
তবে পাহাড়ের নিচে তখন অন্য নাটক চলছে। মোজেসের ফিরতে দেরি দেখে অধৈর্য জনতা তাদের পুরনো অভ্যাসে ফিরে গেল। তারা সোনা গলিয়ে একটি বাছুর বা গোল্ডেন কাফ (Golden Calf) তৈরি করে তার পূজা শুরু করল। এই ঘটনাটি মানুষের দাস মানসিকতা (Slave Mentality)-র পরিচায়ক। তারা শারীরিকভবে মুক্ত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মানসিকভাবে তারা এখনো মিশরের মূর্তিপূজার দাসত্বে আবদ্ধ। মোজেস নিচে নেমে রাগে পাথরের ফলক ভেঙে ফেললেন। এই ভাঙা এবং গড়া, বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসের দোলাচল আব্রাহামিক ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
মরুভূমির বিচরণ এবং মোজেসের ট্র্যাজেডি
পাপের শাস্তিস্বরূপ এবং দাসত্বের মানসিকতা ঝেড়ে ফেলার জন্য ইস্রায়েলীয়দের চল্লিশ বছর ধরে মরুভূমিতে ঘুরে বেড়াতে হলো। উদ্দেশ্য ছিল, মিশরে জন্ম নেওয়া দাস প্রজন্মটি যেন মরুভূমিতেই শেষ হয়ে যায় এবং সম্পূর্ণ স্বাধীন একটি নতুন প্রজন্ম যেন প্রতিশ্রুত ভূমিতে প্রবেশ করতে পারে। এই দীর্ঘ যাত্রায় মোজেস ছিলেন তাদের একচ্ছত্র নেতা, বিচারক এবং মধ্যস্থতাকারী। কিন্তু মিথোলজির সবচেয়ে করুণ এবং ট্র্যাজিক দৃশ্যটি অপেক্ষা করছিল একদম শেষে। যে মোজেস তার সারাটা জীবন উৎসর্গ করলেন তার জাতিকে প্রতিশ্রুত দেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য, ঈশ্বর তাকেই সেই দেশে প্রবেশের অনুমতি দিলেন না। মেরিবা নামক স্থানে ঈশ্বরের নির্দেশের সামান্য বিচ্যুতির কারণে মোজেসকে বলা হলো, “তুমি দূর থেকে সেই দেশ দেখবে, কিন্তু প্রবেশ করতে পারবে না।”
নেবো পর্বতের (Mount Nebo) চূড়ায় দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ মোজেস জর্ডান নদীর ওপারে কানান দেশের সবুজ উপত্যকা দেখলেন। তার চোখের সামনে তার স্বপ্নের দেশ, কিন্তু তার পা সেখানে পড়বে না। মোজেসের এই মৃত্যু এক গভীর দার্শনিক বার্তা বহন করে। এটি আমাদের শেখায় যে, একজন নেতার কাজ গন্তব্যে পৌঁছানো নয়, বরং পথ দেখানো। মোজেস হলেন সেই ট্র্যাজিক হিরো, যিনি পূর্ণতা বা ফুলফিলমেন্ট (Fulfillment)-এর দ্বারপ্রান্তে এসেও অতৃপ্ত থেকে যান। বাইবেলের পঞ্চম বই ডিউটারোনমি বা দ্বিতীয় বিবরণ-এর শেষে বলা হয়েছে, “মোজেসের মতো আর কোনো নবী ইস্রায়েলের বুকে ওঠেননি, যার সাথে ঈশ্বর মুখোমুখি কথা বলতেন।” মোজেসের কবর কোথায় কেউ জানে না, পাছে মানুষ তাকেই পূজা শুরু করে দেয়। তিনি ইতিহাসে মিশে গেলেন এক বিশাল ছায়া হয়ে, রেখে গেলেন এক আইন এবং এক জাতির স্বপ্ন।
রাজা, নবী এবং মসিহ-এর ধারণা: গৌরব, পতন এবং অনন্ত প্রতীক্ষা
মোজেস বা মুসার মৃত্যুর পর ইস্রায়েলীয় জাতির ইতিহাসে এক দীর্ঘ রাজনৈতিক এবং আধ্যাত্মিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। জশুয়া বা ইউশা তাদের কানান দেশে নিয়ে গেলেন বটে, কিন্তু সেখানে কোনো কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা ছিল না। এই সময়কালকে বলা হয় বিচারকদের যুগ (Era of Judges)। এটি ছিল এক অরাজক সময়, বাইবেলের ভাষায় – “সে সময় ইস্রায়েলে কোনো রাজা ছিল না; যার যা ইচ্ছা, সে তাই করত।” এই বিশৃঙ্খলার মধ্যেই মানুষের মনে এক নতুন আকাঙ্ক্ষা জন্ম নিল। তারা চাইল, আশেপাশের অন্য জাতিদের মতো তাদেরও একজন রাজা থাকবে, যে তাদের যুদ্ধে নেতৃত্ব দেবে। কিন্তু আব্রাহামিক মিথোলজির মূল স্পিরিট বা দর্শনের সাথে এটি ছিল সাংঘর্ষিক। কারণ, ইস্রায়েল হলো একটি থিওক্রেসি (Theocracy) বা ধর্মরাষ্ট্র, যেখানে একমাত্র রাজা হলেন স্বয়ং ঈশ্বর (YHWH)। মানুষের ওপর মানুষের রাজত্ব করার ধারণাটি ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের প্রতি এক ধরণের অবিশ্বাস। তবুও, নবী স্যামুয়েল অনিচ্ছাসত্ত্বেও জনগণের দাবিতে সাউলকে (Saul) প্রথম রাজা হিসেবে অভিষেক করলেন। সাউল ছিলেন দীর্ঘদেহী ও সুদর্শন, কিন্তু মানসিকভাবে ছিলেন অস্থির এবং ট্র্যাজিক। তার পতন ছিল অনিবার্য, কারণ মিথোলজি আমাদের শেখায় যে, কেবল শারীরিক শক্তি দিয়ে ঈশ্বরের রাজ্য শাসন করা যায় না; এর জন্য প্রয়োজন হৃদয়ের শুদ্ধতা। সাউলের ব্যর্থতা মঞ্চ প্রস্তুত করে দিল আব্রাহামিক ইতিহাসের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য, রোমান্টিক এবং জটিল চরিত্রটির জন্য – ডেভিড বা দাউদ (David)।
ডেভিড: মেষপালক থেকে রাজা এবং পাপী থেকে সাধক
ডেভিডের চরিত্রটি আব্রাহামিক সাহিত্যে এক অনন্য প্যারাডক্স বা বৈপরীত্যের সমাহার। তিনি একাধারে কোমল হৃদয়ের কবি ও সুরকার, যিনি সামসঙ্গীত বা সামস (Psalms) বা যবুর কিতাব রচনা করেন; আবার অন্যদিকে তিনি এক দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, যার হাত রক্তে রঞ্জিত। বেথলেহেমের এক সাধারণ মেষপালক কিশোর হিসেবে তার উত্থান শুরু হয় গোলিয়াথ নামের এক দৈত্যাকার মানবকে স্লিংশট বা গুলতি দিয়ে হত্যা করার মাধ্যমে। এই আন্ডারডগ আর্কিটাইপ (Underdog Archetype) – যেখানে দুর্বল সবলকে পরাজিত করে – পরবর্তীতে পশ্চিমা সাহিত্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। রাজা হওয়ার পর ডেভিড জেরুজালেম দখল করেন এবং একে রাজ্যের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ঈশ্বরের জন্য একটি স্থায়ী ঘর বা মন্দির বানাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ঈশ্বর নাথান নবীর মাধ্যমে জানালেন, “ডেভিড, তুমি অনেক রক্ত ঝরিয়েছ, তাই তুমি আমার মন্দির বানাবে না। কিন্তু আমি তোমার সাথে এক নতুন চুক্তি বা ডেভিডিক কোভেন্যান্ট (Davidic Covenant) করব। তোমার বংশধররাই চিরকাল সিংহাসনে থাকবে।” এই প্রতিশ্রুতিটিই হলো মসিহ (Messiah) ধারণার বীজ। এখান থেকেই বিশ্বাস করা শুরু হয় যে, ঈশ্বরের মনোনীত ত্রাণকর্তা অবশ্যই ‘হাউস অফ ডেভিড’ বা ডেভিডের বংশ থেকেই আসবেন।
তবে ডেভিডের জীবনের সবচেয়ে নাটকীয় এবং মানবিক অংশটি হলো বাথশেবার (Bathsheba) সাথে তার অবৈধ সম্পর্ক। ডেভিড তার এক বিশ্বস্ত সেনাপতি ইউরিয়ার স্ত্রী বাথশেবাকে দেখে কামাসক্ত হন এবং তাকে গর্ভবতী করেন। পরে নিজের পাপ ঢাকতে তিনি ইউরিয়াকে যুদ্ধের ফ্রন্টলাইনে পাঠিয়ে কৌশলে হত্যা করান। একজন ‘ঈশ্বরের মনোনীত’ রাজা এমন জঘন্য কাজ করতে পারেন – এটি মিথোলজির এক সাহসি স্বীকারোক্তি। বিখ্যাত সাহিত্য সমালোচক এবং বাইবেল বিশারদ রবার্ট অল্টার (Robert Alter) তার বই The Art of Biblical Narrative-এ বিশ্লেষণ করেছেন যে, বাইবেল তার নায়কদের কখনো নিখুঁত বা ‘হোয়াইটওয়াশড’ করে দেখায় না। ডেভিডের এই স্খলন প্রমাণ করে যে, আব্রাহামিক মিথোলজিতে মানুষ যতই উঁচুতে উঠুক, তার মানবীয় প্রবৃত্তি (Human Nature) এবং পাপের সম্ভাবনা সবসময়ই থেকে যায়। ডেভিড তার পাপের জন্য অনুতপ্ত হয়েছিলেন এবং ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করেছিলেন, কিন্তু তার কৃতকর্মের ফলস্বরূপ তার নিজের পরিবারেই রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ ও বিপর্যয় নেমে এসেছিল।
সলোমন এবং প্রথম মন্দির: প্রজ্ঞার চূড়া ও ফাটল
ডেভিডের পর সিংহাসনে বসলেন তার পুত্র সলোমন বা সুলাইমান (Solomon)। তার রাজত্বকালকে ধরা হয় ইস্রায়েলীয় ইতিহাসের স্বর্ণযুগ বা গোল্ডেন এজ (Golden Age)। সলোমন কোনো যুদ্ধ করেননি, তিনি ছিলেন কূটনীতি এবং বাণিজ্যের জাদুকর। তবে মিথোলজিতে তিনি অমর হয়ে আছেন তার প্রজ্ঞা বা উইজডম (Wisdom)-এর জন্য। ঈশ্বর যখন তাকে স্বপ্নে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তুমি কী চাও?”, সলোমন ধনসম্পদ না চেয়ে ‘বিচার করার মতো জ্ঞানী হৃদয়’ চেয়েছিলেন। সলোমনের সবচেয়ে বড় কীর্তি হলো জেরুজালেমে ‘ফার্স্ট টেম্পল’ বা প্রথম মন্দির নির্মাণ। এটি কেবল একটি উপাসনালয় ছিল না; ধর্মতত্ত্ববিদদের মতে, এটি ছিল অ্যাক্সিস মান্ডি (Axis Mundi) বা মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে স্বর্গ এবং মর্ত্য মিলিত হয়েছে। মন্দিরের ভেতরে ‘হোলি অফ হোলিস’ বা মহাপবিত্র স্থানে রাখা হলো সেই আর্ক অফ দ্য কোভেন্যান্ট (Ark of the Covenant), যার ভেতরে ছিল মোজেসের পাওয়া দশ আজ্ঞার পাথর। ঈশ্বর যেন এতদিন পর যাযাবর জীবন শেষ করে একটি স্থায়ী ঠিকানায় বসলেন।
কিন্তু সলোমনের গল্পের শেষটা সুখকর নয়। মিথোলজি দেখায়, অত্যধিক ক্ষমতা এবং ঐশ্বর্য মানুষকে অন্ধ করে দেয়। রাজনৈতিক মৈত্রী বা এলায়েন্সের প্রয়োজনে সলোমন শত শত ভিনদেশি নারীকে বিয়ে করেছিলেন। এই স্ত্রীদের সন্তুষ্ট করতে তিনি জেরুজালেমের বুকে ভিনদেশি দেবতাদের মূর্তিপূজার অনুমতি দিলেন। যে প্রজ্ঞা তাকে উপরে তুলেছিল, সেই প্রজ্ঞাই যেন তার পতনের কারণ হলো। সমাজতাত্ত্বিক ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber) তার Ancient Judaism বইয়ে একে বর্ণনা করেছেন কারিশম্যাটিক অথরিটি (Charismatic Authority)-র রুটিনাইজেশন বা গতানুগতিকতায় রূপান্তর হিসেবে, যেখানে প্রাথমিক ধর্মীয় আবেগ হারিয়ে গিয়ে আমলাতান্ত্রিক এবং ভোগবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি হয়। সলোমনের মৃত্যুর পর তার রাজ্যের ওপর চাপানো বিশাল করের বোঝা এবং বাধ্যতামূলক শ্রমের কারণে বিদ্রোহ দেখা দিল। এক অখণ্ড রাজ্য ভেঙে দুই টুকরো হয়ে গেল – উত্তরে ইস্রায়েল (দশটি গোত্র) এবং দক্ষিণে জুদাহ (ডেভিডের বংশধররা)। এই বিভাজন বা গ্রেট স্কিজম (Great Schism) ছিল আব্রাহামিক ইতিহাসের এক বিশাল ট্র্যাজেডি, যা পরবর্তীতে তাদের রাজনৈতিক পতনকে ত্বরান্বিত করে।
নবীদের উত্থান: বিবেকের কণ্ঠস্বর
রাজ্য যখন দুর্নীতি, অনাচার এবং মূর্তিপূজায় ছেয়ে গেল, তখন দৃশ্যপটে আবির্ভূত হলেন এক নতুন শ্রেণির মানুষ – নবী বা প্রফেট (Prophet)। হিব্রু ভাষায় এদের বলা হয় ‘নাভি’ (Navi), যার অর্থ হলো ‘যিনি ডাকেন’ বা ‘যাকে ডাকা হয়েছে’। এরা কোনো জাদুকর বা ভাগ্যগণনাকারী ছিলেন না। এরা ছিলেন সমাজের সবচেয়ে সংবেদনশীল এবং তীব্র আবেগী মানুষ। বিখ্যাত ইহুদি দার্শনিক আব্রাহাম জশুয়া হেশেল (Abraham Joshua Heschel) তার মাস্টারপিস The Prophets-এ নবীদের মনস্তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ডিভাইন প্যাথোস (Divine Pathos) বা ‘ঐশ্বরিক বেদনা’ তত্ত্বের অবতারণা করেছেন। হেশেলের মতে, নবীরা ঈশ্বরের অনুভূতিকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করতেন। ঈশ্বর যখন মানুষের পাপে রাগান্বিত বা দুঃখিত হতেন, নবী সেই রাগ বা দুঃখ নিজের শরীরে অনুভব করতেন এবং তা মানুষের কাছে চিৎকার করে বলতেন।
এলাইজা বা ইলিয়াস (Elijah), আমোস, আইজায়া বা ইশাইয়া (Isaiah), এবং জেরেমায়া বা ইয়ারমিয়াহ – এরা রাজাদের চোখের দিকে তাকিয়ে অপ্রিয় সত্য কথা বলতেন। তারা বলতেন, “তোমাদের মন্দির, তোমাদের কোরবানি – সব অর্থহীন, যদি তোমরা এতিম ও বিধবার হক আদায় না করো।” আব্রাহামিক মিথোলজিতে নবীরাই প্রথমবারের মতো ধর্মের ফোকাসকে রিচুয়াল বা আচার থেকে সরিয়ে সামাজিক ন্যায়বিচার (Social Justice)-এর দিকে নিয়ে আসেন। যেমন, আমোস বলেছিলেন, “ন্যায়বিচারকে জলের মতো এবং সততাকে খরস্রোতা নদীর মতো প্রবাহিত হতে দাও।” জেরেমায়া যখন জেরুজালেমের পতন আসন্ন দেখে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছিলেন, তখন মানুষ তাকে পাগল ভেবেছিল। কিন্তু নবীদের ট্র্যাজেডি হলো, তারা ভবিষ্যৎ দেখতে পান, কিন্তু তা পরিবর্তন করার ক্ষমতা তাদের থাকে না। তাদের কাজ কেবল সতর্ক করা। তারা ছিলেন একাধারে কবি, রাজনীতিবিদ এবং সমাজ সংস্কারক – যারা ইতিহাসের ঝড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ঈশ্বরের নৈতিক দাবিকে টিকিয়ে রেখেছিলেন।
নির্বাসন এবং ধর্মতত্ত্বের বিবর্তন
নবীদের সতর্কবাণী সত্য হলো। ৫৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যবিলনের রাজা নেবুচাদনেজার জেরুজালেম আক্রমণ করলেন। তিনি সলোমনের সেই জাঁকজমকপূর্ণ মন্দির পুড়িয়ে ধূলিসাৎ করলেন এবং ইহুদিদের শিকল পরিয়ে ব্যবিলনে নিয়ে গেলেন। একে বলা হয় ব্যবিলনীয় নির্বাসন (Babylonian Exile)। মিথোলজির ইতিহাসে এটি একটি অস্তিত্বের সংকট বা এক্সিস্টেনশিয়াল ক্রাইসিস (Existential Crisis)। প্রাচীনকালে বিশ্বাস করা হতো, যুদ্ধে হেরে যাওয়া মানে নিজের দেবতার হেরে যাওয়া। তাহলে কি আব্রাহামের ঈশ্বর ইয়াহওয়ে ব্যবিলনের দেবতা মারদুকের কাছে হেরে গেলেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ইহুদি ধর্মতত্ত্ব এক নতুন রূপ নিল। তারা বুঝল, ঈশ্বর কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বা মন্দিরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নন। তিনি বিশ্বজনীন। তিনি তাদের শাস্তি দিয়েছেন তাদের পাপের কারণে, অন্য দেবতার শক্তির কারণে নয়।
এই নির্বাসনের সময়েই ইহুদি ধর্ম একটি টেম্পল-বেসড রিলিজিয়ন (Temple-based Religion) থেকে টেক্সট-বেসড রিলিজিয়ন (Text-based Religion)-এ রূপান্তরিত হলো। মন্দির নেই, তাই কোরবানিও নেই। তাহলে ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে কোথায়? পাওয়া যাবে তোরাহ বা ধর্মগ্রন্থের পাতায় এবং সিনাগগ বা সমবেত প্রার্থনায়। এই সময়েই পুরনো কাহিনীগুলো, সৃষ্টিতত্ত্ব, এবং রাজাদের ইতিহাসগুলো লিপিবদ্ধ ও সম্পাদনা করা হয়। নির্বাসনের এই যন্ত্রণা থেকেই জন্ম নেয় এক তীব্র হাহাকার এবং ঘরে ফেরার আকুতি। তারা মনে করত, এই শাস্তি সাময়িক। ঈশ্বর আবার মুখ তুলে চাইবেন। কিন্তু এবার আর কোনো সাধারণ বিচারক বা রাজা দিয়ে হবে না, এবার প্রয়োজন এক অলৌকিক ত্রাণকর্তার।
মসিহ-এর ধারণা: এক কসমিক আশাবাদ
ভগ্ন হৃদয় এবং পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখতে দেখতে ইহুদি মিথোলজিতে দানা বাঁধল মসিহ (Messiah) বা ‘মেসায়াহ’ ধারণাটি। হিব্রু শব্দ ‘মাশিয়াহ’ (Mashiach) অর্থ হলো ‘অভিষিক্ত জন’ বা অ্যানয়েন্টেড ওয়ান (Anointed One)। প্রাচীনকালে রাজাদের মাথায় তেল ঢেলে অভিষেক করা হতো, তাই প্রথমে মসিহ বলতে বোঝাত একজন বৈধ রাজাকে। কিন্তু নির্বাসনের দীর্ঘ রাতে এই ধারণাটি বিবর্তিত হয়ে এক মহাজাগতিক রূপ নিল। তারা আর কেবল একজন রাজনৈতিক নেতার অপেক্ষা করছিল না, তারা অপেক্ষা করছিল এমন এক অতিমানবীয় সত্তার, যিনি এসে কেবল ইস্রায়েলকে নয়, বরং পুরো পৃথিবীকে পাপ ও মৃত্যু থেকে মুক্ত করবেন।
প্রখ্যাত স্কলার গারশম শলেম (Gershom Scholem) তার The Messianic Idea in Judaism বইয়ে দেখিয়েছেন যে, মসিহ ধারণাটির মধ্যে দুটি বিপরীতমুখী স্রোত আছে। একটি হলো রেস্টোরেটিভ (Restorative) বা পুনরুদ্ধারমূলক – যা আমাদের ডেভিডের স্বর্ণযুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। অন্যটি হলো ইউটোপিয়ান (Utopian) – যা এমন এক নতুন পৃথিবী তৈরি করবে যা আগে কখনো ছিল না, যেখানে “নেকড়ে এবং মেষশাবক একসাথে বাস করবে” (আইজায়া ১১:৬)। নবীদের বাণীতে এই মসিহ-এর চিত্রটি ছিল রহস্যময়। আইজায়া নবী তার বিখ্যাত ‘সাফারিং সার্ভেন্ট’ বা দুঃখী সেবক (Suffering Servant) কবিতায় (অধ্যায় ৫৩) এমন এক মসিহ-এর কথা বলেন, যিনি “আমাদের পাপের জন্য বিদ্ধ হবেন এবং যার ক্ষতের মাধ্যমে আমরা আরোগ্য লাভ করব।” এই ধারণাটি – যে মসিহ রাজকীয় বীর না হয়ে একজন যন্ত্রণাকাতর সেবকও হতে পারেন – পরবর্তীতে খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বের মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।
ইহুদি মিথোলজিতে মসিহ-এর অপেক্ষা কোনো নিষ্ক্রিয় বসে থাকা নয়; এটি একটি সক্রিয় আশা। একে বলা হয় টিক্কুন ওলাম (Tikkun Olam) বা ‘বিশ্বের মেরামত’। তারা বিশ্বাস করে, মানুষ যখন ঈশ্বরের আইন মেনে চলবে এবং পৃথিবীকে প্রস্তুত করবে, তখনই মসিহ আসবেন। এই অনন্ত প্রতীক্ষাই ইহুদি জাতিকে হাজার বছরের নির্যাতন, হলোকাস্ট এবং দেশহীনতার মধ্যেও টিকিয়ে রেখেছে। তারা বিশ্বাস করে, ইতিহাসের শেষ অধ্যায়টি এখনো লেখা বাকি, এবং সেই অধ্যায়ের নায়ক হবেন ডেভিডের বংশধর সেই মসিহ, যিনি জেরুজালেমে তৃতীয় মন্দির নির্মাণ করবেন এবং পৃথিবীতে ঈশ্বরের রাজ্য বা কিংডম অফ গড (Kingdom of God) প্রতিষ্ঠা করবেন। রাজা, নবী এবং মসিহ-এর এই ত্রয়ী আখ্যান আব্রাহামিক মিথোলজিকে দিয়েছে এক অনন্য গতিশীলতা – যা অতীতকে সম্মান করে, বর্তমানকে সমালোচনা করে এবং ভবিষ্যতের দিকে এক অদম্য আশায় তাকিয়ে থাকে।
যিশু খ্রিস্ট: নতুন এক বাঁক ও রক্তিম চুক্তি
আব্রাহামিক মিথোলজির মহাকাব্যিক যাত্রাপথ ধরে আমরা দেখেছি একের পর এক নাটকীয় মোড়। মোজেসের আইন, ডেভিডের তরবারি এবং নবীদের হাহাকারের ভেতর দিয়ে ইহুদি মানসপটে তৈরি হয়েছিল এক অদম্য প্রতীক্ষা। রোমান সাম্রাজ্যের লৌহকঠিন বুটের তলায় পিষ্ট জুদিয়া তখন ধুঁকছে। তাদের একমাত্র আশা, নবীদের কিতাবে লেখা সেই প্রতিশ্রুত পুরুষ – মসিহ বা মেসায়াহ – আবির্ভূত হবেন। তিনি হবেন ‘লায়ন অফ জুদাহ’ বা জুদাহর সিংহ, যিনি রোমান ঈগলকে ছিন্নভিন্ন করে আবার জেরুজালেমে ডেভিডের সিংহাসন প্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে যখন সেই মুহূর্তটি এল, তখন চিত্রনাট্যটি এমনভাবে পাল্টে গেল যা কেউ কল্পনাও করেনি। গালীল প্রদেশের এক ধূলিমাখা গ্রামে, এক কাঠমিস্ত্রির ঘরে জন্ম নেওয়া এক যুবক নিজেকে ঈশ্বরের পুত্র বলে দাবি করলেন। তার হাতে কোনো তলোয়ার ছিল না, ছিল না কোনো সেনাবাহিনী। তিনি রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন না, বরং বললেন, “তোমার শত্রুকে ভালোবাসো।” আব্রাহামিক মিথোলজির এই বাঁকটি এতটাই আকস্মিক এবং বৈপ্লবিক যে, একে বলা হয় প্যারাডাইম শিফট (Paradigm Shift)। ইহুদিরা চেয়েছিল এক রাজনৈতিক মুক্তিদাতা বা পলিটিক্যাল লিবারেটর (Political Liberator), কিন্তু যিশু বা জিসাস (Jesus) এলেন আত্মিক মুক্তিদাতা বা স্পিরিচুয়াল রিডিমার (Spiritual Redeemer) হিসেবে। এখান থেকেই জন্ম নিল ‘নতুন নিয়ম’ বা নিউ টেস্টামেন্ট (New Testament) – যেখানে ঈশ্বরের সাথে মানুষের সম্পর্ক ভীতি বা আইনের নয়, বরং ভালোবাসা এবং ত্যাগের।
অবতারবাদ: শব্দ যখন মাংসে পরিণত হলো
যিশুর জন্মকাহিনী খ্রিস্টান মিথোলজির (একাডেমিক অর্থে) এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর অধ্যায়। গসপেল বা সুসমাচারগুলোর বর্ণনা অনুযায়ী, তার জন্ম কোনো সাধারণ জৈবিক প্রক্রিয়ায় হয়নি। কুমারী মেরি বা মরিয়ম পবিত্র আত্মার প্রভাবে গর্ভবতী হন। একে বলা হয় ভার্জিন বার্থ (Virgin Birth) বা কুমারী জন্ম। কম্পারেটিভ মিথোলজিতে দেবতাদের সন্তান হওয়ার ঘটনা নতুন নয় – গ্রিক বীর হারকিউলিস বা পার্সিউস ছিলেন জিউসের সন্তান। কিন্তু সেখানে দেবতা মানুষের সাথে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হতেন। আব্রাহামিক মিথোলজিতে যিশুর জন্ম সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দার্শনিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে। এখানে ঈশ্বর কোনো জৈবিক পিতা নন, বরং তিনি তার ‘বাক্য’ বা লোগোস (Logos)-কে মানুষের রূপ দিলেন। চতুর্থ সুসমাচার বা গসপেল অফ জন-এর শুরুতে বলা হয়েছে, “আদিতে বাক্য ছিলেন, এবং বাক্য ঈশ্বরের সঙ্গে ছিলেন… এবং সেই বাক্য মাংসে পরিণত হলেন (And the Word became flesh)।” গ্রিক দর্শনে, বিশেষ করে স্টোয়িকবাদে, ‘লোগোস’ ছিল মহাবিশ্বের চালিকাশক্তি বা যুক্তি। খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্ববিদরা সেই বিমূর্ত যুক্তিকে এক রক্ত-মাংসের মানুষে রূপান্তরিত করলেন। এই ঘটনাকে বলা হয় ইনকারনেশন (Incarnation) বা অবতারবাদ।
এই ইনকারনেশনের ধারণাটি যিশুকে আব্রাহামিক মিথোলজির পূর্ববর্তী সব নবীদের থেকে আলাদা করে ফেলে। মোজেস বা ইশাইয়া ছিলেন ঈশ্বরের বার্তাবাহক, তারা আঙুল দিয়ে চাঁদের দিকে ইশারা করতেন। কিন্তু খ্রিস্টান বিশ্বাস অনুযায়ী, যিশু নিজেই সেই চাঁদ। তিনি এবং ঈশ্বর এক। এই দ্বৈত সত্তাকে থিওলজির ভাষায় বলা হয় হাইপোস্ট্যাটিক ইউনিয়ন (Hypostatic Union)। অর্থাৎ, যিশু একই সাথে ১০০ ভাগ ঈশ্বর (Fully God) এবং ১০০ ভাগ মানুষ (Fully Man)। তিনি মানুষের মতো ক্ষুধা, তৃষ্ণা এবং ব্যথা অনুভব করেন, আবার ঈশ্বরের মতো পাপ ক্ষমা করার ক্ষমতা রাখেন। বিখ্যাত লেখক এবং তাত্ত্বিক সি.এস. লুইস (C.S. Lewis) তার প্রবন্ধ সংকলন God in the Dock-এ এই বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেছেন ‘মিথ বিকেম ফ্যাক্ট’ (Myth Became Fact) হিসেবে। লুইসের মতে, মানুষের মনের গভীরে সবসময়ই এক ‘মৃত ও পুনরুত্থিত দেবতা’-র (Dying and Rising God) মিথ ছিল (যেমন – মিশরীয় ওসাইরিস বা নর্স বালডার)। যিশুর জীবনে সেই চিরকালীন মিথটিই ইতিহাসে বাস্তবে রূপ নিয়েছে। বেথলেহেমের আস্তাবলে জন্ম নেওয়া সেই শিশুটি তাই কেবল একটি শিশু নয়, তিনি হলেন ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দু, যার আগমনে ক্যালেন্ডারের সময়ও দুই ভাগ হয়ে যায় (BC এবং AD)।
ঈশ্বরের রাজ্য এবং র্যাডিক্যাল এথিক্স
তিরিশ বছর বয়সে যিশু তার জনজীবন বা মিনিস্ট্রি শুরু করলেন। তিনি জর্ডান নদীতে বাপ্তিস্ম বা অভিসিঞ্চন নিলেন এবং মরুভূমিতে চল্লিশ দিন উপবাস করলেন, যেখানে শয়তান তাকে প্রলোভন দেখাল। এই প্রলোভন জয়ের পর তিনি গালীলের গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচার শুরু করলেন। তার বার্তা ছিল খুব সরল কিন্তু বিস্ফোরক – “মন ফেরাও, কারণ ঈশ্বরের রাজ্য সন্নিকটে।” কিন্তু এই ‘ঈশ্বরের রাজ্য’ বা কিংডম অফ গড (Kingdom of God) কোনো ভৌগোলিক সীমানা বা রাজনৈতিক রাষ্ট্র ছিল না। এটি ছিল মানুষের হৃদয়ের এক অবস্থা। যিশুর শিক্ষা তৎকালীন ইহুদি ধর্মীয় নেতাদের (ফরীশী বা ফ্যারিসিজ (Pharisees)) আইনের কঠোরতাকে চ্যালেঞ্জ করে বসল। ফরীশীরা মনে করত, তোরাহ-র ৬১৩টি নিয়ম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালন করাই ধর্ম। যিশু বললেন, “বিশ্রামবার বা সাবাথ মানুষের জন্য তৈরি হয়েছে, মানুষ সাবাথের জন্য নয়।” তিনি ধর্মকে আচারসর্বস্বতা থেকে বের করে এনে করুণা এবং মানবতার ওপর দাঁড় করালেন।
তার সবচেয়ে বিখ্যাত শিক্ষা হলো ‘পাহাড়ি উপদেশ’ বা সারমন অন দ্য মাউন্ট (Sermon on the Mount)। এখানে তিনি এমন এক এথিক্স বা নীতিশাস্ত্রের অবতারণা করলেন যা মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তির সম্পূর্ণ বিপরীত। একে বলা হয় ইনভার্সন অফ পাওয়ার (Inversion of Power)। তিনি বললেন, “ধন্য তারা, যারা নম্র, কারণ তারা পৃথিবীর অধিকারী হবে।” তিনি বললেন, “কেউ যদি তোমার এক গালে চড় মারে, তবে অন্য গালটিও পেতে দাও।” খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্ব মতে এই অহিংসা বা প্যাসিফিজম (Pacifism) দুর্বলতা নয়, বরং এটি আত্মিক শক্তির এক চরম প্রকাশ। যিশু সমাজের ব্রাত্যজন – কর আদায়কারী, পতিতা, কুষ্ঠরোগী এবং অচ্ছুতদের সাথে মিশতেন এবং তাদের সাথে খাবার খেতেন। তৎকালীন সমাজে ‘একসাথে খাওয়া’ বা টেবল ফেলোশিপ (Table Fellowship) ছিল সামাজিক স্বীকৃতির প্রতীক। যিশু এই সীমানাগুলো ভেঙে দিয়ে এক নতুন সমাজ বা ইগ্যালিটারিয়ান কমিউনিটি (Egalitarian Community) গড়ার ডাক দিলেন, যেখানে ঈশ্বরের চোখে সবাই সমান। তিনি গল্প বা প্যারাডল (Parables)-এর মাধ্যমে জটিল আধ্যাত্মিক সত্য বোঝাতেন। ‘হারানো ছেলে’ (Prodigal Son) বা ‘গুড সামারিটান’-এর গল্পের মাধ্যমে তিনি বোঝালেন যে, ঈশ্বরের ভালোবাসা কোনো শর্ত মানে না, তা অঢেল এবং অযৌক্তিক। এই নিঃশর্ত ভালোবাসাকে গ্রিক ভাষায় বলা হয় আগাপে (Agape) – যা খ্রিস্টীয় দর্শনের মূল ভিত্তি।
লাস্ট সাপার এবং নতুন চুক্তির প্রস্তাবনা
যিশুর জনপ্রিয়তা যত বাড়ছিল, জেরুজালেমের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক এস্টাবলিশমেন্টের জন্য তিনি ততই হুমকি হয়ে উঠছিলেন। তিনি যখন গাধার পিঠে চড়ে জেরুজালেমে প্রবেশ করলেন (পাম সানডে), জনতা তাকে ‘রাজা’ বলে সম্ভাষণ জানাল। এটি ছিল রোমান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সরাসরি চ্যালেঞ্জ। কিন্তু যিশু জানতেন তার গন্তব্য সিংহাসন নয়, বরং ক্রুশ। তার মৃত্যুর আগের রাতে তিনি তার বারোজন শিষ্যকে নিয়ে শেষবারের মতো রাতের খাবার খেলেন, যা ইতিহাসে দ্য লাস্ট সাপার (The Last Supper) নামে পরিচিত। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির বিখ্যাত ছবিতে আমরা এই দৃশ্যটি দেখি, কিন্তু এর ধর্মতাত্ত্বিক গুরুত্ব আরও গভীর। এই ভোজে যিশু রুটি ছিঁড়ে বললেন, “এটি আমার শরীর,” এবং দ্রাক্ষারসের পেয়ালা দিয়ে বললেন, “এটি আমার রক্ত, যা নতুন নিয়মের বা নিউ কোভেন্যান্ট (New Covenant)-এর জন্য পাতিত হবে।”
এখানেই আব্রাহামিক মিথোলজিতে এক বিশাল পরিবর্তন আসে। সিনাই পর্বতে মোজেস পশুর রক্ত দিয়ে ঈশ্বরের সাথে ইস্রায়েলের চুক্তি করেছিলেন। আর এখানে যিশু নিজের রক্ত দিয়ে ঈশ্বরের সাথে সমগ্র মানবজাতির চুক্তি করছেন। এই অনুষ্ঠানটিই পরবর্তীতে খ্রিস্টধর্মে ইউকারিস্ট (Eucharist) বা হলি কমিউনিয়ন নামে প্রধান উপাসনায় পরিণত হয়। রুটি এবং মদের মাধ্যমে বিশ্বাসীরা ঈশ্বরের সত্তাকে নিজেদের মধ্যে গ্রহণ করে। এই রাতে যিশুর শিষ্য জুদাস ইস্কারিয়ট তাকে মাত্র ত্রিশটি রৌপ্যমুদ্রার বিনিময়ে ধরিয়ে দেয়। গেৎশিমানি বাগানে যিশুর প্রার্থনা – “হে পিতা, যদি সম্ভব হয় তবে এই পানপাত্র আমার থেকে সরিয়ে নাও, তবুও আমার ইচ্ছা নয়, তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক” – তার মানবিক যন্ত্রণার এক করুণ দলিল। তিনি জানতেন সামনে কী ভয়ানক মৃত্যু অপেক্ষা করছে, তবুও তিনি স্বেচ্ছায় তা বরণ করে নিলেন। একে থিওলজিতে বলা হয় ক্যানোসিস (Kenosis) বা নিজেকে শূন্য করে দেওয়া – ঈশ্বরের সমকক্ষ হয়েও তিনি দাসের রূপ ধারণ করলেন।
ক্রুশবিদ্ধকরণ: পাপের প্রায়শ্চিত্ত এবং স্কেপগোট মেকানিজম
যিশুর বিচার হলো প্রহসনের মতো। ইহুদি মহাসভা বা সানহেড্রিন তাকে ঈশ্বরনিন্দার (Blasphemy) দায়ে অভিযুক্ত করল, আর রোমান গভর্নর পন্টিয়াস পাইলেট তাকে রাজদোহিতার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দিলেন। তাকে চাবুক মারা হলো, মাথায় কাঁটার মুকুট পরানো হলো এবং নিজের ক্রুশ কাঁধে করে গলগথা পাহাড়ে নিয়ে যেতে বাধ্য করা হলো। ক্রুশে হাত-পা পেরেক দিয়ে বিদ্ধ করে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো। এই মৃত্যুদণ্ড ছিল রোমানদের সবচেয়ে অপমানজনক এবং যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি, যা কেবল দাস এবং বিদ্রোহীদের দেওয়া হতো। ভরদুপুরে আকাশ অন্ধকার হয়ে এল। যিশু ক্রুশ থেকে চিৎকার করে বললেন, “এলি, এলি, লামা শবক্তানী?” অর্থাৎ, “হে আমার ঈশ্বর, হে আমার ঈশ্বর, তুমি কেন আমায় ত্যাগ করলে?” এই আর্তনাদ বা ক্রাই অফ ডেরিলিকশন (Cry of Dereliction) প্রমাণ করে যে, সেই মুহূর্তে তিনি ঈশ্বরের বিচ্ছেদ বা নরকের যন্ত্রণা অনুভব করছিলেন।
এখন প্রশ্ন হলো, যিশুকে কেন মরতে হলো? ঈশ্বর কি এমনিতেই মানুষকে ক্ষমা করতে পারতেন না? খ্রিস্টান মিথোলজির কেন্দ্রে আছে অ্যাটোনমেন্ট (Atonement) বা প্রায়শ্চিত্তের তত্ত্ব। আদিপুস্তকে আদম এবং ইভ যে ‘আদি পাপ’ (Original Sin) করেছিলেন, তার ফলে মানুষ এবং ঈশ্বরের মধ্যে যে বিচ্ছেদ ঘটেছিল, তা পূরণ করার জন্য এক নিখুঁত বলির প্রয়োজন ছিল। মানুষ পাপী, তাই কোনো মানুষ অন্য মানুষের পাপের ভার নিতে পারে না। আবার ঈশ্বর অমর, তাই তিনি মরতে পারেন না। তাই ঈশ্বর মানুষ হলেন (যিশু), যাতে তিনি মারা যেতে পারেন এবং নিখুঁত বলি হিসেবে মানবজাতির সব পাপ নিজের কাঁধে তুলে নিতে পারেন। একাদশ শতাব্দীর ধর্মতাত্ত্বিক অ্যানসেলম অফ ক্যান্টারবেরি (Anselm of Canterbury) তার বই Cur Deus Homo (ঈশ্বর কেন মানুষ হলেন)-এ এই তত্ত্বকে স্যাটিসফ্যাকশন থিওরি (Satisfaction Theory) হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে, মানুষের পাপ ঈশ্বরের অসীম সম্মানে আঘাত করেছে, তাই এর ক্ষতিপূরণও হতে হবে অসীম, যা কেবল ঈশ্বর-মানব বা গড-ম্যান যিশুই দিতে পারেন।
ফরাসি দার্শনিক রেনে জিরার্ড (René Girard) তার Things Hidden Since the Foundation of the World বইয়ে এই ঘটনাকে সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে দেখেছেন। তিনি একে বলেছেন স্কেপগোট মেকানিজম (Scapegoat Mechanism)-এর চূড়ান্ত প্রকাশ। আদিম সমাজে শান্তি বজায় রাখার জন্য কোনো নির্দোষ ব্যক্তিকে বলি দেওয়া হতো। যিশু হলেন সেই চূড়ান্ত ‘স্কেপগোট’ বা বলির পাঁঠা, যাকে সমাজ তার সমস্ত হিংসা এবং পাপ চাপিয়ে হত্যা করেছে। কিন্তু জিরার্ডের মতে, যিশুর মৃত্যু এই মিথটিকে উন্মোচন করে দিয়েছে এবং প্রমাণ করেছে যে বলিদান অর্থহীন, কারণ ঈশ্বর সহিংসতার পক্ষে নন, তিনি ভিকটিম বা নির্যাতিতের পক্ষে। যিশু যখন বললেন “ইহা সমাপ্ত হলো” (It is finished), তখন জেরুজালেমের মন্দিরের পর্দা ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত ছিঁড়ে দুভাগ হয়ে গেল। এটি প্রতীকী অর্থে বোঝায় যে, ঈশ্বরের কাছে যাওয়ার জন্য আর কোনো পুরোহিত বা কোরবানির প্রয়োজন নেই; রাস্তা এখন সবার জন্য উন্মুক্ত।
পুনরুত্থান: মৃত্যুর মৃত্যু এবং নতুন ভোরের সূচনা
গল্প যদি ক্রুশেই শেষ হতো, তবে যিশু হতেন ইতিহাসের আরেকজন ব্যর্থ বিদ্রোহী। কিন্তু আব্রাহামিক মিথোলজির সবচেয়ে বড় অলৌকিক ঘটনাটি ঘটে তিন দিন পর। যিশুর মৃতদেহ একটি গুহায় পাথরের সমাধি দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল এবং রোমান প্রহরীরা তা পাহারা দিচ্ছিল। রবিবার ভোরে কয়েকজন নারী (যাদের মধ্যে মেরি ম্যাগডালিন প্রধান) গিয়ে দেখলেন পাথরটি সরানো এবং সমাধি খালি। সেখানে দেবদূত ঘোষণা করলেন, “তোমরা যাকে খুঁজছ, তিনি এখানে নেই। তিনি জীবিত হয়েছেন।” একে বলা হয় রেজারেকশন (Resurrection) বা পুনরুত্থান। এটি কেবল আত্মিক পুনর্জন্ম নয়, এটি ছিল শারীরিক পুনরুত্থান। বাইবেলের বর্ণনায়, পুনরুত্থিত যিশু তার শিষ্যদের দেখা দিলেন, তাদের সাথে মাছ খেলেন এবং অবিশ্বাসী টমাসকে তার হাতের পেরেকের দাগ স্পর্শ করতে বললেন। তবে তার এই শরীর ছিল এক বিশেষ ধরণের ‘গ্লোরিফায়েড বডি’ বা মহিমান্বিত শরীর, যা দেওয়াল ভেদ করে চলাচল করতে পারত।
জার্মান ধর্মতাত্ত্বিক রুডলফ বল্টম্যান (Rudolf Bultmann) তার বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘New Testament and Mythology’-তে প্রস্তাব করেছিলেন যে, আধুনিক মানুষের কাছে এই পুনরুত্থানের কাহিনী অবিশ্বাস্য হতে পারে, তাই একে ডিমাইথোলজাইজ (Demythologize) বা মিথ-মুক্ত করে এর অস্তিত্ববাদী অর্থটি গ্রহণ করা উচিত। তার মতে, যিশুর পুনরুত্থান মানে হলো বিশ্বাসীর হৃদয়ে যিশুর শিক্ষার জেগে ওঠা (Bultmann, 1941)। তবে প্রথাগত খ্রিস্টান বিশ্বাস এবং আধুনিক অনেক ঐতিহাসিক, যেমন এন.টি. রাইট (N.T. Wright) তার The Resurrection of the Son of God বইয়ে যুক্তি দিয়েছেন যে, প্রথম শতাব্দীর ইহুদিরা রূপক পুনরুত্থানে বিশ্বাসী ছিল না। শিষ্যরা যে রাতারাতি ভীতু পলাতক থেকে অকুতোভয় শহীদে পরিণত হয়েছিল এবং ‘যিশু প্রভু’ বলে রোমান সাম্রাজ্য কাঁপিয়ে দিয়েছিল, তার পেছনে অবশ্যই কোনো বাস্তব এবং অভাবনীয় ঘটনা ছিল। রাইট বলেন, রেজারেকশন হলো নিউ ক্রিয়েশন (New Creation) বা নতুন সৃষ্টির সূচনা। যিশু মৃত্যুকে জয় করে প্রমাণ করলেন যে, অশুভ শক্তি এবং মৃত্যু শেষ কথা নয়।
পুনরুত্থানের এই ঘটনাটি পশ্চিমা জগত এবং আব্রাহামিক ইতিহাসের গতিপথ চিরতরে বদলে দেয়। ইহুদিদের পবিত্র দিন ছিল শনিবার (সাবাথ), কিন্তু খ্রিস্টানরা উপাসনা শুরু করল রবিবার (লর্ডস ডে), কারণ এই দিনেই যিশু মৃত্যুঞ্জয়ী হয়েছিলেন। যিশুর এই বিজয়কে বলা হয় ক্রিস্টাস ভিক্টর (Christus Victor)। এটি ঘোষণা করে যে, শয়তানের রাজত্ব শেষ, এবং ঈশ্বরের রাজ্যের সূচনা হয়ে গেছে। এই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে চার্চ বা মণ্ডলী, যা পরবর্তী দুই হাজার বছর ধরে মানব সভ্যতার শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি এবং দর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। যিশু খ্রিস্টের এই ‘নতুন চুক্তি’ বা নিউ কোভেন্যান্ট মানুষকে শেখাল যে, ঈশ্বর কেবল ভয়ে কম্পমান হওয়ার সত্তা নন, তিনি এমন এক পিতা যিনি তার সন্তানের জন্য দৌড়ে আসেন এবং তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। ক্রুশ, যা ছিল লজ্জার প্রতীক, তা হয়ে উঠল ভালোবাসা এবং বিজয়ের বিশ্বজনীন প্রতীক।
ইসলাম: শেষ মোহর (Islam: The Final Seal)
সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভে, যখন বাইজেন্টাইন এবং সাসানীয় সাম্রাজ্যের দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষে মধ্যপ্রাচ্য বিধ্বস্ত, ঠিক তখনই আরবের রুক্ষ এবং জনপদহীন মরুপ্রান্তরে আব্রাহামিক মিথোলজির সবচেয়ে নাটকীয় এবং চূড়ান্ত অধ্যায়টির উন্মোচন ঘটে। মক্কা নামক এক বাণিজ্যকেন্দ্র, যা ছিল প্রাচীন আরবদের তীর্থস্থান, সেখানে কুরাইশ বংশের এক চিন্তাশীল মানুষ, মুহাম্মদ, হেরা গুহার নির্জনতায় ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। আব্রাহামিক ইতিহাসের এই পর্যায়টিকে বলা হয় জাহিলিয়াহ (Jahiliyyah) বা ‘অজ্ঞতার যুগ’ – যেখানে মূর্তিপূজা, গোত্রগত সংঘাত এবং কন্যাশিশুকে জীবন্ত কবর দেওয়ার মতো প্রথা প্রচলিত ছিল। এই বিশৃঙ্খল পটভূমিতে মুহাম্মদের আবির্ভাব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, বরং এটি ছিল মিথোলজির সেই চিরায়ত কাঠামো – ক্যাওস (Chaos) থেকে কসমস (Cosmos) বা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া। মুহাম্মদ নিজেকে কোনো অভিনব বা নতুন ধর্মের প্রবর্তক হিসেবে দাবি করেননি; তিনি নিজেকে উপস্থাপন করেছিলেন আব্রাহাম, মোজেস এবং যিশুর সেই হারিয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধারকারী হিসেবে। ইসলামি ধর্মতত্ত্বে তাকে বলা হয় খাতামুন নাবিয়্যিন (Seal of the Prophets)। এই ‘সিল’ বা মোহর ধারণাটি অত্যন্ত প্রতীকী; এটি বোঝায় যে, আদম থেকে শুরু হওয়া নবুওয়তের যে দীর্ঘ ধারা বা প্রফেটিক সাইকেল (Prophetic Cycle) চলে আসছিল, মুহাম্মদ হলেন তার সমাপ্তি এবং পূর্ণতা। একটি চিঠির শেষে যেমন মোহর মেরে সেটিকে বন্ধ করা হয় যাতে আর কিছু যোগ করা না যায়, তেমনি মুহাম্মদের মাধ্যমে ঐশ্বরিক বার্তা পূর্ণতা লাভ করেছে এবং এর পর আর কোনো নতুন ওহী বা নবীর প্রয়োজন নেই। ইসলামি ন্যারেটিভ অনুযায়ী, পূর্ববর্তী ইহুদি এবং খ্রিস্টানরা তাদের মূল বার্তা থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং তাদের পবিত্র গ্রন্থগুলোতে মানবিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে তাহরিফ (Tahrif) বা বিকৃতি সাধন করেছে। তাই কুরআন নাজিল হয়েছে এক চূড়ান্ত, অপরিবর্তনীয় এবং অবিকৃত সত্য হিসেবে, যা পূর্ববর্তী সব কিতাবের সত্যতাকে যাচাই করে এবং সংশোধন করে।
ইসলামি মিথোলজিতে ঈশ্বরের ধারণাটি পূর্ববর্তী আব্রাহামিক ধর্মগুলোর তুলনায় আরও বেশি বিমূর্ত এবং আপোষহীন। এখানে ঈশ্বরের কোনো সাকার রূপ, পুত্র বা অংশীদার নেই। একে বলা হয় তাওহীদ (Tawhid) বা পরম একেশ্বরবাদ। খ্রিস্টধর্মে যেখানে ঈশ্বর মানুষ হয়েছেন (ইনকারনেশন (Incarnation)), ইসলামে সেখানে ঈশ্বর কিতাব বা শব্দে পরিণত হয়েছেন। ধর্মতত্ত্ববিদ এবং দার্শনিক হ্যারি অস্ট্রিন উলফসন (Harry Austryn Wolfson) তার দর্শনের ইতিহাসে এই প্রক্রিয়াটিকে চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি খ্রিস্টধর্মের ‘ইনকারনেশন’-এর বিপরীতে ইসলামের এই প্রক্রিয়াকে বলেছেন ইনলিবারেশন (Inlibration) বা ‘ঈশ্বর কিতাবে পরিণত হওয়া’। যিশু যেমন খ্রিস্টানদের কাছে ‘লোগোস’ বা ঈশ্বরের বাক্য, কুরআন ঠিক তেমনি ঈশ্বরের শাশ্বত বাণী বা আনক্রিয়েটেড ওয়ার্ড (Uncreated Word) হিসেবে গণ্য হয়। হেরা গুহায় জিবরাইল বা গ্যাব্রিয়েল যখন মুহাম্মদকে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন “ইকরা” (পাঠ করো), তখন থেকেই এই মৌখিক বাচনিক অলৌকিকতার সূচনা। মুসা লাঠি দিয়ে সমুদ্র ভাগ করেছিলেন, যিশু মৃতকে জীবিত করেছিলেন – এগুলো ছিল ভিজ্যুয়াল বা দৃশ্যমান অলৌকিকতা। কিন্তু মুহাম্মদের প্রধান মোজেজা বা অলৌকিকত্ব হলো ভাষাতাত্ত্বিক। আরবের যে সমাজে কবিতা ছিল জাদুর মতো শক্তিশালী, সেখানে কুরআনের ছন্দ, ভাষা এবং গভীরতা ছিল এক অভাবনীয় চ্যালেঞ্জ। ইসলামি মিথোলজি তাই মূর্তিনির্ভর বা আইকনোগ্রাফিক নয়, বরং এটি ক্যালিগ্রাফি বা লিপি এবং ধ্বনি-নির্ভর। এই ধর্মে ঈশ্বরের উপস্থিতি অনুভব করা হয় তেলাওয়াত বা আবৃত্তির মাধ্যমে, কোনো চিত্রকর্মের মাধ্যমে নয়।
ইসমাইল এবং কাবার পুনর্গঠন: আব্রাহামিক ভূগোলের স্থানান্তর
আব্রাহামিক মিথোলজির ভূ-রাজনীতিতে ইসলাম এক বিশাল পরিবর্তন নিয়ে আসে। ইহুদি এবং খ্রিস্টান ঐতিহ্যে পবিত্র ভূমি বা প্রমিসড ল্যান্ড ছিল কানান বা জেরুজালেম, এবং আব্রাহামের আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী ধরা হতো আইজ্যাক বা ইসহাককে। কিন্তু ইসলামি ন্যারেটিভ ফোকাস ঘুরিয়ে দেয় আব্রাহামের জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাইল এবং তার মা হাগারের দিকে। জেনেসিসে হাগার ও ইসমাইলকে মরুভূমিতে নির্বাসিত করার যে ট্র্যাজিক গল্পটি আছে, ইসলামে সেটিই হয়ে ওঠে এক পবিত্র রীতিনীতি বা রিচুয়াল। মক্কার সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝে হাগারের জলের জন্য সেই ব্যাকুল দৌড়াদৌড়ি আজ হজ্জ্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ, যাকে বলা হয় সাঈ (Sa’i)। এই মিথোলজি আমাদের শেখায় যে, ঈশ্বরের করুণা কেবল নির্দিষ্ট কোনো বংশের জন্য নয়, বরং মরুভূমিতে পরিত্যক্ত এক দাসী ও তার পুত্রের কান্নাও ঈশ্বরের আরশ কাঁপিয়ে দিতে পারে। ইসমাইলের পায়ের আঘাতে বা জিবরাইলের পাখার ঝাপটায় সৃষ্টি হওয়া জমজম কুপটি হলো জীবনের উৎস বা ফাউন্টেন অফ লাইফ (Fountain of Life)-এর প্রতীক। ইসলামি বিশ্বাস মতে, আব্রাহাম পরবর্তীতে মক্কায় ফিরে আসেন এবং ইসমাইলকে সাথে নিয়ে কাবা ঘর পুনর্নির্মাণ করেন। এই কাবাঘরটি হলো ইসলামের অ্যাক্সিস মান্ডি (Axis Mundi) বা পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু। প্রাক-ইসলামিক যুগে এই ঘরটি ছিল ৩৬০টি মূর্তির আবাসস্থল, যা বিভিন্ন গোত্রের দেবতার প্রতীক ছিল। মক্কা বিজয়ের পর মুহাম্মদ যখন লাঠি দিয়ে সেই মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলেন এবং ঘোষণা করেন “সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে,” তখন তিনি আসলে আব্রাহামের সেই আদিম আইকনোক্লাজম বা মূর্তিবিরোধী আন্দোলনেরই পুনরাবৃত্তি করছিলেন। এর মাধ্যমে জেরুজালেম থেকে আধ্যাত্মিক কেন্দ্রবিন্দু সরে এল মক্কায়, এবং ইসমাইল – যাকে বাইবেলে ‘বুনো গাধা’ বলে তুচ্ছ করা হয়েছিল – তিনিই হয়ে উঠলেন আরব জাতির পিতা এবং শেষ নবীর পূর্বপুরুষ।
যিশু বনাম ঈসা: নবী বনাম ঈশ্বর-পুত্র
ইসলামি মিথোলজিতে যিশু বা ঈসা (Isa) এক অত্যন্ত সম্মানিত এবং কেন্দ্রীয় চরিত্র, কিন্তু তার পরিচয় খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্ব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ইসলামে যিশু ঈশ্বরের পুত্র নন, বরং তিনি আল্লাহর ‘রুহ’ বা আত্মা এবং তার ‘কালিমা’ বা বাক্য দ্বারা সৃষ্ট একজন মানুষ ও নবী। কুরআনে যিশুর জন্মকে অলৌকিক বা ভার্জিন বার্থ হিসেবে স্বীকার করা হয়, যা আদমের সৃষ্টির সাথে তুলনীয় – উভয়েই সাধারণ জৈবিক প্রক্রিয়ার বাইরে ঈশ্বরের আদেশে সৃষ্ট। কিন্তু আব্রাহামিক মিথোলজির সবচেয়ে বড় বিভাজনরেখাটি তৈরি হয় যিশুর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। খ্রিস্টধর্মের মূল ভিত্তি হলো ক্রুশবিদ্ধকরণ এবং পুনরুত্থান, যার মাধ্যমে মানবজাতির পাপ মোচন হয়েছে। কিন্তু ইসলামি ন্যারেটিভে যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়নি এবং হত্যাও করা হয়নি। কুরআনে বলা হয়েছে, “তারা তাকে হত্যা করেনি, ক্রুশবিদ্ধও করেনি, বরং তাদের সামনে ধাঁধার সৃষ্টি করা হয়েছিল” (সূরা নিসা: ১৫৭)। এই ধারণাটি প্রারম্ভিক খ্রিস্টানদের একটি শাখা, বিশেষ করে নস্টিসিজমের ডসেটিজম (Docetism) মতবাদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, যেখানে মনে করা হতো যে যিশুর শরীর ছিল মায়া বা ইলিউশন, তাই তাকে শারীরিকভাবে কষ্ট দেওয়া সম্ভব নয়। ইসলামি ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ঈশ্বর তার প্রিয় নবীকে শত্রুদের হাতে এমন অপমানজনক মৃত্যু বরণ করতে দেননি। হয়তো অন্য কাউকে যিশুর মতো চেহারা দিয়ে ক্রুশে চড়ানো হয়েছিল (যাকে শুব্বিহা (Substitution Theory) বলা হয়), এবং আসল যিশুকে ঈশ্বর সশরীরে আকাশে তুলে নিয়েছিলেন। মিথোলজির দৃষ্টিকোণ থেকে, এটি ঈশ্বরের সর্বশক্তিমান ক্ষমতার এক ভিন্ন প্রকাশ – তিনি তার দূতকে ট্র্যাজেডির হাত থেকে রক্ষা করেন, বলির পাঁঠা বানান না। ইসলামে যিশু হলেন একজন এসকাটোলজিক্যাল ফিগার (Eschatological Figure) বা কেয়ামতকালীন চরিত্র, যিনি শেষ জমানায় আবার পৃথিবীতে ফিরে আসবেন, দজ্জালকে হত্যা করবেন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। এখানে যিশু কোনো নতুন ধর্ম আনবেন না, বরং তিনি মুহাম্মদের আনীত শরীয়ত অনুসরণ করবেন এবং ক্রস ভেঙে ফেলে খ্রিস্টান ত্রিত্ববাদের অবসান ঘটাবেন।
মেরাজ: মহাজাগতিক আরোহণ এবং স্বর্গের স্থাপত্য
ইসলামি মিথোলজির সবচেয়ে মিস্টিক্যাল এবং দৃশ্যায়নযোগ্য ঘটনাটি হলো ইসরা এবং মেরাজ (Isra and Mi’raj)। এটি কেবল একটি ভৌগোলিক ভ্রমণ নয়, এটি হলো মানুষের আত্মার ঊর্ধ্বগমন বা এসেনশন (Ascension)-এর চূড়ান্ত রূপক। এক রাতে জিবরাইল এসে মুহাম্মদকে জাগিয়ে তোলেন এবং বোরাক (Buraq) নামক এক অদ্ভুত ডানাওয়ালা প্রাণীতে বসিয়ে মক্কা থেকে জেরুজালেমে নিয়ে যান। বোরাক শব্দটির মূল ‘বারক’ অর্থ বিদ্যুৎ, যা গতির প্রতীক। এই প্রাণীটি ঘোড়াও নয়, গাধাও নয় – বরং এটি মর্ত্য এবং স্বর্গের মধ্যবর্তী এক হাইব্রিড সত্তা। জেরুজালেমে পৌঁছে মুহাম্মদ আব্রাহাম, মোজেস এবং যিশু সহ সকল নবীর সাথে নামাজ পড়েন। এই ঘটনাটি মিথোলজিক্যাল টাইমলাইন বা সময়রেখাকে এক বিন্দুতে নিয়ে আসে, যেখানে অতীত এবং বর্তমানের সকল নবী এক কাতারে দণ্ডায়মান। এরপর শুরু হয় ঊর্ধ্বগমন বা মেরাজ। তিনি সাতটি আসমান বা হেভেন পার হন। প্রতিটি আসমানে তিনি একেকজন বিশিষ্ট নবীর সাক্ষাৎ পান – প্রথম আসমানে আদম, দ্বিতীয় আসমানে যিশু ও জন দ্য ব্যাপ্টিস্ট, তৃতীয় আসমানে ইউসুফ, চতুর্থ আসমানে ইদ্রিস, পঞ্চম আসমানে হারুন, ষষ্ঠ আসমানে মুসা এবং সপ্তম আসমানে আব্রাহাম। এই ক্রমবিন্যাসটি বা হায়ারার্কি অফ প্রফেটস (Hierarchy of Prophets) ইসলামি আধ্যাত্মিকতায় নবীদের মর্যাদা নির্দেশ করে। আব্রাহামকে সপ্তম বা সর্বোচ্চ আসমানে বাইতুল মামুর (স্বর্গীয় কাবা)-এর সাথে হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখা যায়, যা প্রমাণ করে যে ইসলামি ঐতিহ্যে আব্রাহামের অবস্থান কতটা উঁচুতে।
এই যাত্রার পরিসমাপ্তি ঘটে সিদরাতুল মুনতাহা (Sidrat al-Muntaha) বা ‘প্রান্তিক কুলগাছ’-এর কাছে। এটি মহাবিশ্বের শেষ সীমানা, যার ওপারে কোনো সৃষ্টি বা ফেরেশতা যেতে পারে না, এমনকি জিবরাইলও সেখানে থেমে যান। কেবল মুহাম্মদ সেই সীমানা অতিক্রম করে ঈশ্বরের একান্ত সান্নিধ্যে পৌঁছান। এই স্থানটিকে সুফি দর্শনে সৃষ্টি এবং স্রষ্টার মিলনের এক পরম মুহূর্ত হিসেবে দেখা হয়। এখানেই মুহাম্মদকে দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের নির্দেশ দেওয়া হয়। মুসার সাথে মুহাম্মদের কথোপকথন এবং বারবার ঈশ্বরের কাছে ফিরে গিয়ে নামাজের সংখ্যা কমানোর ঘটনাটি আব্রাহামিক মিথোলজির এক চমৎকার মানবিক দিক। এটি মনে করিয়ে দেয় আব্রাহাম কর্তৃক সোডম ও গোমোরার মানুষের জন্য ঈশ্বরের সাথে দর কষাকষির ঘটনাকে। বিখ্যাত স্পেনীয় পণ্ডিত মিগেল আসিন পালাসিওস (Miguel Asín Palacios) তার যুগান্তকারী গবেষণা La Escatología Musulmana en la Divina Comedia-তে দেখিয়েছেন যে, ইতালীয় কবি দান্তে আলিগিয়েরি (Dante Alighieri) তার মহাকাব্য The Divine Comedy-তে নরক ও স্বর্গের যে বিস্তারিত এবং স্তরভিত্তিক বর্ণনা দিয়েছেন, তার সাথে ইসলামি মেরাজের হাদিস এবং ইবনে আরাবীর বর্ণনার বিস্ময়কর মিল রয়েছে। যদিও দান্তে ইসলামকে তার কাব্যে নেতিবাচকভাবে চিত্রিত করেছেন, তবুও সাহিত্যিক কাঠামো বা স্ট্রাকচারাল ইনফ্লুয়েন্সের ক্ষেত্রে মেরাজের প্রভাব অনস্বীকার্য বলে অনেক তুলনামূলক সাহিত্য বিশারদ মনে করেন। মেরাজ কেবল একটি অলৌকিক ভ্রমণ নয়, এটি মানুষের অসীম সম্ভাবনার গল্প – যে মানুষ মাটির তৈরি হয়েও নক্ষত্রের সীমানা ছাড়িয়ে স্বয়ং স্রষ্টার মুখোমুখি হতে পারে।
আধ্যাত্মিক সংগ্রাম এবং শেষ দিবসের মহাকাব্য
ইসলামি মিথোলজিতে জীবনের উদ্দেশ্যকে দেখা হয় এক নিরন্তর সংগ্রাম বা জিহাদ (Jihad) হিসেবে। পশ্চিমা বিশ্বে এই শব্দটি প্রায়শই ভুলভাবে কেবল ‘পবিত্র যুদ্ধ’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়, কিন্তু মিথোলজিক্যাল এবং থিওলজিক্যাল অর্থে এর গভীরতা অনেক বেশি। নবী মুহাম্মদ যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে বলেছিলেন, “আমরা ছোট জিহাদ (যুদ্ধ) থেকে বড় জিহাদ (আত্মশুদ্ধি)-এর দিকে ফিরে এসেছি।” এখানে মানুষের নফস বা রিপুর সাথে যুদ্ধকে বলা হয় জিহাদ আল-আকবর (Greater Jihad)। এটি জোসেফ ক্যাম্পবেলের ‘হিরোজ জার্নি’-র মতোই এক অভ্যন্তরীণ যাত্রা, যেখানে মানুষকে নিজের ভেতরের পশুপ্রবৃত্তি বা ইগোকে দমন করে ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়। ‘ইসলাম’ শব্দের অর্থই হলো আত্মসমর্পণ, আর যিনি আত্মসমর্পণ করেন তিনি হলেন ‘মুসলিম’। এই মিথোলজিতে শয়তান বা ইবলিস কোনো সমান ক্ষমতার প্রতিপক্ষ নয় (যেমনটি জরোয়াস্ট্রিয়ান ধর্মে দেখা যায়), বরং সে কেবল মানুষের মনে কুমন্ত্রণা বা ওয়াসওয়াসা দেওয়ার ক্ষমতাপ্রাপ্ত এক পরীক্ষক। মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা বা ফ্রি উইল (Free Will) এবং ঈশ্বরের পূর্বনির্ধারণ বা কদর (Qadar)-এর মধ্যে যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য, তা ইসলামি দর্শনের এক জটিল অধ্যায়।
আব্রাহামিক মিথোলজির চূড়ান্ত দৃশ্যপট বা ক্লাইম্যাক্স হলো কেয়ামত বা এসকাটোলজি (Eschatology)। ইহুদি এবং খ্রিস্টান ধর্মের মতো ইসলামেও সময়ের একটি রৈখিক বা লিনিয়ার ধারণা আছে – সৃষ্টির শুরু আছে এবং এর একটি নিশ্চিত শেষ আছে। শেষ জমানায় পৃথিবী ভরে যাবে অনাচার, অবিচার এবং মিথ্যায়। তখন আবির্ভাব ঘটবে ইমাম মাহদী (The Mahdi) বা ‘পথপ্রদর্শক’-এর, যিনি মুহাম্মদের বংশধর হবেন এবং পৃথিবীকে ন্যায়বিচারে পূর্ণ করবেন। তার সাথে যোগ দেবেন আকাশ থেকে নেমে আসা ঈসা বা যিশু। তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ হবে আল-মাসিহ আদ-দজ্জাল (Al-Masih ad-Dajjal) বা ‘মিথ্যা মসিহ’। দজ্জাল হবে এক চোখ কানা (আধ্যাত্মিক অন্ধত্বের প্রতীক) এবং সে মানুষকে ভেলকি দেখিয়ে নিজেকে ঈশ্বর দাবি করবে। এই মহাজাগতিক যুদ্ধে দজ্জাল পরাজিত হবে। এরপর প্রাচীর ভেঙে বেরিয়ে আসবে ইয়াজুজ ও মাজুজ (Gog and Magog) নামক বর্বর জাতি, যারা পঙ্গপালের মতো পৃথিবীকে গ্রাস করতে চাইবে। অবশেষে ইসরাফিল ফেরেশতা শিঙ্গায় ফুঁ দেবেন এবং মহাপ্রলয় শুরু হবে। আকাশ ফেটে যাবে, পাহাড়গুলো ধুনো তুলার মতো উড়বে, এবং সমুদ্রগুলো আগুনে পরিণত হবে। এরপর হবে হাশর বা পুনরুত্থান। ইসলামি মিথোলজিতে বিচার দিবসের চিত্রণ অত্যন্ত গ্রাফিক এবং ভীতিপ্রদ। মানুষের আমলনামা বা কর্মের খাতা তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। সবাইকে পার হতে হবে পুল সিরাত (As-Sirat) নামক এক চুলের চেয়েও চিকন এবং তরবারির চেয়েও ধারালো সেতু। যারা পুণ্যবান, তারা বিদ্যুতের গতিতে পার হয়ে যাবে, আর পাপীরা নিচে জাহান্নামের আগুনে পতিত হবে। জান্নাত বা স্বর্গের বর্ণনা ইসলামে অত্যন্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য – দুধ ও মধুর নহর, সুশীতল ছায়া এবং অনন্ত যৌবন – যা মরুভূমির মানুষের কাছে পরম আকাঙ্ক্ষিত শান্তির প্রতীক। অন্যদিকে জাহান্নামের আগুন এবং যন্ত্রণার বর্ণনা মানুষকে নৈতিকভাবে সৎ থাকার জন্য এক অনন্ত সতর্কবার্তা দেয়। এভাবে, ‘শেষ মোহর’ হিসেবে ইসলাম আব্রাহামিক মিথোলজির বৃত্তটি সম্পন্ন করে – আদমের স্বর্গচ্যুতি দিয়ে যে গল্পের শুরু হয়েছিল, জান্নাতে মানুষের প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমেই তার পরিসমাপ্তি ঘটে।
অতিপ্রাকৃত জগত: ফেরেশতা, জিন এবং শয়তান (Angelology and Demonology)
আব্রাহামিক মিথোলজির মহাবিশ্ব কেবল দৃশ্যমান জগত, রক্ত-মাংসের মানুষ আর এক অসীম ঈশ্বরের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই মহাজাগতিক নাটমঞ্চের নেপথ্যে এবং মানুষের চোখের আড়ালে রয়েছে এক বিশাল, জটিল এবং কোলাহলপূর্ণ অতিপ্রাকৃত জগত। ইহুদি, খ্রিস্টান এবং ইসলাম – তিনটি ধর্মেই এই অদৃশ্য সত্তাদের উপস্থিতি কেবল বিশ্বাসের অংশ নয়, বরং কসমোলজি বা সৃষ্টিতত্ত্বের অপরিহার্য উপাদান। ঈশ্বর হলেন ট্রান্সসেন্ডেন্ট (Transcendent) বা ধরাছোঁয়ার বাইরের এক সত্তা, আর মানুষ হলো নশ্বর ও সীমাবদ্ধ। এই দুই মেরুর মাঝখানে সংযোগ স্থাপনের জন্য প্রয়োজন একদল মধ্যস্থতাকারীর, যারা ঈশ্বরের আদেশ বহন করবে এবং মহাবিশ্বের ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করবে। থিওলজির ভাষায় একে বলা হয় গ্রেট চেইন অফ বিইং (Great Chain of Being) বা অস্তিত্বের মহৃঙ্খল, যেখানে ঈশ্বর সবার ওপরে, তারপর ফেরেশতা, এরপর মানুষ এবং সর্বশেষে অন্যান্য প্রাণী। আব্রাহামিক ধর্মে এই অদৃশ্য জগতকে বলা হয় আল-গায়েব (Al-Ghaib) বা অদৃশ্যের জগত। আধুনিক বিজ্ঞান যেমন ডার্ক ম্যাটার বা ডার্ক এনার্জি দিয়ে মহাবিশ্বের শূন্যস্থান পূরণ করে, ঠিক তেমনি মিথোলজি এই শূন্যস্থান পূরণ করে ফেরেশতা, জিন এবং শয়তানের মতো সত্তা দিয়ে। এরা মানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে – কখনও রক্ষাকর্তা হিসেবে, কখনও বা পরীক্ষক বা প্রলুব্ধকারী হিসেবে। এদের জগতটা আমাদের জগতের সমান্তরালে চলে, ঠিক যেন আয়নার ওপাশের এক রহস্যময় প্রতিবিম্ব।
স্বর্গীয় আমলাতন্ত্র: ফেরেশতা বা এঞ্জেলস
ফেরেশতা বা এঞ্জেলস (Angels) আব্রাহামিক মিথোলজির সবচেয়ে বিশুদ্ধ এবং পবিত্রতম সৃষ্টি। হিব্রু শব্দ ‘মালাখ’ (Malakh) এবং আরবি শব্দ ‘মালাক’ (Malak)-এর আক্ষরিক অর্থ হলো ‘বার্তাবাহক’। গ্রিক শব্দ ‘এঞ্জেলোস’ (Angelos) থেকেও একই অর্থের উৎপত্তি। মিথোলজিক্যাল বর্ণনা অনুযায়ী, এদের সৃষ্টি হয়েছে বিশুদ্ধ আলো বা নূর (Nur) থেকে (ইসলামি মতে), অথবা ঈশ্বরের নিঃশ্বাস বা পবিত্র আগুন থেকে (ইহুদি ও খ্রিস্টান মতে)। এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এরা পাপমুক্ত এবং ঈশ্বরের আদেশের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত। তবে এখানে একটি সূক্ষ্ম দার্শনিক পার্থক্য আছে। ইসলামি বিশ্বাস মতে, ফেরেশতাদের নিজস্ব কোনো স্বাধীন ইচ্ছা বা ফ্রি উইল (Free Will) নেই; তারা অনেকটা কম্পিউটারের কোডের মতো – যাকে যে কাজের জন্য প্রোগ্রাম করা হয়েছে, সে কেবল সেটাই করতে পারে, এর বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা বা ইচ্ছা তাদের নেই। অন্যদিকে, খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বে বিশ্বাস করা হয় যে ফেরেশতাদেরও স্বাধীন ইচ্ছা ছিল, যার কারণেই লুসিফার বা শয়তান বিদ্রোহ করতে পেরেছিল এবং একদল ফেরেশতা তার সাথে ফলেন এঞ্জেলস (Fallen Angels) বা পতিত ফেরেশতায় পরিণত হয়েছিল। পঞ্চম বা ষষ্ঠ শতাব্দীর রহস্যময় ধর্মতাত্ত্বিক সিউডো-ডায়োনিসিয়াস দ্য অ্যারিওপাগাইট (Pseudo-Dionysius the Areopagite) তার বিখ্যাত বই The Celestial Hierarchy-তে ফেরেশতাদের নয়টি স্তরের এক জটিল সিলেস্টিয়াল হায়ারার্কি (Celestial Hierarchy) বা স্বর্গীয় ক্রমবিন্যাসের বর্ণনা দিয়েছেন। এই স্তরগুলো হলো – সেরাফিম (ঈশ্বরের সবচেয়ে কাছের, আগুনের তৈরি), চেরুবিম (জ্ঞানের ধারক), থ্রোন্স, ডোমিনিয়নস, ভার্চুস, পাওয়ারস, প্রিন্সিপালিটিস, আর্চএঞ্জেলস এবং সাধারণ এঞ্জেলস। এই ক্রমবিন্যাস মধ্যযুগীয় শিল্প ও সাহিত্যে গভীর প্রভাব ফেলেছিল এবং স্বর্গের দরবারকে একটি সুশৃঙ্খল রাজকীয় আদালতের রূপ দিয়েছিল।
ফেরেশতাদের জগতটি কেবল গুণগান গাওয়ার জন্য নয়, বরং এটি একটি অত্যন্ত ব্যস্ত ‘কসমিক ব্যুরোক্রেসি’ বা মহাজাগতিক আমলাতন্ত্র। এখানে প্রধান চারজন ফেরেশতা বা আর্চএঞ্জেল (Archangel) চারটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের দায়িত্বে আছেন।
- গ্যাব্রিয়েল বা জিবরাইল (Gabriel/Jibrail): ইনি হলেন ওহী বা প্রত্যাদেশ বিভাগের প্রধান। তাকে বলা হয় রুহুল কুদুস (Holy Spirit) বা পবিত্র আত্মা। আব্রাহামিক ইতিহাসের প্রতিটি সন্ধিক্ষণে – দানিয়েল নবীর দর্শনে, মেরির কাছে যিশুর জন্মের সুসংবাদ নিয়ে, কিংবা হেরা গুহায় মুহাম্মদের কাছে কুরআনের বাণী নিয়ে – তিনিই আবির্ভূত হয়েছেন। ইসলামি বর্ণনায় তার রূপ অত্যন্ত বিশাল ও মহিমান্বিত, যার ছয়শোটি ডানা দিগন্তের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ঢেকে রাখে।
- মাইকেল বা মিকাইল (Michael/Mikail): ইনি হলেন মহাজাগতিক সেনাবাহিনীর প্রধান এবং প্রকৃতির শক্তির নিয়ন্ত্রক। ইহুদি মিথোলজিতে তিনি ইস্রায়েলের রক্ষাকর্তা। ইসলামি মতে, তিনি বৃষ্টি, বাতাস এবং জীবিকার (রিজিক) দায়িত্বে নিয়োজিত। তিনি ঈশ্বরের দয়ার প্রতীক, যিনি কখনও হাসেন না বলে জনশ্রুতি আছে (কারণ নরক সৃষ্টির পর তিনি আর হাসেননি)।
- আজরাইল বা মালাক আল-মউত (Azrael/Malak al-Maut): ইনি মৃত্যুর ফেরেশতা। যদিও বাইবেল বা কুরআনে ‘আজরাইল’ নামটি সরাসরি নেই (লোককথা ও এক্সিজেসিস থেকে এসেছে), কিন্তু এই চরিত্রটি মানুষের মনে সবচেয়ে বেশি ভীতি ও সমীহের সঞ্চার করে। তিনি কোনো খলনায়ক নন, বরং ঈশ্বরের একনিষ্ঠ ভৃত্য যিনি প্রাণের পাখিটিকে দেহখাঁচা থেকে মুক্ত করে নিয়ে যান। তার দেহ অগণিত চোখ ও জিহ্বা দিয়ে আবৃত বলে কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায়, যা সর্বদর্শিতার প্রতীক।
- রাফায়েল বা ইসরাফিল (Raphael/Israfil): ইনি হলেন মহাজাগতিক সিগন্যালম্যান। তার কাজ হলো শিঙ্গায় বা ট্রাম্পেটে ফুঁ দেওয়া। তিনি সৃষ্টির শুরু থেকে শিঙ্গা মুখে নিয়ে অপেক্ষা করছেন ঈশ্বরের আদেশের জন্য। তার ফুঁক দিলেই মহাবিশ্বের সমাপ্তি বা কেয়ামত শুরু হবে। ইহুদি ও খ্রিস্টান ঐতিহ্যে তাকে আরোগ্যের ফেরেশতা বা হিলার (Healer) হিসেবেও দেখা হয়।
এছাড়াও মুনকার ও নাকির (কবরের প্রশ্নকারী), কিরামান-কাতিবিন (কাঁধের লেখক যারা মানুষের পাপ-পুণ্য লেখেন), এবং রিদওয়ান ও মালিক (যথাক্রমে স্বর্গ ও নরকের প্রহরী) – এরা প্রত্যেকেই এই বিশাল প্রশাসনিক ব্যবস্থার অংশ। ফেরেশতাদের এই উপস্থিতি মানুষকে এক ধরণের ‘ডিভাইন সার্ভিল্যান্স’ বা ঐশ্বরিক নজরদারির মধ্যে রাখে, যা মানুষের নৈতিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
সমান্তরাল সত্তা: জিন বা ধোঁয়াবিহীন আগুন
আব্রাহামিক মিথোলজির মধ্যে ইসলামি শাখায় এক অনন্য এবং বৈচিত্র্যময় সংযোজন হলো জিন (Jinn)। ইহুদি বা খ্রিস্টান মূলধারার ধর্মতত্ত্বে জিনের সরাসরি কোনো ধারণা নেই (সেখানে যা আছে তা হলো ডিমন বা অশুভ আত্মা), কিন্তু ইসলামে এবং প্রাক-ইসলামিক আরব লোককথায় জিন একটি স্বতন্ত্র এবং বিশাল অধ্যায়। ‘জিন’ শব্দটির উৎপত্তি আরবি ‘জান্না’ থেকে, যার অর্থ ‘লুকানো’ বা ‘আড়ালে থাকা’। মিথোলজিক্যাল বায়োলজি বা সৃষ্টিতত্ত্ব অনুযায়ী, ফেরেশতারা আলোর তৈরি, মানুষ মাটির তৈরি, আর জিন তৈরি হয়েছে মারিজ (Marij) বা ‘ধোঁয়াবিহীন আগুন’ (Smokeless Fire) থেকে। এই আগুনের প্রকৃতিই তাদের চঞ্চল, অদৃশ্য এবং রূপবদলকারী বা শেপ-শিফটার (Shape-shifter) করে তুলেছে। জিনের ধারণাটি মানুষের অস্তিত্বের এক কৌতূহলোদ্দীপক সমান্তরাল। মানুষের মতোই তাদের স্বাধীন ইচ্ছা বা ফ্রি উইল (Free Will) আছে, যার ফলে তারাও মানুষের মতো ভালো বা খারাপ হতে পারে। তাদের নিজস্ব সমাজ আছে, রাজা-প্রজা আছে, বিয়ে-শাদী হয়, সন্তান জন্ম নেয় এবং মৃত্যুও হয়। এমনকি তাদের মধ্যেও বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী (মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান বা নাস্তিক) জিন থাকতে পারে। এই দিক থেকে তারা ফেরেশতাদের চেয়ে মানুষের অনেক বেশি কাছাকাছি।
লোককথা এবং ধর্মীয় বর্ণনায় জিনদের পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয় – জান (সাধারণ জিন), জিন (বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন), শয়তান (অবাধ্য ও দুষ্ট), ইফরিত (অত্যন্ত শক্তিশালী ও ধূর্ত) এবং মারিদ (সবচেয়ে বিশাল ও ধ্বংসাত্মক)। সলোমন বা সুলাইমান নবীর কাহিনীতে জিনদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সলোমনকে ঈশ্বর এমন ক্ষমতা দিয়েছিলেন যে তিনি জিনদের বশ করতে পারতেন এবং তাদের দিয়ে বিশাল ইমারত, ডুবুরির কাজ এবং ভারী কাজ করাতেন। এই কাহিনীটি পরবর্তীকালে আরব্য রজনী (One Thousand and One Nights) এবং পশ্চিমা সাহিত্যের ‘জিনি ইন দ্য ল্যাম্প’ ধারণার জন্ম দেয়। তবে পপ কালচারের নীল রঙের জাদুর জিনের চেয়ে ধর্মীয় জিনের ধারণা অনেক বেশি গম্ভীর। ইসলামি বিশ্বাসে প্রতিটি মানুষের সাথে একটি করে জিন সঙ্গী থাকে, যাকে বলা হয় কারিন (Qareen)। এই কারিন মানুষকে খারাপ কাজের দিকে প্ররোচিত করে। জিনরা সাধারণত মানুষের পরিত্যক্ত স্থান, মরুভূমি, কবরস্থান বা নোংরা জায়গায় বাস করে। তারা মানুষের জীবনে হস্তক্ষেপ করতে পারে, যাকে সাধারণ ভাষায় ‘আছর করা’ বা পজেশন (Possession) বলা হয়। জিনের এই অস্তিত্ব মানুষের মনে এক ধরণের ভীতিমিশ্রিত রোমাঞ্চ তৈরি করে – আমরা এই পৃথিবীতে একা নই, আমাদের পাশেই অদৃশ্য কেউ হয়তো আমাদের দেখছে, কিন্তু আমরা তাকে দেখছি না। আধুনিক যুগে অনেকে এই জিনদের প্যারালাল ইউনিভার্স বা ভিন্ন ডাইমেনশনের সত্তা হিসেবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন, যা মিথোলজির অভিযোজন ক্ষমতারই প্রমাণ।
অহংকারের পতন: ইবলিস এবং শয়তানের মনস্তত্ত্ব
অতিপ্রাকৃত জগতের সবচেয়ে ট্র্যাজিক এবং জটিল চরিত্রটি হলো শয়তান বা ডেভিল (The Devil)। হিব্রু শব্দ ‘হা-সাতান’ (ha-satan)-এর মূল অর্থ ছিল ‘প্রতিবন্ধক’ বা ‘আইনজীবী’ (Prosecutor) – যে ঈশ্বরের আদালতে মানুষের ভণ্ডামি ধরিয়ে দিত। জিব বা ইয়োব (Job) নবীর পুস্তকে আমরা এই সত্তাকে দেখি ঈশ্বরের অনুমতিক্রমে ইয়োবকে পরীক্ষা করতে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে, বিশেষ করে পারস্যের জরোয়াস্ট্রিয়ান ডুয়ালিজম (Zoroastrian Dualism) বা দ্বৈতবাদের প্রভাবে, শয়তান কেবল একজন অভিযোগকারী থেকে ঈশ্বরের প্রতিপক্ষ বা অ্যাডভারসারি (Adversary)-তে পরিণত হয়। ইসলামি মিথোলজিতে শয়তানের নাম ইবলিস (গ্রিক ‘Diabolos‘ থেকে আগত হতে পারে), এবং তার পতনের গল্পটি অত্যন্ত মনস্তাত্ত্বিক। ইবলিস ছিল এক জিন (হাসান আল-বসরির মতে) অথবা ফেরেশতাদের মধ্যে অত্যন্ত উচ্চপদস্থ এক সত্তা (ইবনে আব্বাসের মতে), যে তার ইবাদতের মাধ্যমে ফেরেশতাদের স্তরে উন্নীত হয়েছিল। কিন্তু সংকট তৈরি হলো যখন ঈশ্বর আদমকে সৃষ্টি করলেন। মাটির তৈরি এই নতুন প্রাণীকে দেখে ইবলিস ঈর্ষান্বিত হলো। ঈশ্বর যখন সবাইকে আদেশ দিলেন আদমকে সিজদা বা সম্মান জানাতে, তখন সবাই মাথা নত করল, কেবল ইবলিস ছাড়া।
ইবলিসের এই অবাধ্যতার কারণ অবিশ্বাস ছিল না, বরং ছিল হিউব্রিস (Hubris) বা চরম অহংকার এবং এক ধরণের বর্ণবাদী যুক্তি। সে ঈশ্বরকে বলল, “আমি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে আগুন দিয়ে সৃষ্টি করেছেন আর তাকে মাটি দিয়ে।” (কুরআন ৭:১২)। আগুন মাটির চেয়ে ঊর্ধ্বে ওঠে, তাই আগুনের তৈরি সত্তা মাটির কাছে মাথা নত করবে না – এই ছিল তার যুক্তি। এই প্রত্যাখ্যানের কারণে সে ঈশ্বরের রহমত থেকে বিতাড়িত হলো এবং তার নাম হলো ‘শয়তান‘ (যার অর্থ ‘দূরে সরে যাওয়া’)। জন মিল্টন তার মহাকাব্য Paradise Lost-এ শয়তানের এই পতনকে এক মহাকাব্যিক রূপ দিয়েছেন। মিল্টনের শয়তান এক বিদ্রোহী নায়ক, যে ঘোষণা করে, “স্বর্গে দাসত্ব করার চেয়ে নরকে রাজত্ব করা শ্রেয়” (Better to reign in Hell, than serve in Heaven)। আধুনিক সাহিত্য সমালোচকরা, যেমন উইলিয়াম এম্পসন, মিল্টনের শয়তানের মধ্যে এক ধরণের গণতান্ত্রিক বিদ্রোহের ছায়া দেখেছেন, যদিও ধর্মতাত্ত্বিকভাবে সে মন্দের প্রতীক। আব্রাহামিক ধর্মে শয়তান কোনো ‘এন্টি-গড’ বা ঈশ্বরের সমান ক্ষমতার অধিকারী প্রতিপক্ষ নয় (যা মানিকেইজম বা দ্বৈতবাদে দেখা যায়); বরং সে ঈশ্বরের সৃষ্টি এবং ঈশ্বরের অনুমতিক্রমেই সে মানুষকে পরীক্ষা করে। তার ক্ষমতা কেবল প্ররোচনা বা কুমন্ত্রণা (ওয়াসওয়াসা) দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ; সে কাউকে জোর করে পাপ করাতে পারে না।
ডিমনোলজি: অশুভ শক্তির সমীকরণ
ফেরেশতা এবং জিনের পাশাপাশি অশুভ শক্তির জগত বা ডিমনোলজি (Demonology) আব্রাহামিক মিথোলজির এক অন্ধকার অধ্যায়। খ্রিস্টান ঐতিহ্যে ডিমনরা মূলত সেই সব ফলেন এঞ্জেলস (Fallen Angels) বা পতিত ফেরেশতা, যারা লুসিফারের সাথে বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল এবং স্বর্গ থেকে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। সেন্ট অগাস্টিন এবং টমাস অ্যাকুইনাসের মতো ধর্মতাত্ত্বিকরা এদের নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। মধ্যযুগীয় গ্রিমোয়ার বা জাদুর বইগুলোতে (যেমন – The Lesser Key of Solomon) ৭২ জন প্রধান ডিমনের নাম ও কাজের বিবরণ পাওয়া যায়, যা তৎকালীন মানুষের কুসংস্কার এবং ভয়ের জগতকে প্রতিফলিত করে। ইসলামি মতে, শয়তানের অনুসারী দুষ্ট জিনরাই হলো শয়তান বা ডিমন। এরা মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারে, মানুষকে পাগল করতে পারে এবং যাদুবিদ্যায় সাহায্য করতে পারে। ইহুদি লোককথায় (কাবালাহ এবং তালমুদ) লিলিথ (Lilith), আজাজেল (Azazel) এবং সামায়েল (Samael)-এর মতো শক্তিশালী ডিমনিক সত্তার উল্লেখ আছে। বিশেষ করে ‘ডিব্বুক’ (Dybbuk) নামক এক অশুভ আত্মার ধারণা ইহুদি মরমিবাদে প্রবল, যা জীবিত মানুষের শরীরে আশ্রয় নেয়।
এই অতিপ্রাকৃত জগত – ফেরেশতার পবিত্রতা, জিনের রহস্যময়তা এবং শয়তানের প্রলোভন – মূলত মানুষের নৈতিক সংগ্রামের এক বহিঃপ্রকাশ। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ জেফরি বার্টন রাসেল (Jeffrey Burton Russell) তার বই The Devil: Perceptions of Evil from Antiquity to Primitive Christianity-তে দেখিয়েছেন যে, মানুষ যুগে যুগে নিজের ভেতরের অশুভ প্রবৃত্তি এবং জাগতিক অমঙ্গলকে ব্যাখ্যা করার জন্যই শয়তান বা ডিমনের অবয়ব তৈরি করেছে। আবার ঈশ্বরের অসীম দয়া এবং সুরক্ষার অনুভূতিকে মূর্ত করার জন্য সে ফেরেশতাদের কল্পনা করেছে। আব্রাহামিক মিথোলজিতে এই সত্তারা তাই কেবল রূপকথা নয়; এরা হলো থিওডিসি (Theodicy) বা ঈশ্বরের ন্যায়বিচারের ধারণার অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঈশ্বর কেন পৃথিবীতে অশুভকে থাকতে দিলেন? শয়তানের অস্তিত্ব সেই প্রশ্নেরই উত্তর দেয় – পরীক্ষা ছাড়া পুরস্কারের কোনো মূল্য নেই, এবং অন্ধকার ছাড়া আলোর কোনো অস্তিত্ব নেই। ফেরেশতা, জিন এবং শয়তান – এই ত্রয়ী সত্তা মিলে মানুষের আধ্যাত্মিক যাত্রাপথকে করে তুলেছে কণ্টকাকীর্ণ অথচ রোমাঞ্চকর।
রহস্যবাদ: সুফিজম, কাবালাহ এবং নস্টিসিজম (Mysticism: Sufism, Kabbalah, and Gnosticism)
আব্রাহামিক ধর্মগুলোর বাহ্যিক কাঠামো সাধারণত আইন, অনুশাসন, এবং আচার-অনুষ্ঠানের ওপর ভিত্তি করে দণ্ডায়মান। ইহুদি ধর্মে হালাখা, খ্রিস্টান ধর্মে ক্যানন ল এবং ইসলামে শরীয়ত – এই সবই মানুষের সামাজিক ও নৈতিক জীবনকে সুশৃঙ্খল করার জন্য তৈরি। কিন্তু এই বাহ্যিক খোলস বা এক্সোটেরিসিজম (Exotericism)-এর ভেতরে সবসময়ই একটি অন্তঃসলিলা ফল্গুধারা প্রবাহিত ছিল, যাকে বলা হয় এসোটেরিসিজম (Esotericism) বা গূঢ় রহস্যবাদ। সাধারণ বিশ্বাসীরা যেখানে ঈশ্বরকে রাজা বা বিচারক হিসেবে দেখে এবং তার আদেশ পালন করে স্বর্গে যাওয়ার আশা করে, রহস্যবাদীরা বা মিস্টিকরা সেখানে ঈশ্বরকে প্রেমিক বা পরম সত্তা হিসেবে দেখে এবং এই জীবনেই তার সাথে মিলিত হতে চায়। আব্রাহামিক মিথোলজির এই ধারাটি মনে করে যে, ধর্মগ্রন্থের প্রতিটি শব্দের পেছনে লুকিয়ে আছে অসীম রহস্য, যা কেবল দীক্ষাপ্রাপ্ত বা আধ্যাত্মিকভাবে উন্নতরাই ভেদ করতে পারে। এখানে ঈশ্বর কোনো দূরবর্তী সত্তা নন, বরং তিনি মানুষের আত্মার গভীরে বা সৃষ্টির প্রতিটি অণুতে বিদ্যমান এক বাস্তবতা, যাকে যুক্তি দিয়ে নয়, বরং অভিজ্ঞতা বা ইনটিউশন (Intuition) দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। কাবালাহ, নস্টিসিজম এবং সুফিজম – এই তিনটি ধারা যদিও ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে বিকশিত হয়েছে, তবুও তাদের মূল সুর এক: বস্তুজগতের মায়াজাল ভেদ করে উৎসের দিকে ফিরে যাওয়া।
কাবালাহ: অসীমের মানচিত্র এবং সৃষ্টির জ্যামিতি
ইহুদি মরমীবাদ বা কাবালাহ (Kabbalah) আব্রাহামিক রহস্যবাদের অন্যতম প্রাচীন এবং জটিল শাখা। হিব্রু শব্দ ‘কাবালাহ’-এর অর্থ হলো ‘গ্রহণ করা’ (To Receive), যা ইঙ্গিত করে যে এই জ্ঞান কোনো বই পড়ে অর্জন করা যায় না, বরং এটি গুরু-শিষ্য পরম্পরায় বা ওরাল ট্র্যাডিশনের মাধ্যমে গ্রহণ করতে হয়। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে দক্ষিণ ফ্রান্সে এবং স্পেনে এই ধারার বিকাশ ঘটে, যার মূল ভিত্তি হলো জোহর (The Zohar) বা ‘দীপ্তি’ নামক একটি রহস্যময় গ্রন্থ। কাবালাহিস্টরা বিশ্বাস করেন, তোরাহ বা হিব্রু বাইবেল কেবল কিছু ঐতিহাসিক গল্প বা আইনের সমষ্টি নয়। তোরাহ-র প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি স্পেস এবং প্রতিটি সংখ্যা হলো ঈশ্বরেরই একেকটি কোড বা সংকেত। হিব্রু বর্ণমালার প্রতিটি অক্ষরের একটি করে গাণিতিক মান আছে, এবং এই মান বিশ্লেষণ করে শব্দের গোপন অর্থ বের করার পদ্ধতিকে বলা হয় জেমেট্রিয়া (Gematria)। কাবালাহর দর্শনে ঈশ্বরকে বলা হয় এইন সোফ (Ein Sof), যার অর্থ হলো ‘অসীম’ বা ‘অন্তহীন’। এই এইন সোফ হলেন নিরাকার, গুণহীন এবং মানুষের বোধগম্যতার সম্পূর্ণ বাইরে। প্রশ্ন হলো, এই অসীম এবং নিরাকার সত্তা থেকে কীভাবে এই সসীম এবং বস্তুগত মহাবিশ্বের সৃষ্টি হলো?
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কাবালাহিস্টরা সেফিরাত (Sefirot) বা দশটি ডিভাইন এমানেশনের ধারণা প্রবর্তন করেন। এই দশটি সেফিরাত হলো ঈশ্বরের গুণাবলী বা শক্তির দশটি চ্যানেল, যার মাধ্যমে অসীম ঈশ্বর সসীম জগতে নিজেকে প্রকাশ করেন। এদেরকে একটি বিশেষ জ্যামিতিক নকশায় সাজানো হয়, যাকে বলা হয় ট্রি অফ লাইফ (Tree of Life) বা জীবনবৃক্ষ। এই বৃক্ষের শীর্ষে থাকে ‘কেতের’ (মুকুট), এবং নিচে থাকে ‘মালখুত’ (রাজ্য), যা আমাদের এই ভৌত জগত। এই দশটি সেফিরাতের ভারসাম্যপূর্ণ মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমেই মহাবিশ্ব টিকে আছে। ষোড়শ শতাব্দীর বিখ্যাত কাবালাহিস্ট আইজ্যাক লুরিয়া (Isaac Luria) এই সৃষ্টিতত্ত্বকে আরও নাটকীয় রূপ দেন। তার লুরিয়ানিক কাবালাহ (Lurianic Kabbalah) তত্ত্বে বলা হয়, সৃষ্টির শুরুতে ঈশ্বরের আলো এত তীব্র ছিল যে, তা ধারণ করতে না পেরে মহাজাগতিক পাত্রগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। একে বলা হয় শেভিরাত হাকেলিম (Shevirat HaKelim) বা ‘পাত্রের ভঙুরতা’। এই ভাঙা পাত্রের টুকরোগুলো এবং ঈশ্বরের পবিত্র আলোর স্ফুলিঙ্গ বা ডিভাইন স্পার্ক (Divine Spark) আমাদের এই অপূর্ণ জগতে ছড়িয়ে আছে। মানুষের কাজ হলো ভালো কাজ এবং প্রার্থনার মাধ্যমে সেই স্ফুলিঙ্গগুলোকে উদ্ধার করা এবং ভেঙে যাওয়া জগতকে মেরামত করা। এই মেরামত করার প্রক্রিয়াকেই বলা হয় টিক্কুন ওলাম (Tikkun Olam) বা ‘বিশ্বের সংশোধন’। অর্থাৎ, কাবালাহ মতে মানুষ কেবল ঈশ্বরের দাস নয়, সে ঈশ্বরের সৃষ্টি প্রক্রিয়ার অংশীদার।
নস্টিসিজম: নিষিদ্ধ জ্ঞান এবং বিদ্রোহী ঈশ্বরতত্ত্ব
খ্রিস্টান ধর্মের একদম শুরুর দিকে, যখন চার্চ তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি, তখন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে এমন কিছু আধ্যাত্মিক গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল যারা যিশুর বাণীকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করত। এদেরকে বলা হয় নস্টিক (Gnostic), গ্রিক শব্দ ‘নসিস’ (Gnosis) থেকে যার উৎপত্তি, যার অর্থ হলো ‘গূঢ় জ্ঞান’ বা ‘ইনসাইট’। ১৯৪৫ সালে মিশরের নাগ হাম্মাদি নামক স্থানে মাটির নিচ থেকে উদ্ধার করা প্রাচীন প্যাপিরাস পান্ডুলিপি, যা নাগ হাম্মাদি লাইব্রেরি (Nag Hammadi Library) নামে পরিচিত, পাওয়ার আগ পর্যন্ত নস্টিসিজম সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানতাম। গসপেল অফ থমাস (The Gospel of Thomas) বা এপোক্রিফন অফ জন (Apocryphon of John)-এর মতো টেক্সটগুলো আমাদের দেখায় যে, নস্টিকরা বাইবেলের ঈশ্বর এবং জগত সম্পর্কে এক বৈপ্লবিক এবং কিঞ্চিৎ হতাশাবাদী ধারণা পোষণ করত। তারা বিশ্বাস করত যে, আমাদের এই দৃশ্যমান পৃথিবীটা কোনো দয়ালু ঈশ্বরের সৃষ্টি নয়, বরং এটি একটি ভুল, একটি কারাগার বা ট্র্যাপ। এই কারাগারটি তৈরি করেছেন একজন নিচু স্তরের, অজ্ঞ এবং অহংকারী দেবতা, যাকে তারা নাম দিয়েছিল ডেমিয়ার্জ (Demiurge)। এই ডিমায়ার্জ নিজেকেই একমাত্র ঈশ্বর বলে মনে করেন এবং ওল্ড টেস্টামেন্টের ঈর্ষাপরায়ণ ও রাগী ঈশ্বর ‘ইয়াহওয়ে‘ আসলে এই ডেমিয়ার্জের প্রতিচ্ছবি।
নস্টিক মিথোলজি অনুযায়ী, প্রকৃত সর্বোচ্চ ঈশ্বর বা মোনাড (Monad) এই মহাবিশ্বের ধরাছোঁয়ার বাইরে এক অছ্যুৎ সত্তা। ডেমিয়ার্জ অজ্ঞতাবশত মানুষের দেহে প্রকৃত ঈশ্বরের কিছু আলোককণা বা আত্মা আটকে রেখেছে। মানুষ ভুলে গেছে তার আসল ঘর কোথায়; সে এই মাটির দেহ এবং জাগতিক মোহমায়ায় আটকা পড়ে আছে। এই অবস্থা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় বিশ্বাস বা ভক্তি নয়, বরং জ্ঞান বা নসিস। যিশু খ্রিস্ট নস্টিসিজমে পাপের প্রায়শ্চিত্তকারী বলি নন, বরং তিনি হলেন সেই দিব্য জ্ঞানের বার্তাবাহক, যিনি আলোর জগত থেকে নেমে এসেছেন মানুষকে তার আসল পরিচয় – যে সে ঈশ্বরেরই একটি অংশ – তা মনে করিয়ে দিতে। নস্টিকরা মনে করত, যিশুর কোনো রক্ত-মাংসের শরীর ছিল না (যাকে ডসেটিজম (Docetism) বলা হয়), কারণ পবিত্র ঈশ্বর কখনোই দূষিত ‘ম্যাটার’ বা বস্তুর সংস্পর্শে আসতে পারেন না। তারা বাইবেলের ইভ বা হাওয়া এবং সাপকে নেতিবাচকভাবে দেখত না; বরং তাদের মতে সাপটি ছিল জ্ঞানের প্রতীক, যে মানুষকে ডেমিয়ার্জের অন্ধত্ব থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিল। প্রাতিষ্ঠানিক চার্চ বা অর্থোডক্সি এই মতবাদকে ‘হেরাসি’ বা ধর্মদ্রোহিতা বলে নিষিদ্ধ করেছিল, কারণ এটি চার্চের কর্তৃত্ব এবং যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ঐতিহাসিকতাকে অস্বীকার করত। ধর্মতত্ত্ববিদ ইলেং পেগেলস (Elaine Pagels) তার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, নস্টিসিজম ছিল মূলত একটি আধ্যাত্মিক বিদ্রোহ, যা অন্ধ বিশ্বাসের পরিবর্তে নিজস্ব অভিজ্ঞতার ওপর জোর দিত।
সুফিজম: প্রেমের আগুন এবং বিলীন হওয়ার সাধনা
ইসলামের কঠোর একেশ্বরবাদ এবং শরীয়তের আইনের কাঠামোর ভেতরেই জন্ম নিয়েছে এক সুগভীর প্রেমময় ধারা, যা সুফিজম (Sufism) বা ‘তাসাউফ’ নামে পরিচিত। অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে যখন ইসলামি সাম্রাজ্য ধনসম্পদ এবং বিলাসিতায় মগ্ন, তখন একদল মানুষ পার্থিব ভোগবিলাস ত্যাগ করে পশমের (আরবিতে ‘সুফ’) মোটা কাপড় পরে মরুভূমিতে বা নির্জনে ঈশ্বরের ধ্যানে মগ্ন হতেন – এখান থেকেই ‘সুফি’ নামের উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়। সুফিদের মতে, শরীয়ত হলো ধর্মের দেহ, আর তাসাউফ হলো তার আত্মা বা হৃৎপিণ্ড। তারা ধর্মের যাত্রাপথকে তিনটি স্তরে ভাগ করেন: শরীয়ত (আইন), তরিকত (পথ), এবং হাকিকত (সত্য)। শরীয়ত বলে, “তোমারটা তোমার, আমারটা আমার”; তরিকত বলে, “আমারটা তোমার, তোমারটা তোমার”; আর হাকিকত বলে, “না আমার আছে, না তোমার আছে – সবই ঈশ্বরের।” সুফি দর্শনের কেন্দ্রে রয়েছে ঈশ্বরের প্রতি এক সর্বগ্রাসী ভালোবাসা বা ইশক (Ishq)। এখানে ঈশ্বরকে দেখা হয় ‘প্রিয়তম’ বা বিলাভড (Beloved) হিসেবে। রাবিয়া আল-বসরী (Rabia Basri)-র মতো প্রাথমিক যুগের সুফিরা বেহেশতের লোভ বা দোযখের ভয়ে ইবাদত করাকে ঘৃণা করতেন; তারা বলতেন, “হে আল্লাহ, আমি যদি নরকের ভয়ে তোমার পূজা করি, তবে আমাকে নরকে পোড়াও; আর যদি স্বর্গের লোভে করি, তবে স্বর্গ আমার জন্য নিষিদ্ধ করো। আমি কেবল তোমাকে পাওয়ার জন্য তোমার ইবাদত করি।”
ত্রয়োদশ শতাব্দীর পারস্যের কবি এবং সুফি সাধক জালালুদ্দিন রুমি (Jalaluddin Rumi) সুফিজমকে বিশ্বজনীন রূপ দিয়েছেন। তার বিখ্যাত মসনভি (Masnavi)-র শুরুতেই তিনি বাঁশের বাঁশির (Ney) রূপক ব্যবহার করেছেন। বাঁশঝাড় থেকে কেটে আনা বাঁশি যেমন তার মূলের জন্য হাহাকার করে সুর তোলে, তেমনি মানুষের আত্মাও তার উৎস বা ঈশ্বরের থেকে বিচ্ছিন্নের বেদনায় কাঁদে। সুফিজমের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ফানা (Fana) বা ঈশ্বরে বিলীন হয়ে যাওয়া। যেমন এক ফোঁটা জল সমুদ্রে পড়লে তার আলাদা কোনো অস্তিত্ব থাকে না, তেমনি সুফি সাধনায় মানুষের ‘নফস’ বা অহং পুড়ে ছাই হয়ে যায় এবং সে ঈশ্বরের সত্তায় লীন হয়ে যায়। এই অবস্থাকেই বলা হয় বাকা (Baqa) বা ঈশ্বরে চিরস্থায়ী হওয়া। বিখ্যাত আন্দালুসিয়ান সুফি দার্শনিক ইবনে আরাবি (Ibn Arabi) এই দর্শনকে তাত্ত্বিক রূপ দেন, যা ওয়াহদাত আল-ওজুদ (Wahdat al-Wujud) বা ‘অস্তিত্বের একত্ব’ নামে পরিচিত। এর অর্থ হলো, মহাবিশ্বে আল্লাহ ছাড়া আর কোনো কিছুরই প্রকৃত অস্তিত্ব নেই; আমরা যা দেখি তা সবই সেই এক সত্তারই প্রতিচ্ছবি বা আয়না। সুফিদের উপাসনা পদ্ধতি বা জিকির (Dhikr), নাচ বা সামা (Sama) (যেমন তুর্কির ঘূর্ণায়মান দরবেশরা করে), এবং কবিতা – সবই সেই পরম সত্তার ধ্যানে মগ্ন হওয়ার একেকটি উপায়। আব্রাহামিক ধর্মের এই তিনটি মিস্টিক্যাল ধারাই প্রমাণ করে যে, ভৌগোলিক বা ধর্মীয় লেবেল ভিন্ন হলেও, মানুষের আত্মার তৃষ্ণা এবং অসীমের সাথে মিলিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা চিরন্তন এবং এক।
শেষের শুরু: এসকাটোলজি বা কেয়ামততত্ত্ব (Eschatology: The End Times)
যেকোনো মহাকাব্যের বা ভালো গল্পের একটি অনিবার্য সমাপ্তি বা ‘ক্লোজার’ থাকে। আব্রাহামিক মিথোলজি, যা শুরু হয়েছিল ‘শুরুতে ঈশ্বর আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করলেন’ – এই বাক্য দিয়ে, তার পরিসমাপ্তি ঘটে অ্যাপোক্যালিপ্স (Apocalypse) বা মহাপ্রলয়ের মাধ্যমে। গ্রিক শব্দ ‘অ্যাপোক্যালিপ্স’-এর অর্থ হলো ‘উন্মোচন করা’ বা পর্দা সরিয়ে দেওয়া। অর্থাৎ, ইতিহাসের যবনিকা পতন এবং চূড়ান্ত সত্যের প্রকাশ। প্রাচ্য দেশীয় দর্শন, যেমন হিন্দুধর্ম বা বৌদ্ধধর্মে সময়কে দেখা হয় চক্রাকার বা সাইক্লিক্যাল টাইম (Cyclical Time) হিসেবে, যেখানে সৃষ্টি ও ধ্বংসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। কিন্তু আব্রাহামিক মিথোলজিতে সময় হলো রৈখিক বা লিনিয়ার টাইম (Linear Time) – এটি একটি তীরের মতো, যা ধনুক থেকে ছুটেছে এবং একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সেই লক্ষ্যই হলো কেয়ামত বা ‘এন্ড টাইম’। ইহুদি, খ্রিস্টান এবং ইসলাম – এই তিনটি ধর্মেই শেষ জমানার আখ্যান বা এসকাটোলজি (Eschatology) নিয়ে বিস্তারিত এবং রোমহর্ষক বর্ণনা রয়েছে। যদিও তাদের চরিত্র এবং ঘটনার বিন্যাসে ভিন্নতা আছে, কিন্তু মূল সুরটি একই: বর্তমান পৃথিবী পাপ ও অনাচারে ধ্বংস হয়ে যাবে, এবং তার ধ্বংসস্তূপের ওপর ঈশ্বরের ন্যায়বিচারের এক শাশ্বত জগত প্রতিষ্ঠিত হবে। এই বিশ্বাস মানুষকে ইতিহাসের প্রতি এক ধরণের দায়বদ্ধতা এবং ভবিষ্যতের প্রতি এক অদম্য আশাবাদ বা মেসিয়ানিক হোপ (Messianic Hope) প্রদান করে।
মহাজাগতিক অরাজকতা এবং গগ-মাগগ এর মুক্তি
মহাপ্রলয়ের আগে পৃথিবী এক চরম বিশৃঙ্খলা বা ক্যাওস (Chaos)-এর মধ্য দিয়ে যাবে। একে বলা হয় ‘মেসিয়ানিক প্যাংস’ বা প্রসব বেদনা। যেমন নতুন শিশু জন্মের আগে মাকে তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়, তেমনি নতুন জগত আসার আগে এই জগতকে যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। মিথোলজিক্যাল বর্ণনা অনুযায়ী, এই সময়ে প্রকৃতির নিয়ম উল্টে যাবে – ভূমিকম্প, মহামারী এবং দুর্ভিক্ষ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়াবে। নৈতিকতা বা মোরালিটি সম্পূর্ণ ধসে পড়বে; সন্তান পিতামাতাকে হত্যা করবে, এবং শাসকরা হবে অত্যাচারী। এই অরাজকতার চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ পাবে গগ এবং মাগগ (Gog and Magog) বা ইয়াজুজ-মাজুজ নামক দুই অশুভ জাতির মুক্তির মাধ্যমে। হিব্রু বাইবেলের ইজিকিয়েল নবীর পুস্তকে এবং খ্রিস্টান নিউ টেস্টামেন্টের ‘রিভিলেশন’ বা প্রকাশিত বাক্য অধ্যায়ে গগ ও মাগগ হলো ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা এক বর্বর জাতি। ইসলামি মিথোলজিতে এদের বর্ণনা আরও নাটকীয়। কুরআনের সূরা কাহফ অনুযায়ী, মহান বাদশাহ জুলকারনাইন (Dhul-Qarnayn) (যাকে অনেকে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট বা সাইরাস দ্য গ্রেট মনে করেন) দুটি পাহাড়ের মাঝখানে লোহা ও গলিত তামা দিয়ে এক বিশাল প্রাচীর নির্মাণ করে এই ধ্বংসাত্মক জাতিটিকে আটকে রেখেছিলেন। শেষ জমানায় সেই প্রাচীর ভেঙে তারা পঙ্গপালের মতো বেরিয়ে আসবে এবং পৃথিবীর সমস্ত জল পান করে ফেলবে। এই মিথোলজিটি সভ্যতার প্রতি মানুষের অবচেতন ভয়ের প্রতীক – যে বর্বরতা ও হিংস্রতাকে আমরা সভ্যতার প্রাচীর দিয়ে আটকে রেখেছি, তা যেকোনো সময় সেই বাঁধ ভেঙে আমাদের গ্রাস করতে পারে।
দ্য গ্রেট ডিসিভার: অ্যান্টিক্রাইস্ট বা দাজ্জাল
অরাজকতার এই অন্ধকার সময়ে মঞ্চে প্রবেশ করবে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ভিলেন বা খলনায়ক। খ্রিস্টান মিথোলজিতে তাকে বলা হয় অ্যান্টিক্রাইস্ট (Antichrist), আর ইসলামি মিথোলজিতে তার নাম আল-মাসিহ আদ-দাজ্জাল (Al-Masih ad-Dajjal)। ‘অ্যান্টিক্রাইস্ট’ মানে কেবল যিশুর বিরোধী নয়, এর অর্থ হলো যে নিজেকে যিশুর স্থানে বসাতে চায়। আর ‘দাজ্জাল’ শব্দের অর্থ হলো ‘মহাপ্রতারক’। এই চরিত্রটি আব্রাহামিক মিথোলজির ‘ফলস প্রফেট’ বা মিথ্যা নবীর আর্কিটাইপ। সে আসবে এক ত্রাণকর্তার মুখোশ পরে। যখন পৃথিবী দুর্ভিক্ষে ধুঁকছে, তখন তার এক হাতে থাকবে রুটির পাহাড় (পার্থিব প্রাচুর্য) আর অন্য হাতে থাকবে আগুন (কষ্ট)। কিন্তু মিথোলজি আমাদের সাবধান করে দেয় – তার রুটি আসলে অপমান, আর তার আগুন আসলে সুশীতল জল। ইসলামি বর্ণনায় দাজ্জালের শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে – তার ডান চোখ হবে অন্ধ বা আঙ্গুরের মতো ফোলা, যা তার আধ্যাত্মিক অন্ধত্বের প্রতীক। তার কপালে ‘কাফির’ বা অবিশ্বাসী শব্দটি লেখা থাকবে, যা কেবল বিশ্বাসীরাই পড়তে পারবে। দাজ্জাল মানুষকে এমন এক পরীক্ষার বা ট্রায়াল (Trial)-এর মুখে ফেলবে, যেখানে বেঁচে থাকার জন্য ঈমান বিসর্জন দিতে হবে। সে মৃতকে জীবিত করার এবং আকাশ থেকে বৃষ্টি নামানোর ভেলকি দেখাবে। আধুনিক অনেক ধর্মতত্ত্ববিদ এবং তাত্ত্বিকরা দজ্জালকে কোনো ব্যক্তি হিসেবে না দেখে একে একটি বস্তুবাদী, নাস্তিক্যবাদী এবং ভোগবাদী সভ্যতার রূপক বা সিস্টেমিক ইভল (Systemic Evil) হিসেবে ব্যাখ্যা করেন, যা মানুষকে আত্মা থেকে দূরে সরিয়ে যান্ত্রিকতার দাস বানায়।
আরমাগেডন এবং মসিহ-এর প্রত্যাবর্তন
নাটকের ক্লাইম্যাক্স বা চূড়ান্ত দৃশ্যপটে আবির্ভাব ঘটবে প্রকৃত নায়কের। তিনি হলেন যিশু খ্রিস্ট বা ঈসা মসিহ। খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বে একে বলা হয় প্যারুজিয়া (Parousia) বা দ্বিতীয় আগমন। তিনি আসবেন মহিমান্বিত রাজা এবং বিচারক হিসেবে। ইসলামি বর্ণনায়, তিনি আকাশ থেকে দামেস্কের এক সাদা মিনারে দুই ফেরেশতার কাঁধে ভর দিয়ে নামবেন। তার আগমনের উদ্দেশ্য হলো দজ্জালকে হত্যা করা এবং পৃথিবীতে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। ইসলামি মিথোলজিতে যিশুর সাথে যোগ দেবেন ইমাম মাহদী (The Mahdi) বা ‘পথপ্রদর্শক’, যিনি মুসলিমদের নেতৃত্ব দেবেন। এই দুই পবিত্র সত্তা মিলে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে এক চূড়ান্ত যুদ্ধে লিপ্ত হবেন, যা বাইবেলে আরমাগেডন (Armageddon) নামে পরিচিত। হিব্রু শব্দ ‘হার-মগিদ্দো’ (Har Megiddo) বা মগিদ্দো পাহাড় থেকে এই নামের উৎপত্তি। ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে এই মগিদ্দো উপত্যকা বহু প্রাচীন যুদ্ধের সাক্ষী। মিথোলজিতে এই ভৌগোলিক স্থানটি এক মহাজাগতিক রণক্ষেত্রে পরিণত হয়, যেখানে আলো এবং অন্ধকারের শেষ ফয়সালা হবে। এই যুদ্ধে দাজ্জাল পরাজিত হবে – খ্রিস্টান মতে যিশুর মুখের নিঃশ্বাসে, আর ইসলামি মতে লুদ (Lud) নামক স্থানে যিশুর বর্শার আঘাতে। এই যুদ্ধের পর পৃথিবীতে এক স্বর্ণযুগ বা মিলেনিয়াম (Millennium) নেমে আসবে, যেখানে বাঘ ও হরিণ এক ঘাটে জল খাবে এবং কোনো যুদ্ধবিগ্রহ থাকবে না। এই ইউটোপীয় স্বপ্ন বা মিলেনিয়ারিয়ানিজম (Millenarianism) যুগ যুগ ধরে নিপীড়িত মানুষকে আশা জাগিয়েছে যে, অন্যায়ের রাজত্ব চিরস্থায়ী নয়।
বিচার দিবস: শিঙ্গার শব্দ এবং পুনরুত্থান
শান্তির এই যুগের পর আসবে সেই মুহূর্ত, যার জন্য সমগ্র মহাবিশ্ব অপেক্ষা করছে – মহাপ্রলয় বা দ্য আওয়ার (The Hour)। প্রধান ফেরেশতা ইসরাফিল তার শিঙ্গায় বা ট্রাম্পেটে ফুঁ দেবেন। এই শব্দের তীব্রতায় মহাবিশ্বের সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। এরপর দ্বিতীয়বার ফুঁ দেওয়া হবে, এবং শুরু হবে বডিলি রেজারেকশন (Bodily Resurrection) বা শারীরিক পুনরুত্থান। আব্রাহামিক মিথোলজির একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে কেবল আত্মার মুক্তি বা মোক্ষ লাভ হয় না, বরং শরীর ও আত্মা – উভয়েই পুনরুজ্জীবিত হয়। কারণ, এই শরীর দিয়েই মানুষ পাপ বা পুণ্য করেছে, তাই শরীরের অংশগ্রহণ বিচার প্রক্রিয়ায় অপরিহার্য। কবর থেকে কোটি কোটি মানুষ উঠে আসবে এবং এক বিশাল ময়দানে সমবেত হবে। খ্রিস্টান ঐতিহ্যে একে বলা হয় ‘গ্রেট হোয়াইট থ্রোন জাজমেন্ট’, আর ইসলামে একে বলা হয় ‘হাশরের ময়দান’। এখানে ঈশ্বরের সামনে প্রত্যেকের জীবনের রেকর্ড বুক বা আমলনামা খুলে ধরা হবে। ন্যায়বিচারের দাঁড়িপাল্লায় মানুষের কর্ম মাপা হবে। ইসলামি মিথোলজিতে এই পর্যায়ে একটি ভয়ংকর সেতুর কথা বলা হয়েছে, যার নাম পুল সিরাত (As-Sirat)। এটি জাহান্নামের আগুনের ওপর দিয়ে চলে গেছে এবং এটি চুলের চেয়েও চিকন ও তরবারির চেয়েও ধারালো। প্রত্যেকের ইমান এবং কর্মের আলো অনুযায়ী তাকে এই সেতু পার হতে হবে। কেউ বিদ্যুতের গতিতে পার হবে, কেউ হামাগুড়ি দেবে, আর পাপীরা নিচে গড়িয়ে পড়বে। এই দৃশ্যকল্পটি মানুষের জবাবদিহিতার বা অ্যাকাউন্টেবিলিটি (Accountability)-র চূড়ান্ত রূপ।
গন্তব্য: স্বর্গ ও নরকের মানচিত্র
বিচারের পর মানুষ তার অনন্ত গন্তব্যে পৌঁছাবে। যারা সফল, তাদের জন্য অপেক্ষা করছে স্বর্গ, জান্নাত বা হেভেন। আব্রাহামিক মিথোলজিতে স্বর্গের বর্ণনা অত্যন্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং মনোরম। সেখানে দুধ ও মধুর নদী বইবে, সুউচ্চ অট্টালিকা থাকবে, এবং কোনো দুঃখ, জরা বা মৃত্যু থাকবে না। তবে ধর্মতাত্ত্বিকদের মতে, স্বর্গের সর্বোচ্চ পুরস্কার হলো বিয়েটিফিক ভিশন (Beatific Vision) বা ঈশ্বরের দর্শন লাভ করা। স্রষ্টাকে নিজের চোখে দেখা এবং তার সান্নিধ্য লাভ করাই হলো আত্মার পরম তৃপ্তি। অন্যদিকে, পাপীদের জন্য অপেক্ষা করছে নরক, জাহান্নাম বা হেল। নরকের বর্ণনা আব্রাহামিক সাহিত্যে অত্যন্ত গ্রাফিক এবং ভীতিপ্রদ। সেখানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলবে, পাপীদের চামড়া পুড়ে যাবে এবং আবার নতুন চামড়া গজাবে যাতে তারা শাস্তি ভোগ করতে পারে। সেখানে খাদ্য হবে কাঁটাযুক্ত গাছ বা জাক্কুম এবং পানীয় হবে ফুটন্ত পানি বা পুজ।
ইতালীয় কবি দান্তে আলিগিয়েরি (Dante Alighieri) তার মহাকাব্য The Divine Comedy-র প্রথম খণ্ড Inferno-তে নরকের যে স্তরভিত্তিক মানচিত্র এঁকেছেন, তা পশ্চিমা মানসপটে নরকের ধারণাকে স্থায়ী রূপ দিয়েছে। দান্তের বর্ণনায় নরক হলো পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে নেমে যাওয়া এক বিশাল গর্ত, যার নয়টি বৃত্ত বা সার্কেল আছে। পাপের ধরণ অনুযায়ী পাপীরা বিভিন্ন বৃত্তে শাস্তি পায় – যেমন কামুকরা ঝড়ের কবলে ঘোরে, আর বিশ্বাসঘাতকরা বরফের হ্রদে জমে থাকে (Alighieri, 1320)। যদিও দান্তের বর্ণনা ধর্মগ্রন্থের আক্ষরিক অনুবাদ নয়, তবুও এটি মিথোলজিক্যাল ইমেজারির এক শক্তিশালী উদাহরণ। আধুনিক অনেক তাত্ত্বিক, যেমন জেরি এল. ওয়ালস (Jerry L. Walls), নরক ও স্বর্গের ধারণাকে দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে, নরক ঈশ্বরের নিষ্ঠুরতা নয়, বরং এটি মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার প্রতি ঈশ্বরের সম্মান। মানুষ যদি ঈশ্বরকে ছাড়া থাকতে চায়, তবে ঈশ্বর তাকে সেই স্বাধীনতা দেন, আর ঈশ্বরবিহীন অবস্থাই হলো নরক (Walls, 2002)। অন্যদিকে, স্বর্গ হলো সেই স্থান যেখানে মানুষের আনন্দ পূর্ণতা পায়। ঐতিহাসিক এলান ই. বার্নস্টেইন (Alan E. Bernstein) তার বই The Formation of Hell-এ দেখিয়েছেন যে, নরকের ধারণাটি সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা থেকে জন্ম নিয়েছে – পার্থিব জীবনে যারা অন্যায় করে পার পেয়ে গেছে, পরকালে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করাই এর উদ্দেশ্য (Bernstein, 1993)। এভাবে, আব্রাহামিক মিথোলজির মহাকাব্যটি একটি নৈতিক সমীকরণের মাধ্যমে শেষ হয়, যেখানে ভালো এবং মন্দের চূড়ান্ত ফয়সালা হয়।
প্রাচীন বিশ্বের কথোপকথন: আব্রাহামিক মিথোলজির ওপর অন্যান্য সভ্যতার প্রভাব (Intertextuality and Syncretism)
আব্রাহামিক মিথোলজি কোনো শূন্যগর্ভ বা বিচ্ছিন্ন দ্বীপে জন্ম নেয়নি; বরং এটি ছিল প্রাচীন বিশ্বের এক বিশাল ও জীবন্ত কথোপকথনের ফসল। মধ্যপ্রাচ্য বা ‘উর্বর চন্দ্রকলা’ (Fertile Crescent) অঞ্চলটি ছিল মানব সভ্যতার আদিমতম ক্রুসিবল বা গলনপাত্র, যেখানে সুমেরীয়, ব্যবিলনীয়, মিশরীয়, কেনানীয়, পারসিক এবং গ্রিক সভ্যতার চিন্তাধারা হাজার বছর ধরে একে অপরের সাথে মিশেছে, সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে এবং বিবর্তিত হয়েছে। আধুনিক প্রত্নতত্ত্ব এবং তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব বা কম্পারেটিভ রিলিজিয়ন (Comparative Religion) প্রমাণ করেছে যে, জেনেসিসের সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে শুরু করে যিশুর লোগোস বা বাণী, কিংবা ইসলামের মেরাজের ঘটনা – প্রতিটির শেকড় প্রাক-আব্রাহামিক মিথোলজিগুলোর গভীরে প্রোথিত। একে তাত্ত্বিক ভাষায় বলা হয় সিঙ্ক্রেটিজম (Syncretism) বা সমন্বয়বাদ এবং কালচারাল ডিফিউশন (Cultural Diffusion) বা সাংস্কৃতিক ব্যাপন। আব্রাহামিক লেখকরা তাদের প্রতিবেশী জাতিগুলোর গল্প, রূপক এবং আইকনোগ্রাফি ধার করেছেন, কিন্তু সেগুলোকে হুবহু নকল করেননি; বরং তারা সেগুলোকে ভেঙেচুরে নিজেদের একেশ্বরবাদী দর্শনের ছাঁচে নতুন করে গড়ে তুলেছেন। এই প্রক্রিয়াকে বলা যেতে পারে থিওলজিক্যাল পলেমিক (Theological Polemic) বা ধর্মতাত্ত্বিক বিতর্ক – যেখানে পুরনো মিথোলজিকে ব্যবহার করা হয়েছে পুরনো দেবতাদেরই বাতিল করার জন্য। এই অংশে আমরা দেখব কীভাবে টাইগ্রিস, ইউফ্রেটিস এবং নীল নদের তীরের প্রাচীন গল্পগুলো জর্ডান নদীর তীরে এসে নতুন রূপ পেল।
মেসোপটেমীয় ছায়া: আদিম জলরাশি ও বিশৃঙ্খলার দানব
আব্রাহামিক মিথোলজির সবচেয়ে গভীর এবং স্পষ্ট প্রভাব এসেছে প্রাচীন মেসোপটেমিয়া (বর্তমান ইরাক) থেকে, বিশেষ করে সুমেরীয় এবং ব্যবিলনীয় সভ্যতা থেকে। বাইবেলের জেনেসিস বা আদিপুস্তকের শুরুতেই আমরা দেখি সৃষ্টির আগে গভীর জলরাশি বা ‘তেহোম’ (Tehom) বিরাজমান ছিল। ভাষাতাত্ত্বিকরা দেখিয়েছেন যে, এই হিব্রু শব্দ ‘তেহোম’ এবং ব্যবিলনীয় সৃষ্টি-মহাকাব্য এনুমা এলিশ (Enuma Elish)-এর বিশৃঙ্খলার দেবী টিয়ামাত (Tiamat)-এর নাম একই ভাষাতাত্ত্বিক উৎস থেকে এসেছে। এনুমা এলিশ-এ দেখা যায়, দেবতা মারদুক সমুদ্ররূপী দানবী টিয়ামাতকে হত্যা করে তার দেহ চিরে আকাশ ও পৃথিবী তৈরি করছেন। বাইবেলে যদিও সরাসরি কোনো দেবীকে হত্যার কথা নেই, কিন্তু সেখানেও ঈশ্বর জলরাশিকে দ্বিখণ্ডিত করে আকাশ ও পৃথিবী তৈরি করেন। অনেক গীতসংহিতা বা সামসঙ্গীত (Psalms) এবং ইজিকিয়েল বা ইয়োব নবীর পুস্তকে ঈশ্বরকে সমুদ্রের দানব লেভায়াথান (Leviathan) বা ‘রাহাব’-এর সাথে যুদ্ধ করতে এবং তাকে চূর্ণ করতে দেখা যায়। জার্মান পন্ডিত হারম্যান গুনকেল (Hermann Gunkel) তার বিখ্যাত গবেষণায় একে কেওসকাম্ফ (Chaoskampf) বা ‘বিৃঙ্খলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ মোটিফ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আব্রাহামিক মিথোলজিতে ঈশ্বর এই বিশৃঙ্খলার শক্তিকে পুরোপুরি ধ্বংস করেন না, বরং তাকে নিয়ন্ত্রণ করেন এবং সীমানার মধ্যে বেঁধে রাখেন।
বন্যার গল্প বা ফ্লাড মিথ (Flood Myth)-এর ক্ষেত্রে এই প্রভাব আরও বেশি প্রত্যক্ষ। ঊনবিংশ শতাব্দীতে জর্জ স্মিথ যখন দ্য এপিক অফ গিলগামেশ (The Epic of Gilgamesh)-এর একাদশ ফলক পাঠোদ্ধার করেন, তখন দেখা যায় যে নূহের প্লাবনের গল্পের সাথে এর মিল কেবল কাকতালীয় নয়। গিলগামেশ মহাকাব্যের বন্যা থেকে বেঁচে যাওয়া নায়ক উতনাপিশতিম (Utnapishtim) গিলগামেশকে জানান যে, দেবতা এনলিল মানুষের কোলাহলে বিরক্ত হয়ে বন্যা পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু দেবতা ইয়া তাকে গোপনে নৌকা বানাতে বলেন। নূহের গল্পের মতোই সেখানে নৌকা তৈরির মাপজোক, পশুপাখি তোলা, এবং শেষে কাক ও ঘুঘু পাঠানোর বর্ণনা আছে। এমনকি বন্যার শেষে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ বেদি তৈরি করে পশু উৎসর্গ করার দৃশ্যটিও হুবহু এক। বিখ্যাত সুমেরোলজিস্ট স্যামুয়েল নোহ ক্রেমার (Samuel Noah Kramer) তার বই দ্য সুমেরিয়ান্স (The Sumerians)-এ দেখিয়েছেন যে, ইডেন উদ্যানের ধারণাটিও সুমেরীয় মিথোলজি ‘দিলমুন’ (Dilmun) থেকে অনুপ্রাণিত হতে পারে, যা ছিল এক পবিত্র এবং দুঃখহীন স্থান। এমনকি ইভ বা হাওয়াকে আদমের পাঁজর (Rib) থেকে তৈরির গল্পটির পেছনে সুমেরীয় শব্দ ‘টি’ (Ti)-এর একটি শ্লেষ বা পান (Pun) থাকতে পারে। সুমেরীয় ভাষায় ‘নিন-টি’ (Nin-ti) মানে একই সাথে ‘পাঁজরের দেবী’ এবং ‘যিনি জীবন দেন’। হিব্রু ভাষায় এই শব্দগুলোর অর্থ আলাদা হয়ে যাওয়ায় মূল শ্লেষটি হারিয়ে গেছে, কিন্তু গল্পের কঙ্কালটি রয়ে গেছে।
বাইবেলের জেনেসিসে বর্ণিত প্রথম মানুষ আদমের কাহিনীর সাথে প্রাচীন মেসোপটেমীয় মিথোলজির চরিত্র আদাপা (Adapa)-র গল্পের বিস্ময়কর মিল রয়েছে। সুমেরীয় মিথ অনুযায়ী, আদাপা ছিলেন এরিদু শহরের এক জ্ঞানী পুরোহিত বা মৎস্যজীবী, যাকে দেবতা এনকি সৃষ্টি করেছিলেন। আদম যেমন জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়ে অমরত্ব হারিয়েছিলেন, তেমনি আদাপাও একটি ভুল সিদ্ধান্তের কারণে অমরত্ব হারান। স্বর্গের দেবতা আনু আদাপাকে ‘জীবনের রুটি’ এবং ‘জীবনের জল’ খেতে দিয়েছিলেন, যা তাকে অমর করতে পারত। কিন্তু আদাপার সৃষ্টিকর্তা এনকি তাকে আগে থেকেই সতর্ক করেছিলেন যে স্বর্গে তাকে যা দেওয়া হবে তা আসলে ‘মৃত্যুর খাবার’। এনকির কথা বিশ্বাস করে আদাপা সেই অমৃত প্রত্যাখ্যান করেন এবং ফলস্বরূপ মানবজাতি অমরত্ব থেকে বঞ্চিত হয়। উভয় গল্পেই একজন আদিমানব, ঈশ্বরের সান্নিধ্য, একটি খাদ্য-সংক্রান্ত পরীক্ষা এবং অমরত্ব হারানোর ট্র্যাজেডি উপস্থিত। আধুনিক আসিরিওলজিস্টরা মনে করেন, ‘আদাপা’ এবং ‘আদম’ – উভয়ই সম্ভবত মানুষের নশ্বরতা এবং ঈশ্বরের সাথে তার সম্পর্কের টানাপোড়েন ব্যাখ্যা করার জন্য একই সেমেটিক মিথোলজিক্যাল ঐতিহ্যের দুটি ভিন্ন সংস্করণ।
এছাড়াও, জেনেসিসে বর্ণিত টাওয়ার অফ বাবেল বা বাবেল টাওয়ারের গল্পটি মেসোপটেমিয়ার বিশাল সিড়ির মতো মন্দির বা জিগুরাত (Ziggurat)-এর (যেমন – ব্যাবিলনের ‘এতেমেনানকি‘) স্মৃতি বহন করে। জিগুরাতগুলো আকাশ ছোঁয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হতো, যা হিব্রু লেখকদের কাছে মানুষের অহংকার বা হিউব্রিস (Hubris)-এর প্রতীক মনে হয়েছিল। আব্রাহামিক লেখকরা এই বিশাল স্থাপনাগুলোকে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবে চিত্রিত করেছেন এবং এর পতনকে ভাষার বিভ্রান্তির কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।
মিশরীয় জ্ঞান এবং একেশ্বরবাদের পূর্বসূরি
ইস্রায়েলীয়রা দীর্ঘকাল মিশরে ছিল, তাই মিশরীয় মিথোলজির প্রভাব আব্রাহামিক চিন্তাধারায় পড়াটা ছিল স্বাভাবিক। সবচেয়ে বিতর্কিত এবং আকর্ষণীয় তত্ত্বটি হলো একেশ্বরবাদের উৎস নিয়ে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতাব্দীতে মিশরের ফারাও আখেনাতেন (Akhenaten) সমস্ত দেবদেবীর পূজা নিষিদ্ধ করে কেবল এক সূর্যদেবতা ‘আতেন’ (Aten)-এর উপাসনা চালু করেছিলেন। একে বলা হয় আতেনিজম (Atenism)। বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের (Sigmund Freud) মতে, মোজেস বা মুসা সম্ভবত আখেনাতেনের এই একেশ্বরবাদী দর্শনে প্রভাবিত ছিলেন বা তিনি নিজেই একজন মিশরীয় রাজপুত্র ছিলেন যিনি এই ধারণাটি হিব্রু দাসদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। যদিও আধুনিক ঐতিহাসিকরা ফ্রয়েডের সব দাবি মানেন না, তবুও বাইবেলের ১০৪ নম্বর সামসঙ্গীত (Psalm 104) এবং আখেনাতেনের রচিত গ্রেট হিম টু দি আতেন (Great Hymn to the Aten)-এর মধ্যে সাহিত্যিক মিল এতই গভীর যে, একটির ওপর আরেকটির প্রভাব অস্বীকার করা কঠিন। উভয় স্তোত্রেই ঈশ্বরকে আলো, জীবনদাতা এবং প্রকৃতির একমাত্র প্রতিপালক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
মিশরীয় প্রজ্ঞাসাহিত্য বা উইজডম লিটারেচার (Wisdom Literature)-এর প্রভাব বাইবেলের হিতোপদেশ (Proverbs) বইয়ে স্পষ্টভাবে দেখা যায়। বিশেষ করে ইনস্ট্রাকশন অফ আমেনেমোপ (Instruction of Amenemope) নামক মিশরীয় রচনার সাথে হিতোপদেশের ২২ এবং ২৩ অধ্যায়ের বহু আয়াতের হুবহু মিল পাওয়া যায়। গরিবের প্রতি অবিচার না করা, সীমানা না সরানো এবং জ্ঞানীদের কথা শোনার উপদেশগুলো মিশরীয় নৈতিকতা থেকে সরাসরি আহরিত হয়েছে বলে পন্ডিতরা মনে করেন। তদুপরি, আব্রাহামিক সৃষ্টিতত্ত্বে ঈশ্বর যে ‘বাক্য’ বা শব্দের মাধ্যমে সৃষ্টি করেন (জেনেসিস এবং জন-এর গসপেল), তার সাথে মিশরের মেম্ফিস শহরের সৃষ্টিতত্ত্ব বা মেম্ফাইট থিওলজি (Memphite Theology)-র মিল আছে। সেখানে দেবতা ‘পতাহ’ (Ptah) তার হৃদয়ে চিন্তা করেন এবং জিহ্বা দিয়ে শব্দ উচ্চারণ করে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেন। খ্রিস্টানদের ‘লোগোস’ বা বাক্যের ধারণাটির আদিম রূপ আমরা এখানেই দেখতে পাই। খৎনা বা সারকামসিশন (Circumcision) প্রথাটিও হিব্রুরা মিশরীয়দের কাছ থেকে গ্রহণ করেছিল বলে ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়, কারণ হিব্রুদের আগমনের বহু আগে থেকেই মিশরে এটি পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে প্রচলিত ছিল।
কেনানীয় প্রতিবেশী: এল এবং বাল-এর রূপান্তর
ইস্রায়েলীয়রা যখন প্রতিশ্রুত ভূমি বা কেনানে বসতি স্থাপন করে, তখন তারা সেখানকার স্থানীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির সাথে গভীরভাবে মিশে যায়। কেনানীয় মিথোলজির প্রধান দেবতা ছিলেন এল (El), যিনি ছিলেন দেবতাদের পিতা এবং দয়ালু বৃদ্ধ। আব্রাহামিক ঈশ্বরকে বাইবেলে অনেক সময় ‘এল’, ‘এল এলিয়ন’ (সর্বোচ্চ ঈশ্বর), বা ‘এল শাদ্দাই’ (পাহাড়ের বা সর্বশক্তিমান ঈশ্বর) নামে ডাকা হয়েছে। আধুনিক বাইবেল বিশারদ, যেমন মার্ক এস. স্মিথ (Mark S. Smith) তার দ্য অরিজিন্স অফ বিবলিক্যাল মনোকিজম (The Origins of Biblical Monotheism) বইয়ে দেখিয়েছেন যে, আদিম ইস্রায়েলীয়রা ‘এল’ দেবতার বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের নিজস্ব দেবতা ইয়াহওয়ের (Yahweh) মধ্যে একীভূত করে নিয়েছিল। কেনানীয়দের আরেক জনপ্রিয় দেবতা ছিলেন ঝড়ের দেবতা বাল (Baal), যাকে ‘মেঘের আরোহী’ বলা হতো। বাইবেলে ইয়াহওয়েকেও প্রায়ই ‘মেঘের আরোহী’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং তার কন্ঠস্বরকে বজ্রপাতের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
উগারিত (Ugarit) নামক প্রাচীন শহর থেকে আবিষ্কৃত রাস শামরা ট্যাবলেট (Ras Shamra Tablets) পাঠোদ্ধারের পর দেখা গেছে যে, হিব্রু ভাষা এবং কবিতার ছন্দ উগারিতীয় সাহিত্যের খুব কাছাকাছি। বাইবেলের অনেক সামসঙ্গীত (যেমন – সাম ২৯) আসলে বাল দেবতার উদ্দেশ্যে রচিত স্তোত্র ছিল, যা পরে নাম পরিবর্তন করে ইয়াহওয়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়েছে। কেনানীয় মিথোলজিতে ঈশ্বর একা নন, তিনি একটি ডিভাইন কাউন্সিল (Divine Council) বা স্বর্গীয় সভার প্রধান, যেখানে অন্যান্য ‘ঈশ্বরের পুত্ররা’ (Bene Elohim) উপস্থিত থাকে। জেনেসিস এবং ইয়োব পুস্তকে আমরা এই স্বর্গীয় সভার উল্লেখ পাই, যা পরবর্তীতে একেশ্বরবাদী কাঠামোর মধ্যে ফেরেশতাদের সভায় রূপান্তরিত হয়েছে। ইয়াহওয়ে যে সমুদ্র-দানব লেভায়াথানকে পরাজিত করেন, তা আসলে কেনানীয় দেবতা বালের হাতে সমুদ্র-দানব লোতান (Lotan)-এর পরাজিত হওয়ার গল্পেরই হিব্রু সংস্করণ। তবে পার্থক্য হলো, কেনানীয় মিথোলজিতে দেবতাদের মৃত্যু ও পুনর্জন্ম হয়, কিন্তু আব্রাহামিক ঈশ্বর ইতিহাসের ঊর্ধ্বে এবং মৃত্যুহীন।
জেনেসিসে আব্রাহাম কর্তৃক পুত্র আইজ্যাককে বলি দেওয়ার ঘটনাটি, যা আকিদাহ (Akedah) নামে পরিচিত, তৎকালীন কেনানীয় সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে একটি বৈপ্লবিক বাঁক হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ এবং বাইবেলের নিজস্ব সাক্ষ্য (যেমন লেভিটিকাস ১৮:২১) থেকে জানা যায় যে, প্রাচীন কেনানে মলোচ (Molech) বা বাল দেবতার উদ্দেশ্যে শিশু উৎসর্গ করার প্রথা প্রচলিত ছিল, বিশেষ করে তোফেৎ নামক স্থানে। আব্রাহামের গল্পটি শুরু হয় এই প্রচলিত প্রথার মতোই – ঈশ্বর তার কাছে সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটি চাইছেন। কিন্তু গল্পের শেষে ঈশ্বর মানুষের (আইজ্যাকের) পরিবর্তে পশুর (ভেড়া) বলিদান গ্রহণ করে একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তাত্ত্বিক জন ডি. লেভেনসন (Jon D. Levenson) তার বই দ্য ডেথ অ্যান্ড রেজারেকশন অফ দ্য বিলাভেড সান (The Death and Resurrection of the Beloved Son)-এ যুক্তি দিয়েছেন যে, এই মিথোলজিটির মূল উদ্দেশ্য ছিল ইস্রায়েলীয় ধর্মের একটি মৌলিক পরিবর্তন ঘোষণা করা: তাদের ঈশ্বর ইয়াহওয়ে শিশু-বলি চান না, বরং তিনি আনুগত্য এবং প্রতীকী ত্যাগ চান। এটি ছিল মলোচ পূজার বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী ধর্মতাত্ত্বিক প্রতিবাদ বা পলেমিক (Polemic), যা নির্দেশ করতে চায় যে আব্রাহামিক ঈশ্বর প্রাণের রক্ষক, সংহারক নন।
পারস্যের উপহার: দ্বৈতবাদ এবং কেয়ামত
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে ব্যবিলনীয় নির্বাসনের সময় এবং পরে পারস্যের সাইরাস দ্য গ্রেটের অধীনে থাকাকালীন ইহুদি চিন্তাধারা পারসিক ধর্ম বা জরোয়াস্ট্রিয়ানইজম (Zoroastrianism) দ্বারা আমূল পরিবর্তিত হয়। এর আগে হিব্রু ধর্মে শয়তান কোনো স্বতন্ত্র অশুভ শক্তি ছিল না এবং পরকাল বা পুনরুত্থান নিয়ে কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না। জরোয়াস্ট্রিয়ান ধর্মে বিশ্বজগতকে দুটি পরম শক্তির যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে দেখা হয় – ভালোর দেবতা আহুরা মাজদা (Ahura Mazda) এবং মন্দের শক্তি আংরা মাইনয়ু (Angra Mainyu)। পন্ডিতরা মনে করেন, এই কসমিক ডুয়ালিজম (Cosmic Dualism)-এর প্রভাবেই আব্রাহামিক ধর্মে শয়তান বা ইবলিস ঈশ্বরের কেবল একজন ভৃত্য থেকে ঈশ্বরের রাজ্যের প্রধান শত্রু বা ‘গড অফ দিস ওয়ার্ল্ড’-এ পরিণত হয়েছে।
কেয়ামত বা এসকাটোলজি (Eschatology)-র ধারণাগুলোর বড় অংশই পারস্য থেকে এসেছে। মৃত্যু পরবর্তী বিচার, স্বর্গের সুখ এবং নরকের আগুন, মৃতদের শারীরিক পুনরুত্থান বা ফ্রাশোকেরেটি (Frashokereti), এবং শেষ জমানায় একজন ত্রাণকর্তা বা সাওশিয়ান্ত (Saoshyant)-এর আগমন – এই সব ধারণা জরোয়াস্ট্রিয়ান ধর্মে আব্রাহামিক ধর্মের বহু আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। ইসলামি মিথোলজির পুল সিরাত (As-Sirat) বা পারলৌকিক সেতুর ধারণাটির সাথে জরোয়াস্ট্রিয়ান চিনভাট ব্রিজ (Chinvat Bridge)-এর অদ্ভুত মিল রয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই এই সেতুটি পুণ্যবানদের জন্য চওড়া এবং পাপীদের জন্য সরু হয়ে যায়। এমনকি দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং ওজু বা পবিত্রতার ধারণাগুলোর সাথেও জরোয়াস্ট্রিয়ান আচারের সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। ব্রিটিশ পন্ডিত মেরি বয়েস (Mary Boyce) তার জরোয়াস্ট্রিয়ান্স: দেয়ার রিলিজিয়াস বিলিফস অ্যান্ড প্র্যাকটিসেস (Zoroastrians: Their Religious Beliefs and Practices) বইয়ে দেখিয়েছেন যে, ইহুদি ধর্ম (এবং পরবর্তীতে খ্রিস্টান ও ইসলাম) পারসিকদের কাছ থেকে এই মহাজাগতিক নাটকের কাঠামোটি ধার করেছে, যেখানে ইতিহাস একটি চূড়ান্ত যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
ইসলামি মিথোলজিতে নবী মুহাম্মদের মেরাজ বা স্বর্গারোহণের ঘটনার সাথে সাসানীয় পারস্যের জরোয়াস্ট্রিয়ান গ্রন্থ বুক অফ আরদা ভিরাফ (Book of Arda Viraf)-এর কাহিনীর গঠনগত সাদৃশ্য পন্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আরদা ভিরাফ ছিলেন একজন ধার্মিক জরোয়াস্ট্রিয়ান পুরোহিত, যিনি এক বিশেষ পানীয় পান করে সাত দিন সাত রাত ঘুমিয়ে ছিলেন এবং তার আত্মা স্বর্গের দিকে যাত্রা করেছিল। তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন দুই ফেরেশতা – সরোশ এবং আদার। মুহাম্মদের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, জিবরাইল তাকে নিয়ে সাত আসমান বা হেভেন পার করেন। আরদা ভিরাফ স্বর্গে আহুরা মাজদার (ঈশ্বর) সিংহাসন এবং নরকের শাস্তি প্রত্যক্ষ করেন, ঠিক যেমনটি মুহাম্মদ করেছিলেন। বিশেষ করে, নরকে পাপীদের শাস্তির গ্রাফিক বর্ণনা – যেমন জিহ্বা কেটে ফেলা বা আগুনে পোড়ানো – উভয় আখ্যানেই প্রায় হুবহু এক। ফরাসি গবেষক জেমস ডার্মেস্টেটার (James Darmesteter) এবং অন্যান্যরা মনে করেন, সপ্তম শতাব্দীর আরবে পারসিক প্রভাব প্রবল ছিল, এবং সম্ভবত এই প্রাচীন পারসিক আখ্যানটি ইসলামি মেরাজের বর্ণনায় (বিশেষ করে হাদিস সাহিত্যে) অবচেতনভাবে বা সাংস্কৃতিক স্মৃতির মাধ্যমে প্রবেশ করেছে, যদিও মূল বিশ্বাসটি ওহী-নির্ভর।
গ্রিক দর্শন: লোগোস এবং আত্মার মুক্তি
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের বিজয়ের পর মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে হেলেনিস্টিক বা গ্রিক সংস্কৃতির জোয়ার আসে। এই সময় ইহুদি বুদ্ধিজীবীরা, বিশেষ করে আলেকজান্দ্রিয়ার ফাইলো (Philo of Alexandria), প্লেটো এবং স্টয়িক দর্শনের সাথে তাদের ধর্মগ্রন্থের সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করেন। গ্রিক দর্শনের লোগোস (Logos) বা মহাজাগতিক যুক্তি/বাণীর ধারণাটি খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বে গভীরভাবে মিশে যায়। গসপেল অফ জন-এর শুরুতে যখন বলা হয় “আদিতে বাক্য (Logos) ছিলেন”, তখন তা সরাসরি গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাস এবং স্টয়িকদের ধারণাকে ব্যবহার করে যিশুর ঈশ্বরত্ব প্রমাণ করছে। প্লেটোর দর্শনে দেহকে আত্মার কারাগার মনে করা হতো এবং আত্মাকে অমর ও অবিনশ্বর বলা হতো। আদিম হিব্রু চিন্তায় মানুষ ছিল দেহ ও শ্বাসবায়ুর (Nefesh) একটি অবিচ্ছেদ্য একক; মৃত্যুর পর তার কোনো সচেতন অস্তিত্ব থাকত না (শিয়োল)। কিন্তু গ্রিক প্রভাবে আব্রাহামিক ধর্মে (বিশেষ করে খ্রিস্টান ও পরে ইসলামে) দেহ ও আত্মার দ্বৈতবাদ বা বডি-সোল ডুয়ালিজম (Body-Soul Dualism) প্রবল হয়, যেখানে মৃত্যুর পর আত্মা দেহ ছেড়ে অমরলোকে যাত্রা করে।
গ্রিক মদের দেবতা ডায়োনিসাস (Dionysus) বা বাক্কাস এবং যিশু খ্রিস্টের কাহিনীর মধ্যে যে সমান্তরাল দেখা যায়, তা তুলনামূলক মিথোলজির এক চমকপ্রদ অধ্যায়। উভয় চরিত্রই একজন মরণশীল মা এবং এক ঐশ্বরিক পিতার (জিউস এবং ঈশ্বর) সন্তান। ডায়োনিসাসের মৃত্যু ও পুনর্জন্ম যিশুর রেজারেকশন (Resurrection)-এর ধারণার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। আরও তাৎপর্যপূর্ণ হলো, ডায়োনিসাসের উপাসনায় মদকে দেবতার রক্ত হিসেবে গণ্য করা হতো, যা খ্রিস্টান ইউকারিস্ট (Eucharist)-এর আদিম প্রতিচ্ছবি। টিমোথি ফ্রিক (Timothy Freke) এবং পিটার গ্র্যান্ডি (Peter Gandy) তাদের বিতর্কিত বই দ্য জিসাস মিস্ট্রিস (The Jesus Mysteries)-এ দাবি করেছেন যে, আদিম খ্রিস্টানরা এই প্যাগান রহস্যধর্মের মোটিফগুলো ধার করেছিলেন (Freke & Gandy, 1999)। তবে মূলধারার ঐতিহাসিক ব্যারি বি. পাওয়েল (Barry B. Powell) তার ক্লাসিক্যাল মিথ (Classical Myth) গ্রন্থে এবং গবেষক পিটার উইক (Peter Wick) তার বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন যে, এটি কেবল নকল নয়; বরং এটি ছিল হেলেনিস্টিক সংস্কৃতির সাথে ইহুদি ধর্মতত্ত্বের এক গভীর সিঙ্ক্রেটিজম (Syncretism) বা সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান, যা বিশেষ করে যোহনের সুসমাচারে লক্ষ্য করা যায় (Powell, 2007; Wick, 2004)।
এছাড়াও, ধর্মগ্রন্থের রূপক বা অ্যালিগোরিক্যাল ইন্টারপ্রিটেশন (Allegorical Interpretation)-এর পদ্ধতিটিও গ্রিকদের কাছ থেকে আসা। হোমারের ইলিয়াড বা ওডিসিকে যেমন গ্রিক দার্শনিকরা রূপক হিসেবে ব্যাখ্যা করতেন, তেমনি ফাইলো এবং পরবর্তী চার্চ ফাদাররা (যেমন অরিজেন) বাইবেলের কঠিন বা অযৌক্তিক অংশগুলোকে রূপক হিসেবে ব্যাখ্যা করা শুরু করেন। এই পদ্ধতিটি পরবর্তীতে সুফি এবং কাবালাহিস্টদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে।
আরবীয় লোককথা এবং ইসলামি সমন্বয়
ইসলামের উদ্ভবের প্রাক্কালে আরব উপদ্বীপ ছিল বিভিন্ন ধর্ম ও বিশ্বাসের এক সংমিশ্রণ। সেখানে মূর্তিপূজক আরবদের পাশাপাশি ইহুদি, খ্রিস্টান এবং হানিফ (Hanif) (যারা কোনো ধর্মে না থেকেও একেশ্বরবাদী ছিলেন) সম্প্রদায়ের বাস ছিল। ইসলামি মিথোলজি এই স্থানীয় উপাদানগুলোকে স্বীকৃতি দেয় এবং পরিশোধন করে। জিন (Jinn)-এর ধারণাটি প্রাক-ইসলামিক আরব লোককথা থেকে সরাসরি এসেছে। আরবরা বিশ্বাস করত মরুভূমিতে অদৃশ্য সত্তারা বাস করে। কুরআন এই লোকবিশ্বাসকে বাতিল করেনি, বরং একে একেশ্বরবাদী কাঠামোর মধ্যে নিয়ে এসেছে – জিনরাও ঈশ্বরের সৃষ্টি এবং তাদেরও বিচার হবে।
হজ্জ বা তীর্থযাত্রার রিচুয়ালগুলো, যেমন – কাবা ঘর প্রদক্ষিণ (তাওয়াফ), সাফা-মারওয়া দৌড়ানো, বা আরাফাতের ময়দানে অবস্থান – এগুলো প্রাক-ইসলামিক যুগেও আরবদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। ইসলামি ন্যারেটিভ অনুযায়ী, এগুলো আসলে আব্রাহাম ও ইসমাইলের প্রবর্তিত ইবাদত, যা আরবরা বিকৃত করে ফেলেছিল। মুহাম্মদ এই আচারগুলোকে পুনর্গঠন করেন এবং মূর্তিপূজার উপাদানগুলো বাদ দিয়ে সেগুলোকে একমাত্র আল্লাহর ইবাদতে রূপান্তরিত করেন। একে বলা হয় রি-স্যাক্রালাইজেশন (Re-sacralization) বা পুনরায় পবিত্রকরণ। কাবার কালো পাথর বা হাজরে আসওয়াদ (Hajr al-Aswad)-কে সম্মান প্রদর্শনও এই প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা, যাকে ইসলামি মিথোলজিতে বেহেশত থেকে পতিত পাথর হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
পরিশেষে, আব্রাহামিক মিথোলজির ওপর অন্যান্য মিথোলজির এই প্রভাব প্রমাণ করে না যে এগুলো কেবল ‘নকল’ বা ‘চুরি’ করা গল্প। বরং এটি প্রমাণ করে যে, ধর্ম এবং সংস্কৃতি সর্বদা প্রবাহমান নদীর মতো। আব্রাহামিক ধর্মগুলো তাদের চারপাশের জগত থেকে উপাদান সংগ্রহ করেছে, কিন্তু সেগুলোকে এমন এক নতুন নৈতিক এবং দার্শনিক সুতোয় গেঁথেছে যে, তা এক স্বতন্ত্র এবং শক্তিশালী মহাকাব্যে পরিণত হয়েছে। গিলগামেশের বন্যা যেখানে ছিল দেবতাদের খামখেয়ালিপনা, নূহের বন্যা সেখানে হয়ে উঠেছে নৈতিক বিচারের প্রতীক। টিয়ামাতের শরীর চিরে যেখানে আকাশ তৈরি হয়েছিল, সেখানে ঈশ্বরের ‘বাক্য’ বা ইচ্ছাশক্তিই সৃষ্টির উৎস হয়ে উঠেছে। এই রূপান্তর বা ট্রান্সফরমেশন (Transformation)-ই আব্রাহামিক মিথোলজির আসল সৌন্দর্য এবং শক্তির উৎস।
মিথোলজির ব্যবচ্ছেদ: তাত্ত্বিক, দার্শনিক এবং সমালোচকদের দৃষ্টিতে (Theoretical Perspectives on Abrahamic Mythology)
আব্রাহামিক মিথোলজি কেবল কতগুলো প্রাচীন গল্পের সমষ্টি নয়; এটি মানব সভ্যতার চিন্তাকাঠামো, নৈতিকতা এবং সমাজব্যবস্থাকে এমনভাবে গড়ে তুলেছে যে, একে উপেক্ষা করা অসম্ভব। গত দুই শতাব্দী ধরে পৃথিবীর বাঘা বাঘা পন্ডিত, দার্শনিক, মনোবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানীরা এই মিথোলজির ব্যবচ্ছেদ করেছেন। তারা জানার চেষ্টা করেছেন, কেন হাজার বছর ধরে মানুষ এই গল্পগুলোকে আঁকড়ে ধরে আছে? কেন মরুভূমির এক যাজাবর জাতির ঈশ্বর ভাবনা পুরো পৃথিবীর ইতিহাস বদলে দিল? এই অংশে আমরা সেই সব তাত্ত্বিক (Theorists) এবং তাদের তত্ত্ব (Theories) নিয়ে আলোচনা করব, যারা আব্রাহামিক মিথোলজিকে বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের ঊর্ধ্বে উঠে জ্ঞানতাত্ত্বিক লেন্স দিয়ে দেখেছেন। তাদের বিশ্লেষণ আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে, আদমের আপেল খাওয়া থেকে শুরু করে কেয়ামতের শিঙায় ফুঁ দেওয়া পর্যন্ত – প্রতিটি ঘটনার পেছনে লুকিয়ে আছে মানুষের মনস্তত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব এবং অস্তিত্ববাদের গভীর সব সমীকরণ।
তুলনামূলক মিথোলজি ও মহাজাগতিক নায়কের যাত্রা
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী মিথোলজি বিশারদ জোসেফ ক্যাম্পবেল (Joseph Campbell) তার কালজয়ী গ্রন্থ দ্য হিরো উইথ আ থাউজ্যান্ড ফেসেস (The Hero with a Thousand Faces)-এ দেখিয়েছেন যে, পৃথিবীর সমস্ত মিথোলজির মূলে একটিই কাঠামো কাজ করে, যাকে তিনি নাম দিয়েছেন মনোমিথ (Monomyth) বা হিরোজ জার্নি (Hero’s Journey)। আব্রাহামিক মিথোলজিতে এই তত্ত্বটি খাপে খাপে মিলে যায়। ক্যাম্পবেলের মতে, নায়কের যাত্রা তিনটি ধাপে বিভক্ত: প্রস্থান (Departure), দীক্ষা (Initiation) এবং প্রত্যাবর্তন (Return)। লক্ষ্য করুন আব্রাহাম, মোজেস, যিশু কিংবা মুহাম্মদের জীবনের দিকে। আব্রাহামকে তার নিজের দেশ এবং পিতার ঘর ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হয়েছিল (প্রস্থান)। মোজেসকে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে মিডিয়ানের মরুভূমিতে নির্বাসিত হতে হয়েছিল এবং সেখানে জ্বলন্ত ঝোপের মাধ্যমে ঈশ্বরের দর্শন পেতে হয়েছিল (দীক্ষা)। এরপর তিনি নতুন জ্ঞান ও শক্তি নিয়ে তার জাতির কাছে ফিরে এসেছিলেন তাদের মুক্ত করার জন্য (প্রত্যাবর্তন)। যিশুর ক্ষেত্রেও তাই – মরুভূমিতে শয়তানের প্রলোভন জয় করা এবং মৃত্যুর জগত থেকে পুনরুত্থিত হয়ে ফিরে আসা। ক্যাম্পবেল যুক্তি দেন যে, এই নবীরা কেবল ঐতিহাসিক চরিত্র নন; তারা হলেন আর্কিটাইপ (Archetype) বা আদিম নমুনা, যারা মানুষকে শেখান কীভাবে নিজের ক্ষুদ্র গণ্ডি (ইগো) অতিক্রম করে বৃহত্তর সত্যের সাথে মিলিত হতে হয়। ক্যাম্পবেলের এই তত্ত্ব আমাদের বুঝতে শেখায় যে, মিথোলজি আসলে মানুষের আধ্যাত্মিক বিবর্তনেরই মানচিত্র।
অন্যদিকে, স্কটিশ নৃতাত্ত্বিক জেমস জর্জ ফ্রেজার (James George Frazer) তার বিশাল গ্রন্থ দ্য গোল্ডেন বাউ (The Golden Bough)-এ তুলনামূলক পদ্ধতির মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, আব্রাহামিক মিথোলজির অনেক রিচুয়াল বা আচার-অনুষ্ঠানের শেকড় আসলে প্রাগৈতিহাসিক উর্বরতা পূজা এবং বলিদান প্রথার মধ্যে নিহিত। ফ্রেজার দেখান যে, ‘মৃত ও পুনরুত্থিত দেবতা’ বা ডাইং অ্যান্ড রাইজিং গড (Dying and Rising God)-এর ধারণাটি যিশুর জন্মের বহু আগে থেকেই প্রাচীন কৃষিভিত্তিক সমাজগুলোতে (যেমন – মিশরীয় ওসাইরিস বা মেসোপটেমীয় তাম্মুজ) প্রচলিত ছিল। ঋতুচক্রে শস্যের মৃত্যু এবং বসন্তে তার পুনর্জন্মকে কেন্দ্র করে যে মিথ তৈরি হয়েছিল, আব্রাহামিক মিথোলজি তাকেই এক নতুন নৈতিক এবং ঐতিহাসিক মাত্রা দিয়েছে। ফ্রেজারের এই বিশ্লেষণ ভিক্টোরিয়ান যুগের মানুষকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল, কারণ এটি প্রমাণ করেছিল যে বাইবেলের গল্পগুলো আকাশ থেকে পড়েনি, বরং তা মানব সংস্কৃতির দীর্ঘ বিবর্তনের ফসল। ফ্রেজারের কাজকে আরও এগিয়ে নেন রোমানিয়ান ধর্মতাত্ত্বিক মিরচা এলিয়াদ (Mircea Eliade)। এলিয়াদ তার দ্য সেক্রেড অ্যান্ড দ্য প্রোফেন (The Sacred and the Profane) বইয়ে দেখান যে, আব্রাহামিক ধর্মের মানুষ পৃথিবীকে দুটি ভাগে ভাগ করে দেখে – পবিত্র (Sacred) এবং অপবিত্র (Profane)। তিনি অ্যাক্সিস মান্ডি (Axis Mundi) বা মহাবিশ্বের কেন্দ্রের ধারণাটি ব্যাখ্যা করেন। জেরুজালেমের মন্দির, সিনাই পর্বত কিংবা মক্কার কাবা – এগুলো সবই হলো অ্যাক্সিস মান্ডি, যেখানে স্বর্গ, মর্ত্য এবং পাতাল একবিন্দুতে মিলিত হয়। এলিয়াদ আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য তুলে ধরেন: অন্যান্য মিথোলজিতে সময় হলো চক্রাকার বা সাইক্লিক্যাল টাইম (Cyclical Time), যেখানে সবকিছুর পুনরাবৃত্তি ঘটে। কিন্তু আব্রাহামিক মিথোলজিতে সময় হলো রৈখিক বা লিনিয়ার টাইম (Linear Time) এবং অপরিবর্তনীয়। এই ধর্মে ইতিহাস বা হিস্ট্রি (History) নিজেই ঈশ্বরের প্রকাশের মাধ্যম বা থিওফ্যানি (Theophany)। এলিয়াদের মতে, এই রৈখিক সময়ের ধারণাই মানুষকে ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধ করেছে এবং শেষ বিচারের দিনের দিকে ধাবিত করেছে।
মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ: অবচেতন মনের খেলা
মিথোলজিকে যদি মানুষের মনের আয়না বলা হয়, তবে সেই মনকে সবচেয়ে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড (Sigmund Freud) এবং কার্ল ইয়ুং (Carl Jung)। ফ্রয়েড তার বিতর্কিত বই মোজেস অ্যান্ড মনোকিজম (Moses and Monotheism)-এ দাবি করেন যে, একেশ্বরবাদের জন্ম হয়েছে এক ধরণের মনস্তাত্ত্বিক ট্রমা থেকে। ফ্রয়েডের মতে, আদিম সমাজে ছেলেরা তাদের পিতাকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করত, কিন্তু পরে অনুশোচনায় ভুগত। এই আদিম অপরাধবোধ বা প্রাইমাল গিল্ট (Primal Guilt) থেকেই সর্বশক্তিমান পিতা বা ঈশ্বরের ধারণা তৈরি হয়েছে, যাকে খুশি করার জন্য মানুষ নিয়মকানুন মেনে চলে। ফ্রয়েড মনে করতেন, ধর্ম হলো এক ধরণের কালেক্টিভ নিউরোসিস (Collective Neurosis) বা সমষ্টিগত স্নায়ুরোগ, যা মানুষকে তার অবদমিত কাম এবং ক্ষোভ থেকে রক্ষা করে। যদিও আধুনিক ঐতিহাসিকরা ফ্রয়েডের সব ঐতিহাসিক দাবি (যেমন – মোজেস মিশরীয় ছিলেন এবং তাকে তার অনুসারীরা হত্যা করেছিল) মেনে নেন না, কিন্তু পিতা-ঈশ্বরের (Father God) সাথে মানুষের জটিল সম্পর্কের ফ্রয়েডীয় ব্যাখ্যা মিথোলজির পাঠে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
ফ্রয়েডের ছাত্র হয়েও কার্ল ইয়ুং (Carl Jung) সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে হেঁটেছেন। ইয়ুং মিথোলজিকে কোনো রোগ বা নিউরোসিস মনে করতেন না। তার মতে, মিথোলজি হলো কালেক্টিভ আনকনশাস (Collective Unconscious) বা সমষ্টিগত অবচেতনের প্রকাশ। আমাদের ডিএনএ-তে যেমন আমাদের পূর্বপুরুষদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য থাকে, তেমনি আমাদের মনের গভীরে থাকে কিছু সর্বজনীন প্রতীক বা আর্কিটাইপ (Archetype)। আব্রাহামিক মিথোলজির চরিত্রগুলো আসলে এই আর্কিটাইপেরই মূর্ত রূপ। যেমন, শয়তান বা ইবলিস হলো মানুষের মনের অন্ধকার দিক বা শ্যাডো (Shadow) – যাকে আমরা অস্বীকার করি কিন্তু যা আমাদের ভেতরেই থাকে। মসিহ বা যিশু হলেন সেলফ (Self) বা পূর্ণাঙ্গ সত্তার প্রতীক, যা আমাদের জীবনের লক্ষ্য। ইয়ুংয়ের মতে, ধর্মীয় আখ্যানগুলো মানুষের ইন্ডিভিজুয়েশন (Individuation) বা আত্ম-উপলব্ধির প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে। যখন নূহ প্লাবনের সময় নৌকায় ওঠেন, তখন তা আসলে মানুষের অবচেতনের গভীর সমুদ্রে যাত্রা করার এবং সেখান থেকে নতুন জ্ঞান নিয়ে ফিরে আসার প্রতীক। ইয়ুংয়ের এই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি মিথোলজিকে আধুনিক মানুষের কাছে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।
সমাজতত্ত্ব এবং পবিত্রতার রাজনীতি
মিথোলজি কেবল মনের ব্যাপার নয়, এটি সমাজ গঠনের হাতিয়ারও বটে। ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম (Émile Durkheim) তার দ্য এলিমেন্টারি ফর্মস অফ রিলিজিয়াস লাইফ (The Elementary Forms of Religious Life) বইয়ে দেখিয়েছেন যে, ধর্ম এবং মিথোলজি আসলে সমাজেরই নিজের প্রতি নিজের উপাসনা। যখন কোনো গোষ্ঠী কোনো টোটেম বা প্রতীকের পূজা করে, তখন তারা আসলে নিজেদের ঐক্যেরই পূজা করে। আব্রাহামিক মিথোলজিতে ঈশ্বর যখন বনি ইসরায়েলকে সিনাই পর্বতে আইন দেন, তখন তা কেবল ধর্মীয় আইন ছিল না; তা ছিল একটি বিশৃঙ্খল যাযাবর গোষ্ঠীকে একটি সুশৃঙ্খল জাতিতে বা নেশন (Nation)-এ পরিণত করার সামাজিক চুক্তি। ডুর্খেইমের মতে, আচার-অনুষ্ঠান বা রিচুয়ালগুলো মানুষকে প্রতিদিনের তুচ্ছ জীবন থেকে বের করে এক কালেক্টিভ এফারভেসেন্স (Collective Effervescence) বা সমষ্টিগত আবেগের জোয়ারে ভাসিয়ে দেয়, যা সমাজের সংহতি রক্ষা করে।
ব্রিটিশ নৃতাত্ত্বিক মেরি ডগলাস (Mary Douglas) তার বিখ্যাত বই পিউরিটি অ্যান্ড ডেঞ্জার (Purity and Danger)-এ আব্রাহামিক মিথোলজির বিশেষ করে লেভিটিকাস বইয়ের খাদ্যবিধি বা ডায়েটারি ল’জ (Dietary Laws) নিয়ে এক যুগান্তকারী বিশ্লেষণ করেছেন। কেন শূকর খাওয়া নিষিদ্ধ? কেন চিংড়ি মাছ খাওয়া ইহুদি ধর্মে বারণ? ডগলাস দেখান যে, এটি কেবল স্বাস্থ্য বা হাইজিনের বিষয় নয়। এটি হলো ক্লাসিফিকেশন (Classification) বা শ্রেণিবিন্যাসের বিষয়। প্রাচীন হিব্রু মনন মনে করত, যা কিছু তার শ্রেণির বাইরে বা ‘হাইব্রিড’, তা-ই অপবিত্র। যেমন, মাছের আঁশ ও পাখনা থাকা উচিত। যার নেই (যেমন চিংড়ি), সে জলের প্রাণী হয়েও মাছের নিয়ম মানছে না, তাই সে অপবিত্র। শূকর খুরওয়ালা প্রাণী কিন্তু জাবর কাটে না – এই দ্বৈত আচরণের কারণেই সে নিষিদ্ধ। ডগলাসের মতে, “Dirt is matter out of place” (ময়লা হলো স্থানচ্যুত বস্তু)। আব্রাহামিক মিথোলজিতে পবিত্রতা রক্ষা করার এই আপ্রাণ চেষ্টা আসলে মহাজাগতিক শৃঙ্খলা বা কসমিক অর্ডার (Cosmic Order) বজায় রাখারই একটি সামাজিক রূপ। সমাজকে পবিত্র রাখার অর্থ হলো ঈশ্বরের সৃষ্টিকে বিশৃঙ্খলা থেকে রক্ষা করা।
অন্যদিকে, জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber) আব্রাহামিক ধর্মের বিকাশে নবীদের ভূমিকা নিয়ে তার এনশিয়েন্ট জুডাইজম (Ancient Judaism) গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ওয়েবার একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব দেন, যা হলো কারিশম্যাটিক অথরিটি (Charismatic Authority)। মোজেস, যিশু কিংবা মুহাম্মদের মতো নবীরা কোনো প্রথাগত বা আমলাতান্ত্রিক নেতা ছিলেন না। তাদের ক্ষমতা আসত তাদের ব্যক্তিগত ‘কারিশমা’ বা ঐশ্বরিক কৃপা থেকে। তারা সমাজের প্রচলিত কাঠামোর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন এবং নতুন মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু ওয়েবার দেখান, নবীর মৃত্যুর পর সেই কারিশমাকে ধরে রাখার জন্য তার অনুসারীরা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়, যাকে তিনি বলেছেন রুটিনাইজেশন অফ কারিশমা (Routinization of Charisma)। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই মিথোলজি বা ওহী শেষ পর্যন্ত আইন বা শরীয়তে পরিণত হয়।
সহিংসতা, বলির পাঁঠা এবং আকাঙ্ক্ষার তত্ত্ব
আব্রাহামিক মিথোলজিতে সহিংসতার উপস্থিতি – কেইনের হত্যা, আব্রাহামের বলিদান, যিশুর ক্রুশবিদ্ধকরণ – বারবার ফিরে আসে। ফরাসি দার্শনিক এবং সাহিত্য সমালোচক রেনে জিরার্ড (René Girard) এই সহিংসতার ব্যাখ্যায় এক বৈপ্লবিক তত্ত্ব প্রদান করেছেন, যা মিমেটিক থিওরি (Mimetic Theory) বা অনুকরণমূলক আকাঙ্ক্ষা নামে পরিচিত। জিরার্ডের মতে, মানুষের নিজস্ব কোনো মৌলিক আকাঙ্ক্ষা নেই; মানুষ অন্যকে দেখে চাইতে শেখে। “সে ওটা চায়, তাই আমাকেও ওটা চাইতে হবে” – এই মানসিকতা থেকেই দ্বন্দ্বে বা রাইভালরি (Rivalry)-র জন্ম হয়। কেইন ও অ্যাবেলের গল্পে আমরা এটাই দেখি। এই দ্বন্দ্ব যখন সমাজে চরম আকার ধারণ করে, তখন সমাজ নিজেকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে একজনকে দোষী সাব্যস্ত করে হত্যা করে বা নির্বাসিত করে। এই হতভাগ্য ব্যক্তিটিই হলো স্কেপগোট (Scapegoat) বা বলির পাঁঠা। জিরার্ড তার ভায়োলেন্স অ্যান্ড দ্য স্যাক্রেড (Violence and the Sacred) এবং থিংস হিডেন সিন্স দ্য ফাউন্ডেশন অফ দ্য ওয়ার্ল্ড (Things Hidden Since the Foundation of the World) বইগুলোতে দেখিয়েছেন যে, প্রাচীন মিথোলজিগুলো আসলে এই স্কেপগোটিং মেকানিজমকে ঢাকার চেষ্টা করত, যেখানে বলিদানকে পবিত্র মনে করা হতো। কিন্তু আব্রাহামিক মিথোলজি, বিশেষ করে বাইবেল, এই মেকানিজমকে উন্মোচন করে দিয়েছে। জিরার্ড বলেন, বাইবেল সর্বদা ভিকটিম বা নির্যাতিতের পক্ষ নেয় (যেমন – অ্যাবেল, জোসেফ, যিশু)। যিশুর ক্রুশবিদ্ধকরণ হলো ইতিহাসের চূড়ান্ত স্কেপগোটিং, যা প্রমাণ করে দিয়েছে যে ঈশ্বর সহিংসতা চান না, বরং মানুষই নিজের পাপ ঢাকার জন্য সহিংসতা ব্যবহার করে। জিরার্ডের মতে, খ্রিস্টধর্মের এই সত্য উন্মোচনের কারণেই আধুনিক বিশ্বে আমরা ভিকটিমদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে শিখেছি।
সাহিত্য সমালোচনা এবং মহৎ কোড
কানাডিয়ান সাহিত্য সমালোচক নর্থরপ ফ্রাই (Northrop Frye) তার দ্য গ্রেট কোড: দ্য বাইবেল অ্যান্ড লিটারেচার (The Great Code: The Bible and Literature) বইয়ে আব্রাহামিক মিথোলজিকে সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেছেন। ফ্রাই বাইবেলকে কোনো ধর্মগ্রন্থ হিসেবে না দেখে একে পশ্চিমা সাহিত্যের ‘জিনোম’ বা ডিএনএ হিসেবে দেখেছেন। তিনি দেখান যে, বাইবেলের গঠন একটি ইউ-শেপড ন্যারেটিভ (U-shaped Narrative) বা ইংরেজি ‘U’ অক্ষরের মতো। শুরুতে ইডেন উদ্যানে মানুষ ঈশ্বরের সাথে উঁচুতে ছিল, এরপর পাপের কারণে নিচে পড়ে গেল (পতন), এবং শেষে নিউ জেরুজালেম বা স্বর্গে আবার উঁচুতে উঠল (মুক্তি)। এই পতন এবং উত্থানের কাঠামোটিই কমেডি, ট্র্যাজেডি এবং রোমান্সের জন্ম দিয়েছে। ফ্রাইয়ের মতে, আব্রাহামিক মিথোলজির ভাষা হলো মেটাফোরিক্যাল (Metaphorical) বা রূপকধর্মী। এখানে ‘দিন’ মানে ২৪ ঘণ্টা নাও হতে পারে, ‘সাত’ মানে কেবল সংখ্যা নয় বরং পূর্ণতা। ফ্রাই যুক্তি দেন যে, এই মিথোলজি আমাদের কল্পনাশক্তিকে প্রসারিত করে এবং আমাদের এমন এক জগত দেখায় যা আমরা বাস্তবে দেখতে পাই না, কিন্তু অনুভব করতে পারি।
নারীবাদী পাঠ: হারানো স্বর পুনরুদ্ধার
উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে আব্রাহামিক মিথোলজির এক নতুন পাঠ বা রি-রিডিং (Re-reading) শুরু হয় নারীবাদী তাত্ত্বিকদের হাত ধরে। এলিজাবেথ ক্যাডি স্ট্যান্টন (Elizabeth Cady Stanton) তার দ্য ওম্যান্স বাইবেল (The Woman’s Bible)-এ প্রথম প্রশ্ন তোলেন, কেন ইভ বা হাওয়াকে পাপের জন্য একতরফা দায়ী করা হবে? কেন ঈশ্বরকে সবসময় পুরুষবাচক শব্দে ডাকা হবে? স্ট্যান্টন দেখান যে, ধর্মগ্রন্থের পিতৃতান্ত্রিক ব্যাখ্যা নারীকে হাজার বছর ধরে দমিয়ে রেখেছে। আধুনিক যুগে ফিলিস ট্রিবল (Phyllis Trible) তার টেক্সটস অফ টেরর (Texts of Terror) এবং গড অ্যান্ড দ্য রেটোরিক অফ সেক্সুয়ালিটি (God and the Rhetoric of Sexuality) বইগুলোতে বাইবেলের অবহেলিত নারীদের গল্প – যেমন হাগার, তামার, বা জেপৎথার মেয়ে – নতুন করে সামনে আনেন। ট্রিবল দেখান যে, মূল হিব্রু টেক্সটে ঈশ্বরকে কেবল পিতা হিসেবে নয়, বরং মা হিসেবেও (যিনি গর্ভধারণ করেন বা করুণা করেন – ‘রাহামিম’ শব্দটি জরায়ু বা ‘রেহেম’ থেকে এসেছে) চিত্রিত করা হয়েছে। ট্রিবলের এই ‘লিটারারি-ফেমিনিস্ট’ বিশ্লেষণ প্রমাণ করে যে, মিথোলজির ভেতরেই সমতা ও ন্যায়ের বীজ নিহিত আছে, যা পিতৃতান্ত্রিক ব্যাখ্যাকাররা ঢেকে রেখেছিল।
অস্তিত্ববাদ এবং ব্যাখ্যার দ্বন্দ্ব
উনিশ শতকের ড্যানিশ দার্শনিক সোরেন কিয়ের্কেগার্ড (Søren Kierkegaard) আব্রাহামিক মিথোলজিকে দর্শনের এক চরম পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করান। তার ফিয়ার অ্যান্ড ট্রেমলিং (Fear and Trembling) বইয়ে তিনি আব্রাহাম কর্তৃক পুত্র বলিদানের ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে এক্সিস্টেনশিয়ালইজম (Existentialism) বা অস্তিত্ববাদের ভিত্তি স্থাপন করেন। কিয়ের্কেগার্ড দেখান যে, বিশ্বাস কোনো আরামদায়ক বা যৌক্তিক বিষয় নয়। এটি একটি লিপ অফ ফেইথ (Leap of Faith) বা অন্ধকারের মধ্যে ঝাঁপ দেওয়া। আব্রাহাম যখন ছুরি হাতে নেন, তখন তিনি নীতি-নৈতিকতা বা যুক্তির জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সম্পূর্ণ একা হয়ে যান। এই একাকীত্ব এবং ঈশ্বরের সামনে মানুষের অসহায়ত্ব বা অ্যাংস্ট (Angst)-ই হলো অস্তিত্ববাদের মূল কথা। কিয়ের্কেগার্ডের এই বিশ্লেষণ ধর্মকে কেবল রবিবারের প্রার্থনার বিষয় থেকে বের করে এনে এক জীবন্ত এবং জ্বলন্ত অভিজ্ঞতায় পরিণত করে।
বিংশ শতাব্দীতে ফরাসি দার্শনিক পল রিকোয়ার (Paul Ricoeur) মিথোলজির ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে হারমেনিউটিক্স (Hermeneutics) বা ব্যাখ্যাতত্ত্বের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তার দ্য সিম্বলিজম অফ ইভল (The Symbolism of Evil) বইয়ে রিকোয়ার বলেন, মিথোলজি হলো এক ধরণের প্রতীকী ভাষা, যা আমাদের অস্তিত্বের গভীরতম দাগগুলো (যেমন – পাপ বা দোষ) প্রকাশ করে। রিকোয়ার দুটি ভিন্ন এপ্রোচের কথা বলেন: একটি হলো হারমেনিউটিক্স অফ সাসপিশন (Hermeneutics of Suspicion) বা সন্দেহের ব্যাখ্যা (যেমন – ফ্রয়েড বা মার্ক্স, যারা ধর্মের পেছনের গোপন উদ্দেশ্য খোঁজেন), এবং অন্যটি হলো হারমেনিউটিক্স অফ ফেইথ (Hermeneutics of Faith) বা বিশ্বাসের ব্যাখ্যা (যা প্রতীকের ভেতরের সত্যকে শুনতে চায়)। রিকোয়ারের মতে, আধুনিক মানুষকে এই দুইয়ের সমন্বয় করতে হবে – যাকে তিনি বলেন সেকেন্ড নাইভটি (Second Naivete)। অর্থাৎ, বিজ্ঞানের সব সমালোচনা জানার পরেও আবার নতুন করে মিথোলজির সত্যকে গ্রহণ করা, তবে এবার আর অন্ধভাবে নয়, বরং সচেতনভাবে।
অন্যদিকে, জার্মান ধর্মতত্ত্ববিদ রুডলফ বুল্টমান (Rudolf Bultmann) আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের জন্য বাইবেলকে প্রাসঙ্গিক করার লক্ষ্যে ডিমাইথোলজাইজেশন (Demythologization) বা ‘মিথমুক্তকরণ’ তত্ত্বের প্রস্তাব করেন। বুল্টমান যুক্তি দেন যে, তিনতলা মহাবিশ্ব (স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল) বা অলৌকিক ঘটনার ধারণা আজকের যুগে অচল। তাই আমাদের উচিত মিথোলজির আক্ষরিক খোসা ফেলে দিয়ে এর ভেতরের অস্তিত্ববাদী বার্তাটি বা কেরিগমা (Kerygma) গ্রহণ করা। যেমন, পুনরুত্থান মানে কোনো মৃতদেহের হেঁটে বেড়ানো নয়, বরং মানুষের ভেতরে বিশ্বাসের পুনর্জন্ম।
ইতিহাসের শেষ এবং নতুন ঈশ্বর
ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ নরমান কোহন (Norman Cohn) তার দ্য পারস্যুট অফ দ্য মিলেনিয়াম (The Pursuit of the Millennium) বইয়ে দেখিয়েছেন যে, আব্রাহামিক মিথোলজির এসকাটোলজি (Eschatology) বা শেষ জমানার ধারণা কীভাবে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত বিভিন্ন বৈপ্লবিক আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছে। তার মতে, দাজ্জাল বা অ্যান্টিক্রাইস্টকে হত্যা করে পৃথিবীতে স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠার এই স্বপ্নই ধর্মনিরপেক্ষভাবে মার্ক্সবাদ বা নাৎসিবাদের মতো মতবাদের জন্ম দিয়েছে, যেখানে একটি ইউটোপিয়া বা নিখুঁত সমাজ গড়ার জন্য রক্তপাতকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। কোহনের এই বিশ্লেষণ আমাদের সাবধান করে দেয় যে, মিথোলজির শক্তি কতটা ধ্বংসাত্মক হতে পারে যদি তাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
সবশেষে, ধর্মতত্ত্ববিদ ক্যারেন আর্মস্ট্রং (Karen Armstrong) তার আ হিস্ট্রি অফ গড (A History of God) বইয়ে দেখিয়েছেন যে, আব্রাহামিক মিথোলজিতে ঈশ্বরের ধারণা স্থির নয়, বরং এটি মানুষের ইতিহাসের সাথে সাথে বিবর্তিত হয়েছে। আব্রাহামের সেই গোত্রীয় দেবতা থেকে শুরু করে আজকের বিশ্বজনীন, নিরাকার এবং দার্শনিক ঈশ্বর পর্যন্ত – এই যাত্রাপথটি আসলে মানুষের নিজের চেতনারই বিবর্তনের ইতিহাস। আর্মস্ট্রং এবং তার সমসাময়িক ইয়ান আসমান (Jan Assmann)-এর মতো তাত্ত্বিকরা দেখিয়েছেন যে, মোজেসের একেশ্বরবাদ বা মোজাইক ডিসটিংকশন (Mosaic Distinction) (সত্য বনাম মিথ্যা ধর্মের বিভাজন) পশ্চিমা সভ্যতার সত্য ও মিথ্যার ধারণাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। আসমানের বই মোজেস দ্য ইজিপশিয়ান (Moses the Egyptian)-এ তিনি দেখান যে, একেশ্বরবাদের শেকড় হয়তো মিশরের আখেনাতেনের সূর্যপূজার মধ্যেই নিহিত ছিল, যা পরে হিব্রু স্মৃতিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
এই সমস্ত তাত্ত্বিক, দার্শনিক এবং সমালোচকদের কাজ আমাদের সামনে আব্রাহামিক মিথোলজির এক বিশাল এবং বহুমাত্রিক ছবি তুলে ধরে। তারা প্রমাণ করেন যে, এই গল্পগুলো কেবল মরুভূমির বালুকণায় হারিয়ে যাওয়া কোনো উপকথা নয়। এগুলো হলো মানব মনের জীবন্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। ফ্রয়েডের অবচেতন, মার্ক্সের সমাজ, জিরার্ডের বলিদান কিংবা কিয়ের্কেগার্ডের ভীতি – সবকিছুই এই মিথোলজির বিশাল ক্যানভাসে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তাত্ত্বিক ব্যবচ্ছেদ আমাদের এই গল্পগুলোর জাদুকরী প্রভাব নষ্ট করে না, বরং এগুলোকে আরও গভীরভাবে বুঝতে এবং অনুভব করতে সাহায্য করে। আমরা বুঝতে পারি, কেন আমরা আজও সেই আদিম আপেলের স্বাদ ভুলতে পারিনি, কিংবা কেন আমরা আজও কোনো এক নূহের নৌকার অপেক্ষায় দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকি।
উপসংহার
আমরা এতক্ষণ যে বিশাল ক্যানভাসে ভ্রমণ করলাম, তা কেবল কিছু প্রাচীন গল্পের সমষ্টি নয়। সৃষ্টির শুরু থেকে মহাপ্রলয় পর্যন্ত বিস্তৃত এই আখ্যান আসলে মানুষের আশা, আকাঙ্ক্ষা, ভয় এবং নৈতিকতার এক জটিল বুনন। আব্রাহামিক মিথোলজি আমাদের শিখিয়েছে ভালো এবং মন্দের (Good and Evil) দ্বন্দ্ব। হাজার হাজার বছর ধরে এই গল্পগুলো বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষকে শিখিয়েছে কীভাবে বাঁচতে হয়, কীভাবে মৃত্যু বা নশ্বরতাকে মেনে নিতে হয়, এবং কীভাবে অজানাকে আলিঙ্গন করতে হয়। গ্রিক বা রোমান দেবতারা যেখানে নিজেদের খেয়ালখুশিমত চলত, সেখানে আব্রাহামিক ঈশ্বর মানুষকে দিয়েছেন আইনের শাসন, দিয়েছেন নৈতিকতার পাঠ।
বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী কার্ল ইয়ুং (Carl Jung) এবং নৃতাত্ত্বিকরা বলেন, মিথোলজি আসলে আমাদের ‘কালেক্টিভ আনকনশাস’ (Collective Unconscious) বা সমষ্টিগত অবচেতনের অংশ (Jung, 1968)। অর্থাৎ, আমরা চাই বা না চাই, এই গল্পের কাঠামো আমাদের ডিএনএ-তে মিশে আছে। আদমের একাকীত্ব আমাদের সবার একাকীত্ব। ভাইয়ের হাতে ভাইয়ের খুনের যে গ্লানি কেইন (Cain) বহন করেছে, তা আজও মানব সমাজে বিদ্যমান। নূহের ধৈর্য, আব্রাহামের অবিশ্বাস্য ত্যাগ, মোজেসের মুক্তিপাগল মন, মেরির পবিত্রতা, যিশুর করুণা কিংবা মুহাম্মদের অবিচল বিশ্বাস – এগুলো কেবল ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, এগুলো আমাদের মনেরই বিভিন্ন অবস্থার একেকটি রূপক বা আর্কিটাইপ (Archetype)।
অনেকে ভাবতে পারেন, আজকের এই বিজ্ঞানমনস্ক, প্রযুক্তি-নির্ভর যুগে বুঝি মিথোলজির প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। আদতে তা নয়। মিথোলজি মরে না, সে কেবল রূপ বদলায়। বর্তমান আধুনিক যুগেও আব্রাহামিক মিথোলজির প্রভাব বিন্দুমাত্র কমেনি। আমাদের সাহিত্য, শিল্পকলা, সিনেমা, এমনকি রাজনীতি – সবকিছুতেই এদের ছায়া। হলিউডের ব্লকবাস্টার সিনেমা ‘স্টার ওয়ার্স’-এর লুক স্কাইওয়াকার কিংবা ‘ম্যাট্রিক্স’-এর নিও – সবার যাত্রাপথেই আমরা সেই আদিম ‘মেসায়াহ’ বা ত্রাণকর্তার ছায়া দেখতে পাই। জোসেফ ক্যাম্পবেল যাকে বলেছেন ‘হিরোজ জার্নি’ (Hero’s Journey), সেই যাত্রাপথ এই মিথোলজিগুলোই আমাদের মস্তিষ্কে গেঁথে দিয়েছে।
দিনশেষে, আব্রাহামিক মিথোলজি আমাদের একটি খুব জরুরি কথা মনে করিয়ে দেয় – মানুষ কেবল রক্ত-মাংসের শরীর নয়; মানুষ আসলে গল্পের তৈরি। গল্পই মানুষকে পশু থেকে আলাদা করেছে। মরুভূমির সেই সব যাযাবর মানুষেরা নক্ষত্রভরা আকাশের নিচে বসে যে আগুনের শিখা জ্বালিয়েছিল, সেই আলো আজও আমাদের পথ দেখাচ্ছে। এই গল্পগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আমাদের টিকিয়ে রেখেছে, আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছে এক প্রতিশ্রুত ভূমির (Promised Land)। এক অসীম, অনন্ত এবং রহস্যময় মহাজাগতিক নাটকের কুশীলব আমরা সবাই, যেখানে আমরা প্রতিনিয়ত খুঁজে ফিরছি আমাদের হারানো ইডেন।
তথ্যসূত্র
- Alighieri, D. (1320). The Divine Comedy. (Trans. J. Ciardi). New York: W.W. Norton & Company.
- Alter, R. (1981). The Art of Biblical Narrative. New York: Basic Books.
- Anselm of Canterbury. (1098). Cur Deus Homo [Why God Became Man]. (Trans. J. Hopkins & H. Richardson). Toronto: Edwin Mellen Press.
- Armstrong, K. (1993). A History of God: The 4,000-Year Quest of Judaism, Christianity and Islam. New York: Alfred A. Knopf.
- Asín Palacios, M. (1919). La Escatología Musulmana en la Divina Comedia [Islam and the Divine Comedy]. Madrid: Real Academia Española.
- Assmann, J. (1997). Moses the Egyptian: The Memory of Egypt in Western Monotheism. Cambridge: Harvard University Press.
- Augustine. (426). The City of God. (Trans. M. Dods). New York: Modern Library.
- Bailey, D. S. (1955). Homosexuality and the Western Christian Tradition. London: Longmans, Green & Co.
- Bernstein, A. E. (1993). The Formation of Hell: Death and Retribution in the Ancient and Early Christian Worlds. Ithaca: Cornell University Press.
- Boyce, M. (1979). Zoroastrians: Their Religious Beliefs and Practices. London: Routledge & Kegan Paul.
- Buber, M. (1946). Moses: The Revelation and the Covenant. Oxford: East and West Library.
- Bultmann, R. (1941). New Testament and Mythology. (Trans. S.M. Ogden). Philadelphia: Fortress Press.
- Campbell, J. (1949). The Hero with a Thousand Faces. New York: Pantheon Books.
- Campbell, J. (1988). The Power of Myth. New York: Doubleday.
- Chittick, W. C. (1989). The Sufi Path of Knowledge: Ibn al-Arabi’s Metaphysics of Imagination. Albany: SUNY Press.
- Cohn, N. (1970). The Pursuit of the Millennium: Revolutionary Millenarians and Mystical Anarchists of the Middle Ages. Oxford: Oxford University Press.
- Cohn, N. (1996). Noah’s Flood: The Genesis Story in Western Thought. New Haven: Yale University Press.
- Collins, S., & Scott, L. C. (2013). Discovering the City of Sodom: The Fascinating, True Account of the Discovery of the Old Testament’s Most Infamous City. New York: Howard Books.
- Darmesteter, J. (1883). The Zend-Avesta. Oxford: Clarendon Press.
- Davidson, G. (1967). A Dictionary of Angels: Including the Fallen Angels. New York: Free Press.
- Douglas, M. (1966). Purity and Danger: An Analysis of Concepts of Pollution and Taboo. London: Routledge & Kegan Paul.
- Durkheim, E. (1912). The Elementary Forms of Religious Life. (Trans. K.E. Fields). New York: Free Press.
- Eliade, M. (1959). The Sacred and the Profane: The Nature of Religion. New York: Harcourt, Brace & World.
- Finkel, I. (2014). The Ark Before Noah: Decoding the Story of the Flood. London: Hodder & Stoughton.
- Frazer, J. G. (1890). The Golden Bough: A Study in Comparative Religion. London: Macmillan and Co.
- Frazer, J. G. (1918). Folk-lore in the Old Testament. London: Macmillan and Co.
- Freke, T., & Gandy, P. (1999). The Jesus Mysteries: Was the “Original Jesus” a Pagan God?. London: Thorsons.
- Freud, S. (1939). Moses and Monotheism. (Trans. K. Jones). New York: Vintage Books.
- Friedman, R. E. (1987). Who Wrote the Bible?. New York: Summit Books.
- Frye, N. (1982). The Great Code: The Bible and Literature. New York: Harcourt Brace Jovanovich.
- Geertz, C. (1973). The Interpretation of Cultures: Selected Essays. New York: Basic Books.
- Girard, R. (1972). Violence and the Sacred. (Trans. P. Gregory). Baltimore: Johns Hopkins University Press.
- Girard, R. (1978). Things Hidden Since the Foundation of the World. (Trans. S. Bann & M. Metteer). Stanford: Stanford University Press.
- Gunkel, H. (1895). Creation and Chaos in the Primeval Era and the Eschaton. (Trans. K.W. Whitney Jr.). Grand Rapids: Eerdmans.
- Heschel, A. J. (1962). The Prophets. New York: Harper & Row.
- Jung, C. G. (1968). The Archetypes and the Collective Unconscious. Princeton: Princeton University Press.
- Kierkegaard, S. (1843). Fear and Trembling. (Trans. A. Hannay). London: Penguin Classics.
- Kramer, S. N. (1963). The Sumerians: Their History, Culture, and Character. Chicago: University of Chicago Press.
- Kugel, J. L. (2007). How to Read the Bible: A Guide to Scripture, Then and Now. New York: Free Press.
- Leeming, D. A. (2005). The Oxford Companion to World Mythology. Oxford: Oxford University Press.
- Levenson, J. D. (1993). The Death and Resurrection of the Beloved Son: The Transformation of Child Sacrifice in Judaism and Christianity. New Haven: Yale University Press.
- Lewis, C. S. (1970). God in the Dock: Essays on Theology and Ethics. Grand Rapids: Eerdmans.
- Loader, J. A. (1990). A Tale of Two Cities: Sodom and Gomorrah in the Old Testament, Early Jewish and Christian Traditions. Kampen: J.H. Kok.
- Malinowski, B. (1926). Myth in Primitive Psychology. London: Kegan Paul, Trench, Trubner & Co.
- Matt, D. C. (2009). The Essential Kabbalah: The Heart of Jewish Mysticism. New York: HarperOne.
- McCall, H. (1990). Mesopotamian Myths. London: British Museum Publications.
- Meyer, M. W. (Ed.). (2007). The Nag Hammadi Scriptures. New York: HarperOne.
- Milton, J. (1667). Paradise Lost. London: Samuel Simmons.
- Nasr, S. H. (2002). The Heart of Islam: Enduring Values for Humanity. San Francisco: HarperSanFrancisco.
- Nicholson, R. A. (1914). The Mystics of Islam. London: G. Bell and Sons.
- Pagels, E. (1979). The Gnostic Gospels. New York: Random House.
- Patai, R. (1967). The Hebrew Goddess. New York: KTAV Publishing House.
- Philo. (1993). The Works of Philo: Complete and Unabridged. (Trans. C. D. Yonge). Peabody: Hendrickson.
- Powell, B. B. (2007). Classical Myth. Upper Saddle River: Pearson Prentice Hall.
- Pritchard, J. B. (Ed.). (1969). Ancient Near Eastern Texts Relating to the Old Testament. Princeton: Princeton University Press.
- Pseudo-Dionysius. (1987). The Celestial Hierarchy. (Trans. C. Luibheid). New York: Paulist Press.
- Rank, O. (1914). The Myth of the Birth of the Hero. (Trans. F. Robbins & S.E. Jelliffe). New York: The Journal of Nervous and Mental Disease Publishing Company.
- Ricoeur, P. (1967). The Symbolism of Evil. (Trans. E. Buchanan). New York: Harper & Row.
- Russell, J. B. (1977). The Devil: Perceptions of Evil from Antiquity to Primitive Christianity. Ithaca: Cornell University Press.
- Scholem, G. (1941). Major Trends in Jewish Mysticism. New York: Schocken Books.
- Scholem, G. (1971). The Messianic Idea in Judaism and Other Essays on Jewish Spirituality. New York: Schocken Books.
- Schwartz, R. M. (1997). The Curse of Cain: The Violent Legacy of Monotheism. Chicago: University of Chicago Press.
- Smith, G. (1876). The Chaldean Account of Genesis. New York: Scribner, Armstrong & Co.
- Smith, M. S. (2001). The Origins of Biblical Monotheism: Israel’s Polytheistic Background and the Ugaritic Texts. Oxford: Oxford University Press.
- Stanton, E. C. (1895). The Woman’s Bible. New York: European Publishing Company.
- Steinbeck, J. (1952). East of Eden. New York: Viking Press.
- Trible, P. (1978). God and the Rhetoric of Sexuality. Philadelphia: Fortress Press.
- Trible, P. (1984). Texts of Terror: Literary-Feminist Readings of Biblical Narratives. Philadelphia: Fortress Press.
- Walls, J. L. (2002). Heaven: The Logic of Eternal Joy. Oxford: Oxford University Press.
- Watt, W. M. (1953). Muhammad at Mecca. Oxford: Clarendon Press.
- Weber, M. (1952). Ancient Judaism. (Trans. H.H. Gerth & D. Martindale). Glencoe: The Free Press.
- Wick, P. (2004). Jesus gegen Dionysos? Ein Beitrag zur Kontextualisierung des Johannesevangeliums. Biblica, 85(2), 179-198.
- Wolfson, H. A. (1976). The Philosophy of the Kalam. Cambridge: Harvard University Press.
- Wright, N. T. (2003). The Resurrection of the Son of God. Minneapolis: Fortress Press.
